বৈশ্বিক ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী আল-কায়েদার পশ্চিম আফ্রিকান শাখা “জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল-মুসলিমিন” (জেএনআইএম)। সম্প্রতি দলটির প্রতিরোধ যোদ্ধারা মালির ঐতিহাসিক রাজ্য টিম্বাকটুতে তাঁদের অবস্থান আরও মজবুত করেছে। টানা দেড় মাস ধরে রাজ্যটিতে প্রবেশের স্থল ও নদী পথের উপর অবরোধের পর এবার মালিয়ান সেনাবাহিনীর জন্য আকাশ পথকেও সংকুচিত করে ফেলছে দলটি।
স্থানীয় সূত্রমতে, গত ১১ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে এই রাজ্যের কেন্দ্রীয় শহরের বিমানবন্দর লক্ষ্য করে অভিযান শুরু করেছে ‘জেএনআইএম’। মালিয়ান সেনাবাহিনী এবং রাশিয়ান ওয়াগনার মিলিশিয়াদের দখলে থাকা বিমানবন্দরে মর্টার শেল, ক্ষেপণাস্ত্র ও আর্টিলারি দ্বারা হামলা চালানো শুরু করেছেন প্রতিরোধ যোদ্ধারা।
অবরুদ্ধ শহরেটির সবকটি সামরিক অবস্থান এবং এর বিমানবন্দরে ক্রমাগত বোমাবর্ষণের ফলে রাজ্যটিতে বেসামরিক বিমান চলাচল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে সামরিক জান্তা। ফলে রাজ্যটি স্থলপথ ও নদীপথের পর এবার আকাশ পথেও অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অভিযানরত জেএনআইএম মুজাহিদিন
স্থানীয় সূত্রমতে, টিম্বাকটু রাজ্য গত দেড় মাস ধরে আল-কায়েদার অবরোধের মধ্যে রয়েছে। এই সময়টাতে তাঁরা রাজ্যটির সাথে যুক্ত আলজেরিয়া ও মৌরতানিয়া সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, সীমান্ত হয়ে সমস্ত ট্রাক ও যানবাহন চলালের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞার পর কিছু ট্রাক শহরে ঢুকার চেষ্টা করলে সেগুলো জব্দ করা হয় এবং কিছু পুড়িয়ে ফেলা হয়।
স্থলপথে আল-কায়েদার অবরোধের ফলে শহরের ভিতরে আটকা পড়া সৈন্যরা তাদের রসদপত্র পরিবহনের জন্য নদী পথ ব্যবহার করার চেষ্টা করে। এই লক্ষ্যে তারা ভিতরে আটকা পড়া সেনাদের সহায়তা করতে বেসামরিক জাহাজে করে একটি বড় সেনা ইউনিট ও প্রচুর রসদ সামগ্রী প্রেরণের কৌশল গ্রহণ করে। জাহাজটি গত ৭ সেপ্টেম্বর বিকালে টিম্বুকটো নদীর জেরহাউয়া এলাকায় প্রবেশ করলে এটি লক্ষ্য করে একে একে ৩টি শেল নিক্ষেপ করা হয়। যেগুলো সরাসরি জাহাজে আঘাত হানে। আর সামরিক বাহিনীর রসদ সামগ্রীতে প্রচুর বিস্ফোরক থাকায় মুহুর্তেই পুরো জাহাজে আগুন লেগে যায় বিকট বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
বিস্ফোরণের পর আগুনে পুড়ছে সেনাবাহিনীর সরবরাহ জাহাজ
এই ঘটনার পর সরকার দাবি করে যে, জাহাজে হামলার ঘটনায় ৪৯ জন বেসামরিক নাগরিক সহ ১৫ সেনা সদস্য নিহত হয়েছে। অপরদিকে বেসামরিক সূত্র বলছে, জাহাজটি বেসামরিক সংস্থার হলেও এতে আরোহীরা ছিলো মালিয়ান সামরিক বাহিনীর সদস্য, যারা মোপ্তি রাজ্যের দিকে যাওয়া এই জাহাজটিতে করে অবরুদ্ধ টিম্বাকটুতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। আর মূলত আল-কায়েদা মুজাহিদদের বদনাম করতে মালির জান্তা সরকারের বরাত দিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় খবর প্রচার করা হয় যে, প্রতিরোধ যোদ্ধারা বেসামরিক মানুষ হত্যা করেছেন; যা ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটি গুজব।
