সেইল_নম্বর_২১০
(দ্বিতীয় কিস্তি)
ভয়ে হাত পা জমে গেলো আমার। কপালে তাহলে এটাই ছিলো। ক্যাম্পে পচে মরা। বাইরের আলো বাতাস আর কখনো কী আমি দেখতে পাবো? এলিনা আর ময়েজকে কী আরেকবার বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুতে পারবো?
টানা তিনদিন তিনরাত ধরে চললো জিজ্ঞাসাবাদ। আমি কেন মিশর গিয়েছিলাম, আমি কাকে কাকে চিনি, আমি কোন অর্গানাইজেশনের হয়ে কাজ করি… সেই গৎবাঁধা প্রশ্ন। আমি মিশরে ছিলাম, দুই একটা বিদেশী ভাষা জানি, তাই চীন সরকার আমাকে গুপ্তচর হিসেবে ফাঁসানোর ধান্দা করছে। প্রচন্ড মারলো ওরা আমাকে। পুডিং এর মতো ছোপ ছোপ রক্তে ভরে গেলো ঘরে মেঝে। দুইবার অজানা অষুধ খেতে দিলো আমাকে পুলিশ। মুখে একেবারে আঙ্গুল ঢুকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলো আমি আসলেই ট্যাবলেট খেয়েছি। ট্যাবলেটগুলো খাবার পর মাথা কেমন জানি এলোমেলো হয়ে গেলো। শরীর পুরো ছেড়ে দিলো, রাজ্যের ঘুম নামলো দুচোখে!
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল আন্ডারগ্রাউন্ড এক সেলে। কোনো জানালা নেই সেলের। প্রবেশপথ ভারী মোটা লোহার দরজা দিয়ে আটকানো। কম্পিউটারে পাসওয়ার্ড দিলেই কেবল এই দরজা খোলা সম্ভব। সিলিং এ জায়গায় জায়গায় ছিদ্র করা, বাতাস প্রবেশের একমাত্র পথ এগুলো। রুমে কোন টয়লেট, কমোড কিছুই নেই। এক কোণায় একটা বালতি রাখা, ব্যস। টয়লেট টিস্যু বা পানির কোনো চিহ্ন নেই আশেপাশে। কোনো আড়ালও নেই। পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। এই সেলে এমন মানুষও আছে যারা ১ বছর ধরে গোসল করতে পারেনি। রুমের ভেতরে চারটা সিসিক্যামেরা লাগানো। রুমের প্রত্যেকটা নড়াচড়া, এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার দৃশ্যও ক্যামেরায় ধরা পড়ে। পুরো রুমে কেবল একটা লাইট। এ লাইট কখনো বন্ধ হয়না।
প্রথম রাতের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা এখনো তাড়া করে বেড়ায় আমাকে। আমার হাত এবং পায়ে শেকল বাঁধা। কোনোমতে শুয়ে আছি আরো অনেক অসহায় মেয়েদের সাথে। লম্বা একটা শেকল দিয়ে আমাদের প্রত্যেককে প্রত্যেকের সাথে বেঁধে রেখেছে ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ!
আমার দোষটা আসলে কী? কোনো অভিযোগ ছাড়া কেন আমাকে এভাবে বন্দী করে রেখেছে ওরা? কী অপরাধ আমি করেছি যার কারণে এতোটা অমানবিক, এতোটা নির্দয় ব্যবহার করা হচ্ছে আমার সাথে? প্রাইভেসি বজায় রেখে টয়লেট করার অধিকারও আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। ওরা কেনো আমাকে গোসল করার পানি দিচ্ছেনা? ওরা কেনো আমাকে পেটপুরে খেতে পর্যন্ত দিচ্ছেনা? আমার অপরাধটা কী? আমার সাথের এই মানুষগুলোর অপরাধ কী? কেন আমাদের সাথে পশুর মতো আচরণ করা হচ্ছে?
ভোর পাঁচটায় তারস্বরে অ্যালার্ম বাজতো। সঙ্গে সঙ্গে উঠে কম্বল ভাজ করতে হতো আমাদের। কারো কম্বল ভাজ করা গার্ডদের পছন্দ না হলে শাস্তি দেওয়া হতো পুরো সেলের সবাইকে। সবকটা কম্বল নিয়ে যেতো, আমাদের বাধ্য করতো সিমেন্টের মেঝেতে ঘুমুতে।
সকালের নাস্তায় জুটতো সামান্য একটু ভাত আর দুঢোক পানি। ব্যাস, এই! এই খাবারটুকু পর্যন্ত পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসা করে সবাই মিলে গান গাওয়ার আগে স্পর্শ করতে পারতাম না। । চাইনিজে স্লোগান দিতে হতো আমাদের- দীর্ঘজীবী হোক প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ! যারা অনুতপ্ত হয়েছে তাদের জন্য দয়া আর বিরোধিতাকারীদের জন্য কঠোর শাস্তি!
ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ মনে হয় ভাবলো আমার শাস্তি কম হয়ে যাচ্ছে। স্পেশাল ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করলো তাই আমার জন্য। ইলেক্ট্রিক চেয়ারে (ক্যাম্পে এটাকে টাইগার চেয়ার বলা হয়) বসানোর জন্য টর্চার রুমে নিয়ে গেলো একদিন। পুরো রুমে আসবাব পত্র বলতে একটা চেয়ার। মাথার ওপর ঝুলছে একটা শেডওয়ালা লাইট। দেয়ালে থরে থরে সাজানো চামড়ার বেল্ট, চাবুক। আমাকে চেয়ারে বসানো হলো। তারপর একটা সুইচ চাপলো একজন অফিসার। ক্লিক করে একটা শব্দ হবার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতগতিতে হাত পা শক্ত ভাবে আটকে গেলো চেয়ারের সাথে। একজন এসে হেলমেটের মতো কিছু একটা গলিয়ে দিলো আমার মাথায়। তারপর শুরু হলো ইলেকট্রিক শক। প্রত্যেকবার ওরা সুইচ চাপছিল আর আমার পুরো শরীর তীক্ষ্ণ ব্যাথায় নীল হয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমার প্রত্যেকটা অণু পরমানুতে বিষাক্ত সূচ ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ।
এই কষ্ট সহ্য করার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক সহজ। ওদের কাছে কাকুতি মিনতি করলাম- দয়া করে আমাকে মেরে ফেলো, আমার ওপর একটু দয়া করো, আমাকে মেরে ফেলো’।
আমার কাকুতি মিনতি শুনে শুয়োরের মতো ঘোত ঘোত করে হেসে উঠলো ওরা। একে ওপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে ওরা নোংরা নোংরা কথা বলছিল। ‘দোষ স্বীকার কর, তোর অপরাধ স্বীকার কর…’ একটু পর পর কর্কশ গলায় বলছিলো এক অফিসার। দোষ করলে না আমি স্বীকার করবো। বিদেশে থাকার সময় স্বামী, সংসার, পড়াশোনা এগুলো নিয়েই তো কাটতো আমার অষ্টপ্রহর। নিতান্তই ছাপোষা জীবন ছিলো আমার!
শারীরিক নির্যাতনের সাথে সাথে ক্যাম্প অথোরিটি শুরু করলো মনস্তাত্ত্বিক অত্যাচার। নির্জলা মিথ্যে বললো সবাই মিলে-জানিস, তোর মা মারা গেছে? আর তোর বাবাকে যে যাবতজীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে? তোর ছেলে ময়েজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। কয়েকদিন আগে সেও পটল তুলেছে। অন্ধ হয়ে গেছে তোর মেয়ে, ওর চোখ আর কখনো ঠিক হবেনা। তোর মেয়েকে দেখার এখন আর কেউ নেই। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ভিক্ষা করে সে। তোর পরিবারের সবাই শেষ’!
চিন্তা করুন, একজন মা, একজন মেয়ে কীভাবে এই খবরগুলো হজম করবে? পৃথিবীর সমস্ত অপরাধবোধ, শূণ্যতা, রিক্ততায় ছেয়ে গেলো আমার মন। মনে হলো পুরো পরিবারের জন্য আমি একরাশ কষ্ট ছাড়া আর কিছুই না। আমাকে মেরে ফেলো, প্লিজ আমাকে মেরে ফেলো- কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে গেলো আমার। মুখে ফেনা উঠা শুরু হলো, জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম আমি। জ্ঞান হারানোর আগে শুনলাম একজন অফিসার চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে, ‘তুই একজন উইঘুর! আর এটাই সবচেয়ে বড় অপরাধ!’
২১০ নম্বর সেলে আমি যখন যাই তখন সেখানে ৪০ জন মহিলা বন্দী ছিলো। এদের বয়েস ১৭ থেকে ৬২ বছরের মধ্যে। প্রত্যেকদিন সেলে নতুন নতুন বন্দী আসতো। আবার অনেকে চলে যেতো। যাওয়া আসা চলো সবসময়। তিনমাস পরে যখন মুক্তি পেলাম তখন বন্দিনীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৮ তে। এদের আমি আগে থেকে চিনতাম। অনেকেই ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী, আমার একজন শিক্ষকের পিচ্চি একটা মেয়েও সেখানে ছিলো। অধিকাংশ বন্দিনীই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত কর্মজীবী। শিক্ষক, ডাক্তার ইত্যাদি। আমাদের সেলে একজন ডাক্তার ছিলেন যিনি ইংল্যান্ড থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছিলেন। বন্দী হবার আগে আমি ওর কাছ থেকে বেশ কয়েকবার চিকিৎসাও নিয়েছিলাম।
একরাতে আমাদের সেলের একজন মারা গেলো। জীবনের কঠিনতম রাত ছিলো সেটা। প্রত্যেকটা রাত আসতো একেকটা দুঃস্বপ্ন নিয়ে। রাতের নীরবতা ছারখার করে দিয়ে পুরুষ বন্দীদের সেল থেকে ভেসে আসতো মারধোরের শব্দ, খিস্তি খেউর, বন্দীদের অমানষিক চিৎকার। সহ্য করার মতোনা। মনে হতো সমস্ত সৃষ্টিকে কেউ বোধহয় জবাই করছে, রগ কাটার ঘড়্ঘড় শব্দ হচ্ছে। আহত বা মৃত বন্দীদের শরীর মেঝেতে ঘষে ঘষে টেনে নিয়ে যাওয়া হতো, রাতের নীরবতায় শতোগুন শক্তিশালী হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়তো শেকলের শব্দ। এই বন্দীদের মধ্যে হয়তো আমাদের কারো বাবা বা ভাই রয়েছে- এই চিন্তা হিংস্র জন্তুর মতো হামলে পড়তো আমাদের ওপর। বিষাক্ত নখর দিয়ে ছিড়ে ছুবড়ে ফেলতো আমাদের!
চলবে ইনশা আল্লাহ…
(সংগৃহীত)
পড়ুনঃ
সেইল নম্বর ২১০ (প্রথম কিস্তি)- https://www.dawahilallah.com/showthr...B%26%232496%3B
রেফারেন্সঃ
মিহিরগুল তারসুনের পুরো অভিজ্ঞতার কথা শুনুন এবং দেখুন এই ভিডিওতে- Video: In Full – Ex-Xinjiang detainee Mihrigul Tursun’s full testimony at the US congressional hearing- https://tinyurl.com/u4mwf7g
Comment