#সেইল_নম্বর_২১০
(শেষ কিস্তি)
আমাদের ২১০ নম্বর সেলে ছিলো ৬৮ জন। তিনমাসে ৯ জন মারা গেলো। যদি আমাদের এই ছোট্ট সেইলে মাত্র ৩ মাসেই ৯ জন মারা যায় তাহলে চিন্তা করেন পুরো পূর্ব তুর্কিস্তানে প্রতিদিন কতো বন্দী মারা যায়!
৬২ বছরের এক বৃদ্ধা ছিলেন নাম গুলনিসা। হাতের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলোনা উনার, হাত কাঁপত সবসময়। সারা শরীর জুড়ে ফুসকুড়ি বের হয়েছিলো। কিছু খেতে পারতেন না। মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ক্যাম্পের ডাক্তারেরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রিপোর্ট দিলো- গুলনিসা একদম সুস্থ! রসিকতা মনে হতে পারে, কিন্তু এছাড়া ডাক্তারদের কিছু করারও নেই। কোনো ডাক্তার যদি রিপোর্ট দেয় যে অমুক বন্দী অসুস্থ, তাহলেই ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের সন্দেহের তালিকায় নাম উঠে যাবে তার- লাল কালিতে লেখা হবে, ‘এই ডাক্তার বন্দীদের প্রতি সহানুভূতিশীল’! এক রাতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসা করে চাইনিজে লিখা বইয়ের কিছু লাইন মুখস্থ বলতে না পারায় চরম অপমান করা হলো ৬২ বছরের বৃদ্ধা গুলনিসাকে। অঝোরে অশ্রু বিসর্জন দিলেন বৃদ্ধা। অশ্রু ঘুম পাড়ালো এক সময় তাকে। পুরো রাত তাঁর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেলনা। প্রতিরাতের মতো সে রাতে নাক ডাকলেন না। সকালে অ্যালার্ম বাজার পরও ঘুম থেকে উঠছিলেন না। আমরা গুলনিসার শরীর ঝাঁকিয়ে ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করলাম। উনার শরীরে হাত দিয়েই চমকে উঠলাম। বরফের মতো ঠাণ্ডা শরীর।
ঘুমের মধ্যেই অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছেন বুড়ো মানুষটা!
গুলনিসার মতোই এক রাতে হুট করে মারা গেলো পাতেমহান। ২৩ বছরের এই মেয়েটা ঘুরে এসেছে শোকের সবকয়টি দ্বীপ থেকে। মাকে হারিয়েছে অনেক আগেই। বাবা, ভাই, স্বামী সবাইকেই চাইনিজ পুলিস পাঠিয়েছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। এদের সবার অপরাধ ২০১৪ সালে তারা এক বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়েছিলো। ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী বিয়ে হচ্ছিলো। কাজেই গান বাজনা, নাচ গান, মদ পান এসব কিছুই ছিলোনা। এটাই ছিলো তাদের অপরাধ! এই ‘ভয়ঙ্কর’ অপরাধের কারণে ওদের সবাইকে ধরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। সেই বিয়ের দাওয়াত খেতে যাওয়া সবাইকে, ৪০০ জন লোককেই খুঁজে খুঁজে বের করেছে পুলিস, তারপর পাঠিয়েছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। একজনকেও ছাড় দেয়নি।
পাতেমহানকে যখন পুলিস ধরে নিয়ে আসে তখন তাঁর বাচ্চারা লুকিয়ে ছিলো বাড়ির পেছনের উঠোনে। বাচ্চাদের কথা মনে করে মাথানিচু করে কাঁদত সে। বুক-খালি করা দীর্ঘশ্বাসে গুমোট হয়ে যেতো ৪৩০ স্কয়ার ফিটের সেইলটা।অচেনা একধরণের পিল খেতে বাধ্য করা হয়েছিলো আমাদের। পিলের প্রভাবেই বোধহয় পাতেমহানের ব্লিডিং শুরু হয় একদিন। এক মাস ধরে ব্লিডিং হতে থাকে তাঁর। এই পুরো একটা মাস ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ কোনো ধরণের চিকিৎসা করেনি। একরাতে পালা করে দাঁড়িয়ে থাকার সময় (সেইলে জায়গা অত্যন্ত কম ছিলো। সব বন্দী একসঙ্গে ঘুমুতে পারতোনা। পালাক্রমে ঘুমুতে হতো। একদল ঘুমুতো বাকী দল তখন দাঁড়িয়ে থাকতো) কাঁটাগাছের মতো ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল সে হঠাৎ। শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। ছুটে আসে মাস্ক পরা বেশ কয়েকজন লোক। পা ধরে টেনে নিয়ে যায় ওকে। তারপর পাতেমহানের আর কোন খবর আমরা কেউ জানিনা।
