আমি এখানে কাঁদতে আসিনি,
‘মৃত্যুবার্তা’ নিয়ে এসেছি
‘মৃত্যুবার্তা’ নিয়ে এসেছি
এক.
আরাকান। একটি পীড়িত জনপদের নাম।
এখানে লাশের গন্ধে ঘুম ভাঙ্গে ভোরের পাখিদের।
এখানে লাশের মিছিলে প্রভাতের সূর্য উদিত হয়।
এখানে লাশের পাহাড় জমেছে খুনের দরিয়ার উপরে।
এখানে লাশের স্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে এতিম শিশুরা আহত মায়ের বুকে দুধের পরিবর্তে খুনের নহর দেখে।
এখানে বিধবা বোন তাঁর স্বামীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মৃত দেহের সামনে বসে আর্তনাদ করতে থাকে।
এখানে সুন্দর-নির্মল সুখের সংসার নিমিষেই শেষ হয়ে যায় বারুদের গরম শীষায়।
হ্যাঁ, আমি আরাকানের কথাই বলছি। আরাকানের প্রতিদিনের নির্মমতা আমাদের চোখের সামনে। সামান্যতম বিবেক-বোধসম্পন্ন কোনো মুসলমানের পক্ষেই আরাকানের এই পাশবিক নির্মমতা থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখার সুযোগ নেই। পৃথিবীতে এমন নিপীড়িত মুসলিম জনপদ অসংখ্য। আফগান, ইরাক, কাশ্মির, বসনিয়া, চেচনিয়া, ফিলিপাইন সোমালিয়াসহ প্রায় প্রতিটি মুসলিম জনপদে চলছে কাফির ও তাগুতি শক্তির রক্তের হোলি খেলা। আরাকানের নির্মমতা সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে ঠিক। কিন্তু প্রতিটি মুসলিম জনপদের অবস্থা প্রায় এক ও অভিন্ন। উম্মাহর অতন্দ্র প্রহরী মুজাহিদদের দৃষ্টি এড়ায় না বলেই শত বৈরী পরিবেশেও তারা জিহাদের জন্য আমরণ সংগ্রাম করে যাচ্ছে। মুহাম্মদী চেরাগে পুরো পৃথিবীতে আলোকিত করার দৃপ্ত মানসে তারা ছুটে ফিরছে জিহাদের এক ময়দান থেকে অন্য ময়দানে।
দীনে হানিফকে তার প্রকৃত অবস্থার উপর টিকিয়ে রাখার জন্য প্রত্যেক যুগেই এমন এক জামাত বিদ্যমান থাকবে; যাদের ত্যাগ ও কুরবানির রক্তে লেখা থাকে উম্মাহর স্বাধীন ও নিরাপত্তার ফায়সালা। এই ত্যাগী কাফেলার মুজাহিদরা জেল-জুলুম কিংবা উম্মাহর একজন নিপীড়িত সদস্যকে মুক্ত রাখার লক্ষ্যে জীবনবাজি রাখতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। তাদের জীবনের ত্যাগের বিমিনয়ে উম্মাহকে এই পয়গাম দিয়ে যায় যে, হক ও বাতিলের পার্থক্যের সুস্পষ্ট ব্যবধান কী? এমন ত্যাগী কাফেলার কথাই বর্ণনা করা হয়েছে হাদিসে এইভাবে
عن جابربن عبد الله رضي الله تعالى عنه يقول سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول- لا تزال طائفة من أمتى يقاتلون على الحق ظاهرين إلى يوم القيامة قال فينزل عيسى بن مريم عليه السلام فيقول أميرهم تعال صل لنا فيقول لا إن بعضكم على بعض أمراء تكرمة الله هذه الأمة،
হজরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি; আমার উম্মতের একটি জামাত হকের জন্যে যুদ্ধ করতে থাকবে। তারা কেয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী থাকবে। যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম আ. দুনিয়ায় আগমন করবেন; তখন মুসলমানদের আমির তাঁকে ডেকে বলবে যে, আসুন! আমাদের ইমামতি করুন। তখন তিনি বলবেন, না, তোমরাই একে অপরের ইমামতি করো। এই উম্মতকে আল্লাহ তায়ালা সম্মানিত করেছেন। (সহিহ মুসলিম)
