হাসিনার শাসন আমলে রাষ্ট্রীয় মদদে করা হতো গুম; গুম কমিশনের প্রতিবেদনে র্যাব ও ডিজিএফআইয়ের নিষ্ঠুরতা

পলাতক হাসিনার টানা ১৬ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের ছত্রছায়ায় একটি ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর চর্চা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল—গুম ও নির্যাতন। গুম সংক্রান্ত কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন এই কালো অধ্যায়ের নির্মম বাস্তবতা প্রকাশ্যে এনেছে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কীভাবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষ করে র্যাব ও ডিজিএফআই-এর মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে হাজারো নাগরিককে গুম করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হতে বাধ্য করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর পদ্ধতিগত নির্মাণ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে গুম ছিল একটি সুপরিকল্পিত ও পদ্ধতিগত রাষ্ট্রীয় চর্চা। র্যাব-২, সিপিসি-৩, টিএফআই সেল, এবং সিটিটিসি এর মতো ইউনিটগুলোতে নির্যাতনের জন্য বিশেষ কৌশল ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হতো। ঘূর্ণায়মান চেয়ার, ‘পুলি সিস্টেম’ (যেখানে মানুষকে ঝুলিয়ে রাখা হত), এবং শব্দনিরোধক নির্যাতনকক্ষ গড়ে তোলা হয়েছিল যাতে ভুক্তভোগীদের চিৎকার বাইরের কেউ শুনতে না পায়। এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়, বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে গোপনীয় ও কার্যকর রাখার একটি প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুক্তভোগীদের আটক ও হেফাজতের কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড রাখার নিয়ম ছিল না, ফলে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দায়মুক্ত থাকত। শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য মলম লাগানো হতো কিংবা দাগ মুছে যাওয়া পর্যন্ত আটক রাখা হতো। অনেকের মুক্তির সময় এমন অবস্থা করা হতো, যাতে কেউ তাদের ক্ষতবিক্ষত শরীর শনাক্ত করতে না পারে। বহু ভুক্তভোগী স্পষ্ট নির্যাতনের চিহ্নসহ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থিত হয়েছে, কিন্তু বিচারব্যবস্থা ছিল নির্বিকার।
শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি গুমের শিকাররা মানসিক নির্যাতন ও সন্ত্রাসেরও শিকার হয়েছিল। অর্ধেকের বেশি ভুক্তভোগীকে খাবার দেওয়া হতো না, চোখ বেঁধে ও হাতকড়াসহ একাকী সেলে রাখা হতো। দিনের পর দিন ঘুমাতে না দিয়ে জাগিয়ে রাখা, খালি পায়ের উপর বসিয়ে রাখা, মশার কামড় সহ্য করানো—এসব ছিল তাদের দৈনন্দিন দুঃখ।
নারীত্বের ওপর নিষ্ঠুর ও অপমানজনক নির্যাতন
নারীদের নির্যাতনের মাত্রা ছিল আরও নিষ্ঠুর। এক নারী ভুক্তভোগী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাকে ওড়না ছাড়া জানালার দিকে মুখ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, যেন পুরুষ প্রহরীরা তার শরীর উপভোগ করতে পারে। পিরিয়ড চলাকালে প্রয়োজনীয় প্যাড চাওয়ার সময় হাসাহাসি করা হয়। এটি ছিল নারী সত্তার ওপর নগ্ন ও সামাজিক আঘাত।
নির্মম প্রহার, বৈদ্যুতিক শক ও যৌনাঙ্গে নির্যাতন
প্রায় সকল ভুক্তভোগীই লাঠিপেটা, পিঠ থেঁতলে দেওয়া, পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা, হাত-পা বেঁধে উল্টো ঝুলিয়ে পায়ের তালুতে আঘাত—এসব নিয়মিত শাস্তির শিকার হয়েছেন। শুধু হাত-পা নয়, যৌনাঙ্গেও বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো । কেউ বলেছেন, প্যান্ট খুলে ক্লিপ লাগিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হতো, যা তাদের অজ্ঞান হওয়ার পর্যায়ে নিয়ে যেত।
ভয়াবহ “ওয়াটারবোর্ডিং” ও ঘূর্ণায়মান চেয়ারের নির্যাতন
মুখে পানি ঢেলে শ্বাসরোধ করে শ্বাসকষ্ট তৈরি করা হতো, যা “ওয়াটারবোর্ডিং” নামে পরিচিত। এতে ভুক্তভোগীরা মনে করতেন তারা ডুবে যাচ্ছেন। র্যাব ও ডিজিএফআই ব্যবহৃত ঘূর্ণায়মান চেয়ার দ্রুত ঘোরানোর মাধ্যমে শারীরিক যন্ত্রণার এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছিল। এতে অনেকেই প্রস্রাব বা পায়খানা করে ফেলতেন, কেউ কেউ জ্ঞান হারাতেন।
যৌন নির্যাতন: রাষ্ট্রীয় পরিকল্পিত অপমান
পুরুষদের যৌনাঙ্গ চেপে ধরা, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, প্রস্রাব করাতে বাধ্য করে শক দেওয়া—এসব ছিল গোপন কিন্তু বহুল প্রচলিত নির্যাতনের অংশ। এক ভুক্তভোগী বলেছিলেন, “আমি পাঁচ ফুট উপরে উঠছি মনে হয়েছিল, এমন শক লাগছিল। আমার দুই পায়ের চামড়া ছিঁড়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেটা টেরই পাইনি, কারণ ব্যথার কেন্দ্র ছিল অন্য স্থানে।”
অনেক ভুক্তভোগী আজও তাদের শরীরে ফাটা চামড়া, হাড়ের জোড়া নষ্ট, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস এবং যৌন অঙ্গের বিকলতা নিয়ে জীবনযাপন করছেন। মানসিকভাবে অনেকেই সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছেন। এক পিতা জানিয়েছেন, তার ১৬ বছরের ছেলেটি ২০ মাস ১৩ দিন গুম অবস্থায় থাকার পর ফিরে এসে একাকী হয়ে গেছে, হঠাৎ চিৎকার করে, ফেনা ফেলে, ঘুম থেকে ওঠে এবং ওষুধ খেতে চায় না। তারা বিচার, চিকিৎসা বা আইনগত সহায়তায় এখন অসহায়।
এই ভয়াবহ নিপীড়নের প্রতিটি ঘটনা প্রমাণ করে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন কর্মচারীর কাজ নয়, বরং একটি পরিকল্পিত, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্র অনুমোদিত দমননীতি। গুম সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদন শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকালের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দলিল। এই দলিল আমাদের সামনে রাষ্ট্রের নির্মম ও কুরুচিপূর্ণ চেহারা উন্মোচন করেছে।
গুম আর নিখোঁজ নয়—এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, গুম হয়েছে রাষ্ট্রের পরিকল্পনায়, রাষ্ট্রের যন্ত্র দিয়ে, এবং রাষ্ট্রের মদদে।
তথ্যসূত্র:
১. র্যাব ও ডিজিএফআইয়ের নিষ্ঠুরতা গুম কমিশনের প্রতিবেদনে
– https://tinyurl.com/25bt9cxk