পৃথিবীতে লিবারেলদের পতন এবং ডানপন্থীদের উত্থান: বাস্তবতা, কারণ এবং শিক্ষা
( সকল পর্ব একত্রে )
( সকল পর্ব একত্রে )
বর্তমানে অনেক জায়গায় লিবারেল দলগুলোর জনপ্রিয়তা কমে গেছে, যেখানে ডানপন্থী দল ও মতাদর্শের উত্থান স্পষ্ট। লিবারেলদের পতনের প্রধান কারণ হলো তাদের নীতির সাথে বাস্তব কাজের মিল না থাকা এবং বাস্তবসম্মত নীতির অভাব। অন্যদিকে, ডানপন্থীরা মানুষের প্রকৃত প্রয়োজন ও চাহিদা লক্ষ্য করে রাজনীতি চালাচ্ছে এবং সফলভাবে মানুষের সমর্থন পাচ্ছে। এই পরিবর্তন শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সামাজিকবিজ্ঞানের একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ, যেখানে রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব এবং সামাজিক পরিবর্তনের গভীর বিশ্লেষণ করা যায়।
লিবারেলদের পতনের কিছু কারণ -
ক। কথা আর কাজে মিল নেইঃ
১. লিবারেল নীতির দ্বন্দ্ব: লিবারেল মতাদর্শের মূল কথা হলো মানবাধিকার, সমতা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এটি মানুষের জন্য ন্যায্য এবং সমৃদ্ধ সমাজের স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু বাস্তবতায়, লিবারেল দেশগুলো প্রায়ই তাদের কথা অনুযায়ী কাজ করতে ব্যর্থ হয়। তারা কথায় মানবাধিকার রক্ষা করে, কিন্তু বাস্তবে তাদের নীতিতে প্রায়শই স্ববিরোধিতা দেখা যায়।
২. মানবাধিকার ও যুদ্ধ: যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো লিবারেল দেশগুলো প্রায়ই মানবাধিকার রক্ষার কথা বলে। কিন্তু বাস্তবিকভাবে, তাদের কার্যক্রম এই নীতির সাথে মিল না খাওয়ায় প্রায়ই বিপরীত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে যুদ্ধ শুরু করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অভিযোগ তুলে। পরে জানা যায়, এই অভিযোগ ভিত্তিহীন ছিল। এর ফলে ইরাকে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ নিহত হয় এবং দেশটি চরম অস্থিতিশীলতায় পড়ে। ইউরোপীয় দেশগুলো শরণার্থীদের মানবিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও, শরণার্থী সংকটের সময় ভূমধ্যসাগরে শরণার্থীদের ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনাগুলোতে তাদের উদাসীনতা স্পষ্ট দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালে শরণার্থী সংকটের সময় ইউরোপের ভূমধ্যসাগরে প্রায় ৮,০০০ শরণার্থী ডুবে মারা যায়, যা মানবাধিকারের নীতি বিরোধী আচরণের একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
৩. অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও দারিদ্র্য: লিবারেল দেশগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বিভিন্ন দেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞাগুলো সাধারণ মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সাধারণ ইরানিদের খাদ্য ও ওষুধের সংকটে ফেলেছে, যা মানবাধিকার ধারণার বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালে ইরানে খাদ্য এবং ওষুধের দাম প্রায় ৩০% বাড়ে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলে।
৪. জলবায়ু পরিবর্তনে প্রতিশ্রুতি ও কর্পোরেট প্রভাব: লিবারেল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কাজ করার বড় প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু কর্পোরেট লবিগুলোর চাপে তারা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে প্রায়ই ব্যর্থ হয়। ইউরোপের অনেক দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও, বেশ কিছু কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষার জন্য এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দেরি করছে। কানাডার লিবারেল প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তির একজন প্রবক্তা ছিল। তবে, তার সরকার তেল পাইপলাইন সম্প্রসারণ প্রকল্প (Trans Mountain Pipeline Expansion) অনুমোদন করে। এই প্রকল্পটি জীবাশ্ম জ্বালানি পরিবহনে ব্যবহৃত হবে, যা কার্বন নির্গমন আরও বাড়াবে। ট্রুডো সরকারের এই পদক্ষেপকে পরিবেশবাদী গোষ্ঠীগুলো তীব্র সমালোচনা করেছে, তারা এটিকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেছে।
