Announcement

Collapse
No announcement yet.

উইঘুর মুসলিম এক বোনের হৃদয় বিদায়ক কাহিনী

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • উইঘুর মুসলিম এক বোনের হৃদয় বিদায়ক কাহিনী

    সেইল_নম্বর_২১০

    (প্রথম কিস্তি)


    বাসার সামনের সবুজ লনে ছোটাছুটি করছিলো ওরা দুই ভাই বোন [১]। মনে হচ্ছে যেন ছড়ানো ছিটানো মুক্তো।

    ‘বাচ্চারা এদিকে আসো’ আদুরে গলায় ভাইবোনকে ডাকলেন মিহিরগুল তারসুন। ওদের মা।
    এক দৌড়ে মায়ের কাছে এলো ওরা। মিহিরগুলের হাতে পরিচিত সেই ছবিটা দেখতে পেয়ে নিষ্পাপ পবিত্র সরল হাসিতে ভরে গেলো ওদের দুজনের মুখ।

    ছবিটা ২০১৫ সালের। বাচ্চাদের জন্মের ঠিক পরপরই তোলা।
    ‘এটা আমি’ নিজের ল্যাদাগ্যাদা ছবির দিকে তাকিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো তিন বছরের ময়েজ। হাসির চোটে আগেই ফোকলা দাঁত বের হয়ে গিয়েছে।
    ‘আর এটা আমি, এলিনা’ মাথার দুইপাশে শিঙ্গের মতো ঝুঁটি বাঁধা ময়েজের জমজ বোন এলিনা খুশিতে হাততালি দিলো।
    ‘ছবির তৃতীয় বাচ্চাটা কে’?

    বাচ্চাদের কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হলো। মায়ের হাত ধরে ঝুলে পড়লো ময়েজ। ‘মা বলো, আমাদের পাশের এই বাচ্চাটা কে?

    ওদের মা মিহিরগুল চুপ করে থাকেন। দীর্ঘশ্বাস চেপে শান্ত করলেন বাচ্চাদের, ‘ বড় হও, সোনা, বড় হও। তারপর তোমাদের বলবো, ও কে’!

    ২৯ বছরের মিহিরগুল তারসুন, ময়েজ আর এলিনার কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছেন ছবির এই তৃতীয় শিশুটির পরিচয়, এখন সে কোথায় … কিন্তু ইউ এস কনগ্রেসের হিয়ারিং রুমে সবাইকে কাঁদিয়েছেন হারিয়ে যাওয়া সন্তানের কাহিনী শুনিয়ে…। [২]

    আমার নাম মিহিরগুল তারসুন। বয়স ২৯। উইঘুর। ছেরছনে (Cherchen ) আমার জন্ম। চায়নার পশ্চিমাঞ্চলে উইঘুরদের আবাসভূমি যার অফিশিয়াল নাম পূর্ব তুর্কিস্থান উইঘুর অটোনোমোস রিজন’ এর একটা শহর ছেরছেন। অনেকে একে কারকানও বলে থাকে। ১২ বছর বয়সে আমাকে গুয়াংঝৌতে (Guangzhou) পাঠিয়ে দেয়া হলো আমাকে হাইস্কুলে পড়াশোনা করার জন্য। চীন সরকার একটা প্রকল্প নিয়েছিলো- ‘পূর্ব তুর্কিস্থান ক্লাসরুম পলিসি’, উইঘুর বাচ্চাদের চায়না প্রপারের স্কুল গুলোতে পড়ানোর। এই প্রকল্পের খপ্পড়ে পড়েই অল্প বয়সে বাবা মা ভাইবোন ছেড়ে আমাকে দূরে চলে আসতে হলো। শুধু আমি একা না, আমার মতো হাজার হাজার উইঘুর ছেলেমেয়েদের বাবা মার আদর থেকে বঞ্চিত হয়ে চায়না প্রপারের হান চাইনিজ দ্বারা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়তে হতো।

    আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, জীবন যাপনের পদ্ধতি সবকিছু হানদের চেয়ে আলাদা। কিন্তু কী করার, আমাদেরকে বাধ্য করা হতো হানদের স্কুলে পড়তে। আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, আমাদের ইসলাম সব ছুড়ে ফেলে গ্রহণ করে নিতে হতো হান চাইনিজদের সংস্কৃতি। ওদের মতো করে চলতে হতো,খেতে হতো, কথা বলতে হতো। সরকার চাইতো আমরা যেন আমাদের নিজেস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম ভুলে যাই চিরতরে। নিজেদের সব ভুলে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় হানদের সাথে।

    আমার ক্ষেত্রে হলো উলটোটা। ওরা যতোবেশী আমাদেরকে হানদের কার্বন কপি বানাতে চাইতো, আমি ততোবেশি করে অনুভব করতাম আমরা কখনোই হানদের মতো না, আমরা ওদের চাইতে আলাদা। নিজের পরিচয়কে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরতাম। কেবলমাত্র উইঘুর হবার কারণে পদে পদে বৈষম্য , ব্যাঙ্গ বিদ্রূপের শিকার হতাম। সমস্ত অণু পরমাণুতে গেঁথে যেতো - আমরা ওদের মতো না, আমরা আলাদা, আমরা আলাদা, আলাদা!

    স্কুল শেষে গেলাম গুয়াংঝৌ ইউনিভার্সিটিতে। ইকোনোমিকস নিয়ে পড়তে। সেটাও শেষ করলাম। তারপর কাজ নিলাম একটা প্রাইভেট ফার্মে। ওরা আরবদের সাথে ব্যবসা করতো। আজন্ম সাধ ছিলো দেশের বাইরে কোথাও ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা করার। মিশরে, ব্রিটিশ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পাবার পর তাই আর দু’বার ভাবলাম না। ২০১১, ডিসেম্বরের ১০ তারিখে উড়াল দিলাম মিশরের উদ্দেশ্যে। তখনো জানতাম না, মিশরেই অপেক্ষা করে আছে আমার স্বপ্নের পুরুষ!

    ২০১৫ সালের মার্চে মা হলাম আমি। দুটো ছেলে আর একটা মেয়ে! একই সংগে তিনতিনটা বাচ্চা হলো আমার! ট্রিপলেট বাচ্চা! জন্মসূত্রেই মিশরের নাগরিকত্ব পেয়ে গেলো ওরা। একা হাতে পড়াশোনা, স্বামী সংসার, তিন তিনটা বাচ্চা সামলাতে গিয়ে আমার প্রাণ যায়যায় অবস্থা! বাচ্চাদের ঝামেলায় ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে ভাবলাম বাড়ি যাই। বাবা মার সাহায্য নেই। একদিন বাড়ি যাবার বিমানে উঠলাম। ভুলটা করলাম এখানেই। চীনের মাটিতে পা দেবার সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেলো ঝামেলা।
    মহা ঝামেলা!

    উরুমকি এয়ারপোর্টে বিমান ল্যান্ড করার পরপরই আমাকে ঘিরে ফেললো বর্ডার পেট্রল গার্ডের সদস্যরা। দুই-তিন মাস বয়সী বাচ্চাদের ছিনিয়ে নিলো আমার কাছ থেকে। তারপর আমাকে নিয়ে গেলো ইন্টারোগেশন রুমে।ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে চললো কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ। পুলিস বারবার জিজ্ঞাসা করলো- মিশরে কার কার সাথে দেখা করেছেন আপনি? কী নিয়ে কথা বলেছেন ওদের সাথে’। জবাব শুনে হয়তো মন ভরলোনা ওদের। হাতপা পিছেমোড়া করে বাঁধল আমার, তারপর কালো কাপড়ে ঢেকে দিলো আমার মুখ, মাথা, চোখ। আমার সোনামানিক কলিজাদের সঙ্গে আমার আর দেখা হলোনা। আমার বুক থেকে বাচ্চাদের কোথায় কেড়ে নিয়ে গেলো পুলিশ!

