অখণ্ড ভারত কোনো প্রচ্ছন্ন হুমকি নয়
ভারতীয় সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের মন্তব্যটি খেয়াল করুণ। তিনি বলছেন, “অখণ্ড ভারতের তত্ত্বটিকে প্রাতিষ্ঠানিক সত্য হিসাবে প্রমাণ করতে নানা প্রচেষ্টা চলেছে। তারই একটা বৃহৎ প্রকাশ আমরা দেখছি ওই অখণ্ড ভারতের মানচিত্র পার্লামেন্ট ভবনে রেখে দেওয়ার মাধ্যমে। এর মধ্যে দিয়ে সংঘের ওই মতাদর্শগত চিন্তাটাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হল।”
সম্প্রতি ভারতের নতুন উদ্বোধনকৃত পার্লামেন্ট ভবনে অখণ্ড ভারতের মানচিত্রের মুরাল স্থাপনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন। ঐ মানচিত্রে ভারতের অংশ হিসেবে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কা এই সবকটি দেশকেই দেখানো হয়েছে।
এখানে আরো একজন বিশেষজ্ঞের মতামত উপস্থাপন করা প্রাসঙ্গিক।
নতুন পার্লামেন্ট ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান পূর্ণ হিন্দু রীতি-নীতি ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে করা হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে লেখক ও প্রাবন্ধিক রন্তিদেব সেনগুপ্তের বলেছেন, “একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সংসদে কেন কোনও একটা বিশেষ ধর্মের রীতি মেনে যজ্ঞ হবে! কেন সেখানে একটা ধর্মের সাধু সন্ন্যাসীরা হাজির হবেন? কেন সেখানে আরএসএসের চিন্তা অনুসারে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র রাখা হবে? বার্তাটা খুব স্পষ্ট –ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরা।”
অখণ্ড ভারত, হিন্দুরাষ্ট্র এবং হিন্দুত্ববাদ এই তিনটি ধারণাই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের মূল মতাদর্শগত চিন্তার অন্যতম, ধারণা বা নীতিগুলো আবার একটি আরেকটির পরিপূরকও।
আরএসএস সম্পর্কে যারা এখনো অবগত নন, তাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আরএসএস হলো, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি সহ বজরং দল ও ভিএইচপির মতো প্রায় সকল হিন্দুত্ববাদী দলের মাতৃ সংগঠন।
হিন্দুত্ববাদ বিষয়ক গবেষক ও সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য আরও বলেছেন, “সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক, বা সঙ্ঘ প্রধান এম এস গোলওয়ালকর এই অখণ্ড ভারতের চিন্তা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তার পরেও সংঘের অনেক তাত্ত্বিক নেতা অখণ্ড ভারত নিয়ে লিখেছেন। ওই তত্ত্ব অনুযায়ী অখণ্ড ভারতের শুরু হয়েছিল বর্তমান ইরান থেকে। সেটাকে আগে পারস্য বলা হতো, কিন্তু আরএসএস সেটাকে মনে করে পরশুরামের জন্মস্থান, তাই তারা এটিকে পরশুদেশ বলে। আবার নেপাল থেকে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার সবটাই প্রাচীন ভারতের অংশ বলে তারা মনে করে।”
আর প্রধান সঙ্ঘচালক মোহন ভগবত অখণ্ড ভারত বাস্তবায়নের ঘোষণা ইতিমধ্যেই দিয়ে রেখেছে।
ভাগবতের আরো দাবি, অখণ্ড ভারত বানানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। সে বাঁশি বাজিয়ে বাকিদেরও ডাকছে। এখন আর ভারতকে আটকানো সম্ভব নয়।
আর অখণ্ড ভারত নিয়ে হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করেছে সংসদীয় দপ্তরের মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী। সে ওই অখণ্ড ভারতের মানচিত্র শেয়ার করে টুইট করেছে : “সংকল্পটা স্পষ্ট – অখণ্ড ভারত।”
হিন্দুরাষ্ট্র অখণ্ড ভারতের হুমকি:
অখণ্ড ভারত তত্ত্বটিকে দীর্ঘদিন যাবত কেবলমাত্র একটি সাংস্কৃতিক ধারণা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু উপমহাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় অখণ্ড ভারত তত্ত্বটি গোটা উপমহাদেশকে দ্রুত এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধাবিত করছে।
অখণ্ড ভারত তত্ত্বের প্রথম প্রশ্ন আসে যে, এই অখণ্ড ভারত রাষ্ট্রের প্রকৃতি কেমন হবে।
এর উত্তর হিন্দুত্ববাদী নেতারা একবাক্যে দিয়ে দেন যে, অখণ্ড ভারত হবে একটি হিন্দু রাষ্ট্র।
আর তার থেকেও ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, এই হিন্দু রাষ্ট্রে মুসলিম সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকবে। আবার অন্যান্য ধর্মের কোন অস্তিত্ব না থাকার কথাও হিন্দুত্ববাদী নেতারা প্রকাশ্যেই বলছে; যদিও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মুখে এখনো এর প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণা উচ্চারিত হয়নি। তবে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর “ঘার ওয়াপসি”র নামে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ করে মুসলিমদের জোরপূর্বক হিন্দু বানানো আর মোহন ভগবতের ভারতের সকল নাগরিককে হিন্দু বলে সম্বোধন ভাল কিছুর ইঙ্গিত দেয়নি কখনোই।
অখণ্ড ভারত নামক হিন্দুরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের কাজও ইতিমধ্যে চলমান। হিন্দুত্ববাদী সাধুদের একটি অংশ এই কাজ নিয়োজিত রয়েছে বলে জানা গেছে। বারাণসী-ভিত্তিক শঙ্করাচার্য পরিষদের হিন্দুত্ববাদী সভাপতি স্বামী আনন্দ স্বরূপ জানায়, শাম্ভবী পীঠধীশ্বরের পৃষ্ঠপোষকতায় দার্শনিক ও পণ্ডিতের ৩০ জনের একটি দল এই ‘সংবিধান’-এর খসড়া তৈরি করছে। সংবিধানটি হবে ৭৫০ পৃষ্ঠার। এটি নিয়ে ধর্মীয় গুরু ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে। এর ভিত্তিতে ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত হতে চলা মাঘ মেলায় অর্ধেক সংবিধান (প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠা) প্রকাশিত হবে।
অখণ্ড ভারত খুলে দিবে গণহত্যার পথ:
ইতিমধ্যে হিন্দুরাষ্ট্র অখণ্ড ভারত কায়েমের ঘোষণা দিয়ে ভারতজুড়ে হিন্দুদের খেপিয়ে তোলা হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দুরাও এখন অখণ্ড ভারতের প্রচারণা জোরেশোরে চালাচ্ছে। আর যেহেতু উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হচ্ছে ইসলাম, সুতরাং হিন্দু রাষ্ট্র তথা অখণ্ড ভারত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ‘প্রধান বাঁধা’ মুসলিমদের উপরেই চাপ আসছে বেশি। ভারতজুড়েই এখন নানান অজুহাতে মুসলিমদের হামলা-ধর্ষণ-হত্যা করা হচ্ছে। মুসলিমদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বয়কটের আহবান জানানো হচ্ছে। এমনকি মুসলিমদের উপর গণহত্যা চালানোর ঘোষণাও এখন হিন্দু সাধুরা এবং রাজনৈতিক নেতারা প্রকাশ্যে দিচ্ছে। সিনেমা-নাটকের ও গানের মাধ্যমে মুসলিমবিরোধী প্রচার-প্রচারনাও থেমে নেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ঘিরে উস্কানিমূলক গান বাজিয়ে হিন্দুরা হামলে পড়ছে মুসলিম এলাকাগুলোতে, চালানো হচ্ছে লুটপাট এমনকি ধর্ষণ। নানান অজুহাত তুলে একে একে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঐতিহাসিক সব মসজিদ-মাদ্রাসা ও মুসলিম স্থাপনা, বুলড্রোজার চালানো হচ্ছে মুসলিমদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে। আসামে নাগরিকপঞ্জি থেকে বিরাট সংখ্যক মুসলিমকে কৌশলে বাদ দিয়ে তাদেরকে দেশছাড়া করার পায়তারা করা হচ্ছে, চীনের আদলে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে বিশাল আয়তনের সব বন্দীশালা। কাশ্মীরকে গোটা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুসলিমদের উপর ক্র্যাকডাউন চালানো হচ্ছে কয়েক বছর ধরেই।