অপর হাদিসে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, যখন শামবাসী ধ্বংস হয়ে যাবে; তখন আমার উম্মতের মধ্যে কোনো কল্যাণ থাকবে না। আমার উম্মতের একটি দল তখন হকের জন্য কিতাল করতে থাকবে। তারা বিজয়ী থাকবে। তারা বিরোধীদের কোনো পরোয়া করবে না এবং কোনো পক্ষপাতিত্বেরও পরোয়া করবে না। এমন কি তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুম (কেয়ামত) আসার আগ পর্যন্ত সেই অবস্থায়ই থাকবে। (কানযুল উম্মাল: হাদিস নং : ৮৩২৩৩)
‘বিজয়ী থাকার' উদ্দেশ্য সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম বলেন, একথার মর্মার্থ হলো, যে হকের জন্য বরকতময় এ কাফেলার মুজাহিদিন জিহাদ করতে থাকবে; কিতাল করবে, সেই হক ও ইসলামকে বাঁচিয়ে রাখা হবে। হতে পারে যে, তারা প্রকাশ্য বিজয় অর্জন করবে। কিন্তু প্রকাশ্য বিজয় যদি অর্জন নাও হয় এবং মুজাহিদিনের সবাই যদি শহিদ হয়ে যায়; তবুও তাদেরকে দুশনদের উপর বিজয়ী রাখা হবে। তারা থাকাবস্থায় ইসলামের দুশমনরা কখনো বাতিলকে `হক' বলে প্রমাণিত করতে পারবে না। অন্যান্য দীন ও ধর্মের ব্যাপারে যেভাবে করা হয়েছে। এ কাফেলার সদস্যগণ বাতিলের সামনে সিনা টান করে দাঁড়িয়ে যাবে এবং বাতিলের তুফানকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিবে। এজন্যই ইসলামি ইতিহাসের দিকে তাকালে স্পষ্ট দেখা যায়, এসব ত্যাগী মুজাহিদগণ ইসলামি ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল ঝলমলে নক্ষত্রের মতো চমকাচ্ছে দিক-দিগন্তে। মুজাহিদদের এই পবিত্র আত্মাগুলো ইসলামের জন্য নিজের রক্ত সিঞ্চন করে এই বরকতময় বৃক্ষকে প্রতিপালন করছে। একের পর এক হামলা, অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাক্রমণ, ইসলামের আলোকিত পোশাক পরিহিত মুনাফিকদের মুনাফেকী সত্ত্বেও বিগত দেড় হাজার বছর ধরে পূর্ণিমার চাঁদের মতোই জ্বল জ্বল করছে মুহাম্মদী চেরাগ।
দুই.
আরাকান-কাশ্মিরি ইজ্জত হারানো মা-বোনদের কান্নার আওয়াজ শুনেও যারা বলে, এখনো জিহাদ ফরজ হয়নি। যারা বলে, জিহাদ বলতে বর্তমানে কিছু নেই। তাদের নিয়ে আমরা খুব একটা আশাবাদী না হলেও হতাশ নই। হয়তো তাদের চোখ-কান খুলবে; তখন আমাদের কিছু করার থাকবে না। আলেম হওয়ার পরও যারা শরিয়তের এমন অমোঘ বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে; সত্যি তাদের হতভাগ্য পরিণতির জন্য বড়ো আফসোস হয়! অথচ তাদের সামনেও জিহাদের হুকুমের এই ব্যাখ্যাগুলো সুস্পষ্ট। যা জিহাদ ফরজ হওয়ার কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে-
قال ابن عابدين(۱): (وفرض عين إن هجم العدو على ثغر من ثغور الإسلام فيصير فرض عين على من قرب منه، فأما من وراءهم ببعد من العدو فهو فرض كفاية إذا لم يحتج إليهم، فإن احتيج إليهم بأن عجز من كان بقرب العدو عن المقاومة مع العدو أو لم يعجزوا عنها ولكنهم تكاسلوا ولم يجاهدوا فإنه يفترض على من يليهم فرض عين كالصلاة والصوم لا يسعهم تركه، وثم وثم إلى أن يفترض على جميع أهل الإسلام شرقا وغربا على هذا التدريج)، وبمثل هذا أفتى الكاساني(٢) وابن نجيم(۳) وابن الهمام (٤(