    তিনমাস পরে চীন কর্তৃপক্ষ আমাকে ডেকে নিয়ে বললো- তোমাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তোমার বাচ্চারা অসুস্থ। যতোদিন না ওরা সুস্থ হয় ততোদিন তোমার জামিন। সাবধান পালানোর চেষ্টা করবেনা, তোমার ওপর আমাদের ২৪ ঘন্টা নজরদারি থাকবে’!
    পাসপোর্ট, আইডেন্টিন্টি কার্ড, সেলফোন কিছুই ফেরত দিলোনা ওরা আমাকে।

    সব হারানোর বেদনা নিয়ে ছুটে গেলাম হাসপাতালে। আমার বড়ছেলে আইসিইউ তে ভর্তি। গ্লাসডোরের এ পাশ থেকে দেখলাম আমার সোনামানিক নল, তার, যন্ত্রপাতির জঞ্জালে শুয়ে আছে। নিথর। এতোদিন পর দেখলাম ওকে, একটু ছুঁয়ে দেখার সুযোগও পেলাম না। ডাক্তাররা সেদিনের মতো বাড়ি পাঠিয়ে দিলো আমাকে। বললো আগামীকাল আবার আসবেন, এখন বাসায় যান, বিশ্রাম নিন।

    পরদিন আবার হাসপাতালে গেলাম। এবার ছেলেকে কোলে নিতে দিলো ডাক্তাররা। তিন মাস পর ছেলেকে কোলে নিলাম প্রথমবারের মতো। আইসিইউতে থাকতে হবেনা ওকে আর। ধীর পায়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে বের হয়ে আসলাম আমি। বাড়ি যেতে হবে দ্রুত, বাবা মাকে জানাতে হবে। সামনে অনেক কাজ।
    কবর দিতে হবে আমার ছেলেকে…

    ছেলের কবরে ঝুপ ঝুপ করে মাটি ফেলছিলো লোকজন, আর ধীরে ধীরে একটু একটু করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলো ও আমার চোখের সামনে। বাঁচাতে পারলাম না আমি আমার ছেলেকে- এই অপরাধবোধ, এই শোক কীভাবে বয়ে বেড়াবো সারাজীবন?
    বাচ্চারা কিছু খেতে চাইতোনা। গলায় টিউব দিয়ে ওদের খাওয়ানো হতো। আমার কাছে যখন ছিলো তখন এমন কোনো সমস্যাই ছিলোনা। বড় ছেলে তো মারাই গেলো, বাকী দুজনও এই তিনমাসে অনেক অসুখ বাঁধিয়ে ফেলেছে। পরের কয়েকটা মাস কাটলো ওদের নিয়ে ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি করে। আমার মেয়েটার চোখে অপারেশন পর্যন্ত করা লাগলো। এখনো ওদের নিয়ে মাঝে মাঝেই হাসপাতালে যেতে হয়। কোন না কোন অসুখ লেগেই আছে ওদের।

    বাচ্চাদের নিয়ে যে মিশরে ফেরত যাবো তার কোনো উপায় ছিলোনা। আগেই বলেছি আমার সব কাগজপত্র, প্রশাসন জব্দ করে রেখেছে। আইডি কার্ড ফেরত পেলাম, কিন্তু কার্ডে একটা কালো দাগ পড়ে গেলো। যেখানেই যাই হাসপাতাল, ফার্মেসি এমনকি বাস, সবজায়গার সিকিউরিটি সিস্টেমে কার্ড আটকে যেতো। পুলিস আসতো, সব কিছু চেক করে তারপর আমাকে যেতে দিতো।
    প্রত্যেকটা ধাপ ফেলার আগে পুলিশের ক্লিয়ারেন্স লাগতো।

    ২০১৭ এর এপ্রিলে পুলিশের হঠাৎ করে মনে হলো, আরে মিহিরগুল তারসুন মিশরে কী করছিলো তার সদুত্তর তো আমরা পাইনি। যাও তুলে নিয়ে এসো ওকে আবার। বাবার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেলো ওরা আমাকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে।
    চারদিন চাররাত ধরে একই প্রশ্ন করে গেলো ওরা- মিশরে আমি কী করছিলাম। এই পুরোটা সময় এক ফোটা ঘুমুতে দিলোনা আমাকে। সমানে চললো মারধোর, মাথা কামিয়ে দিলো। তিনমাস বন্দী করে রাখলো তারপর তুলে দিল মানসিক হাসপাতালের ডাক্তারদের হাতে। এই তিনমাসের বন্দী জীবনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। মূর্ছা যেতাম একটু পর পর। বাবা চেষ্টা তদবির করে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে গেলো আমাকে। নিজেদের মতো করে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করালো। আমি স্বাভাবিক হলাম আবার!