আর হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন থেকে যে অন্য ধর্মের অনুসারীরা নিরাপদ থাকবে, সেটাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। সম্প্রতি মনিপুরের উত্তপ্ত পরিস্থিতি ও হিন্দু-খ্রিস্টান সংঘাত আমাদেরকে এমন কিছুরই আভাস দিচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অখণ্ড ভারত বা হিন্দুরাষ্ট্রের ঘোষণা কি উপমহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পরা উগ্র হিন্দুত্ববাদের আগুনে ঘি বা বারুদ ঢেলে দিবে না? এই যে হিন্দুত্ববাদী নেতারা কথায় কথায় সেনা পাঠিয়ে বাংলাদেশ দখলের হুমকি দেয়, কুমিল্লার মতো সাজান ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশে সেনা মোতায়েন করতে ভারত জাতিসঙ্ঘকে আহবান জানিয়ে চিঠি দেয়, এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষা কি বাস্তব রূপ লাভের প্রয়াশ পাবে না, হিন্দু রাষ্ট্র বা অখণ্ড ভারতের ঘোষণার মাধ্যমে?
হিন্দুত্ববাদের কালো থাবা থেকে নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা নিরাপদ থাকবে কি না, সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রতি হিন্দুত্ববাদীদের আচরণ মুসলমানদের প্রতি তাদের আচরণের মতোই উগ্র ও বৈষম্যমূলক।
শেষের কিছু কথা:
হিন্দুত্ববাদের প্রবল প্রভাব আজ উপমহাদেশের জমিনে তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। পাশাপাশি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যে প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হচ্ছে, তার ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ আরও আগে থেকেই পুরো বিশ্বকে সতর্ক করে আসছেন। জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা এবং গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ড. গ্রেগরি স্টেন্টন গত প্রায় দেড় বছর আগেই সতর্ক করেছেন যে একটি জাতির উপর গণহত্যা বাস্তবায়নের যে ১০ টি ধাপ আছে, ভারত ইতিমধ্যে তার ৮ নং ধাপ অতিক্রম করে ফেলেছে। এসকল কর্মকাণ্ডের ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করাটাও তাই অত্যন্ত জরুরী বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
তবে সবার আগে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতার, যার অভাব আজ আমাদের মাঝে স্পষ্ট। হিন্দুত্ববাদ, হিন্দু রাষ্ট্র আর অখণ্ড ভারতের মতো ধারণাগুলো নিয়ে তাই বেশি বেশি আলোচনা হওয়া উচিৎ। আরও বেশি আলোচনা হওয়া উচিৎ এর কুফল ও সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে এবং প্রত্যেকের অবস্থান থেকে কীভাবে তা প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা যায় তা নিয়ে। মুসলিমদের পাশাপাশি সাধারণ হিন্দুদেরও এ ব্যাপারে সচেতন করা উচিৎ। এতে করে সাধারণ মুসলিমদের পাশাপাশি সাধারণ হিন্দুরাও বুঝতে পারবে – এই হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন কাউকে ছাড় দিবে না।
তথ্যসূত্র:
1. India’s new parliament building features Akhand Bharat map
– https://tinyurl.com/3z68m8j7
2. ১৫ বছরের মধ্যেই অখণ্ড ভারত, বাধা দিলে কঠিন পরিণতি!