এতো বিভীষিকা, এতো অত্যাচার সয়ে কখনো ২১০ নম্বর সেল থেকে বাইরের পৃথিবীতে পা ফেলতে পারবো, তা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু জগতে মাঝে মাঝে অলৌকিক ঘটনা ঘটে। তিন মাস ক্যাম্পে থাকার পর মুক্তি পেলাম সেই জাহান্নাম থেকে। মুক্তির মাত্র ২ ঘণ্টা আগে ওরা আমাকে একটা ইনজেকশন দিলো। মনের মধ্যে কেন জানি কুডাক ডাকছিলো। মনে হচ্ছিলো এই ইনজেকশনেই আমার মৃত্যু লেখা। সেকেন্ড, মিনিট গণনা করে মৃত্যুর অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু মরলাম না। প্রচণ্ড অবাক হলাম। বিস্ময় আরো বাড়লো যখন ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললো ভালো করে পড়ে সই করো এখানে। পড়লাম, সই করলাম, শপথ করলাম। সবকিছু ভিডিও করে রাখলো ওরা। কাগজে লেখা ছিলো-
‘আমি চীনের একজন নাগরিক এবং আমি চীনকে ভালোবাসি। চীনে আমি বেড়ে উঠেছি। আমি কখনোই এমন কিছু করবোনা যাতে চীনের ক্ষতি হয়। পুলিস আমাকে একবারের জন্যও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি, মারধোর করা বা ক্যাম্পে বন্দী করে রাখা তো বহু দূরের কথা’।
পুলিস আমাকে বারবার শাঁসালো, ‘তোর বাচ্চাদের মিশরে রেখেই তুই আবার চীনে ফিরে আসবি। কখনো ভুলে যাস না তোর বাবা মা, ভাইবোন আত্মীয় স্বজন আমাদের দয়ায় বেঁচে আছে’।
২০১৮ এর এপ্রিলের ৫ তারিখে, প্রায় তিন মাস পর সূর্যের আলো দেখলাম আমি। বাচ্চা দুটোকে বুকে নিয়ে আদর করতে পারলাম। বাবা মা কাউকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। কিন্তু পুলিশের ভয়ে এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করতে পারলামনা। ক্যাম্প থেকে বের হবার তিনদিন পর বাচ্চাদের নিয়ে বেইজিং গেলাম। সেখান থেকে প্লেনে করে মিশরে যাবার ইচ্ছা। কিন্তু বেইজিঙে আটকা পড়ে গেলাম ২০ দিনের জন্য। তিন তিন বার আমার ফ্লাইট ক্যান্সেল করে দিলো বিমানবন্দরের ওরা। আমার কী কাগজ জানি নাই…! অবশেষে চার নম্বর বার বিমানে উঠতে পারলাম। এপ্রিলের ২৮ তারিখে কায়রো নামলাম দু বাচ্চা আর এক বুক কষ্ট নিয়ে! কী করবো, কোথায় যাব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
আমার বাবা মা,ভাইবোন খুব সম্ভবত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী, আমি যদি চীন ফেরত না যাই তাহলে ওদের মেরে ফেলবে। আর আমি যদি ফিরে যাই তাহলে আমাকে আবার ছুড়ে ফেলবে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। বাবা মা ভাইবোনকে যে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি দেবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। বরং শতভাগ সম্ভাবনা আছে আমাদের সবাইকে একসাথে ক্যাম্পে মেরে ফেলবে। কাজেই সিদ্ধান্ত নিলাম আর ফিরবোনা চীন। যে কারণে আজ আমার বড় ছেলে মৃত, গুলনিসা, পাতেমহানরা আজ কবরে, যে কারণে আমার বাবা মা’রা নিখোঁজ, যাদের কারণে জীবন আমার কাছে অর্থহীন, তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তি নিয়ে যুদ্ধ করব। আর যেনো কোনোদিন কারো সাথে এমন না হয়। কারো চোখে এতোটা জল যেনো না ঝরে! কারো যেনো পাড়ি দিতে না হয় খুন রাঙ্গা এই পথ!
কনসেন্ট্রেশনের ক্যাম্পের বিভীষিকা এখনো আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। এখনো দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমের ঘোরে আঁতকে উঠি আমি। নরকের সেই দিনরাতের স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারিনা। আমার জীবন আজও আটকা পড়ে আছে ৪৩০ স্কয়ার ফুটের ২১০ নম্বর সেইলে!
