২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর অ্যামেরিকার অর্থনৈতিক (টুইন টাওয়ার), সামরিক(পেন্টাগন) ও রাজনৈতিকভাবে (ক্যাপিটাল হিল) সবচাইতে গুরত্বপূর্ণ ৩টি অবস্থান লক্ষ্য করে একযোগে আক্রমণ চালায় আল-কায়েদা। আর এই হামলার ফাঁদে ফেলেই অ্যামেরিকাকে আফগানের উত্তপ্ত রণাঙ্গনে, ইরাকের মরু প্রান্তরে ও আফ্রিকার দুই প্রান্তে এবং ইয়েমেনে আটকে তাদের শক্তিকে বিক্ষিপ্ত করে ফেলা হয়; ফলশ্রুতিতে অ্যামেরিকা আজ একক বিশ্বমোড়লের পদবি হারানোর দ্বারপ্রান্তে।
আজ আমরা এই আক্রমণের বিরুদ্ধে ইহুদি-খ্রিস্টান মিলিত শক্তির ছড়ানো প্রোপ্যাগান্ডার বিশেষ কয়েকটি দিকের উপর আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ্; ঘটনাচক্রে যে দিকটি থেকে যাচ্ছে অনেকটা আড়ালেই।
মুসলিমবিরোধী ও অভিযানবিরোধী প্রোপ্যাগান্ডা
৯/১১ অভিযানের আগে ধূর্ত অ্যামেরিকা মুসলিমদের সাথে স্ব-শরীরে যুদ্ধের ময়দানে তেমনভাবে না আসলেও, পরোক্ষভাবে সে প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রে পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের নেতৃত্ব দিয়েছে; যার শিকার হয়েছে ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, ইরাক, সুদান, লিবিয়া, সোমালিয়া, চেচনিয়া, বসনিয়াসহ বিশ্বের বহু মুসলিম দেশ। এতোগুলি রাষ্ট্রে আগ্রাসন চালানোর পরেও অ্যামেরিকা বিশ্ববাসীর কাছে ছিলো ‘মানবতাবাদী ও জনদরদী’।
কিন্তু এই অভিযানের পর অ্যামেরিকার কথিত মানবতাবাদী মুখোশ ধীরে ধীরে খসে পরতে শুরু করে। তবে এটা ঠেকাতে প্রোপ্যাগান্ডা ও মিডিয়া আগ্রাসন চালানোর ক্ষেত্রে কোন কমতি করেনি অ্যামেরিকা। অ্যামেরিকার কথিত থিংকট্যাঙ্ক র্যান্ড-এর বিভিন্ন নথি ফাঁস হওয়ার পর এসব প্রোপ্যাগান্ডা-ষড়যন্ত্রের অনেক অজানা বিষয় উঠে আসে বিশ্ববাসির সামনে।
ইতিমধ্যে ৯/১১ অভিযান নিয়ে উত্থাপিত প্রায় সকল অভিযোগের জবাবই দিয়েছেন হক্কানি উলামায়ে কেরাম ও মুজাহিদ উমারাগণ। তবে বহুল চর্চিত বিষয়গুলোর মধ্যেই কিছু বিষয় ঢাকা পরে যায় স্মৃতির আড়ালে; ইতিহাসের পালাবদলের সন্ধিক্ষণে যেগুলোর চর্চা জারি থাকা ও বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরী।
বিশ্বমিডিয়া যেহেতু ইহুদি-খ্রিস্টান জোটের নিয়ন্ত্রণে, এবং পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রভাবশালী মিডিয়া আউটলেটের মালিকানায় সরাসরি ইহুদিরা রয়েছে, তাই তারা সাধ্যের সবটুকু দিয়েই মুসলিমদের কোণঠাসা করতে তাদের মিডিয়াযন্ত্রের ব্যবহার করেছে।
৯/১১ হামলায় নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে জায়নবাদী অ্যামেরিকা ইসলামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা পর্যন্ত বদলে দিতে চেষ্টা চালিয়েছে। ইসলাম অর্থ ‘শান্তি’ আর ইসলামকে তাদের সংজ্ঞানুযায়ী শান্তির ধর্ম আখ্যা দিয়ে তারা মুসলিমদেরকে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছে। মুজাহিদদেরকে কলঙ্কিত করতে এবং তাঁদেরকে