ভারতের নতুন সংসদ ভবনে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে ম্যুরালের মাধ্যমে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যেখানে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কা এই সবগুলো দেশকেই দেখানো হয়েছে।
‘অখণ্ড ভারত’-এর ধারণাটি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের মূল মতাদর্শগত চিন্তার অন্যতম। ওই ধারণায় বলা হয়ে থাকে, প্রাচীনকালে ইরান থেকে বর্তমানের মিয়ানমার, উত্তরে তিব্বত, নেপাল, ভূটান আর দক্ষিণে বর্তমানের শ্রীলঙ্কা – সবই ছিল অখণ্ড ভারতের অন্তর্ভুক্ত। আরএসএস বলছে অখণ্ড ভারত হল প্রাচীন সাংস্কৃতিক ভারতবর্ষ। যেসব এলাকায় ভারতীয় সংস্কৃতি ছিল প্রাচীনকালে, তা নিয়েই ‘অখণ্ড ভারত’।
আরএসএসের নেতা জিষ্ণু বসু বলেছে, “গান্ধার থেকে ব্রহ্মদেশ, দক্ষিণে সিংহল- গোটা অঞ্চল জুড়েই তো একই সংস্কৃতি ছিল একটা সময়ে। এটাই তো ছিল ভারতের প্রাচীন রূপ। আফগানিস্তানের বামিয়ান বুদ্ধ বলুন বা সিন্ধু সভ্যতার যে সব নিদর্শন বর্তমান পাকিস্তানে আছে, সেগুলো তো ভারতেরই এলাকা ছিল। আবার বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে যে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়েছিল, সেটাও তো ভারতবর্ষেরই অঙ্গ ছিল। ভারতের এই সাংস্কৃতিক ইতিহাস যাতে মানুষ ভুলে না যায়, সেজন্যই অখণ্ড ভারতের চিন্তা তুলে ধরা হয়।
হিন্দুত্ববাদের গবেষক ও সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেছে, “সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক বা দ্বিতীয় সঙ্ঘ প্রধান এম এস গোলওয়ালকর এই অখণ্ড ভারতের চিন্তা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তার পরেও সংঘের অনেক তাত্ত্বিক নেতা অখণ্ড ভারত নিয়ে লিখেছেন। ওই তত্ত্ব অনুযায়ী অখণ্ড ভারতের শুরু হয়েছিল বর্তমান ইরান থেকে। সেটাকে আগে পারস্য বলা হতো, কিন্তু আরএসএস সেটাকে মনে করে পরশুরামের জন্মস্থান, তাই তারা এটিকে পরশুদেশ বলে। আবার নেপাল থেকে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার সবটাই প্রাচীন ভারতের অংশ বলে তারা মনে করে।”
তিনি আরো বলেছেন, “শুধু যে সঙ্ঘের তাত্ত্বিক নেতারা এ নিয়ে লিখেছে, তা নয়। সংঘের অধীন যে কয়েক হাজার স্কুল আছে বিদ্যা ভারতী নামে, এবং যে সকল বিদ্যালয়গুলি চালায় সঙ্ঘ, সেখানে একেবারে নীচু ক্লাস থেকে এই তত্ত্ব পড়ানো হয়। ছাত্রছাত্রীদের এবং শিক্ষকদের এই বিষয়টা পড়া বাধ্যতামূলক। পরীক্ষার প্রশ্নও আসে।”
আরএসএস পরিচালিত ‘বিদ্যা ভারতী’ স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর বইয়ের একটি পৃষ্ঠা
‘বিদ্যা ভারতী সংস্কৃতি শিক্ষা সংস্থান’ এর চতুর্থ শ্রেণীর একটি বইতে ‘ভারতের বর্তমান ভৌগলিক সীমা’ শীর্ষক পরিচ্ছেদের প্রশ্ন-উত্তর অংশে লেখা হয়েছে “আমাদের দেশের বর্তমান সীমা-সংলগ্ন কোন কোন দেশ আমাদের দেশের অঙ্গ ছিল? উত্তর: পূর্বে ব্রহ্মদেশ (মিয়ানমার), বাংলাদেশ। পশ্চিমে পাকিস্তান, আফগানিস্তান। উত্তরে – তিব্বত, নেপাল ও ভূটান। দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা।” ওই একই পরিচ্ছেদে আরব সাগরের নাম বলা হয়েছে সিন্ধু সাগর আর বঙ্গোপসাগরের নাম বলা হয়েছে গঙ্গাসাগর।
অখণ্ড ভারতের মানচিত্র রাখার উদ্দেশ্য:
এই অখণ্ড ভারত ও এর মানচিত্র স্থাপন নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করেছে সংসদীয় দপ্তরের মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী। সে অখণ্ড ভারতের ঐ মানচিত্র দিয়ে টুইট করেছে : “সংকল্পটা স্পষ্ট – অখণ্ড ভারত।”
কর্নাটক বিজেপির টুইটার হ্যাণ্ডেল থেকে ওই মানচিত্রের ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে, “আমাদের গর্বিত মহান সভ্যতার জীবনীশক্তির প্রতীক।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন সংসদ ভবনে ‘অখণ্ড ভারত’এর মানচিত্র রাখা, উদ্বোধনের সময় হিন্দু রীতি মেনে যজ্ঞ করা বা বহু সংখ্যক হিন্দু সাধুসন্তদের উপস্থিতি, সব কিছুর মধ্যে দিয়ে ভারতকে একটা হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরারই বিজেপি ও আরএসএসের প্রচেষ্টা।
লেখক ও প্রাবন্ধিক রন্তিদেব সেনগুপ্তের কথায়, “একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সংসদে কেন কোনও একটা বিশেষ ধর্মের রীতি মেনে যজ্ঞ হবে! কেন সেখানে একটা ধর্মের সাধু সন্ন্যাসীরা হাজির হবেন? কেন সেখানে আরএসএসের চিন্তা অনুসারে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র রাখা হবে? বার্তাটা খুব স্পষ্ট –ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরা।”
তিনি আরও বলছিলেন, “অখণ্ড ভারতের চিন্তাটাই তো বর্তমানে অবাস্তব। প্রাচীন কালে কোনও দেশের বিভাজন না থাকতে পারে, কিন্তু এখন তো প্রতিটা দেশের রাজনৈতিক সীমা নির্ধারিত হয়েছে, এখন অখণ্ড ভারতের রূপ কল্পনা করা কি বাস্তবসম্মত?”