তবে প্রতিরোধ যোদ্ধারা এসব অপপ্রচারণায় দমে না গিয়ে বরং একই দিন সকাল ৭টায় গাও রাজ্যের বাম্বা শহরে একটি সামরিক ঘাঁটিতে বড়ধরণের অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানের সময় ঘাঁটিটিতে অবস্থান করছিল কয়েক শতাধিক মালিয়ান সেনা সদস্য এবং ওয়াগনার ভাড়াটে মিলিশিয়ারা।
সূত্রমতে, ঘাঁটিতে অভিযান পরিচালনার সময় শতাধিক ‘জেএনআইএম’ যোদ্ধা আর্টিলারি সহ ভারী অস্ত্রের ব্যবহার করে শত্রুর উপর আঘাত হানেন। প্রায় আড়াই ঘন্টার তীব্র লড়াইয়ে মালিয়ান সেনাবাহিনী ও ওয়াগনার বাহিনী পুরোপুরিভাবে ধ্বংস হয়ে যায় এবং সামরিক ঘাঁটি জেএনআইএম’এর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আর বৃহস্পতিবার বিকেল নাগাদ বাম্বা শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন মুজাহিদগণ।
স্থানীয় সূত্রমতে, ৭ সেপ্টেম্বর মুজাহিদদের পরিচালিত এই দুই অভিযানে মালিয়ান সামরিক বাহিনী ও ভাড়াটে দল ওয়াগনারের অন্তত ১৬৪ সদস্য নিহত হয়েছে। সেই সাথে আহত হয়েছে আরও ৭৪ সৈন্য, যাদের মাঝে ৪০ সেনার অবস্থাই গুরুতর।
এদিকে বামাকোর সামরিক জান্তা সরকার এই দুটি অভিযানে নিহত সেনাদের “সম্মানে” তিন দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে।
আয-যাল্লাকা সহ স্থানীয় অন্যান্য সূত্র জানায়, গত আগস্টে টিম্বুকটো রাজ্যে অবরোধ শুরুর পর সর্বশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজ্যটিতে মালিয়ান সামরিক বাহিনীকে ছাড়াও ওয়াগনার ভাড়াটে মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে ছোট-বড় অন্তত ২১টি পৃথক অভিযান পরিচালনা করেছেন ‘জেএনআইএম’ যোদ্ধারা। এসবের ২ টিতেই ওয়াগনার ভাড়াটে মিলিশিয়া বাহিনীর অন্তত ১৬ সৈন্য নিহত হয়েছে, বাকি অভিযানগুলোতেও অসংখ্য সৈন্য হতাহত হয়। তবে স্বাধীন কোনো সূত্র দ্বারা হতাহতের সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া যায় নি।
জেএনআইএম-এর সামরিক কমান্ডার
স্থানীয় সূত্রমতে, রাজ্যটির অধিকাংশ কেন্দ্রীয় শহর (জাতিসংঘের সহায়তায়) নিয়ন্ত্রণ করছে আজওয়াদ বিদ্রোহীরা। সম্প্রতি জাতিসংঘ এসব এলাকা থেকে চলে যাওয়ায় এগুলোর দখল নেওয়ার চেষ্টা করছে মালিয়ান সেনাবাহিনী ও ওয়াগনার মিলিশিয়ারা। এছাড়া রাজ্যটির সকল প্রধান সড়কপথ ও কৌশলগত গুরত্বপূর্ণ এলাকাগুলো সহ এর ৮০% এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে ‘জেএনআইএম’ যোদ্ধারা।
আর রাজ্যটিতে আল-কায়েদার চলমান এই অবরোধের ফলে মালিয়ান সেনাবাহিনীর জন্য পরিস্থিতি দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে আসছে। তাছাড়া বাহির থেকে বড় কোনো সামরিক ইউনিট এবং রসদপত্র না পৌঁছানোয় আতংকে দিন কাটচ্ছে ভেতরে আটকা পড়া সৈন্যরা।