– https://tinyurl.com/yjahsrtb
3. ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হবে, মুসলিমদের হিন্দু বানানো হবে: বিজেপি বিধায়ক
– https://tinyurl.com/2s47dmkz
4. হিন্দু রাষ্ট্র হবে ভারত, রাজ্যের স্বয়ংসেবকদের প্রস্তুত হতে বলল ভাগবত
– https://tinyurl.com/5n6n424h
5. TimesofIndia : Won’t let minorities vote: ‘Hindu Rashtra statute draft’
– https://tinyurl.com/2t75dnax
6. History of the Akhand Bharat idea, and in the imagination of the RSS
– https://tinyurl.com/3f6eubku
7. অখণ্ড ভারত ‘হিন্দু রাষ্ট্রের’ নতুন ‘সংবিধান’ তৈরী করছে হিন্দুত্ববাদীরা
– https://tinyurl.com/ju24p9t7
8. India Ranks 8th Among Countries at Highest Risk for Mass Killing: US Research Org’s Report ( The Wire )
– https://tinyurl.com/2s36zynk
9. India is in 8th stage of genocide, just one step away from extermination: Genocide Watch founder Prof Stanton
– https://tinyurl.com/2p8ja52t
10. ভারতকে মুসলিম গণহত্যার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে: অ্যামনেস্টি
– https://tinyurl.com/45jy5b8v
11. মুসলিমরা দেশ ছাড়লে হিন্দুরাও আর হিন্দু থাকবে না: মহুয়া মৈত্র
– https://tinyurl.com/mr2zd2mw
ভারতীয় সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের মন্তব্যটি খেয়াল করুণ। তিনি বলছেন, “অখণ্ড ভারতের তত্ত্বটিকে প্রাতিষ্ঠানিক সত্য হিসাবে প্রমাণ করতে নানা প্রচেষ্টা চলেছে। তারই একটা বৃহৎ প্রকাশ আমরা দেখছি ওই অখণ্ড ভারতের মানচিত্র পার্লামেন্ট ভবনে রেখে দেওয়ার মাধ্যমে। এর মধ্যে দিয়ে সংঘের ওই মতাদর্শগত চিন্তাটাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হল।”
সম্প্রতি ভারতের নতুন উদ্বোধনকৃত পার্লামেন্ট ভবনে অখণ্ড ভারতের মানচিত্রের মুরাল স্থাপনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন। ঐ মানচিত্রে ভারতের অংশ হিসেবে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কা এই সবকটি দেশকেই দেখানো হয়েছে।
এখানে আরো একজন বিশেষজ্ঞের মতামত উপস্থাপন করা প্রাসঙ্গিক।
নতুন পার্লামেন্ট ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান পূর্ণ হিন্দু রীতি-নীতি ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে করা হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে লেখক ও প্রাবন্ধিক রন্তিদেব সেনগুপ্তের বলেছেন, “একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সংসদে কেন কোনও একটা বিশেষ ধর্মের রীতি মেনে যজ্ঞ হবে! কেন সেখানে একটা ধর্মের সাধু সন্ন্যাসীরা হাজির হবেন? কেন সেখানে আরএসএসের চিন্তা অনুসারে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র রাখা হবে? বার্তাটা খুব স্পষ্ট –ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরা।”
অখণ্ড ভারত, হিন্দুরাষ্ট্র এবং হিন্দুত্ববাদ এই তিনটি ধারণাই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের মূল মতাদর্শগত চিন্তার অন্যতম, ধারণা বা নীতিগুলো আবার একটি আরেকটির পরিপূরকও।
আরএসএস সম্পর্কে যারা এখনো অবগত নন, তাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আরএসএস হলো, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি সহ বজরং দল ও ভিএইচপির মতো প্রায় সকল হিন্দুত্ববাদী দলের মাতৃ সংগঠন।
