মুসলিমরা এক উম্মাহ, একটি দেহের মতো। দেহের কোনো অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হলে, পুরো দেহ যেভাবে সেই আঘাতের ব্যথা অনুভব করে; তেমনি মুসলিম উম্মাহর কেউ পৃথিবীর কোনো প্রান্তে আঘাতপ্রাপ্ত হলে, মুসলিমরা সেই আঘাতে ব্যথিত হয়, সেই আঘাতের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তৎপর হয়। মুসলিমদের আসলে এমনই হওয়ার কথা। মুসলিমদের ইতিহাসে এমন প্রতিশোধের বহু ঘটনাও আছে।
হুদায়বিয়া সন্ধির সময় উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে শহীদ করে দেওয়ার খবর শুনে প্রতিশোধ নিতে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করার জন্য বায়াতবদ্ধ হন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর প্রায় চৌদ্দশত জন সাহাবী, রাদিয়াল্লাহু আনহুম।
এই ঘটনার বহু বছর পর ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু রাজার কবলে আটকে পড়া এক মুসলিম নারীর আর্তনাদে সাড়া দেন ইতিহাসে জালিম শাসক হিসেবে পরিচিত হাজ্জাজ বিন ইউসুফও! মুহাম্মাদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে মুসলিমদের একটি দল রণাঙ্গনে বেরিয়ে পড়ে মুসলিম বোনকে উদ্ধার করতে।
এগুলো হলো মুসলিমদের ইতিহাস। মুসলিমদের এমনই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে মুসলিমরা কেমন যেন মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের অনেকটাই হারিয়ে বসেছে, ভুলে গিয়েছে একে অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধের কথা। তাই বিশ্বের প্রায় প্রতিটি কারাগার মুসলিম বন্দী দিয়ে ভরে গেলেও অপরাপর মুসলিমদের হৃদয়ে তা দাগ কাটে না। জালিম-কাফেরদের কারাগারে মুসলিম নারীদের সম্ভ্রম হারানোর আর্তনাদেও আজ মুসলিমদের ভাবান্তর হয় না, মুসলিমরা নির্লিপ্ত। কেমন যেন মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করার ক্ষেত্রে কোনো দায়িত্বই নেই অপরাপর মুসলিমদের তথা উম্মাহর।
মুসলিমরা দায়িত্ববোধ নিয়ে সচেতন হলে এবং উম্মাহকে নিয়ে ভাবলে উম্মাহর বোন ড. আফিয়া সিদ্দিকী আজও আমেরিকার কারাগারে বন্দী থাকার কথা নয়। আজ প্রায় বিশ বছর ধরে তিনি বন্দী। বহুদিন ধরে তাঁর কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি। প্রায়ই তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তো। কিন্তু সম্প্রতি ড. আফিয়া সিদ্দিকীর সম্মানিতা বোন ফৌজিয়া সিদ্দিকী এবং মোশতাক আহমাদ খান তাঁর সাথে সাক্ষাত করেছেন, তাঁর অবস্থা সরাসরি দেখেছেন। তিনি এখনও আমেরিকার বদ্ধ কারাগারে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তবে জুলুমে তাঁর দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। জীর্ণ-শীর্ণ দেহ, রুগ্ন শরীর, ক্লান্ত চোখ, বিধ্বস্ত চেহারা, ভাঙ্গা দাঁত নিয়ে তিনি আমেরিকার এক কুখ্যাত কারাগারে জীবনসন্ধ্যা পার করছেন। অবস্থা এমন যে, তিনি প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন, আবার নতুন জীবন লাভ করছেন।
আফিয়া সিদ্দিকীকে নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত এক বার্তায় নিজের উদ্বেগ ও আকুতি এবং মুসলিম উম্মাহর অবস্থান ও করনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন বৈশ্বিক প্রতিরোধ বাহিনী আল-কায়েদা উপমহাদেশ শাখার আমীর শাইখ উসামা মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ্।
শাইখ উসামা মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ বলেন, “বর্তমানে আমাদের চিন্তাধারা ‘উম্মাহ’ হিসেবে ‘প্রাচীন’ অবস্থানে নেই। লাভ-লোকসানের হিসেব বদলে গেছে। সম্মান ও অসম্মানের মানদণ্ডও পরিবর্তিত হয়েছে। এই আর্তনাদ যদি সে যুগে পৌঁছানো যেত, যে যুগে ‘ঈমানী গায়রত’ (ঈমানী আত্মমর্যাদাবোধ) এবং ‘ইসলামী আখলাক’ মুসলিমদের মূল পরিচয় হিসাবে স্বীকৃত ছিল, তাহলে পুরো বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর মাঝে জাগরণ সৃষ্টি হতো। ফলশ্রুতিতে বাবা তার মেয়ের, ভাই তার বোনের সামনা-সামনি হতে লজ্জাবোধ করতো। এই এক ঘটনাই উম্মতের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াতো। রাজা-প্রজা, অভিজাত-সাধারণ, সব শ্রেণীর ভেদাভেদ ভুলে সবাই নিজের বোনের প্রতিশোধ নিতে এবং তাকে ফিরিয়ে আনতে মরতে ও মারতে প্রস্তুত হয়ে যেতো।”