মুসলিম উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করতেও তারা চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। আর একারণেই তারা নিজেদের সামরিক সদর দফতর পেন্টাগনে হামলার বিষয়টিকে আড়াল করতে বাণিজ্যিক কেন্দ্র টুইন টাওয়ারে হামলার বিষয়টিকে প্রচারনার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে। মুসলিম ভূমিগুলোতে পশ্চিমাপন্থী দুর্নীতিবাজ শাসকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত জিহাদকে কলঙ্কিত করতে তারা কখনো কখনো বেসামরিক মুসলিমদের উপর হামলা চালিয়ে মুজাহিদদের উপর দোষ চাপিয়েছে- এমন অসংখ্য প্রমাণও বিদ্যমান।
৯/১১ পরবর্তী সময়ে অ্যামেরিকার অন্যতম সফল একটি প্রোপ্যাগান্ডা ছিল এই যে, ইহুদি নিয়ন্ত্রিত বিশ্বমিডিয়া এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে, এই আক্রমণ আসলে বৈশ্বিক ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী আল-কায়েদা চালায়নি। ‘মুসলিমরা দোর্দণ্ড প্রতাপশালী অ্যামেরিকার মাটিতে আক্রমণ করার সামর্থ্য রাখে না’ – এমন বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার জন্য তারা এই বলে গুজব রটিয়েছে যে, এই হামলা বুশ নিজেই করিয়েছে! যুগ যুগ ধরে অমুসলিমদের শাসনাধীনে থাকা মুসলিম উম্মাহর উপর জেঁকে বসা পরাজিত মানসিকতার সুযোগ তারা ভালভাবেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে।
তাদের এই প্রচারণাটি এতই প্রভাব সৃষ্টিকারী ছিল যে, এমনকি খ্যাতনামা অনেক মুসলিম স্কলার পর্যন্ত এই প্রচারণায় জড়িয়ে পড়েছে। কোন বিমান কোন দিক দিয়ে হামলা করেছে, কোন বিল্ডিং কোন দিকে হেলে পড়েছে, ইঞ্জিনিয়াররা কি বলছে – ইত্যাদি নানা যুক্তি-পাল্টাযুক্তি দেখিয় তারা প্রমান করার চেষ্টা করেছেন যে, মুসলিমরা এই হামলা করে নি, বরং এটা বুশ নিজেই আভ্যন্তরীণভাবে করিয়েছে।
প্রাথমিকভাবে ঘটনার সম্পর্কে নীরব থাকলেও, আল-কায়েদা নেতৃত্ব পরবর্তীতে নিজেদের নানান লেখনি ও বার্তায় ইতিহাসের দিক পরিবর্তনকারী এই হামলায় দায় স্বীকার ও নিজেদের জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ পেশ করেছেন।
শিয়ারা কেন এই প্রোপ্যাগান্ডা চালায়?
৯/১১ তথা অপারেশন ম্যানহাটন সম্পর্কে ইহুদি-খ্রিস্টান জোটের প্রোপ্যাগান্ডা চালানোর কারণ সম্পর্কে ইতিমধ্যে আলোচনা এসেছে। মুসলিমদের পরাজিত মানসিকতার মধ্যে জিইয়ে রাখা, জিহাদ ও মুজাহিদদেরকে কলুষিত করার চেষ্টা করা, নিজেদের শক্তিশালী হিসেবে জাহির করা – ইত্যাদি নানা কারণেই তারা বিশেষ এই ধরণের প্রোপ্যাগান্ডা চালিয়েছে।
এখানে উল্লেখযোগ্য আরেকটি বিষয় হলো, এই প্রোপ্যাগান্ডা চালানোয় অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে ইরান নেতৃত্বাধীন শিয়া রাফেজিরা। তারা নিজেদেরকে অ্যামেরিকা ও পশ্চিমাবিরোধী প্রমাণ করতে এই বলে জোরালো প্রচার চালিয়েছে যে, ৯/১১ অ্যামেরিকা নিজেই ঘটিয়েছে, আর আল-কায়েদা তালিবান সবাই অ্যামেরিকার সৃষ্টি!