‘যদি শত্রুরা মুসলিমদের সীমানায় আক্রমণ চালায় এমতাবস্থায় জিহাদ করা ফরজে আইন হয়ে যায় তাদের উপর, যারা আক্রান্ত এলাকার নিকটে অবস্থান করেছে। যদি নিকটবর্তীদের সাহায্যের প্রয়োজন না হয়; তাহলে আক্রান্ত এলাকা হতে যারা দূরে অবস্থান করছে তাদের উপর ফরজে কিফায়া হবে। যদি তাদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়; তাহলে নিকটবর্তী যারা আছে, তাদের উপর এটি ফরজে আইন হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে হতে পারে যে, নিকটবর্তী মুসলিমদের প্রচেষ্টায় শত্রুরা প্রতিহত হচ্ছে না অথবা তারা অলসতায় বসে আছে কিংবা জিহাদ করছে না; তাহলে এটি তাদের পার্শবর্তী মুসলিমদের উপর ফরজে আইন হয়ে যাবে। ঠিক যেভাবে তাদের উপর সালাত ও সিয়াম ফরজ। এই হুকুমকে পরিত্যাগ করার কোন সুযোগই থাকবে না। যদি তারাও অক্ষম হয়ে পড়ে। তাহলে এটি ফরজে আইন হবে তাদের নিকটবর্তীদের উপর এবং এই পদ্ধতি অব্যাহত থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত পুরো মুসলিম উম্মাহর উপর ফরজে আইন হয়ে যায়। ইমাম কাসানী, ইবনে নুজাইম, ইবনুল হুমাম-এর পক্ষ থেকেও ঠিক একই ফতোয়া দেওয়া হয়েছে।
ইমাম ইবনে কুদামা রহ. তার লিখিত কিতাব ‘আলমুগনিতে উল্লেখ করেন
فصل : ويتعين الجهاد في ثلاثة مواضع : احدها : إذا التقا الزحفان وتقابل الصفان حرم على من حضر الانصراف وتعين عليه المقام لقول االله تعالى : ] يا أيها الذين آمنوا إذا لقيتم فئة فاثبتوا واذكروا االله كثيرا [ وقوله : ] واصبروا إن االله مع الصابرين [ وقوله تعالى : ] يا أيها الذين آمنوا إذا لقيتم الذين كفروا زحفا فلا تولوهم الأدبار * ومن يولهم يومئذ دبره إلا متحرفا لقتال أو متحيزا إلى فئة فقد باء بغضب من االله [الثاني : إذا نزل الكفار ببلد تعين على أهله قتالهم ودفعهم الثالث: إذا استنفر الامام قوما لزمهم النفير معه لقول االله تعالى : ]يا أيها الذين آمنوا ما لكم إذا قيل لكم انفروا في سبيل االله اثاقلتم إلى الأرض [ الآية والتي بعدها وقال النبي صلى االله عليه و سلم : [ إذا استنفرتم فانفروا [
অর্থাৎ, জিহাদ তিন অবস্থায় ফরজে আইন হয়ে যায়। এক. যদি উভয় পক্ষ যুদ্ধে মিলিত হয় এবং একে অপরের মুখোমুখি হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোনো দলের মুখোমুখী হও; তখন অবিচল থাকো আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর। যাতে তোমরা সফল হও। অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কাফেরদের সাথে মুখোমুখী হবে, তখন পশ্চাদবরণ করবে না। আর যে লোক সেদিন তাদের থেকে পশ্চাদবরণ করবে, অবশ্য যে লড়াইয়ের কৌশল পরিবর্তনকল্পে কিংবা যে নিজ সৈন্যদের নিকট আশ্রয় নিতে আসে সে ব্যতীত, অন্যরা আল্লাহর গজব সাথে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করে। তার ঠিকানা হল জাহান্নাম। বস্তুতঃ সেটা হল নিকৃষ্ট অবস্থান।
২. যদি কাফেররা কোন মুসলিমদের ভূমিতে প্রবেশ করে তখন সেখানকার মুসলিমদের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়।
৩. যদি ইমাম অথবা খলিফা মুসলিমদেরকে যুদ্ধে যাওয়ার আদেশ দেন; তখন তাদের উপর এটি ফরজে আইন হয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছেহে ঈমানদারগণ! তোমাদের কি হল যে, যখন আল্লাহর পথে বের হবার জন্যে তোমাদের বলা হয়, তখন মাটি জড়িয়ে ধর, তোমরা কি আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের উপকরণ অতি অল্প। ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন
وإذا دخل العدو بلاد الإسلام فلا ريب أنه يجب دفعه على الأقرب فالأقرب إذ بلاد الإسلام كلها بمنزلة البلدة الواحدة وأنه يجب النفير إليه بلا إذن والد ولا غريم ونصوص أحمد صريحة بهذا
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যদি কোন শত্রু মুসলিম ভূমিতে প্রবেশ করে তবে ঐ ভূমির নিকটবর্তীদের, তারা অক্ষম হলে তাদের নিকটবর্তীদের উপর তাদেরকে প্রতিহত করা ফরজে আইন হয়ে যায়। কারণ, মুসলিমদের ভূমিসমূহ হল একটি ভূমি সমতুল্য। তাই এক্ষেত্রে জিহাদে বের হওয়ার জন্য পিতা-মাতা অথবা ঋণদাতার কাছ থেকে অনুমতি ব্যতীতই অগ্রসর হওয়া ফরজ। এবং এ ব্যাপারে ইমাম আহমাদ রহ. এর বর্ণনাগুলো আরো স্পষ্ট।
তিন.
আমরা যদি আমাদের প্রাত্যহিক কর্মব্যস্ত জীবন নিয়েই মশগুল থাকি এবং আমাদের আশপাশের চলমান অবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই তাহলে পৃথিবীর বর্তমান অস্থিরতা বদলে যাবে না। আমরা চোখ বন্ধ করে রাখলেও জালিম সম্প্রদায়ের পাশবিক উল্লাস থেমে যাবে না। আমাদের বিরুদ্ধে দেওয়া ‘সন্ত্রাসী’ তকমা মুছে যাবে না, আমাদের বিরুদ্ধে দেওয়া ‘মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ’ শ্লোগান বন্ধ হবে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে যা হচ্ছে, আমাদের বিরুদ্ধে যা হচ্ছে সবই বাড়াবাড়ি। শুধু শুধু সরকার, দুশমনরা আমাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করছে। মনে হবে, এখানে আমরা সবাই নিরাপদে আাছি। এখানে কারো জান-মাল নষ্টের ভয় নেই। এখানো কারো ইজ্জত-আব্রু হারাবার শংকা নেই। এখানে আমেরিকা আসবে না মাতব্বরি করতে। ভারত আসবে না নাক গলাতে। কিংবা ভেবে থাকি যদি, এখানে চীন-রাশিয়াও আসবে না আমাদের উপর বাহাদুরি দেখাতে। বিশ্বাস করুন! যারা এসব ভাবছে, এসব প্রচার-প্রসারের প্রয়াস চালাচ্ছে, তারা চরম নির্বুদ্ধিতায় বাস করছে।
এটা এমন এক গাফলতি; যার শেষ পরিণাম শুধুই ধ্বংস। শুধুই যিল্লতি। ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা অতীতে এমন ধ্বংসময় চিত্র অনেক দেখতে পাই। উদাহরণস্বরূপ খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে একটা মাত্র চিত্র আপনাদের সামনে তুলে ধরছিজ্জ
হিজরী সপ্তম শতাব্দীর বাগদাদ নগরী। খেলাফতে আব্বসিয়ার রাজধানী। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম নগরী তখন এই বাগদাদ। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেনো বাগদাদকে বিমোহিত করে রেখেছিলো। বাগদাদের বাজারের চাণক্য দুনিয়ার মানুষদের চুম্বকার্ষণের মতো টানতো। সেখানে তখন মাদরাসা ছিলো, খানকা ছিলো। মসজিদ ছিলো, দীনি কাজও ছিলো। প্রমোদভবন ছিলো, ছিলো মানুষের ভীড়ও। গোটা ইসলামি বিশ্বের মারকায তখন বাগদাদ। বিশ্বাস করুন! তখনকার বাগদাদ যারা দেখেছে, তারা বলতে বাধ্য হতোজ্জবাগদাদের এমন সৌন্দর্য মলিন হবে না কখনো। বাগদাদের যৌবনে কখনো ভাটা পড়বে না। বাগদাদের প্রতিটি শ্রেনীর মানুষ তখন নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। প্রশাসকরা রাজকার্য ও দুনিয়ার মোহে ব্যস্ত। ইলমপিপাসুরা ইলম অর্জনে মশগুল। ব্যবসায়ীরা বাজারে বন্দী। কিন্তু যখন বিপদ এলো; যখন বিপদ বাগদাদের বাইরে বিপদ ছাউনী ফেলল, তখন....! তখন বাগদাদের প্রশাসন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবার মুখেই হাহাকার ধ্বনি। সবার সামনেই স্পষ্ট হয়ে যায় পতনরেখা। এটা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিলো না। হালাকু খান ও তার সেনাবাহিনীর বাগদাদ ঘেরাও আচানক নেমে আসা কোনো বিপদ নয়। বরং বাগদাদবাসীর বিবেক জাগ্রত করার মতো অনেক সামান মওজুদ ছিলো। বাতিলের ষড়যন্ত্রও তাদের সামনে খেলা করছিলো। পূর্বের ইতিহাস তাদের সামনে স্পষ্ট ছিলো। খাওয়ারিজমদের বর্বরতাও তাদের সইতে হয়েছে। কিন্তু স্বপ্নবাজ ও কল্পনার জগতে বসবাসকারীরা এই চিন্তায় বিভোর ছিলো যে, এটা দারুল খিলাফাত। এটি ইসলামি বিশ্বের মারকায। সুতরাং আমাদের উপর এমন বিপদ আসবে না। এখানে ইলমের পাহাড় বিদ্যমান। এখানে হাজারো মসজিদ বিদ্যমান। এখানে বড় বড় খানকা আছে। কিন্তু তাদের এই স্বপ্ন তো স্বপ্নই রয়ে গেছে। ফলে স্বপ্নের প্রাসাদ ভেঙ্গে পড়ে। তাদের উপর এমন বিপদ নেমে আসে যে, ১২৫৮ সালের শেষ দশকে তাতারীরা বাগদাদে প্রবেশ করে। এমন গণহত্যা চালায় যে, ঐতিহাসিকগণের কলম এ ইতিহাস লিখতে গিয়ে থমকে যায়। চল্লিশ দিন পর্যন্ত শুধু গণহত্যা চলতে থাকে। এ বর্বরতা থেকে নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায়নি। রোগীরাও নিস্তার পায়নি। মসজিদে গিয়েও নিরাপত্তা পাওয়া যায়নি। খানকাতেও কোনো নিরাপত্তার বালাই ছিলো না। শুধু ইহুদি-খ্রিস্টান, শিয়া ও খাওয়ারিজদের ছেড়ে দেওয়া হয়। আর ওজির ইবনে আলকামার ঘরে যারা আশ্রয় নিয়েছিলো তারা নিরাপদ থাকে।
ইবনে কাসির রহ. লিখেন, এই গণহত্যায় নিহত জনসংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। কেউ বলেন, দশ লাখ আবার কেউ বলেন বিশ লাখ নিহত হয়েছে। চল্লিশ দিন পর্যন্ত টানা গণহত্যা চালানো হয়। চল্লিশ দিন পর বাগদাদের অবস্থা এমন হয় যে, সমতল ভূমিতে ঝড় বয়ে যায়। শহর বিরান হয়ে যায়। লাশের স্তুপ হয়ে যায়। বৃষ্টি এসে লাশগুলো আরো বিকৃত করে দেয়। ফলে গোটা শহর দুর্গন্ধময় হয়ে পড়ে। বেঁচে যাওয়া লোকগুলো নানা রোগ-ব্যধিতে আক্রান্ত হয়। বাতাস শাম পর্যন্ত বাগদাদের দুর্গন্ধময় দূষিত বায়ু এই ধ্বংসযজ্ঞের নিদর্শন নিয়ে যায়। সেখানেও মহামারি দেখা দেয়। প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সেখানে বহু লোক মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়ে। এ হলো সেই বাগদাদ; যার শান-শওকত, চাকচিক্য, শোরগোল, সৌন্দর্য ও স্বাতন্ত্র্য সবকিছুই ছিলো। কিন্তু কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এ পতন ছিলো শুধুই যুগের ফেতনা আর আসন্ন বিপদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কারণে। এক্ষেত্রে আমরাও যদি মনে করি, আমরা নিরাপদ। আরাকানী বা কাশ্মিরি ভাই-বোনদের পরিণতি আমাদের ভাগ্যে আসবে না। তাহলে তা হবে বোকার স্বর্গে বসবাস। কোনো নির্বোধ আর বোকার পক্ষেই সম্ভব এমন কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে নিরাপদ মনে করা। এমন নির্বোধদের দলে বসবাস করতে আমি অন্তত রাজি নই। তাই উম্মাহর অতন্দ্র প্রহরী মুজাহিদদের কাছেই আমার এই আকুতি, কালির হরফে লেখা আমার এই বিনম্র নিবেদন।
চার.