খ। ইউটোপিয়ান চিন্তাভাবনাঃ
১. লিবারেল আইডিওলজির সীমাবদ্ধতা: লিবারেল চিন্তার মূল লক্ষ্য হলো একটি নিখুঁত এবং ন্যায়সঙ্গত সমাজের স্বপ্ন, যেখানে সবাই সমান সুযোগ পায় এবং কোনো বাধা ছাড়াই নিজের জীবন উন্নত করতে পারে। এটি একটি আদর্শিক ধারণা, যেখানে মানুষের নেতিবাচক দিকগুলো যেমন, লোভ, স্বার্থপরতা এবং প্রতিযোগিতার মতো বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করা হয়। লিবারেলরা প্রায়ই "সবার জন্য সমান সুযোগ" এবং "বিনামূল্যে অভিবাসন" এর মতো ধারণা প্রচার করে। এই ধারণাগুলো কাগজে-কলমে দারুণ শোনলেও বাস্তবে এটি সমাজ এবং অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে।
উদাহরণস্বরূপ বিনামূল্যে অভিবাসন: বিনামূল্যে অভিবাসনের ধারণা অনুযায়ী, যে কেউ যেকোনো দেশে বসবাস ও কাজ করতে পারে। কিন্তু বাস্তবিকভাবে, এটি একটি দেশের অর্থনীতি এবং সংস্কৃতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। যেমন, ইউরোপে অনেক শরণার্থী এসে একটি বড় সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ২০১৫ সালের শরণার্থী সংকটের সময় জার্মানিতে অনেক অভিবাসী প্রবেশ করেছিল। এর ফলে স্থানীয় জনগণের মধ্যে চাকরি হারানোর ভীতি বেড়েছিল এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে জার্মানিতে অভিবাসীদের বেশি হবার কারণে চাকরি বাজারে চাপ পড়ে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে চাকরি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়।
২. বাস্তবতার সীমাবদ্ধতা: ইতিবাচক হলেও, এই ধারণাগুলো বাস্তবে প্রায়ই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের প্রতিভা, পরিবার, এবং সামাজিক অবস্থানের ভিন্নতার কারণে সুযোগের ফারাক থাকে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা দেখতে পারেন। সরকারি স্কুলগুলোতে সবাই সমান শিক্ষা সুযোগ পায়, কিন্তু ধনী পরিবারের সন্তানরা ব্যক্তিগত স্কুলে ভালো শিক্ষা পায়। ফলে, "সমান সুযোগ" শুধুমাত্র একটি ধারণা হিসেবে থেকে যায়।
৩. কর্পোরেট প্রতিযোগিতা: লিবারেল ধারণা অনুযায়ী, মানুষ স্বাভাবিকভাবে পরার্থপর এবং সহানুভূতিশীল। কিন্তু বাস্তবে, মানুষ প্রায়ই নিজের স্বার্থকে আগে রাখে। কর্পোরেট দুনিয়ার উদাহরণ থেকে এটা ভালোভাবে বোঝা যেতে পারে। বড় কোম্পানাগুলো ছোট ব্যবসাগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে তাদের বাজার থেকে বের করে দেয়। এর ফলে "সবার জন্য সমান সুযোগ" কেবল একটি ধারণা হিসেবে থেকে যায়।
গ। মানুষের প্রয়োজনকে গুরুত্ব না দিয়ে বৈশ্বিক নীতিকে গুরুত্ব দেয়াঃ
লিবারেল নীতিগুলো প্রায়শই বড় বিষয়গুলির দিকে মনোযোগ দেয়, কিন্তু সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন এবং সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দেয় না। তারা কর্পোরেট স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেয়, যা অনেক সময় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলে। এর ফলে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয় এবং ডানপন্থী দলগুলোর উত্থান সহজ হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্যাংক এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেইলআউট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একই সময়ে সাধারণ মানুষ চাকরি হারিয়েছিল এবং তাদের বাড়ি বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের জন্যে অইরকম কিছু করা হয়নি। কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সরকারের এই পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল।
লিবারেল দেশগুলো সাধারণ মানুষের চাকরি ও জীবনযাত্রার উন্নতির চাইতে জলবায়ু পরিবর্তন বা বৈশ্বিক নীতির মতো বড় বিষয়গুলিতে বেশি মনোযোগ দেয়। উদাহরণ হিসেবে ফ্রান্সে "ইয়েলো ভেস্ট" আন্দোলনকে দেখা যেতে পারে। ফ্রান্স সরকার যখন পরিবেশ রক্ষার জন্য জ্বালানির ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করল, তখন সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হল। তারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সড়কে নেমে আসে, কারণ এটি তাদের জীবনযাত্রার খরচ বাড়িয়ে দেয়।