    ২০১৮ এর জানুয়ারীতে আবার পুলিশের মনে পড়লো আমার কথা। সেই চিরচেনা পুরোনো কায়দায় হাতে পায়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে, কালো কাপড়ে মাথা, মুখ চোখ বেঁধে নিয়ে গেলো ওরা আমাকে। এবার হাসপাতালে। জামাকাপড় সব ছিড়ে ফেললো আমার। একেবারে নগ্ন করে দাঁড় করিয়ে দিলো ভয়াল দর্শন কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত এক মেশিনের নিচে। দুজন পুরুষ এবং একজন মহিলা ডাক্তার আমার শরীরের সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলো। আমি তখনো নগ্ন। পরীক্ষা শেষে নীল রঙের ইউনিফর্ম পরিয়ে দেওয়া হলো আমাকে। ইউনিফর্মের ওপর ছাপ্পড় মারা- ৫৪!

    একজন অফিসার চাপা স্বরে মনে করিয়ে দিলো আমাকে- এই পোষাক, শুধু ভয়ংকর অপরাধীদের দেয়া হয়। যাদের সামনে পথ কেবল দুটো- ফাঁসির দড়িতে ঝুলে মৃত্যু অথবা কারাগারের অন্ধকারে তিলে তিলে পচে মরা। ইউনিফর্মে এই যে ‘৫৪’ লেখা, এর অর্থ কী জানো? এর মানে হলো- ‘আমি মৃত’

    চলবে ইনশা আল্লাহ…


    রেফারেন্সঃ
    [১] Uyghur refugee tells of death and fear inside China's Xinjiang camps- https://tinyurl.com/y7meatfx
    [২] মিহিরগুল তারসুনের পুরো অভিজ্ঞতার কথা শুনুন এবং দেখুন এই ভিডিওতে- Video: In Full – Ex-Xinjiang detainee Mihrigul Tursun’s full testimony at the US congress

  • #2
    আহ!! এত কষ্ট... আর কতকাল এভাবে চলবে?! কবে আসবে মুক্তির সময়?! কবে ওই পশগুলোকে টুকরো টুকরো করা যাবে?!! হে আল্লাহ তুমি আমাদের সাহায্য করো!

    Comment


    • #3
      আহ!!! আর কতো কাল এভাবে মুসলিম মা-বোনদের আত্মচিৎকার শুনে *যেতে হবে? আমরা কি মুহাম্মাদ বিন কাসিম এবং খলীফা মু`তাসিম বিল্লাহ হয়ে তাঁদের উদ্ধারে আমাদের জীবনগুলো সপে দিতে পারি না?

      Comment


      • #4
        নির্বাক।... বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আল্লাহ! সাহায্য করো।
        হে মু'মিনগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হও।

        Comment


        • #5
          ইয়া রব্ব! আপনি আমাদের অক্ষমতা ও কাপুরুষতাকে ক্ষমা করে দিন। আমীন
          “ধৈর্যশীল সতর্ক ব্যক্তিরাই লড়াইয়ের জন্য উপযুক্ত।”-শাইখ উসামা বিন লাদেন রহ.

          Comment


          • #6
            ইননালিল্লাহ, এত কষ্ট। চোখে পানি চলে আসলো।
            " শহিদের মিছিলে নাম লিখাতে চলো মুসলিম ভাই "

            Comment


            • #7
              আহঃ বক্ষভেদ করে কলিজাই লাগছে!!
              আল্লাহ্ ইয়া রব্ব আমাদেরকে ক্ষমা করুন,,
              আর সয্য হয়না....
              কি যে ব্যাথা..
              অন্তর ফেটে যাচ্ছে..

              Comment

              Working...
              X