ওহে মুসলমান! যারা মিছিলের পদভারে রাজপথ প্রকম্পিত করছো, কথিত দাবি আদায়ের জন্য মিছিলে মিছিলে কাঁপিয়ে তুলছো মানবরচিত বিধানে পরিচালিত সরকারের মসনদ। যারা ভাবছো, জাতিসংঘ মায়ানমারে আসবে উম্মাহর নিপীড়িত কন্যাদের ইজ্জত-আবরু রক্ষা করতে, আমেরিকা আসবে মায়ানমারের সামরিক জান্তাকে শাসাতে, আরাকানী মুসলিম ভাইদের রক্ষা করতে ন্যাটো কিংবা সামরিক জোটশক্তি আসবে মায়ানমারের রক্তপিশাচ সুচির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে। বিশ্বাস করো, তোমাদের এই ধারনা ভুল। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য তারা সবাই একজোট। তারা সবাই আজ ঐকবদ্ধ উম্মাহর বিরুদ্ধে। তারা সবাই *উম্মাহর চোখে ধূলো দেয়ার জন্য মিডিয়ার সামনে মানবতার দোহাইয়ের বুলি ছাড়ছে। তোমাদের এই চিৎকার-চেচামেচি, তোমাদের এই শ্লোগান, রাজপথ গরম করা গলা ফাটানো বক্তৃতা রাজপ্রাসাদের দেয়ালের গায়েও আঘাত করতে সক্ষম নয়। সুতরাং লাভ কি বলো? বলো! তাগুতের কাছে হাত পাতবার কোনো ফায়দা হবে কি? তোমাদের স্মারকলিপি তোমাদের দিকেই ছুড়ে ফেলা হবে আবর্জনার কাগজ ভেবে। আজ আমি তোমাদের কাছে মিছিল করতে আসিনি। আমি তোমাদের সাথে রাজপথ কাঁপাতে আসিনি। আমি তোমাদের মাঝে মিথ্যে বাণী শোনাতে আসিনি। তোমাদের কাছে মায়া কান্না কাঁদতে আসিনি। আমি তোমাদের কাছে ‘মৃত্যু বার্তা নিয়ে এসেছি। বিশ্বাস করুন! এখন সবার উপরই জিহাদ ফরজ। এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। দরবারী আলেমদের ফতোয়াকে ভয় করার কোনো অবকাশ নেই। এখন মুক্তির পথ একটাই জিহাদ, জিহাদ এবং জিহাদ। আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, যেদিন আমার সামর্থ্য হবে বারুদমাখা পাঞ্জাবি পরবার, যেদিন আমি গায়ে তুলে নিতে পারবো নিপীড়িত উম্মাহকে বাঁচিয়ে তুলবার হাতিয়ার। সেদিন আমার হাতে কোন কলম থাকবে না। আমার কোনো লেখা আর তোমাদের মাঝে আলোর মুখ দেখবে না। সেদিন আমার কোনো বক্তৃতা বা প্রবন্ধ তোমাদের সামনে উচ্চারিত হবে না। সেদিন আত্মঘাতির বোমাই হবে আমার হিরন্ময় হাতিয়ার।
Comment