বাংলাদেশ কেন বিশ্বের বুকে গুরুত্বপূর্ণ্ হয়ে উঠছে?
(১)
গুলশান হামলা ও তৎপ্রেক্ষিতে জঙ্গীবাদের উত্থানের কথা ঘটা করে প্রচার করা দ্বারা একটি বিষয় পরিষ্কার তা হলো- সম্রাজ্যবাদীদের বিশেষ নজর পড়েছে বাংলাদেশের দিকে। কিন্তু কেন এবং কি কারণে নজর পড়েছে এই বিষয়টি অনেকেই বুঝতে পারছে না। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ হঠাৎ করে ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠার কারণগুলো এখানে উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
চীনের ‘স্ট্রিং অব পালর্স বা ‘মুক্তার মালা’ :
সম্ভবত আমেরিকার পর নেক্সট সুপার পাওয়ার হচ্ছে চীন। চীন তার সামরিক-বানিজ্যিক সক্ষমতা চতুর্দিক বিস্তৃতি করার জন্য ‘স্ট্রিং অব পালর্স’ নামক সামরিক ও সমুদ্র বন্দর তৈরীর সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষে আফ্রিকা থেকে এশিয়া পর্যন্ত শক্তি বৃদ্ধি বলয় (মুক্তার মালা)করতে চাচ্ছে যা সুদান থেকে শুরু হয়ে, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর হয়ে, মায়ারনমার, থ্যাইল্যান্ড, কোম্বোডিয়া হয়ে চীনে পৌছাবে চীনের স্ট্রিং অব পালর্স বা মুক্তার মালা। অর্থাৎ ভবিষ্যত সম্ভাব্য সুপার পাওয়ার চীনের সম্রাজ্য ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। উল্লেখ্য প্রাথমিকভাবে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর চীনকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও পরবর্তীতে আমেরিকা ও ভারতের চাপে তা প্রত্যাহার করে নেয় আওয়ামী সরকার। যেহেতু চীন হচ্ছে উদীয়মান সুপার পাওয়ার, তাই সে যেকোন উপায়ে চাইবে তার লক্ষ্য পূরণ করতে, যদিও আমেরিকা ভারতের চাপে আপাতত চীন বাংলাদেশে ঘাটি গাড়তে পারছে না কিন্তু তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে তার চাই চাই এবং এ কারণে চীন তার সব ধরনের শক্তি খরচ করবে এটা বলাই বাহুল্য। অর্থাৎ চীনের স্ট্রিং অব পালর্স’ বা ‘মুক্তার মালা’র বাস্তবায়ন বর্তমানে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিকভাবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র করে তুলেছে।
(২)
কিন্তু সেটা বাংলাদেশ সুযোগ না দিলে তৈরী করা সম্ভব নয়। এবার আমরা দেখবো চীনকে সামাল দেওয়ার জন্য বর্তমান পরাশক্তি আমিরকা কি পলিসি নিয়েছে। এশিয়াতে চীনের প্রভাব দ্রুত বিস্তৃতি পেতে থাকায় ২০১২ সালে ওবামা প্রশাসন এশিয়ার জন্য ‘দ্য আমেরিকান পিভট টু এশিয়া’ (Pivot to Asia) পলিসি গ্রহণ করে।
‘দ্য আমেরিকান পিভট টু এশিয়া পলিসি’ সম্পর্কে জানতে দেখুন উইকি-https://goo.gl/633K1V
আমেরিকা কি এশিয়ায় পিভোটিং করছে?
