বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের অতীত-বর্তমান
বর্তমান হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের অনড় আদর্শবাদি অবস্থান দেখে অন্তরে একটু ভালো লাগা অনুভব হয়। আজ মাওলানা মামুনুল হক সাহেব ও আল্লামা জুনাইদ বাবু নগরী সাহেব ঈমানী পরিক্ষার এক কেন্দ্রীয় অবস্থানে আছেন। চরমোনাই পীর সাহেবও মাশাআল্লাহ বেশ ভালো ঈমানী চেতনা দেখাচ্ছেন।
এই ভালো লাগার অনুভব বাস্তবে রূপ নিত, যদি এই অবস্থান কয়েক যুগ ব্যাপী অটল থাকত এবং এর গন্তব্যও মোটামোটি সঠিক হত। আমরা ভালোর আশা রাখি এবং ভালোর জন্য দু’আ করি।
কিন্তু আমাদের অতীতের কিছু বিষয় দেখে আশঙ্কা হয়, আবারো কি অতীতের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতারই পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না।
আমি সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করবো:
১। আওয়ামীলীগের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের স্বৈর শাসনামলের শেষ দিকে সকল ইসলামী দলগুলো আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে এক হয়েছিল। আওয়ামীলীগ বাংলাদেশে ফাতওয়া নিষিদ্ধ করে রায় দিয়েছিল। তার জন্য উলামায়ে কেরাম কাফনের কাপড় মাথায় নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন। তখন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ও মুফতি আমিনী রহ. সহ অনেক আলেমকে কারাগারে নেওয়া হয়েছিল। কয়েকটি মাদরাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এই ইস্যুতে ভ্রাহ্মণবাড়িয়ায় চারজন তালিবুল ইসলম শহিদ হয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে মোটামোটি সকল ইসলামী দলগুলো এক হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু সেই আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আসল এবং ক্ষমতার মজা ভোগ করল; ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় আসল না এবং ইসলামও কায়েম হল না। আলেমদের মাথায় লবণ রেখে বিএনপি জামাত বরই খেল। আলেমরা প্রাণ দিল, রক্ত ঝরাল। কিন্তু ক্ষমতার মজা ভোগ করল বিএনপি-জামাত। তারপর তারা জিএমবি, হরকাতুল জিহাদ সহ সকল জিহাদী দলগুলোকে ভালোভাবে দমন করল। মাদরাসায় মাদরায় তল্লাশি চালিয়ে জিহাদি বই পরিস্কার করল।
২। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম আন্দোলন করল। কিন্তু তার ঘাড়ের উপর চেপে বসেছিল বিএনপি-জামাত। বিএনপি-জামাত চেয়েছিল এই আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামীলীগের পতন ঘটলে তারা ক্ষমতায় যাবে। একারণে জামাতের অনেক সদস্য হেফাজতের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। বিএনপিও তাদের কর্মীদেরকে অংশগ্রহণ করতে বলেছিল।
এখানেও হুজুরদের আন্দোলন ও রক্ত ঝরানোর ফল ভোগ করার জন্য বসেছিল বিএনপি-জামাত। আর আওয়ামীলীগ ক্ষমতা থেকে হটলে বাস্তবেই তারা ক্ষমতায় যেত, এটাতে কোন সন্দেহ নেই। এমনকি বিএনপি-জামাত এক্ষেত্রে হুজুরদেরকে উস্কে দিতেও সচেষ্ট। যাতে নিজেরা ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতার মজা ভোগ করতে পারে।
৩। বর্তমানে যে হেফাজতে ইসলাম সরব ও গরম হয়ে উঠেছে, এখানেও বিএনপি-জামাত আশা করে বসে আছে। আর স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামলীগের পতন হলে বিকল্প বিএনপি-জামাত ব্যতিত কিছু নয়। সবাই এমনটাই বুঝে। এজন্যই অনেক বিএনপি-জামাত ঘেষা সাংবাদিক ও সাবেক সেনাকর্মকর্তারা হুজুরদেরকে উস্কে দেওয়ার মত বিভিন্ন কথাবার্তা বলছে।
মানে এবারও হুজুরদের রক্তে-ঘামে পরিচালিত আন্দোলনের ফল ভোগ করবে বিএনপি-জামাত, যদি আন্দোলন সফল হয়। কারণ এটা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। হুজুররাও মনে করে, এটা হতে বাধ্য। আর বিএনপি জামাতও মনে করে, এটা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
তাহলে হুজুরদের রক্ত-ঘাম ও চেষ্টা-প্রচেষ্টা কি সর্বদা এভাবেই নষ্ট হতে থাকবে? হুজুররা রক্তদান ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে কি বারবার বিএনপি জামাতের ক্ষমতার মূল্য পরিশোধ করতে থাকবে? কখন হুজুরদের চেষ্টা-প্রচেষ্টাগুলো শুধু ইসলামের কাজে লাগবে? কিভাবে এই রক্তের মাধ্যমে সেই ইসলাম বাস্তবায়িত হবে, যার স্বপ্ন হুজুররা দেখে?
হুজুরদের ১৩ দফা দাবি আওয়ামীলীগ মানেনি, কিন্তু বিএনপিও তো মানবে না। কারণ ওই সময় আওয়ামীলীগের জনৈক এমপি বিএনপির জনৈক নেতাকে জিজ্ঞেস করেছিল: আপনারা ক্ষমতায় থাকলে কি এগুলো মেনে নিতেন? সে উত্তর দিল: হয়ত মানতাম না, কিন্তু এভাবে হত্যা করতাম না।
তাহলে ব্যাপার এটাই দাড়ালো যে, তারাও এগুলো মানত না। কারণ তারাও জাতিসঙ্ঘের আইন ও আন্তর্জাতিক নীতির ছত্রছায়ায় থাকতে বাধ্য। নইলে কিছুতেই ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।
তাই এখন হুজুরদের ভেবে দেখা উচিত যে, কিভাবে নিজেদের থেকে বিএনপ-জামাতের এই প্রভাব ও ফায়দা লুটার সুযোগ বন্ধ করা যায়? কিভাবে এই প্রচেষ্টাকে প্রকৃত ইসলাম ও শরীয়ত বাস্তবায়নের পক্ষে কাজে লাগানো যায়। এর জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও পথ আঁকা দরকার।
Comment