ঘ। তাত্ত্বিকতা, "Woke" রাজনীতি এবং জনসাধারণের মূল সমস্যাগুলোর প্রতি উদাসীনতাঃ
লিবারেল দলগুলোর একটি বড় দুর্বলতা হলো তাত্ত্বিক আলোচনা এবং "ওয়োক" ("woke") রাজনীতিতে বেশি মনোযোগ দেওয়া। এর ফলে তারা প্রায়ই সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা এবং বাস্তব সমস্যাগুলো থেকে দূরে চলে যায়। লিবারেলদের আলোচনা অনেক সময় জটিল তাত্ত্বিক বিষয়গুলিতে সীমাবদ্ধ থাকে, যা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্য আকর্ষণীয় হলেও, গ্রামীণ বা কম শিক্ষিত মানুষের সাথে তাদের দূরত্ব বাড়ায়। এই কারণে তারা সাধারণ মানুষের প্রকৃত চাহিদা এবং সমস্যাগুলো সঠিকভাবে বুঝতে পারে না।
১। তাত্ত্বিক আলোচনা: লিবারেল নেতারা প্রায়ই মানবাধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠার মতো বিষয় নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনায় ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু এই আলোচনাগুলো সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার সাথে সম্পর্কহীন। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে ব্রেক্সিট বিতর্কের সময় লিবারেল রাজনীতিকরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে থাকার পক্ষে "অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি" এবং "বৈশ্বিক সংযোগ" এর কথা বলেন। কিন্তু তারা ব্রেক্সিট সমর্থকদের বাস্তব সমস্যাগুলো, যেমন চাকরি হারানো এবং স্থানীয় শিল্পের পতন, ঠিকভাবে বুঝতে পারেনি। এর ফলে, সাধারণ মানুষের বড় একটা অংশ লিবারেল চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
২। "Woke" রাজনীতি: "Woke Politics" শব্দটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক সচেতনতা এবং প্রগতিশীল অ্যাকটিভিজম বোঝাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। "Woke" রাজনীতি একটি সামাজিক আন্দোলন, যা সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়গুলিতে সচেতনতা বাড়াতে এবং প্রগতিশীল পরিবর্তনের দিকে মনোযোগ দেয়। এটি লিঙ্গ সমতা, এলজিবিটিকিউ অধিকার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই LGBTQ+ অধিকারের ব্যাপারে বেশি সচেতনতা দেখা যায়। তবে, এই আন্দোলন প্রায়ই সাধারণ মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলো, যেমন চাকরি, মূল্যস্ফীতি, নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা, উপেক্ষা করে। মূলত, এর দার্শনিক ভিত্তি পোস্ট-মডার্নিজম বা উত্তর-আধুনিকতাবাদ।
৩। রাজনৈতিক শুদ্ধতা: "Woke" রাজনীতি প্রায়ই এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে যেখানে রাজনৈতিক শুদ্ধতার নামে ভিন্নমত প্রকাশ করতে বাধা দেয়। এটি সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরক্তি এবং অসন্তোষ সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি "Woke" আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত নীতি গ্রহণ করেছিল, যা মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষের বাস্তব সমস্যাগুলো সমাধানে সাহায্য করতে পারেনি। এর ফলে, তারা ডানপন্থী রিপাবলিকানদের কাছে ভোট হারায়।
ডানপন্থীদের উত্থানের কারণ, কেন তারা জনপ্রিয়তা অর্জন করছে -
ডানপন্থী দলগুলোর উত্থান বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তারা সাধারণ মানুষের আবেগ এবং বাস্তব সমস্যাগুলোর সাথে সংযুক্ত কৌশল ব্যবহার করে, যা তাদের নির্বাচনে সফল হতে সাহায্য করছে। নিচে ডানপন্থীদের উত্থানের কয়েকটি প্রধান কারণ এবং কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো:
১. সাধারণ মানুষের বাস্তব সমস্যাগুলোকে কেন্দ্র করে প্রচারণাঃ