হিন্দুত্ববাদ বিষয়ক গবেষক ও সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য আরও বলেছেন, “সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক, বা সঙ্ঘ প্রধান এম এস গোলওয়ালকর এই অখণ্ড ভারতের চিন্তা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তার পরেও সংঘের অনেক তাত্ত্বিক নেতা অখণ্ড ভারত নিয়ে লিখেছেন। ওই তত্ত্ব অনুযায়ী অখণ্ড ভারতের শুরু হয়েছিল বর্তমান ইরান থেকে। সেটাকে আগে পারস্য বলা হতো, কিন্তু আরএসএস সেটাকে মনে করে পরশুরামের জন্মস্থান, তাই তারা এটিকে পরশুদেশ বলে। আবার নেপাল থেকে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার সবটাই প্রাচীন ভারতের অংশ বলে তারা মনে করে।”
আর প্রধান সঙ্ঘচালক মোহন ভগবত অখণ্ড ভারত বাস্তবায়নের ঘোষণা ইতিমধ্যেই দিয়ে রেখেছে।
হরিদ্বারে সংঘচালক মোহন ভাগবতের হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, “কুড়ি থেকে পঁচিশ বছরের মধ্যে অখণ্ড ভারত তৈরি হবে। আর একটু চেষ্টা করলে স্বামী বিবেকানন্দ বা ঋষি অরবিন্দের স্বপ্নের অখণ্ড ভারত ১০-১৫ বছরের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে। এটা কেউ আটকাতে পারবে না। এই স্বপ্নপূরণের মাঝে যে আসবে, সে বা তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।”
ভাগবতের আরো দাবি, অখণ্ড ভারত বানানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। সে বাঁশি বাজিয়ে বাকিদেরও ডাকছে। এখন আর ভারতকে আটকানো সম্ভব নয়।
আর অখণ্ড ভারত নিয়ে হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করেছে সংসদীয় দপ্তরের মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী। সে ওই অখণ্ড ভারতের মানচিত্র শেয়ার করে টুইট করেছে : “সংকল্পটা স্পষ্ট – অখণ্ড ভারত।”
হিন্দুরাষ্ট্র অখণ্ড ভারতের হুমকি:
অখণ্ড ভারত তত্ত্বটিকে দীর্ঘদিন যাবত কেবলমাত্র একটি সাংস্কৃতিক ধারণা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু উপমহাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় অখণ্ড ভারত তত্ত্বটি গোটা উপমহাদেশকে দ্রুত এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধাবিত করছে।
অখণ্ড ভারত তত্ত্বের প্রথম প্রশ্ন আসে যে, এই অখণ্ড ভারত রাষ্ট্রের প্রকৃতি কেমন হবে।
এর উত্তর হিন্দুত্ববাদী নেতারা একবাক্যে দিয়ে দেন যে, অখণ্ড ভারত হবে একটি হিন্দু রাষ্ট্র।
আর তার থেকেও ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, এই হিন্দু রাষ্ট্রে মুসলিম সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকবে। আবার অন্যান্য ধর্মের কোন অস্তিত্ব না থাকার কথাও হিন্দুত্ববাদী নেতারা প্রকাশ্যেই বলছে; যদিও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মুখে এখনো এর প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণা উচ্চারিত হয়নি। তবে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর “ঘার ওয়াপসি”র নামে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ করে মুসলিমদের জোরপূর্বক হিন্দু বানানো আর মোহন ভগবতের ভারতের সকল নাগরিককে হিন্দু বলে সম্বোধন ভাল কিছুর ইঙ্গিত দেয়নি কখনোই।