আমার বাচ্চারাও ভালো নেই। শারীরিক মানসিক সব দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওরা। ছোট্ট মনের ওপর চেপে বসেছে আতঙ্ক। দরজায় কেউ নক করলেই ওরা ভয়ে শিউরে ওঠে। আবার আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে ওরা।
আমার গায়ের ক্ষত এখনো শুকোয়-নি। শরীর বয়ে নিয়ে চলেছে ক্যাম্পের মারধোরের চিহ্ন। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য কাটা দাগ । শরীরের ক্ষতো একদিন শুকোবে, কিন্তু মনের ক্ষত কি শুকোবে কোনোদিন? শেকলে বাঁধা থাকতে থাকতে স্থায়ী ব্যথার উৎসে পরিণত হয়েছে গোড়ালি আর হাতের কবজি। ডান কানের ওপর পুলিস প্রচণ্ড জোরে মেরেছিলো, ও কানে এখন আর শুনতে পাইনা। খুব বেশী আলো বা আঁধার কোনটাই সইতে পারিনা আমি। পুলিস সাইরেন শুনলেই আততায়ীর মতো ক্যাম্পের দুঃসহ স্মৃতিগুলো ঘিরে ধরে আমাকে। হৃদপিণ্ড পাগলা ঘোড়ার গতিতে রক্ত পাম্প করতে থাকে, শ্বাস প্রশ্বাস আটকে আসে, মনে হয় দমবন্ধ হয়ে মারা যাবো। মনকে প্রবোধ দেই, আমি এখন নিরাপদ, কিন্তু মন মানেনা। ভয় হয় একরাতে ভারী বুটজুতোর শব্দ তুলে ওরা আবার আসবে। ওরা আসবে অমোঘ নিয়তির মতো। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে । অথবা মেরে ফেলবে।
চীন থেকে বহুদূরে পালিয়ে আসলেও, চীন সরকারের নাগালের বাহিরে যেতে পারিনি আমি। কয়েক সপ্তাহ আগে একদল চাইনিজ পিছু নিয়েছিলো আমার। গাড়িতে ওঠার পরেও আমার পিছ ছাড়লোনা। অনেকদূর পর্যন্ত অনুসরণ করলো।
চীন সরকার আমার ভাইকে চাপ দিয়ে আমার কাছে বার্তা পাঠিয়েছে। একদিন আমার মোবাইলে সে ভয়েসমেইল পাঠালো- আপু, কীভাবে তুই এমনটা করতে পারলি? কেমন মেয়ে তুই? বাবা মার প্রতি একটুকু ভালোবাসাও নেই তোর? আমার ভয়েস মেইল পাওয়া মাত্রই চীন দূতাবাসে যাবি তুই। রেডিও ফ্রি এশিয়ার সাথে ইন্টার্ভিউয়ে চীন সরকারের বিরুদ্ধে যা যা বলেছিস, সব ফিরিয়ে নিবি। বলবি, তুই চীনকে ভালোবাসিস। বলবি, আমেরিকার উইঘুর অর্গানাইজেশন তোকে ভয়ভীতি দেখিয়ে, চাপ দিয়ে ক্যাম্পের নির্যাতনের ব্যাপারে মনগড়া কথা বলিয়েছে। সব অস্বীকার করবি তুই। না হলে আপু তুই যেখানেই লুকাস না কেনো, চীন সরকার তোকে খুঁজে বের করবেই’।
এই হলো আমার কাহিনী। আমি সৌভাগ্যবান, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফিরেছি। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী লক্ষ লক্ষ উইঘুর, কাজাখ মুসলিমের ভাগ্য আমার মতো ভালোনা। নরকের দোরগোড়ায় বসে মৃত্যুপ্রহর গুনছে ওরা।
চীন সরকার খুব স্পষ্টভাবে আমাকে মেসেজ দিয়েছে- ক্যাম্পের ব্যাপারে কথা বলা মানে আমার বাবা মা, ভাইবোনের মৃত্যু!
শরীরের সমস্ত কোষে কোষে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া অপরাধ-বোধের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয় আমাকে। আমার কারণেই তাদের এই করুণ পরিণতি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, পরিবারের গণ্ডির সীমা ছাড়িয়ে মহৎ এক দায়িত্ব পালন করার সময় এখন আমার। বিশ্ববাসীকে আমার সত্যটা জানাতে হবে, যেন কেউ চীনকে থামায় নীরব গণহত্যার পথ থেকে।
বিশ্ববাসী দয়া করে আপনারা এগিয়ে আসুন উইঘুর, কাজাখ মুসলিমদের সাহায্যার্থে। দেশহীন, ভূমিহীন এই মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়ান।
আপনারা কেউ চীনে গেলে দয়া করে চীন সরকারকে জিজ্ঞাসা করবেন কি, মিহিরগুল তারসুনের বাবা, মা আর ভাই কোথায়?
পড়ুন:
সেইল নম্বর ২১০ (প্রথম কিস্তি)-https://www.dawahilallah.com/showthr...B%26%232496%3B
সেইল নম্বর ২১০ (দ্বিতীয় কিস্তি)- https://www.dawahilallah.com/showthr...%26%232463%3B)
রেফারেন্স:
মিহিরগুল তারসুনের পুরো অভিজ্ঞতার কথা শুনুন এবং দেখুন এই ভিডিওতে- Video: In Full – Ex-Xinjiang detainee Mihrigul Tursun’s full testimony at the US congressional hearing- https://tinyurl.com/u4mwf7g
Comment