ডানপন্থীরা সাধারণ মানুষের চাকরি, নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার মতো সমস্যাগুলোকে তাদের প্রচারণার মূল বিষয় করে। ভারতে, মোদি সরকার নির্বাচনের আগে কৃষকদের ঋণ মওকুফ এবং ফসলের ন্যায্যমূল্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা গ্রামীণ ভোটারদের আকৃষ্ট করেছিল। মোদি সরকারের "প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি" প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু আর্থিক সহায়তাও প্রদান করা হয়েছিল। এর ফলে ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি গ্রামীণ এলাকায় ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প 'আমেরিকানদের জন্য চাকরি' নীতির ওপর জোর দিয়ে মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে অনেক সমর্থন পেয়েছিল। তার স্লোগান ছিল, 'মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন (MAGA)', যা আমেরিকান চাকরি এবং আমেরিকান পণ্যকে গুরুত্ব দেয়। ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে কর্পোরেট কর কমানো এবং বাণিজ্য সুরক্ষার নীতি গ্রহণ করে ২০১৮ সালে বেকারত্বের হার ৩.৫% এ নেমে আসে, যা গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল।
২. আবেগকে কেন্দ্র করে প্রচারণাঃ
ডানপন্থীরা জাতীয়তা, ধর্ম, এবং ঐতিহ্যের প্রতি মানুষের আবেগ কাজে লাগায়। তারা এমন বার্তা দেয় যা মানুষকে একত্রিত করে এবং একটি গোষ্ঠীর পরিচয় তৈরি করে। ভারতে মোদি সরকার "হিন্দুত্ববাদ" প্রচারণা চালিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী অনুভূতি তৈরি করেছে। এর ফলে তাদের ভোটব্যাংক শক্তিশালী হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের "MAGA" (Make America Great Again) স্লোগান আমেরিকানদের মধ্যে দেশপ্রেম এবং জাতীয় গৌরব বাড়িয়েছে। এটি মধ্যবিত্ত এবং গ্রামীণ জনগণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছে।
তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ডানপন্থী রাজনীতির একটি ভালো উদাহরণ। সে মানুষের আবেগ, ধর্মীয় পরিচয় এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে বারবার নির্বাচনে জিতেছে। এরদোয়ানের "অভ্যন্তরীণ শত্রু মোকাবিলা" এবং "পশ্চিমা হস্তক্ষেপ বিরোধিতা"র বার্তা মানুষের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়েছে, যা তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য এবং নিরাপত্তা অনুভূতি জাগিয়েছে।
৩. সরল বার্তা এবং কার্যকর উদ্যোগঃ
ট্রাম্পের "MAGA" (Make America Great Again) ভিশন সাধারণ মানুষের আবেগের সাথে মিলেছে। তার সরল ও স্পষ্ট বার্তা মানুষদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছে। ইউরোপের ডানপন্থী দলগুলো "নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষা করো" এবং অভিবাসন বিরোধী বার্তা দিয়ে সহজেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
পোল্যান্ডে ডানপন্থী দল "ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (PiS)" অভিবাসন এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তারা সহজ ভাষায় বার্তা দিয়ে এবং স্থানীয় সমস্যাগুলোতে মনোযোগ দিয়ে মানুষের মন জয় করেছে। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান এবং তার দল "ফিদেজ" (Fidesz) ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীর সফল উদাহরণ। অরবান ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে মানুষের সমর্থন পেয়েছে। তার নেতৃত্বে হাঙ্গেরি সামাজিক ও অর্থনৈতিক কৌশলগুলোর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা শক্তিশালী করেছে। ২০১৫ সালের ইউরোপীয় অভিবাসী সংকটের সময়, অরবান দৃঢ়ভাবে অভিবাসনের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, "হাঙ্গেরি ইউরোপকে রক্ষা করছে।"
৪. প্রাক-নির্বাচনী অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদানঃ
ডানপন্থী দলগুলো প্রায়ই নির্বাচনের ঠিক আগে জনগণের কাছে আর্থিক সুবিধা নিয়ে আসে, যা তাদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করে। ভারতে মোদি সরকার ফ্রি রেশন, নগদ অর্থ বিতরণ, এবং প্রধানমন্ত্রীর 'আবাস ইয়োজনার' মতো প্রকল্প চালু করে সাধারণ মানুষদের মধ্যে প্রভাব ফেলে। এই প্রকল্পগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থা বাড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান পার্টি কর কমানো এবং মধ্যবিত্তদের জন্য বিশেষ সুবিধা ঘোষণা করে জনগণের সমর্থন পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে ট্যাক্স রিফান্ড বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নত করেছিল। রিপাবলিকান পার্টির এই নীতিমালা সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থা বাড়িয়েছে।
