"চায়নার কসাইখানা"
(চতুর্থ কিস্তি)
‘১৯৯৫ সালের ঐ দিনটাতে আমার বস, চিফ সার্জনের রুমে ডাক পড়ে আমার। কঠিন গলায় অর্ডার দেয় বস, তোথি তুমি এখনই উরুমকির একজিকিউশন গ্রাউন্ডে যাবে। ঐখানে একটা রুমে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া একজন বন্দী থাকবে। তুমি তার শরীর থেকে লিভার এবং দুটো কিডনিই কেটে নিবে’।
এরকম কাজ আমি এর আগে কখনো করিনি। কাজটা করতে মন চাচ্ছিলোনা, কিন্তু বসের নির্দেশ, নাও করতে পারলাম না। গেলাম জল্লাদ খানায়।
হতভাগ্য মুসলিম বন্দীকে ডেথ স্কোয়াডের ওরা গুলি করলো। কিন্তু বন্দী মারা গেলোনা। কেবল জ্ঞান হারালো। উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই বন্দীর বুকের ডান দিকে গুলি করেছে গার্ডরা। যেন সে জ্ঞান হারায়, তৎক্ষণাৎ মারা না যায়। বন্দি পটল তোলার আগে কাজ সেড়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট সময় যেন আমি পাই। ওদের নিষ্ঠুরতায় ভড়কে গেলাম আমি। আমি সার্জন। আমার নার্ভ অনেক শক্ত। তারপরেও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রন থাকছিলোনা। আমি গুলি খাওয়া মুসলিম বন্দীর শরীর থেকে লিভার আর কিডনি কেটে নিচ্ছি আর ওদিকে ওর হার্ট বিটের শব্দ শুনছি! আহ! কী নৃশংসতা! [24]
চীন সরকারের অর্গান হারভেস্টিং করার অভ্যেস বহু পুরোনো। উইঘুর,কাযাখ, মুসলিমদের পাশাপাশি ফালুন গংএর লোকদের কাছ থেকেও অঙ্গ কেটে নিতো তারা। ফালুন গংএর লোকদের ওপরও চীন ভয়ংকর নির্যাতন চালিয়েছে। একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
হাতেগোনা কয়েকজন লোক ছাড়া ফালুন গঙ্গের আর কোনো মানুষ দুনিয়াতে নেই। কেমন ছিলো তাদের ওপর চীন সরকারের চালানো অত্যাচার? এক বন্দী জানাচ্ছে- ওরা তার পায়ুপথে টয়লেট ব্রাশ ঢুকিয়ে দিয়েছিলো, সে টয়লেট করতে পারতোনা, তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হতো সূচ দিয়ে গায়ের চামড়া ফুটো করে অথবা বরফ শীতল পানি গায়ে ঢেলে দিয়ে। নারীদের অচেনা ঔষুধ খেতে বাধ্য করা হতো, এতে তাদের মাসিক বন্ধ হয়ে যেতো, অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগল হয়ে যেতো। ধর্ষণ ছিল ডালভাতের মতোই নিত্তনৈমত্তিক ব্যাপার। ইন লিপিং নামের এক সাবেক বন্দিনী জানাচ্ছে- তাকে একটা সেইলে ৪০ জন মিলে ধর্ষণ করে’।
আমাদের গল্প শুরু হয়েছিল এক সার্জনকে নিয়ে। ঐ যে! মাঝরাতে স্ত্রীকে ডেকে তুলে সবকিছু বলতে চেয়েছিলো যে। এই ডাক্তারের স্ত্রী চীন সরকারের অ্যাকাউন্টিং ডিপার্টমেন্ট এ কাজ করতো। স্বামীর এলোমেলো রুটিন দেখে বেশ কিছুদিন ধরেই তার মনে একটা সন্দেহ দানা বাজছিলো- এতোদিনের এতো চেনা মানুষটা হুট করে অন্যরকম হয়ে গেছে। অচেনা মানুষে পরিণত হয়েছে। রাত বিরাতে হাসপাতাল থেকে ফোন আসে, ফোন পাবার সাথে সাথেই ছুটে যায়, আগের চাইতে অনেক অনেক বেশি টাকা বেতন পাচ্ছে, আবার মানসিকভাবেও কেমন জানি ভেঙে পড়েছে। সবসময় কেমন চঞ্চল, কেমন অস্থির আচরণ করছে, কিছু একটা লুকোচ্ছে যেনো