মালিয়ান সেনাবাহিনী চেষ্টা করছিল, রাজ্যটি থেকে জাতিসংঘের সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের সাথে সাথে এর পুরো নিয়ন্ত্রণ নিবে তারা। এই লক্ষ্যে তারা ওয়াগনার বাহিনীর সহায়তায় আগস্টে টিম্বুকটোতে প্রবেশ করে এবং আজওয়াদ বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত ২টি শহর দখল করে। কিন্তু তাদের সমস্যা শুরু হয়, যখন আল-কায়েদা এখানে তাঁর শক্তিমত্তা দেখাতে শুরু করে। রাজ্যটিতে নিযুক্ত আল-কায়েদার গভর্নর তালহা আবু হিন্দ এসময় টিম্বাকটুর অবরোধ এবং মালিয়ান ও ওয়াগনার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তালহা আল-আজওয়াদী (জেএনআইএম নেতা) বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি জান্তা ও ওয়াগনারকে কোনরূপ সমর্থন না করার আহ্বান জানান। তিনি জানান, “আমাদের এই অবরোধের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে সামরিক জান্তা এবং তাদেরকে সহায়তাকারি ভাড়াটে ওয়াগনার বাহিনী। তাই আপনাদেরকে সামরিক অবস্থানগুলো এড়িয়ে চলার জন্য সতর্ক করছি।”
তিনি আরও ঘোষণা করেন, “এই অবরোধের ফলে মৌরতানিয়া এবং আলজেরিয়া সীমান্তে সবরকম পরিবহন বন্ধ থাকবে। টিম্বুকটোতে প্রবেশ ও বের হওয়ার সমস্ত সড়ক বন্ধ থাকবে। জান্তা এবং ওয়াগনারকে সহায়তার জন্য আসা অস্ত্র, সামরিক সরঞ্জাম ও রসদ সরবরাহকারী প্রত্যাকটি যান হামলার লক্ষ্যবস্তু হব। তাই সাধারণ মানুষকে এসব বস্তু পরিবহন ও শহরে প্রবেশে সহায়তা করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।”
তাঁর এই ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যটি অবরোধের মধ্যে আছে। ওয়াগনার এবং মালিয়ান বাহিনী স্থল ও আকাশ পথের অভিযানের মাধ্যমে অবরোধ ভাঙার প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
সম্প্রতি ‘জেএনআইএম’ কর্তৃক একটি সামরিক ঘাঁটি বিজয়ের দৃশ্য
উল্লেখ্য যে, এর আগে অর্থাৎ ২০১০ সালে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২০১৩ সাল পর্যন্ত ঐতিহাসিক এই রাজ্যটি সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ যোদ্ধারা নিয়ন্ত্রণ করেছিল। বর্তমানে বামাকোর ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা সরকারের সাস্প্রতিক ব্যর্থতা এবং রাজ্যটিতে আল-কায়েদার শক্তিশালী অবস্থান বলছে, খুব শীগ্রই রাজ্যটি পূণরায় আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট প্রতিরোধ বাহিনী জেএনআইএম-এর নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে।
একজন আজওয়াদ বিশ্লেষক মোহাম্মদ এজি ইসমাঈল বলেন, মনে হচ্ছে আল-কায়েদা বামাকোকে বার্তা পাঠাতে চাচ্ছে যে, তারা সরকারকে উৎখাতের কাজ শুরু করে দিয়েছে। তাঁরা সরকারকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে চায়। চলমান এই যুদ্ধে আল-কায়েদাকে থামানো মালিয়ান সেনাবাহিনী ও তার মিত্রদের জন্য সহজ হবে না। কেননা আল-কায়েদা সীমান্ত অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করছে, সেই সাথে জনগণের সাথে মিশে কাজ করছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনই যদি একটি সমঝোতায় না পৌঁছাতে পারে, তবে এই যুদ্ধ এই অঞ্চলের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধ হয়ে উঠবে। আমি আশংকা করছি যে, আফ্রিকার পুরো সাহেল অঞ্চল ইউক্রেন হয়ে উঠবে, যার প্রতিটি অঞ্চলেই আল-কায়েদার উপস্থিতি রয়েছে।
Comment