অখণ্ড ভারত নামক হিন্দুরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের কাজও ইতিমধ্যে চলমান। হিন্দুত্ববাদী সাধুদের একটি অংশ এই কাজ নিয়োজিত রয়েছে বলে জানা গেছে। বারাণসী-ভিত্তিক শঙ্করাচার্য পরিষদের হিন্দুত্ববাদী সভাপতি স্বামী আনন্দ স্বরূপ জানায়, শাম্ভবী পীঠধীশ্বরের পৃষ্ঠপোষকতায় দার্শনিক ও পণ্ডিতের ৩০ জনের একটি দল এই ‘সংবিধান’-এর খসড়া তৈরি করছে। সংবিধানটি হবে ৭৫০ পৃষ্ঠার। এটি নিয়ে ধর্মীয় গুরু ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে। এর ভিত্তিতে ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত হতে চলা মাঘ মেলায় অর্ধেক সংবিধান (প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠা) প্রকাশিত হবে।
অখণ্ড ভারত খুলে দিবে গণহত্যার পথ:
ইতিমধ্যে হিন্দুরাষ্ট্র অখণ্ড ভারত কায়েমের ঘোষণা দিয়ে ভারতজুড়ে হিন্দুদের খেপিয়ে তোলা হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দুরাও এখন অখণ্ড ভারতের প্রচারণা জোরেশোরে চালাচ্ছে। আর যেহেতু উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হচ্ছে ইসলাম, সুতরাং হিন্দু রাষ্ট্র তথা অখণ্ড ভারত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ‘প্রধান বাঁধা’ মুসলিমদের উপরেই চাপ আসছে বেশি। ভারতজুড়েই এখন নানান অজুহাতে মুসলিমদের হামলা-ধর্ষণ-হত্যা করা হচ্ছে। মুসলিমদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বয়কটের আহবান জানানো হচ্ছে। এমনকি মুসলিমদের উপর গণহত্যা চালানোর ঘোষণাও এখন হিন্দু সাধুরা এবং রাজনৈতিক নেতারা প্রকাশ্যে দিচ্ছে। সিনেমা-নাটকের ও গানের মাধ্যমে মুসলিমবিরোধী প্রচার-প্রচারনাও থেমে নেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ঘিরে উস্কানিমূলক গান বাজিয়ে হিন্দুরা হামলে পড়ছে মুসলিম এলাকাগুলোতে, চালানো হচ্ছে লুটপাট এমনকি ধর্ষণ। নানান অজুহাত তুলে একে একে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঐতিহাসিক সব মসজিদ-মাদ্রাসা ও মুসলিম স্থাপনা, বুলড্রোজার চালানো হচ্ছে মুসলিমদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে। আসামে নাগরিকপঞ্জি থেকে বিরাট সংখ্যক মুসলিমকে কৌশলে বাদ দিয়ে তাদেরকে দেশছাড়া করার পায়তারা করা হচ্ছে, চীনের আদলে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে বিশাল আয়তনের সব বন্দীশালা। কাশ্মীরকে গোটা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুসলিমদের উপর ক্র্যাকডাউন চালানো হচ্ছে কয়েক বছর ধরেই।
আর হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন থেকে যে অন্য ধর্মের অনুসারীরা নিরাপদ থাকবে, সেটাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। সম্প্রতি মনিপুরের উত্তপ্ত পরিস্থিতি ও হিন্দু-খ্রিস্টান সংঘাত আমাদেরকে এমন কিছুরই আভাস দিচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অখণ্ড ভারত বা হিন্দুরাষ্ট্রের ঘোষণা কি উপমহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পরা উগ্র হিন্দুত্ববাদের আগুনে ঘি বা বারুদ ঢেলে দিবে না? এই যে হিন্দুত্ববাদী নেতারা কথায় কথায় সেনা পাঠিয়ে বাংলাদেশ দখলের হুমকি দেয়, কুমিল্লার মতো সাজান ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশে সেনা মোতায়েন করতে ভারত জাতিসঙ্ঘকে আহবান জানিয়ে চিঠি দেয়, এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষা কি বাস্তব রূপ লাভের প্রয়াশ পাবে না, হিন্দু রাষ্ট্র বা অখণ্ড ভারতের ঘোষণার মাধ্যমে?
