কখনও মানবাধিকার, কখনও-বা নারী অধিকারের ধোঁয়া তুলে ইসলামি ইমারতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইসলামি ইমারতকে অযৌক্তিক অজুহাত দেখিয়ে স্বীকৃতি দিতে দেরি করছে কথিত বিশ্ব সম্প্রদায়।
তাদের অজুহাতগুলো কী?
তাদের অজুহাত হলো আফগানিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে, বিশেষভাবে নারী অধিকার ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে।
কিন্তু বাস্তবে আফগানিস্তানে মানবাধিকার ও নারী অধিকারের অবস্থা আসলে কেমন?
এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে মানবাধিকারের মানে কী, তা নির্ধারণ করতে হবে।
পশ্চিমাদের মানবাধিকারের সংজ্ঞা তাদের নিজস্ব মনগড়া; এই সংজ্ঞার আওতাধীন অনেক বিষয়ই প্রকৃতিবিরুদ্ধ, সকল যুগের সকল সমাজের জ্ঞানীদের দ্বারা পরিত্যাজ্য।
যেমন, পশ্চিমাদের মানবাধিকারের সংজ্ঞায় রয়েছে সমকামিতাকে বৈধতা প্রদান; তবে এমন বিকৃত অধিকারের দাবি কোনো ইসলামি সরকার মেনে নিতে পারেন না। ইসলামি সরকার মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার দেয় স্রষ্টা মনোনীত ইসলামি আইন অনুযায়ী। অর্থাৎ মানবাধিকার, নারী অধিকারসহ যত অধিকারের কথাই বলা হোক-না কেন, একটি ইসলামি রাষ্ট্রে সবকিছুই মূল্যায়ন করা হবে ইসলামের আলোকে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের নির্দেশিত অধিকার ব্যতীত অন্যান্য যে অধিকারের দাবি যেমন সমকামিতা, অবাধ যৌনতা, নিজের লিঙ্গ নির্ধারণের অধিকার, কথিত পোশাকের স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতার নামে ধর্ম অবমাননা- এগুলো মানবাধিকার নয়, বরং মানবতাবিরোধী অপরাধ। তাই ইমারতে ইসলামিয়া সরকার আফগানিস্তানে ইসলামি আইনের আলোকে মানবাধিকার নিশ্চিতের কথা বলেছেন।
যখন মানবাধিকার বলতে বুঝানো হয় মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা; এগুলোতে ইসলামি ইমারত আফগানিস্তানে অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি উন্নতি করে চলেছে। বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থা বিরাজ করছে আফগানিস্তানে। সম্পূর্ণ দেশে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; চোরাচালান, খুন, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি অপরাধ কমে প্রায় শূণ্যের কোটায় নেমে আসছে।
জনগণের খাদ্য সমস্যার সমাধান করতেও ইসলামি ইমারত কর্তৃপক্ষ আমদানিকৃত দ্রব্যের উপর কর কমিয়ে দেওয়াসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। ফলে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে আফগানিস্তানে খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের মূল্যস্ফীতি অনেক কমেছে। ২০২২ সালের জুলাইয়ে উচ্চমানের চালের মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৭.৮%, সেখান থেকে কমে ২০২৩ সালের জুনে হয়েছে -১.৩%; চিনির মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৭%, কমে হয়েছে ১৩%। এভাবে সব খাদ্য দ্রব্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যস্ফীতি কমেছে।
আফগানিস্তানে ঘরহীন মানুষদের আবাসস্থলের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। মাদকাসক্ত হয়ে রাস্তায়, ব্রীজের নিচে পড়ে থাকা লোকদেরকে সেখান থেকে তুলে এনে হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলছে।
শিক্ষাক্ষেত্রেও আফগানিস্তান ইসলামি ইমারত বিশেষ নজর দিয়েছেন। দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর কার্যকর সিলেবাস প্রণয়ন করেছেন। শিক্ষা কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন ইসলামি ইমারত কর্তৃপক্ষ। এসব কারণে মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে।
আর নারী অধিকারের বিষয়েও ইসলামি ইমারত কর্তৃপক্ষ নারীর ইসলাম প্রদত্ত অধিকার নিশ্চিতকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন। নারীদের জন্য শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করছেন। আর একারণে সাময়িক সময়ের জন্য নারীদের উচ্চশিক্ষা আর কিছু অঞ্চলের মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও, অন্য অনেক প্রদেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং সকল প্রদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা চলমান ছিল। তবুও পশ্চিমারা এটিকে ‘নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে তালিবানের অবস্থান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
অথচ ইসলাম নারীকে সর্বোচ্চ অধিকার প্রদান করেছে। আর ইসলামি ইমারত কর্তৃপক্ষ নারীদের ইসলাম প্রদত্ত এসব অধিকার সুরক্ষায় বদ্ধ পরিকর।
প্রকৃতপক্ষে, বর্তমানে ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান ইনসাফভিত্তিক মানবাধিকার ও নারী অধিকার সংরক্ষণকারী অন্যতম একটি রাষ্ট্র। তবুও কথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মানবাধিকার ও নারী অধিকারের ইস্যু দেখিয়েই আফগানিস্তানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ তাদের নিজেদের দেশেই মানবাধিকার ও নারী অধিকারের অবস্থা মুমূর্ষু।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে সারা বিশ্ব চষে বেড়ালেও, নিজ দেশ থেকে সন্ত্রাসবাদ দূর করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রে কিছুদিন পর পরই নিরস্ত্র মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটছে। বর্ণবাদের জঘন্য বহিঃপ্রকাশও দেখা যায় পশ্চিমা দেশগুলোতে। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
নারীদের ধর্ষণের ঘটনাও সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে পশ্চিমা দেশগুলোতেই। এমনকি কথিত মানবাধিকারের পতাকাবাহক যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৬৮ সেকেন্ডে একজন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। প্রতি বছর ৪,৬৩,৬৩৪ জন ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয় আমেরিকায়। যদি প্রকৃতপক্ষেই তারা মানবাধিকার ও নারী অধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়, তবে নিজ দেশে কেন এসব অধিকারের বাস্তবায়ন করছে না?