ডানপন্থীরা সাধারণ মানুষের বাস্তব সমস্যা, আবেগ, এবং সহজ বার্তার মাধ্যমে তাদের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। তারা এমন অঙ্গীকার করে যা সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারে এবং নিজেদের জীবনের সাথে মিল রাখে মনে করে। এই কৌশলগুলো তাদের উত্থানের প্রধান কারণ এবং বিশ্ব রাজনীতিতেও তাদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে।
ইসলামপন্থীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় -
বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে লিবারেলদের পতন এবং ডানপন্থীদের উত্থান ইসলামপন্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হয়ে এসেছে। এটি শেখায় যে, নেতৃত্ব দিতে হলে শুধু তাত্ত্বিক কথা বা আদর্শ প্রচার করাই যথেষ্ট নয়; বরং মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ, আবেগকে সঠিকভাবে ব্যবহার এবং বাস্তবসম্মত কার্যক্রম চালানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামপন্থীদের উচিত নিজেদের কৌশল এবং বার্তা সাধারণ মানুষের সাথে মিল রেখে তৈরি করা। নিচে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. মানুষের প্রয়োজনকে গুরুত্বের সাথে দেখাঃ
ইসলামপন্থীদের অবশ্যই সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো, যেমন - শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান এবং নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের এমন কর্মসূচি চালু করতে হবে যা মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। ইসলামিক শাসনের ইতিহাসে খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর নেতৃত্বে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে জনগণের সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দিতেন এবং সবসময় সবার চাহিদা পূরণে চেষ্টা করতেন। শুধু ধর্মীয় আদর্শ প্রচার নয়, বরং স্থানীয় জনগণের জরুরি প্রয়োজনগুলো যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, খাদ্য, এবং আবাসন নিয়ে সরাসরি কাজ করা উচিত। মসজিদ, মাদ্রাসা বা ইসলামিক সংগঠনের মাধ্যমে ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্র, সস্তা শিক্ষা সহায়তা, খাদ্য বিতরণ ইত্যাদি কর্মসূচি শুরু করা যেতে পারে।
২. আবেগ এবং বাস্তবতার সমন্বয়ঃ
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের আত্মিক এবং শারীরিক উভয় প্রয়োজন পূরণ করে। ইসলামপন্থীদের উচিত ইসলামের মানবিক ও ন্যায়বিচারের বার্তা প্রচার করা এবং তা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সাথে মিলিয়ে তোলা। সামাজিক সমস্যাগুলো যেমন দারিদ্র্য কমানো বা শিশুদের শিক্ষা উন্নয়নের মতো বিষয়গুলিতে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে দেখানো দরকার। উদাহরণস্বরূপ, জাকাত সঠিকভাবে ব্যবহার করা এবং সুবাহি মক্তবের নিয়ম আবার চালু করা। শুধু ধর্মীয় আবেগ জাগানোই নয়; সেই আবেগকে সত্যিকার সমাধানে রূপান্তর করতে হবে। যেমন, "শরিয়াহ আইন" বলার পরিবর্তে, সেই আইনের সামাজিক কল্যাণমূলক দিকগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে (যেমন ন্যায়বিচার, সুদের বিরুদ্ধে অবস্থান, ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পদ ভাগ করা) তা স্পষ্ট করা দরকার।
৩. প্রযুক্তি ও মিডিয়ার সঠিক ব্যবহারঃ
