আসামের বাকসা জেলার নানকে দারাঙ্গা গ্রামে ৩৮ বছর বয়সী সফিক আলীর পরিবার প্রায় ৬০ বছর ধরে বংশানুক্রমে বসবাস করছে। কিন্তু বন বিভাগের বেঁধে দেওয়া ‘১৫ দিনে গ্রাম খালি করা’র সময়সীমার কারণে এখন তারা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়ে ক্রমাগত উদ্বেগ ও ভয়ের মধ্যে বসবাস করছেন।
২২ জুলাই থেকে নানকে দারাঙ্গা বা এন কে দারঙ্গা গ্রামের ২১০ পরিবার বন বিভাগ থেকে উচ্ছেদের বিজ্ঞপ্তি পেতে শুরু করেন। উক্ত গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে পাঠানো নোটিশে লেখা হয়েছে, “আপনারা দারঙ্গা বনাঞ্চলের জমি ময়নাহালী গ্রাম নামকরণ করে অবৈধভাবে দখল করছেন। অতএব, আপনাদেরকে এই নোটিশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে দখলকৃত জমি খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় বন আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
গ্রামের নামের সাথে ননকে বা এনকে নির্দেশ করে যে এটি একটি নন-ক্যাডাস্ট্রাল গ্রাম বা জরিপবিহীন জমি; যার অর্থ বাসিন্দাদের জমির দলিল নেই, তবে সরকারি জমির দলিল না থাকা সত্ত্বেও জরিপবিহীন জমিতে বসতি স্থাপনের কারণে সেখানকার বাসিন্দারা জমির প্রথম পক্ষ হিসাবে বিবেচিত হয়। যতক্ষণ না সরকার একটি জরিপ পরিচালনা করে এবং আনুষ্ঠানিক বন্দোবস্ত না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত জমিটি সরকারি সম্পত্তি হিসাবে লিপিবদ্ধ থাকবে।
গ্রামের বাসিন্দা জহুরুদ্দিন আহমেদ জানান যে, “প্রায় ১০-১৫ দিন আগে গ্রামের প্রধান এবং ভূমি গণনাকারী কর্মকর্তা (লট মন্ডল) আমাদের গ্রামে জরিপ করতে এসেছিল। তারা আমাদের জমির দলিল পাওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন এবং প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। আর তারপর, এখন আমরা গ্রাম খালি করার নোটিশ পেয়েছি।”
গ্রামের বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সী জনাব আহমেদ মকতুব মিডিয়াকে জানান যে, ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে এই গ্রামে বসতি গড়ে উঠেছে। তিনি বলেন, “এখানে বসবাসকারী লোকেরা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে, তারা বেঁচে থাকার জন্য দৈনিক মজুরির উপর নির্ভর করে। কেউ কেউ ভুটান সীমান্তের জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে অল্প আয়ের জন্য বিক্রি করে, আবার কেউ কেউ দিনমজুর হিসেবে কাজ করতে ভুটানে যায়। এই গ্রামই আমাদের সব, আমাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।”
বিটিআর-এ জমির অধিকার সংক্রান্ত সমস্যা
গুয়াহাটি থেকে প্রায় ৯০ কি.মি উত্তরে ননকে দারাঙ্গা গ্রাম ভারত-ভুটান সীমান্ত ক্রসিংয়ের কাছে সামদ্রুপ জংখার এলাকায় অবস্থিত। এটি বোডোল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অঞ্চলের (বিটিআর) প্রশাসনের অধীনে পড়ে, যা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনিক অঞ্চল।
আসাম-ভিত্তিক মানবাধিকার কর্মী জামশের আলি বিটিআর-এর অ-বোড়ো বাসিন্দাদের ভূমি অধিকারের পক্ষে ওকালতি করছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, ২০০৩ সালের আগে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপনকারী সকলকে সম্প্রদায় নির্বিশেষে তাদের ভূমির অধিকার দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, “বোডো জনগণের সুবিধার জন্য অন্যান্য প্রগতিশীল পদক্ষেপের মধ্যে ভূমি অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য ২০০৩ সালে BTR গঠিত হয়েছিল। যাইহোক, এই স্বায়ত্তশাসিত স্ব-শাসিত সংস্থা তৈরির আগে থেকে এখানে বসবাসকারী অন্যান্য সম্প্রদায়ের জমির অধিকার অস্বীকার করার জন্য এটি ব্যবহার করা উচিত নয়। প্রশাসনের উচিত বিটিআরের সকল সম্প্রদায়ের জন্য ভূমি অধিকার সংরক্ষণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা।”