কোন বস্তুর এমন কেন্দ্রকে ‘পিভট’ বলা হয় যাকে কেন্দ্র করে অন্য সকল বিষয় আবর্তিত হয়ে থাকে। যেমন আমাদের এ সৌর জগতের কেন্দ্র হচ্ছে সূর্য, আর অন্য গ্রহগুলো এ সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। মানুষের শরীরের কেন্দ্র হচ্ছে কোমরের ‘পেলভিক’ অঞ্চলের ছোট একটি বিন্দু। শারীরিক কেন্দ্র হচ্ছে এ পিভট পয়েন্ট। শরীরের সকল ব্যালেন্স নির্ভর করে এ পয়েন্টকে কেন্দ্র করে।
এমনিভাবে যে এলাকাকে কেন্দ্র করে প্রাশাসনিক, ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক ও অন্যান্য সকল বিষয় নির্ধারিত হয় তাকে সে অঞ্চলের ‘পিভট’ পয়েন্ট বলে।
ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পৃথিবীর ক্ষমতা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে পরিচালিত হয়ে এসেছে। কখনো সেটা ইউরোপ কখনো এশিয়া। কখনো নিয়ন্ত্রন করেছে মুসলিমরা আর কখনো করেছে খৃষ্টান অথবা কমিউনিষ্টরা। বর্তমানে সার্বিকভাবে ছড়ি ঘোরাচ্ছে ইয়াহুদীরা আমেরিকার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে। এ বিষয় আমরা জানি, তবুও এটা নিয়ে আরেকদিন লেখার ইচ্ছা রয়েছে।
২০১২ সালের ওবামা প্রশাসনের কৌশলগত “পিভট” মধ্য এশিয়া থেকে পূর্ব এশিয়ায় স্থানান্তর বিষয়ে পূর্ব এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ট ক্যাম্পবেল এক সাক্ষাৎকারে এভাবে বলেছিলো যে, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো এই বিষয়গুলি বুঝতে পেরেছে যে, একুশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির এ অঞ্চল থেকেই সমাধা হবে।
তার বক্তব্যে এটা বুঝাতে চেষ্টা করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও এ অঞ্চলে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে আফগানিস্তান এবং ইরাক বিষয়ে চাপের মুখে রয়েছে। এবং এসব দেশ থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার ইতিবাচকভাবে হবে না। আর তাই ‘পিভট’ টি মধ্য এশিয় অঞ্চল থেকে সরিয়ে পূর্ব/দক্ষিণ পূর্ব এশিয় অঞ্চলে স্থানান্তর করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এটা করার জন্য তারা এক প্রকারের মরিয়া।
এ পলিসির স্বাভাবিক সংজ্ঞা হচ্ছে, এশিয়ার শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর (জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতসহ অন্যান্য) সাথে আমিরকার সম্পর্ক আরো দৃঢ় করা এবং এশিয়া অঞ্চলে আরো বেশি মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি ছড়িয়ে দেওয়া। Pivot to Asia পলিসি’র আরো সহজ সংজ্ঞা হচ্ছে- এশিয়াতে চীনকে চর্তুদিক থেকে নিজ দালাল রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা ঘিরে ধরা এবং সামরিকভাবে চাপে রাখা। দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্যেকটি দেশে মার্কিনপন্থী সরকার বসাচ্ছে আমেরিকা। বলতে গেলে প্রায় পুরোটাই দখল করে ফেলেছে বাকি আছে শুধু দুটি দেশ- একটি নেপাল, অন্যটি বাংলাদেশ। এ দুটো এখনও পুরোপুরি মার্কিন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। যেহেতু আমেরিকা চাইছে, এশিয়াতে চর্তুদিক থেকে চীনকে ঘিরে ধরতে, তাই কিছুতেই এখানে কোন রাষ্ট্রকে মার্কিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা চলবে না। আর বাংলাদেশ তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। কেন না চীন চাইছে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র বন্দরকে ব্যবহার করার জন্য। বাংলাদেশ যদি আমেরিকার নিয়্ন্ত্রণের বাইরে থাকে, তবে যে কোন সময় বাংলাদেশ দ্বারা মার্কিন স্বার্থ বিরুদ্ধ কোন কাজ ঘটে যেতে পারে। তাই যে কোন উপায়ে হোক বাংলাদেশকে পুরোপুরি মার্কিন নিয়ন্ত্রণে নিতে হবেই হবে। আর সেই নিয়ন্ত্রণে নিতে বাংলাদেশে হামলা তথা অরাজকতার মাধ্যমে আইএস প্রকারান্তরে আমেরিকারই সহযোগীতা করছে।
(৩)
এবার আমরা দেখবো বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের পলিসি কি বা বাংলাদেশের মাধ্যম দিয়ে ভারত কি করতে চাইছে?
