সোমালিয়ায় প্রতিরোধ বাহিনী হারাকাতুশ শাবাবকে নিশ্চিহ্ন করতে গত বছর সামরিক অভিযানের প্রথম পর্ব শুরু করেছিল পশ্চিমা সমর্থিত মোগাদিশু প্রশাসন। যদিও তারা নিজেদের অভিযানকে সফল দাবি করেছে, তবে পশ্চিমা ও তাদের সমর্থিত পক্ষগুলো নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম করে দেখায় বলে বহু নজির রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শাবাবকে নির্মূল করতে অভিযানটির দ্বিতীয় পর্ব শুরু করতে যাচ্ছে পশ্চিমা সমর্থিত সোমালি সরকার।
এবিষয়ে এক বিবৃতিতে দেশটির পশ্চিমা সমর্থিত নেতা হাসান শেখ মাহমুদ গত ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেছে যে, “আমরা আগামী ৫ মাসের মধ্যে দেশ থেকে আশ-শাবাবকে নিশ্চিহ্ন করবো।”
বলা হয়েছে, এই পর্বের অভিযানটি দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকাগুলো লক্ষ্য করে চালানো হবে, যেগুলো আশ-শাবাবের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল ও শক্ত ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, এই অভিযানের ফলে সোমালিয়ায় সামরিক উত্তেজনা আরও বাড়বে। আবার ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের পরিমাণ আগের সমস্ত রেকর্ড ভাঙার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা দক্ষিণাঞ্চল ও এর শহরগুলোতে অভিযান পরিচালনার অর্থ হচ্ছে অনেকটাই সুসংগঠিত একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নামান্তর। আর রাজধানী মোগাদিশুর পর দক্ষিণাঞ্চল সোমালিয়ার সবচাইতে জনবহুল অঞ্চল, এই অঞ্চলগুলোতে দেশের সিংহভাগ মানুষ বাস করেন। আর এর বাসিন্দাদের প্রায় সবাই আশ-শাবাবের শরিয়াহ্ শাসনের প্রতি সন্তুষ্ট বলেই প্রতীয়মান হয়।
কেমন ছিল পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের প্রথম ধাপের অপারেশন?
পশ্চিমা সমর্থিত সোমালি সেনাবাহিনী গত ২০২২ সালের আগস্টে আশ-শাবাবকে নির্মূল করতে সামরিক অভিযানের প্রথম ধাপ শুরু করেছিল। মোগাদিশু প্রশাসন সর্বাত্মক এই যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে আশ-শাবাবের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জনের দাবি করে। ‘শাবাবের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে’ বলেও দাবি করেছিল তারা। তবে বাস্তবে দেখা গেছে, তাদের এমন দাবির পরেও শাবাব যোদ্ধারা মোগাদিশু প্রশাসন এবং সোমালিয়ায় অন্যান্য আফ্রিকান বাহিনী ও দখলদার সেনাদের বিরুদ্ধে লাগাতার বেশ কিছু বড় আকারের আক্রমণ চালিয়েছেন।
বিভিন্ন দিক বিবেচনায় এবং আশ-শাবাবের দাবি অনুযায়ী প্রথম ধাপের যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে সরকারি বাহিনী। হারাকাতুশ শাবাব তাদের বিভিন্ন অভিযানের তথ্যচিত্র এবং ভিডিও ফুটেজের আপডেট প্রতিনিয়ত জনগণের সামনে প্রচার করেছে। বিপরীত দিকে, মোগাদিশু সরকার তথ্য-প্রমান ছাড়া কিছু বিবৃতি ও দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো, যেগুলো কোনো স্বাধীন সূত্র দ্বারা নিশ্চিত হওয়া যায় নি। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে মোগাদিশুর সরকারি মিডিয়াগুলো আশ-শাবাবের অভিযানের ফুটেজ দেখিয়ে সেগুলোকে নিজেদের বলে দাবি করেছে।
এতে মোগাদিশু সরকার ও পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলো তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে জনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতাকে আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।শাবাবের দেওয়া অফিসিয়াল তথ্যমতে, প্রথম পর্যায়ের অভিযানের প্রথম ৮ মাসের মধ্যেই পশ্চিমা সমর্থিত সোমালি বাহিনীর উচ্চপদস্থ ৩০০ জন সামরিক কর্মকর্তা, ২৭৪ জন উপজাতীয় মিলিশিয়া নেতা এবং ৫ হাজার ৩৪৬ জন সৈন্য নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও অসংখ্য সৈন্য। আর নিহতদের বড় একটি সংখ্যাই হিরান রাজ্যের যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে।
হিরান যুদ্ধে শুধুমাত্র মার্কিন প্রশিক্ষিত সোমালি কমান্ডো ফোর্সের নিহত সদস্য সংখ্যাই সাড়ে ৫ শতাধিক; আর ইথিওপিয়া, উগান্ডা, জিবুতি ও কেনিয়ার নিহত সৈন্য সংখ্যাও ছিলো ৭ শতাধিক।
শাবাবের দেওয়া এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে অনুমান করা হয় যে, অভিযানের বাকি ৪ মাসে সোমালি সরকারি বাহিনীর হতাহত মোট সেনার সংখ্যা হয়ত ১৫ হাজার ছাড়াতে পারে। কেননা পরবর্তী মাসগুলোতে শাবাব আরও ক্ষিপ্র গতিতে আঘাত হানতে শুরু করেছিল। এ সময়টাতে সবচাইতে বড় অভিযানগুলো পরিচালনা করে তাঁরা, যার প্রায় প্রতিটি অভিযানেই কয়েক শতাধিক বিরোধী সৈন্য হতাহত হয়েছে।
এসব অভিযানের ভিডিও ফুটেজ এবং ফটো রিপোর্ট প্রচার করেছে আল-কাতাইব মিডিয়া সহ আঞ্চলিক স্বাধীন গণমাধ্যম সূত্রগুলো।
শাবাবের কৌশল
আশ-শাবাবের খুবই জনপ্রিয় একটি রণকৌশল হচ্ছে, প্রতিপক্ষের সামরিক অভিযানের সময় নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন বসতি ও শহরগুলি ছেড়ে কৌশলে পিছু হটা। শাবাব যোদ্ধারা এসব এলাকা থেকে সরে যাওয়ায় পশ্চিমা সমর্থিত সরকারি সেনারা যখন নির্ভার হয়ে বিজয় উদযাপনের মানসিকতায় থাকে, তখন কিছু সময়ের ব্যবধানেই তাদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালায় আশ-শাবাবের প্রতিরোধ যোদ্ধারা।
অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে তখন সরকারি সেনারা কোনরকম জীবন নিয়ে পালাতে বাধ্য হয়। সাথে নিয়ে আশা ভারি সামরিক সরঞ্জাম আর রসদ সামগ্রীও ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় তারা; ফলে আর্থিক ও সামরিকভাবে লাভবান হয় আশ-শাবাব। সেই সাথে এলাকাগুলো পুনরায় ফিরে আসে আশ-শাবাবের দখলে।দেখা গেছে, শাবাবের এই কৌশলটি প্রথম পর্বের অভিযানে দখল করা প্রায় এলাকাই অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে হাতছাড়া করেছে পশ্চিমা সমর্থিত সোমালি সরকার। বিশেষ করে হিরান রাজ্যে শাবাবের এই কৌশলের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে পশ্চিমা সমর্থিত সোমালি সরকারি বাহিনীগুলো ও তাদের সমর্থিত মিলিশিয়ারা।
এখন, পশ্চিমা সমর্থিত সরকার তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এবং সেনাবাহিনীর মনোবল ধরে রাখতে প্রতিশ্রুতি ও অর্জনের গল্প প্রচার করলেও, বাস্তবতা অনেকটা ভিন্ন বলেই প্রতীয়মান হয়। গত ১৬ আগস্ট তারিখেও কেন্দ্রীয় জালাজদুদ রাজ্যের মাসগাওয়ে শহরে শাবাবের ইস্তেশহাদী অভিযানে অন্তত ১৫ সেনা নিহত এবং আরও ৯ সেনা সদস্য আহত হয়েছে। এর আগে গত ১০ আগস্ট থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত ৩ দিনের ব্যবধানে রাজধানী মোগাদিশু ও কিসমায়ো শহর সহ কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অন্তত ১৫ টি অভিযান চালিয়ে প্রায় শতাধিক সোমালি সেনাকে হতাহত করেছে শাবাব যোদ্ধারা, জব্দ করেছে বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম ও যুদ্ধযান।
আবার গত ২২ আগস্ট তারিখেও শাবাব যোদ্ধারা রাজধানী মোগাদিশু সহ কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অন্তত ৮টি অভিযান চালিয়ে ৪ বুরুন্ডিয়ান সৈন্য সহ অন্তত ৭০ সোমালি সৈন্যকে হতাহত করেছেন বলে জানা গেছে। আর এমন পরিস্থিতির মাঝেই মোগাদিশু সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে যে, দ্বিতীয় পর্বের অভিযানটি শাবাব নিয়ন্ত্রিত জুবাল্যান্ড এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের রাজ্যগুলি লক্ষ্য করে শীঘ্রই শুরু করা হবে।
আশ-শাবাবের বিরুদ্ধে ‘দ্বিতীয় ধাপের আক্রমণের’ প্রস্তুতি
প্রথম ধাপে কেন্দ্রীয় সোমালিয়ায় শাবাবের শক্তিশালী অবস্থানগুলিকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিল মোগাদিশু সরকার। আর অপারেশনের দ্বিতীয় ধাপে তারা দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আশ-শাবাবের শক্ত ঘাঁটিগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করার কথা বলছে।
