রাজসাক্ষী আব্দুল্লাহ আল-মামুন যা যা বলেছিল আদালতে

জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে সারা দেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছিল সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। গতকাল (১৭ নভেম্বর) বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছিল চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে এ জবানবন্দি দেয় সে।
জবানবন্দিতে সাবেক এই আইজিপি রাজসাক্ষী হওয়ার কারণ হিসেবে জানিয়েছে, ট্রাইব্যুনালে স্বজন হারানো পরিবারের আহাজারি ও আন্দোলনে সংগঠিত নৃশংসতা দেখে আমার রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক ছিলো বলে আমি মনে করি।
লাশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে:
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন জানায়, আন্দোলনে মানুষ মেরেছে, আবার কতগুলো লাশ একত্রিত করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আবার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা দিতে বাধা দেয়া হয়েছে। এসব বীভৎসতা আমাকে ভীষণ ভাবে মর্মাহত করেছে।
গণহত্যার দায় আমি এড়াতে পারি না জানিয়ে সে বলেছে, পুলিশ একটি ট্রিকি চাকরি করে। পুলিশের বিরুদ্ধে সব সময়ই বিভিন্ন অভিযোগ আসে। কিন্তু আমার সাড়ে ৩৬ বছরের পুলিশে চাকরি করার সময় আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসেনি। পুলিশের আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালনের শেষ সময়ে এসে এত বড় গণহত্যার দায় আমি এড়াতে পারি না। এজন্য আমি দেশবাসীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
গোপন বন্দিশালা:
র্যাব-১ এ টিআইএফ নামে গোপন বন্দিশালা ছিল জানিয়ে সে জানায়, র্যাব-১ এ টিআইএফ নামে গোপন বন্দিশালা ছিল। অন্যান্য র্যাবের ইউনিটে ছিল এমন বন্দিশালা। রাজনৈতিক ভিন্নমত ও সরকারের জন্য হুমকি হয়- এমন মানুষদের ধরে আনা হতো এখানে।
সাবেক আইজিপি আরও বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসতো এসব নির্দেশনা। কখনো নির্দেশনা দিতো তারেক সিদ্দিকী। আর আয়নাঘরে আটক ও ক্রসফায়ারে হত্যার মতো কাজগুলো করত র্যাবের এডিসি অপারেশন ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক।
পুলিশে রাজনৈতিক প্রভাব:
জবানবন্দিতে সাবেক এই আইজিপি আরও বলেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পুলিশে রাজনৈতিক প্রভাব আরো বেড়ে যায়। প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন কিছু কিছু কর্মকর্তা। ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
সাবেক আইজিপি আরিও বলেছে, এসব কর্মকর্তা প্রায় রাতেই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় বৈঠক করত। গোপন সেসব বৈঠক গভীর রাত পর্যন্ত চলত। বৈঠকে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা হল- সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবিপ্রধান হারুনুর রশীদ, এসবির মনিরুল ইসলাম, ঢাকার ডিআইজি নুরুল ইসলাম, অ্যাডিশনাল ডিআইজি বিপ্লব কুমার, এএসপি কাফী, ওসি মাজহার, ফোরকান অপূর্বসহ আরো অনেকে। এর মধ্যে কারও কারও সঙ্গে শেখ হাসিনার সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
রাজসাক্ষী মামুন আরো বলেছে, সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের ব্যক্তিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকায় চেইন অব কমান্ড মানত না এসব কর্মকর্তা।
তার দাবি, আমি চাইতাম তারা (পুলিশ কর্মকর্তারা) পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক। মূলত পুলিশ বাহিনীতে গড়ে তোলা দুটি গ্রুপই এসব কর্মকাণ্ড চালাত। এছাড়া দুই গ্রুপের নেতৃত্বদানকারীরা চাইত তাদের নিজস্ব বলয়ের লোকজন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং পাক এবং ঢাকায় থাকুক।
সমন্বয়কদের আটক ও নির্যাতনের বিষয়ে মামুন বলেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে সমন্বয়কদের আটক করে মানসিক নির্যাতন করা হয়। একইসঙ্গে আন্দোলন প্রত্যাহারের বক্তব্য দিতে বাধ্য করা হয়।
উল্লেখ্য, এ বছরের ২৪ মার্চ মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। সে জানায়, স্বেচ্ছায় আসামি থেকে রাজসাক্ষী হয়ে সত্য উন্মোচন করতে চায় সে।
তথ্যসূত্র:
১। রাজসাক্ষী আব্দুল্লাহ আল-মামুন যা যা বলেছিলেন আদালতে
– https://tinyurl.com/2v2sj3u8
Comment