আর সবার কাছ থেকে। সার্জন তার স্ত্রীকে ডেকে তুলে নিয়ে বলা শুরু করলো- আমাদের হাসপাতালের মাটির নিচে গোপন কিছু সেল আছে। আন্ডার গ্রাউন্ডের এই সেলগুলোতে ফালুন গঙের লোকদের লুকিয়ে রাখা হয়েছে। প্রায়ই এদের গোপন আন্ডারগ্রাউন সেইল থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়। কিডনি, চোখ, লিভার, স্কিন, টিস্যু ইত্যাদি কেটে নেয়া হয়। অপারেশন শেষে কেউ কেউ বেঁচে থাকে, আবার অনেকেই মারা যায়। পকেট থেকে টাকাপয়সা, আংটি, চেইন, ঘড়ি ইত্যাদি রেখে দেয় হাসপাতালের স্টাফরা। তারপর জীবিত বা মৃত দুই গ্রুপের লোকদেরই চালান করে দেয়া হয় চুল্লিতে পোড়ানোর জন্য। পুড়িয়ে একেবারে ছাই করে ফেলা হয়। কোনো চিহ্ন থাকেনা। না, কাগজে কলমেও কোনো হিসেব রাখা হয়না! [25]
ঠিক একই কায়দায়, সমান নিষ্ঠুরতার সাথে উইঘুর,কাযাখ মুসলিমদের জবাই করে চলেছে হান চাইনিজ কসাইরা। হিউম্যান রাইটস ইনভেস্টিগেটর, The Slaughter: Mass Killings, Organ Harvesting, and China’s Secret Solution to its Dissident Problem বইয়ের লেখক ইথান গাটমান অনেক তথ্য প্রমাণ হাজির করেছেন জল্লাদ চায়নার বিরুদ্ধে। উইঘুরদের দেহ থেকে অর্গান কেটে নেয়ার কাজে জড়িত ডাক্তার, পুলিস অনেক লোকের সাথেই কথা বলেছে গাটমান। টুকরো টুকরো তথ্য জুড়ে দিতেই অর্গান হারভেস্টের পুরো চিত্রটা স্পষ্ট হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্যকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে এসে পুরো প্রসেসটা বলা যাক।
ধরুন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির এক সদস্য হাসপাতালে ভর্তি হলো। স্টাফদের কাছে খবর চলে গেলো অমুক ইউনিটে পার্টির তমুক সদস্য নানাবিধ শারীরিক সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছে। অঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে হবে। বন্দী উইঘুরদের রক্ত পরীক্ষা করা হলো আবার। যার সাথে পার্টি সদস্যের রক্তের গ্রুপ ম্যাচ হলো এবার করা হলো তার টিস্যু ম্যাচিং। টিস্যু মিলে না গেলে সৌভাগ্যবান উইঘুর লোকটা আরো কয়েকদিন ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার সুযোগ পাবে। আর ম্যাচ হলে স্পেশাল প্রিজন ভ্যানে করে পুলিস, ডাক্তারসহ তাকে পাঠিয়ে দেয়া হবে বীভৎস এক মৃত্যুর দিকে। জল্লাদখানায় পৌছানোর পর বুকের ডান পাশে গুলি করা হয় যেনো তৎক্ষণাৎ মারা না গিয়ে ধীরে ধীরে মরে বন্দী। ডাক্তারেরা এই সময় যা যা অর্গান দরকার তা কেটে নেয়! চেতনানাশক বা ব্যাথানাশক কোনো কিছু ব্যবহারের কোনো বালাই নেই! তারপর অর্গান বসিয়ে দেয়া হয় সেই পার্টি সদস্যের শরীরে। মনের আনন্দে শিষ দিতে দিতে বিদায় নেয় সে। উইঘুর, কাযাখ বন্দীর মৃতদেহ সিমেন্টে মুড়িয়ে খুবই গোপনীয়তার সাথে মাটি চাপা দেয়া হয়। [26]
জীবন্ত উইঘুর, কাযাখ মুসলিমদের তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে এভাবে অর্গান কেটে নিচ্ছে চাইনিজরা। আর কতো নীচে নামবে ওরা!