শাবাব সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি, প্রথম পর্বের অভিযানে পশ্চিমা সমর্থিত সোমালি সরকার শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছে। তবুও এখন মোগাদিশু প্রশাসন তার আন্তর্জাতিক অংশীদারদের বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে আশ-শাবাবের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর প্রেসিডেন্টের দেওয়া ‘৫ মাসে শাবাবকে নির্মূল করার’ ঘোষণা নিয়ে এমনকি সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের (REUTERS) এক প্রতিবেদনে।
মোগাদিশু প্রশাসন দাবি করেছে, তারা অভিযানের প্রথম ধাপে আশ-শাবাবকে প্রচণ্ড আঘাত করেছে। কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই হাজার হাজার আশ-শাবাব সদস্যকে হত্যা করার দাবি করেছে তারা। অপরদিকে আঞ্চলিক সূত্রগুলি বলছে, অপারেশনের প্রথম পর্যায়ে মোগাদিশু প্রশাসনের কোন বাস্তব সাফল্য অর্জিত হয়নি। আশ-শাবাবের ক্ষতির বিষয়ে প্রদত্ত পরিসংখ্যান অতিরঞ্জিত ছিল। আর সরকারি বাহিনীর কাছে হারানো বসতিগুলি ইতিমধ্যে পুনরুদ্ধার করেছে আশ-শাবাব। রয়টার্সের প্রতিবেদনে এবিষয়টি কিছুটা হলেও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।
পশ্চিমা ও আফ্রিকান মিত্রদের সহায়তার আশ্বাস
সোমালি সেনাদের অভয় দিতে এই যুদ্ধে তাদের সহায়তায় মার্কিন বিশেষ বাহিনীর সদস্য এবং ইথিওপিয়ান ও কেনিয়ার বাহিনীও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রমতে, ইতিমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের গুরত্বপূর্ণ শহরগুলোর আশপাশে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর কমান্ডারদেরকে শাবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশনা দিতে এবং মাঠে মোগাদিশু প্রশাসনিক বাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে।
অথচ, ২০২২ সালের মে মাসে হাসান শেখ মাহমুদ মোগাদিশু প্রশাসনের নেতা হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর আগস্টে যে প্রথম ধাপের অভিযান শুরু হয়েছিল, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা সেই যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি সোমালি বাহিনী ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা। উল্টো, তথ্যপ্রমাণ বলছে, পশ্চিমা সমর্থিত মোগাদিশু সরকারি বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে।
আবার পুরো সময়টা জুড়ে দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটিতে আশ-শাবাবের ইস্তেশহাদী আক্রমণ ও অ্যাম্বুশে আফ্রিকান ইউনিয়নের অধীনস্থ বিদেশী সামরিক বাহিনীগুলোও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। উগান্ডান সামরিক ঘাঁটিতে শাবাবের আক্রমণে দুই শতাধিক উগান্ডান সেনা নিহত হওয়ার পর বিশিষ্ট উগান্ডান সাংবাদিক ও লেখক অ্যান্ড্রু মুয়েন্ডা নিজ দেশের সৈনিকদের ফিরিয়ে নিতে পরামর্শ দিয়েছেন তাদের সরকারকে।
আর এখন কিনা এই বিদেশি শক্তিগুলোকে নিয়েই ৫ মাসে শাবাবকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দিচ্ছে সোমালি সরকার!
দ্বিতীয় পর্বের অভিযানটি যে অঞ্চলগুলোকে টার্গেট করে চালানো হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো এক দশকেরও অধিক সময় ধরে শাবাবের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এখানে আশ-শাবাব একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলেছে, যার রাজধানী মনে করা হয় জিলিব শহরকে।
এই অঞ্চলে পশ্চিমা সমর্থিত সোমালি বাহিনী ও তাদের মিত্ররা আগের ব্যর্থ কৌশলে আগাবে, নাকি নতুন কোন কৌশল নিয়ে মাঠে নামবে- তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাবে এটা নিশ্চিত যে, নিজেদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আশ-শাবাব যোদ্ধারা ছেড়ে কথা বলবেন না; আর কথিত “দ্বিতীয় পর্যায়ের” এই লড়াই হয়তো বেশ সহিংসই হতে যাচ্ছে। আল্লাহু ‘আলাম।
Comment