ভারতের Act East Policy:
নরেন্দ্র মোদি এসেই একটি পলিসে গ্রহণ করে যার নাম হচ্ছে ‘Act East Policy’ ।
ভারতের Act East Policy পলিসি সম্পর্কে জানতে দেখুন: (১) https://goo.gl/2lHLRz (২)http://goo.gl/S7IkAI (৩)http://goo.gl/H65gso
আসলে এই পলিসির পেছনে ভারতের যতটুকু স্বার্থ জড়িত, তার থেকে বেশি জড়িত আমেরিকার স্বার্থ। সোজা ভাষায় বলতে আমেরিকার স্বার্থ রক্ষার্থেই এ পলিসি গ্রহণ করেছে ভারত। যেহেতু বর্তমান মোদি সরকার হচ্ছে আমেরিকার অন্যতম চামচা, তাই আমেরিকা ভারতের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে চীনের উর্ধ্বগামী প্রভাবকে সামাল দিতে চাইছে, আর সেই পলিসি বাস্তবায়ন করতেই ভারতের মোদি সরকারের এই Act East Policy গ্রহণ। Act East Policy- এর সাধারণ সংজ্ঞা হচ্ছে পূর্ব এশিয়া তথা মায়ানমার, ক্যাম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ অন্যান্য আশিয়ান রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক দৃঢ় করা। তবে আরো সহজ সংজ্ঞা- আমরিকা চাইছে ভারতের মাধ্যমে পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে এবং এর সহায়তায় দক্ষিণ চীন সাগরে চীনকে সামাল দিতে। তবে Act East Policy যত বিস্তৃত পলিসি হোক না কেন, এই পলিসি কখনই সফল হবে না যদি না বাংলাদেশ ভারতে ট্রানজিট/করিডোর বা বন্দর ব্যবহার করতে না দেয়। কারণ বাংলাদেশ হচ্ছে পূর্ব এশিয়ায় ভারতের মূল ভূখণ্ডের ঢুকতে একমাত্র সহজ রাস্তা, ঠিক যেমনটি গুরুত্বপূর্ণ আফগানিস্তান রাশিয়ার জন্য এবং তুরষ্ক ইউরোপের জন্য। ইতিমধ্যে অবশ্য ভারতের Act East Policy সফল করার জন্য বাংলাদেশ নিবেদিত প্রাণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ বাংলাদেশ এরমধ্যেই ভারতকে নৌ ও সড়ক ট্রানজিট দিয়ে ফেলেছে। একই সাথে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে পায়রা বন্দর নির্মাণ করার অনুমতিও পেয়ে গেছে ভারত। যেহেতু ভারতের Act East Policy মূলত ভারত ও আমেরিকার সম্মিলিত স্বার্থ, তাই এর বাস্তবায়নে আমেরিকা-ভারত সবসময় চাইবে বাংলাদেশকে চাপে রাখতে এবং তাদের পলিসি মোতাবেক চলতে। আর সেই চাপ প্রয়োগের একটি রূপ হচ্ছে কথিত জঙ্গিবাদ এর প্রমাণ করে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং কথিত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে জঙ্গীদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা, এবং ধর্মীয় ব্যাক্তিত্বদেরকে বিশেষত আলিমদেরকে এ কাজে ব্যাবহার করা, যার প্রয়োগ ইতিমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি।
Comment