আবারো ফিরে যাই এনভার তোথির কাছে। তোথির ভাষ্যমতে জীবন্ত মানুষের শরীর থেকে অর্গান হারভেস্টিং এর বিশাল এক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলেছে চীন সরকার। গাদি গাদি টাকা কামাচ্ছে সরকার এ থেকে। উরুমকি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের একটা বিশেষ প্যাসেজের ছবি তুলেছেন তোথি। প্যাসেজটার নাম Human Organ Transportation Green-Path (HOTGP)। এই প্যাসেজ দিয়ে চীন থেকে মানবঅঙ্গ অন্য দেশগুলোতে রফতানি করা হয়! চিন্তা করুন, কতো বিপুল পরিমাণ অঙ্গ বিদেশে রফতানি হলে তার জন্য আলাদা প্যাসেজের ব্যবস্থা করতে হয়! তোথির গ্রীন প্যাথ প্যাসেজের ছবি তোলার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই China Southern Airline এর মাধ্যমে পাঁচশোরো বেশি অর্গান বিদেশে রফতানি হয়েছে।
হৃদয় ভেঙে দেয়া আরো তথ্য দিচ্ছেন এনভার তোথি। সৌদি আরবের নাগরিকদের মধ্যে ‘হালাল’ অর্গানের (এরকম হালাল বলে আসলে কিছু ইসলামে নেই) অনেক চাহিদা। তাই তারা বেছে নিয়েছে পূর্ব তুর্কিস্থানের উইঘুর মুসলিমদের! কারণ এরা মদ গাজা কিছু খায়না, নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করে। উরুমকিতে এসে তাই সৌদির নাগরিকেরা অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাচ্ছে! [27]
তোথির এই দাবীকে শক্তিশালী করছেন Saudi Centre for Organ Transplants এর ডিরেক্টর ডাঃ ফাইসাল শাহীন। ২০১৪ সালে আরাবিয়ান বিজনেসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ভদ্রলোক জানাচ্ছেন যে ৭০০০ সৌদি পেশেন্টের কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা দরকার, আরো অর্গানের কথা নাহয় বাদই দিলাম। ব্যাপক ঘাটতি অর্গানের। আমি ৪১০ জন সৌদি নাগরিকদের চিনি যারা ২০১২-২০১৪ সালের ব্যবধানে চীন, পাকিস্তান এবং মিশরের ব্ল্যাক মার্কেট থেকে অর্গান কিনেছে। [28]
এই হলো উম্মাহর অবস্থা! এই হলো মুসলিম ভাতৃত্ববোধ! এই হলো সৌদির অবস্থা! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে কোন মুখে কাউসারের তীরে দেখা করতে যাবো আমরা?
অর্গান হারভেস্টিং এর সাথে জড়িত একজন পুলিস সদস্য স্বগোক্তির মতো করে ইথান গাটমান কে বলেছিলো- আমরা বোধহয় সবাই নরকে যাবো’।
ওরা সবাই নরকে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই!
কিন্তু উইঘুর কাযাখ মুসলিম ভাই-বোনদের ওপর এতো নিষ্ঠুর নির্যাতনের পরেও আমরা উদাসীন বসে আছি আমাদের ঠিকানা কোথায় হবে?
চলবে ইনশা আল্লাহ …
আগের কিস্তিগুলো পড়ুন
(প্রথম / দ্বিতীয়) https://www.dawahilallah.com/showthr...B%26%232494%3B
(তৃতীয় কিস্তি) https://www.dawahilallah.com/showthr...%26%232463%3B)
রেফারেন্সঃ
[24] Muslims Are Being “Slaughtered on Demand” For Their Organs in China- https://tinyurl.com/shzzwgd
[25] Independent Tribunal into Forced Organ Harvesting from Prisoners of Conscience in China – Final Judgement and Summary Report, 17 June 2019, p222
[26] Independent T ribunal into Forced Organ Harvesting from Prisoners of Conscience in China – Final Judgement and Summary Report, 17 June 2019 Ibid., p26
[27] Dr. Enver Tohti: Chinese regime harvesting organs from Uighur detainees in the concentration camps- https://tinyurl.com/vd74bjp
[28] 410 Saudis said to buy organs on black market -https://tinyurl.com/rl73pah
Comment