ড. আফিয়া সিদ্দিকীর এই অবস্থার কথা মুসলিমদের অজানা নয়। মুসলিমরা জানেন, তাদের বোন আফিয়া সিদ্দিকী আমেরিকার কারাগারে জুলুমের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন। এমনকি তাঁর মুক্তির জন্য বড় বড় র্যালি বের করা হয়েছে, আমেরিকাকে বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে, আইনি লড়াই চালানো হয়েছে। অহিংস গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে যা যা করা সম্ভব, তার সবই করা হয়েছে। কিন্তু এসবকিছুই নিষ্ফল প্রমাণিত হয়েছে। জালেম আমেরিকা এসবের প্রতি কর্ণপাত করেনি। কারণ জালিম আমেরিকা বুদ্ধি-যুক্তির ভাষা বুঝে না। আমেরিকা বুঝে শক্তির ভাষা। তাই তার সাথে সেই ভাষাতেই কথা বলতে হবে। আমেরিকার হাত মচকে দিতে হবে, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তার দম্ভ চূর্ণ করে দিতে হবে। আর এটিই মাজলুমকে সাহায্য করার সার্বজনীন নীতি, আত্ম-মর্যাদাবোধসম্পন্ন জাতির এটিই মৌলিক পদ্ধতি।
মুসলিমদের জন্য মাজলুমের সাহায্যার্থে এই নীতির বাস্তবায়ন ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নয়, বরং তা আবশ্যক। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,
“তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছো না! অথচ ঐ দুর্বল ও মাজলুম পুরুষ, নারী এবং শিশুরা চিৎকার করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করছে যে, হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে জালিমদের এই বসতি থেকে বের করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একজন অভিভাবক ও একজন সাহায্যকারী পাঠান।” [সূরা নিসা ৪:৭৫]
মুসলিম উম্মাহর বোন ড. আফিয়া সিদ্দিকীকে মুসলিমদের শত্রু আমেরিকা কেবলই দ্বীন ইসলামের জন্য কারারুদ্ধ করেছে। ড. আফিয়া সিদ্দিকী নিজ দ্বীনের কথা প্রচার করতেন। মুসলিম উম্মাহর অংশ হিসেবে গর্ববোধ করতেন। তিনি পবিত্র কুরআনের হাফেজা ছিলেন। আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটি-তে পড়াশোনা করে নিউরোসাইন্টিস্ট হন। তবুও দুনিয়ার লোভ-লালসা তাঁকে কাবু করতে পারেনি। ইসলামের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন উম্মাহর মজলুম বোন আফিয়া সিদ্দিকী। তিনি সফল ইনশাআল্লাহ। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ তাআলা তাঁকে দুনিয়া-আখিরাতে অনেক কিছু দান করবেন। যার ওয়াদা আল্লাহ করেছেন।
হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, “যদি কোনো মুমিনকে তার জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি আল্লাহর আনুগত্যের পথে উপুড় করে টানা হেঁচড়া করা হয়, কিয়ামতের দিন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সম্মান এবং পুরস্কার পেয়ে নিজের জীবনের এ দুঃখ-কষ্টকে সে তুচ্ছ মনে করবে।” (আল মুজামুল কাবীর তবারানী, ১৭/১২২ হাদীস নং: ৩০৩ [শামেলা])
সর্বশেষে শাইখ উসামা মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ-এর ভাষায় বলতে হয়, “মূল পেরেশানি কিন্তু আমাদের। সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল অবস্থা আমাদের দেড়শ কোটি মুসলমানের। কারণ, এটি আমাদের ঈমান ও ইখলাসের কঠিন পরীক্ষা। আল্লাহ তাআলা যখন আমাদেরকে তাঁর এই প্রিয় বান্দী এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বিশাল উম্মতের মান-মর্যাদা ও ইজ্জত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, তখন আমরা কী জবাব দেবো?”
তথ্যসূত্র:
১. একটি সংবাদ… একটি বার্তা… || উস্তাদ উসামা মাহমুদ হাফিযাহুল্লাহ – https://tinyurl.com/3n7td74b
Comment