আর এই প্রচারণায় তাদের সাথে তাল মিলিয়েছে চীন-রাশিয়া ব্লক।
আরব শাসক ও মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইরানের নেতৃত্বে শিয়া রাফেজিরা একমাত্র নিজেদেরকেই খাঁটি মুসলিম ও উম্মাহর কল্যাণকামী হিসেবে দাবি ও প্রচার করে। সাধারণ মুসলিমদের অনেকেই আবার ইরানের অ্যামেরিকা-ইসরাইল বিরোধি নানান মুখরোচক কথা-বার্তার কারণে তাদেরকে মুসলিম বিশ্বের ত্রানকর্তা ভেবে বসে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ৯/১১ পরবর্তী সময়ে অ্যামেরিকার কথিত ‘ওয়ার অন টেররে’র ময়দানে ইরানের অংশগ্রহণ ছিল সরাসরি ও স্পষ্ট। তারা অ্যামেরিকার সাথে মিলে আফগানিস্তানের মাটিতে আগ্রাসন চালিয়েছে, লড়াই করেছে ন্যাটো ও পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত তালিবান মুজাহিদিনের বিরুদ্ধে। ইরাকে অ্যামেরিকার আক্রমণের পর সেখানে শিয়ারা ক্ষমতার মসনদে আসিন হয়েছে; আহলুস সুন্নাহর অনুসারী মুসলিমদের উপর চালিয়েছে বর্বরতম নির্যাতন। ইয়েমেন ও সিরিয়াতেও তারা মুসলিমদের রক্ত ঝরিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।
আর ইয়েমেনের চতুর্দিকে অ্যামেরিকার ঘাঁটি থাকলেও, সেখানে তারা ইরান সমর্থিত শিয়া হুথি বাহিনীর উপর একটি আক্রমণও চালায়নি; সিরিয়াতেও না।
৯/১১ ও তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আমাদের সামনে অ্যামেরিকা-ইসরাইল নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ইরান নেতৃত্বাধীন শিয়া রাফেজিদের গোপন আঁতাতের বিষয়টি কিছুটা স্পষ্ট করে দিয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, ইরান মুখে পশ্চিমাবিরোধী কথা বললেও, অ্যামেরিকা মুসলিম বিশ্বের যত জায়গায় হস্তক্ষেপ করেছে, ইরান তথা শিয়া রাফেজিরা ততো জায়গাতেই শক্তিশালী হয়েছে। ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেন তার জলন্ত দৃষ্টান্ত।
কয়েক মাস আগে ইরান-আফগান সীমান্তে উত্তেজনার সময় সিনিয়র তালিবান কমান্ডার আব্দুল হামিদ খোরাসানি নির্দেশ পেলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ইরান দখলের হুমকি দিয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি এও বলেছেন যে, “ইরান দেখাচ্ছে পশ্চিমাদের সাথে তাদের সম্পর্ক খারাপ। বাস্তবতা হচ্ছে, পশ্চিমাদের সঙ্গে জোট বেধেছে তারা।…”
তাঁর কথাতেও ৯/১১ পরবর্তী পরিক্রমায় পশ্চিমাদের সঙ্গে ইরানের আঁতাতের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
মূলত, ৯/১১ এর ঘটনা ইহুদি-খ্রিস্টান নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার মূলে আঘাত করে বহুপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছিল। মুসলিম বিশ্ব এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে এবং শত্রু-মিত্র চিনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলে, হারানো নেতৃত্ব ফিরে পাওয়াটা কেবল সময়ের ব্যাপার। ভবিষ্যৎ ঘটনাপ্রবাহে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা প্রতিটি মুসলিমের জন্য জরুরী, অবশ্যই কোরআন-হাদিস এবং জ্ঞানীদের জ্ঞানের আলোকে। এটিও ৯/১১ এর তাৎপর্যপূর্ণ আহ্বানসমূহের মধ্যে অন্যতম।
তথ্যসূত্র:
1. 9/11 was an inside job – Iran president
– https://tinyurl.com/ywe2v8vb
2. Debunking Paranoia: ‘9/11 was not an inside job’
– https://tinyurl.com/22dvf3m5
3. বিশ্ব মানচিত্র থেকে ইরানকে মুছে ফেলার হুমকি তালেবানের | Taliban |
– https://www.youtube.com/watch?v=CLW3IWlEk8w
4. ৯/১১ অভিযান : জিহাদি মেরুকরণের শক্তিশালী অনুঘটক
Comment