স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য যোগ করছিলেন, “অখণ্ড ভারতের তত্ত্বটিকে প্রাতিষ্ঠানিক সত্য হিসাবে প্রমাণ করতে নানা প্রচেষ্টা চলেছে। তারই একটা বৃহৎ প্রকাশ আমরা দেখছি ওই অখণ্ড ভারতের মানচিত্র পার্লামেন্ট ভবনে রেখে দেওয়ার মাধ্যমে। এর মধ্যে দিয়ে সংঘের ওই মতাদর্শগত চিন্তাটাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হল।”
বাংলাদেশের উদ্বেগ:
বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকগণ জানিয়েছেন, ‘অন্য কোনো দেশের অখণ্ড মানচিত্রে বাংলাদেশকে দেখানোটা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।’ এটি বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন এক বিবৃতিতে ভারতের এ ধরনের মানচিত্র তৈরির ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে। সংগঠনটি বলেছে, ‘ভারতের শাসকদের কল্পিত মানচিত্রে বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের অংশ দেখানো আপত্তিকর।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এক বিবৃতিতে বলেছেন, অখণ্ড ভারতের মানচিত্রে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোকে অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে, এটি এসব দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
তবে উদ্বেগের বিষয় হল, নেপাল সরকার এটি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখালেও, এ মানচিত্র নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে নরম সুরে শুধু ব্যাখ্যাই জানতে চাওয়া হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীদের কথায় প্রকাশ পেয়েছে, এটা তেমন কোন বিষয় নয়, তারা শুধু ইতিহাস হিসেবেই এটা রেখেছে! অবশ্য স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে বিভেদ কে টেনে আনতে চায়!
উল্লেখ্য, মুসলিম মুক্ত অখণ্ড ভারত গড়তে আদা-জল খেয়ে মাঠে নেমেছে উগ্র হিন্দুরা। যে অখণ্ড ভারতে তারা কল্পিত রামের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সংঘচালক মোহন ভাগবত অখণ্ড ভারত তৈরীর ঘোষণা দিয়েছে।
হরিদ্বারে সংঘচালক মোহন ভাগবতের হুঙ্কার দিয়েছিল- ‘কুড়ি থেকে পঁচিশ বছরের মধ্যে অখণ্ড ভারত তৈরি হবে। আর একটু চেষ্টা করলে স্বামী বিবেকানন্দ বা ঋষি অরবিন্দের স্বপ্নের অখণ্ড ভারত ১০-১৫ বছরের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে। এটা কেউ আটকাতে পারবে না। এই স্বপ্নপূরণের মাঝে যে আসবে, সে বা তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।’
ভাগবতের আরো দাবি, অখণ্ড ভারত বানানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। সে বাঁশি বাজিয়ে বাকিদেরও ডাকছে। এখন আর ভারতকে আটকানো সম্ভব নয়।
তবে এতদিন নিজেদের বয়ান বক্তৃতায় থাকলেও এবারে কোন রাখঢাখ না রেখেই ভারতের সংসদে বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ ‘অখণ্ড ভারতের’ মানচিত্র স্থাপন করেছে হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার।
তথ্যসূত্র:
1. India’s new parliament building features Akhand Bharat map
– https://tinyurl.com/3z68m8j7
2. History of the Akhand Bharat idea, and in the imagination of the RSS
– https://tinyurl.com/3f6eubku
3. ১৫ বছরের মধ্যেই অখণ্ড ভারত, বাধা দিলে কঠিন পরিণতি!
– https://tinyurl.com/yjahsrtb
Comment