আর কেনই-বা এসব দেশে ক্রমাগত মানবাধিকারের লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও সেসব বিষয়ে নিশ্চুপ কথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়? কেন ইরাক-আফগানিস্তানে জঘন্য হত্যাকাণ্ড চালানো যুক্তরাষ্ট্রকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বিচারের কাঠগড়ায় ওঠানো হয় না? কেন উইঘুরদের ওপর নির্যাতনকারী চীন, রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা চালানো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না? কাশ্মীরে খুন, ধর্ষণ, অপকর্ম করে বেড়ানো ভারতকে কেন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় না? আফ্রিকায় সন্ত্রাসবাদ চালিয়ে আফ্রিকানদের সম্পদ ছিনতাইকারী ফ্রান্সকে শাস্তির মুখোমুখি করা হয় না কেন? এগুলো কি মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়?
আসলে এসব অপরাধের পেছনে দায়ী গোষ্ঠীগুলোই আজ মানবাধিকারের মুখোশ পরে মানবাধিকারের ঠিকাদার সেজেছে। তারাই নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আফগানিস্তান ইসলামি ইমারতের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
কথিত এই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চায় আফগানিস্তানে তাদের পুতুল সরকার থাকুক, যেন তাদের আদেশে দেশ চলে এবং তাদের স্বার্থ যেন সেখানে সংরক্ষিত থাকে। এই লক্ষ্যেই তারা দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর আফগানিস্তানে বোমা হামলা চালিয়েছে, ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে দেশটির অবকাঠামো, অর্থনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সবকিছু। কিন্তু সবশেষে ব্যর্থ হয়ে খালি হাতে নিজ দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছে।
তবে তাদের সেই খারাপ বাসনা পূরণে এখনও ষড়যন্ত্র করছে তারা। স্পষ্টতই, এসব কারণে তারা আফগানিস্তানে চলমান ইসলামি শাসনকে দোষারোপ করে, ইসলামি ইমারতকে তারা এজন্যই সমর্থন করতে প্রস্তুত না। এভাবে তারাই অবরোধ আরোপ করে আফগানিস্তানের মানুষকে মানবেতর জীবনযাপনের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করে, তারাই আবার আফগানিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে।
কিন্তু তাদের এই বাস্তবতা ভুলে গেলে চলবে না যে, আফগানরা কয়েক দশক ধরে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছে, বিদেশিদের জন্য কাজ করা বহু সরকারকে উৎখাত করেছে, নিজ দেশ ও জাতির স্বাধীনতার জন্য অভাবনীয় আত্মত্যাগ করেছে। অতএব নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপকারী দেশগুলোর ব্যাপারে আফগান জাতি কখনও আপস করতে প্রস্তুত নন। আফগানরা তাদের ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার পবিত্র উদ্দেশ্যকে কলংকিত করতে প্রস্তুত নন, এমনকি যদিও বিশ্ববাসী তাদের ইসলামি ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিতে না চায় তবুও।
আফগানরা কখনও পরাশক্তিদের চাপে মাথা নত করেনি, অন্যের আদেশের প্রতি তাঁরা মাথা ঝুকাবেও না ইনশাআল্লাহ্।
তবে আফগানিস্তান বিশ্বের সকল দেশের সাথে পারস্পরিক বৈধ স্বার্থ সংরক্ষণ করতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায়। তাই অবরোধ, হুমকি, নিষেধাজ্ঞা, সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ, ইমারতের নেতৃবৃন্দের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং মানবাধিকারের অজুহাত দাঁড় করানো পরিত্যাগ করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত বর্তমান শক্তিশালী ইসলামি শাসনব্যবস্থার সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন সাধনে সততার সাথে কাজ করা। পাশাপাশি বিশ্ব মাদক বাণিজ্য বন্ধে ইসলামি ইমারত যে অভাবনীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে, অন্তত তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সকল অবৈধ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া।
যদি বিশ্ব শক্তি আফগানিস্তানকে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সহযোগী হিসেবে কাছে চায়, তবে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে তাদের সাথে একটি ভালো সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা জরুরি।
তথ্যসূত্র:
1. Why the world ignores reality of recognising IEA
– https://tinyurl.com/bdhs9zfz
2. Victims of Sexual Violence: Statistics
– https://tinyurl.com/ma7umm7z
3. AFGHANISTAN ECONOMIC MONITOR
– https://tinyurl.com/36nhfk9r
Comment