বিটিআর-এ বসবাসকারী অ-উপজাতি জনগোষ্ঠীর জন্য আরেকটি সমস্যা হল গৌহাটি হাইকোর্টের একটি আইনি সমস্যা। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট আদিবাসী বেল্ট এবং ব্লকগুলিতে বসবাসকারী অ-উপজাতি এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিল। আদালত এই অঞ্চলে ‘জমির দখল প্রদানের যোগ্য নয়’ এমন লোকদের অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে।
বিটিআর মোট ২২৭২টি আদিবাসী বেল্ট এবং ব্লক গ্রাম নিয়ে গঠিত।
ভুল নোটিশ
জেলার বন বিভাগ ৩৮ বছর আগে গড়ে উঠা একটি মসজিদকে উচ্ছেদের নোটিশ পাঠিয়েছে। নোটিশে গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে ময়নাহালি, আর অভিযোগ করা হয়েছে যে এটি দারঙ্গা বনাঞ্চলে অবস্থিত।
তবে নোটিশ পাওয়া গ্রামবাসীরা দৃঢ়ভাবে দাবি করেছেন যে, তাদের গ্রামের নাম ননকে দারাঙ্গা, ময়নাহালি নয়।
জনাব সফিক আলী বলেন, “আমাদের নথি যেমন ভোটার কার্ড, আধার কার্ড বলছে আমাদের গ্রাম দারঙ্গা, ময়নাহালি নয়। কিন্তু আমাদের উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।”
মকতুব মিডিয়া ফোনে জেলা বন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তাকে পায়নি। তবে অফিসের একজন কর্মী জমশের আলী জানান যে গ্রামটি বনভূমি নয়। তিনি বলেন, “বন বিভাগ বিজ্ঞপ্তিতে এটিকে একটি বনাঞ্চল বলে দাবি করেছে, যা ছিল ভুল। এই লোকেরা বনভূমি দখল করেনি, কিন্তু ১৯৫০ এর দশক থেকে তারা ঐ এলাকায় বসবাস করছেন। আর যেহেতু বাসিন্দারা ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই এলাকায় বসবাস করছেন, তাই তারা বন অধিকার আইনের অধীনে জমির অধিকার পাওয়ার যোগ্য।”
কেননা ২০০৬ সালের বন অধিকার আইন ভারতে উপজাতীয় এবং বনে বসবাসকারী অন্যান্য সম্প্রদায়ের জমি, জীবিকা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়।
অল বিটিসি মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তাইসন হুসেন গ্রামবাসীদের নোটিশ জারি করার পর থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি এই আদেশের নিন্দা করে বলেছেন, “বিটিসি-এর ধারা 4.3.A স্পষ্টভাবে বলে যে, চুক্তি স্বাক্ষরের আগে বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারের জমির অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে। সুতরাং, দারাঙ্গার পাশাপাশি বিটিআরের অন্যান্য অংশের মানুষ যারা ২০০৩ সালের আগে থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করছেন, তাদের জমির অধিকার পাওয়া উচিত।”
তবে আসামের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলা যেতে পারে যে, গ্রামের মুসলিম বাসিন্দাদের টার্গেট করেই মূলত এই উচ্ছেদ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়ে থাকতে পারে। কেননা আসামের অনেক স্থানেই মুসলিম অধ্যুষিত অসংখ্য গ্রাম ইতিপূর্বে বিনা নোটিশে প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করেই উচ্ছেদ করা হয়েছে, ভেঙে ফেলা হয়েছে মুসলিমদের শত শত বাড়িঘর, স্থাপনা ও মসজিদ। আর বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন হওয়ায় আসামের এরকম ঘটনাগুলোর সম্মিলিত প্রভাব এদেশেও পরার বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা রয়েছে।
তথ্যসূত্র:
1. Eviction order issued: 210 families, mosque in remote Assam village forced to vacate or face consequences
– https://tinyurl.com/3ys3mtvu
– https://tinyurl.com/yaxn6ev5