হিন্দুত্ববাদের কালো থাবা থেকে নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা নিরাপদ থাকবে কি না, সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রতি হিন্দুত্ববাদীদের আচরণ মুসলমানদের প্রতি তাদের আচরণের মতোই উগ্র ও বৈষম্যমূলক।
তৃণমূল নেত্রী মহুয়া মৈত্র যথার্থই বলেছেন, “ঠিক সেই পর্যন্ত আপনি একজন হিন্দু, যতক্ষণ আপনার দেশে মুসলিমরা আছে। তারা সবাই দেশ ছাড়লে আপনি আর হিন্দু থাকবেন না। তখন আপনি বিভক্ত হবেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র, দলিত ও অচ্ছুত পরিচয়ে।”
শেষের কিছু কথা:
হিন্দুত্ববাদের প্রবল প্রভাব আজ উপমহাদেশের জমিনে তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। পাশাপাশি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যে প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হচ্ছে, তার ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ আরও আগে থেকেই পুরো বিশ্বকে সতর্ক করে আসছেন। জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা এবং গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ড. গ্রেগরি স্টেন্টন গত প্রায় দেড় বছর আগেই সতর্ক করেছেন যে একটি জাতির উপর গণহত্যা বাস্তবায়নের যে ১০ টি ধাপ আছে, ভারত ইতিমধ্যে তার ৮ নং ধাপ অতিক্রম করে ফেলেছে। এসকল কর্মকাণ্ডের ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করাটাও তাই অত্যন্ত জরুরী বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
তবে সবার আগে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতার, যার অভাব আজ আমাদের মাঝে স্পষ্ট। হিন্দুত্ববাদ, হিন্দু রাষ্ট্র আর অখণ্ড ভারতের মতো ধারণাগুলো নিয়ে তাই বেশি বেশি আলোচনা হওয়া উচিৎ। আরও বেশি আলোচনা হওয়া উচিৎ এর কুফল ও সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে এবং প্রত্যেকের অবস্থান থেকে কীভাবে তা প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা যায় তা নিয়ে। মুসলিমদের পাশাপাশি সাধারণ হিন্দুদেরও এ ব্যাপারে সচেতন করা উচিৎ। এতে করে সাধারণ মুসলিমদের পাশাপাশি সাধারণ হিন্দুরাও বুঝতে পারবে – এই হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন কাউকে ছাড় দিবে না।
তথ্যসূত্র:
1. India’s new parliament building features Akhand Bharat map
– https://tinyurl.com/3z68m8j7
2. ১৫ বছরের মধ্যেই অখণ্ড ভারত, বাধা দিলে কঠিন পরিণতি!
– https://tinyurl.com/yjahsrtb
3. ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হবে, মুসলিমদের হিন্দু বানানো হবে: বিজেপি বিধায়ক
– https://tinyurl.com/2s47dmkz
4. হিন্দু রাষ্ট্র হবে ভারত, রাজ্যের স্বয়ংসেবকদের প্রস্তুত হতে বলল ভাগবত
– https://tinyurl.com/5n6n424h
5. TimesofIndia : Won’t let minorities vote: ‘Hindu Rashtra statute draft’
– https://tinyurl.com/2t75dnax
6. History of the Akhand Bharat idea, and in the imagination of the RSS
– https://tinyurl.com/3f6eubku
7. অখণ্ড ভারত ‘হিন্দু রাষ্ট্রের’ নতুন ‘সংবিধান’ তৈরী করছে হিন্দুত্ববাদীরা
– https://tinyurl.com/ju24p9t7
8. India Ranks 8th Among Countries at Highest Risk for Mass Killing: US Research Org’s Report ( The Wire )
– https://tinyurl.com/2s36zynk
9. India is in 8th stage of genocide, just one step away from extermination: Genocide Watch founder Prof Stanton
– https://tinyurl.com/2p8ja52t
10. ভারতকে মুসলিম গণহত্যার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে: অ্যামনেস্টি
– https://tinyurl.com/45jy5b8v
11. মুসলিমরা দেশ ছাড়লে হিন্দুরাও আর হিন্দু থাকবে না: মহুয়া মৈত্র
– https://tinyurl.com/mr2zd2mw
Comment