ইসলামপন্থীদের উচিত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইসলামের বার্তা প্রচার করা। ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করতে এবং ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দিতে সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করতে হবে। পিআর ফার্ম এবং বট আইডির মতো টুলসের প্রচার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে হবে। ইসলামপন্থীরা বড় বই বা লেকচারের পরিবর্তে সহজ ভাষা, গ্রাফিক্স, ভিডিও এবং ছোট লেখায় ইসলামের কল্যাণমুখী দিকগুলো তুলে ধরতে পারে। ইসলামফোবিয়া বা ভুল প্রচারণা মোকাবিলায় সোশ্যাল মিডিয়াতে শক্তিশালী ‘ফ্যাক্ট-চেকিং’ টিম থাকতে পারে, যারা গুজব বা উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার খণ্ডন করবে। এবং এগুলোর ব্যাপক ব্যবহার এবং প্রচার থাকতে হবে। অনলাইনে ইসলামের ইতিহাস, বিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদির ওপর কোর্স বা লাইভ সেমিনার চালু করা যেতে পারে। ইসলামপন্থীরা ‘ইসলামিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ বা ডিজিটাল শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম গড়তে পারেন।
৪. মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিরোধঃ
ইসলামফোবিয়া এবং মুসলিম বিরোধী প্রচারণা মোকাবিলার জন্য ইসলামপন্থীদের কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে হবে। মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ তৈরি করতে হবে এবং সত্যের প্রচার নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে তারা মিথ্যা প্রচারণার শিকার না হয়। এর জন্যে সোশ্যাল মিডিয়াতে আরও বেশি উপস্থিতি থাকতে হবে, ইনশাআল্লাহ্। ইসলামপন্থীদের দরকার শক্তিশালী গবেষণা দল, যারা তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করবেন। এতে মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়ে উত্তর দেওয়া সম্ভব হবে।
পৃথিবীর বর্তমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতিতে লিবারেলদের পতন এবং ডানপন্থীদের উত্থান আমাদের জন্য একটি বড় শিক্ষা। এটি দেখায় যে, মানুষ সেই নেতাদের পছন্দ করে, যারা তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা এবং আবেগ বুঝতে পারে এবং বাস্তবসম্মত সমাধান দিতে পারে। লিবারেলদের পতনের প্রধান কারণ হলো তাদের কথা এবং কাজের মধ্যে মিল না থাকা এবং আদর্শিক চিন্তাধারা বাস্তবতার সাথে না মিলানো। অন্যদিকে, ডানপন্থীরা মানুষের বাস্তব সমস্যা, আবেগ এবং স্থানীয় চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের রাজনৈতিক শক্তি বাড়িয়েছে।
ইসলামপন্থীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। মুসলমানদের নেতৃত্বকে অবশ্যই মানুষের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিতে হবে, আবেগ এবং বাস্তবতার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে এবং মানুষের সাথে কার্যকর সংযোগ স্থাপন করতে হবে। শুধুমাত্র ধর্মীয় আদর্শ প্রচার করা নয়, বরং মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান এবং উন্নয়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া মাধ্যমেই মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব শক্তিশালী হতে পারে।
এটি মনে রাখা জরুরি যে, মানুষ তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদা, নিরাপত্তা, এবং ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চায়। মানুষ তার মৌলিক চাহিদা ও নিরাপত্তা খোঁজে, নেতৃত্ব কেবল তাত্ত্বিক হলেই হবে না। নেতৃত্ব কেবল তাত্ত্বিক নীতি নয়; বরং মানুষের চাহিদা, আবেগ এবং সামাজিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করতে হবে।
এ ব্যাপারে শাইখ আবু মুস/আব আস-সু/রী (ফাক্কাল্লাহু আসরাহ) একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন, যার ব্যাপারে আমরা অনেকে উদাসীন থাকি। কথাটা ভাল ভাবে আমাদের অনুধাবন করা উচিৎ। শাইখ বলেন-
الناس صحيح بَايعوا على الموت وعلى السمع والطاعة وعلى غيره ولكن الإنسان عندما يجوع ويجد إمرأته جائعة وولده مقتول فحتى لو أراد لن يستطيع أن يفكر بصورة صائبة، ولن يستطيع أن يجاهد بصورة صائبة، وسيعيد حسابَته مرة وأخرى ويقول لك "أنت لم تحمن، أنا أريد أن آكل قبل أن أجاهد"
এটা ঠিক যে, মানুষ আপনাকে বায়া-ত দিয়েছে মৃত্যুর উপর, শ্রবণ-আনুগত্যের উপর, আরও অন্য কিছুর উপর। কিন্তু মানুষ যখন ক্ষুধার্ত হবে, নিজ স্ত্রীকে ক্ষুধার্ত পাবে, সন্তানকে নিহত দেখবে, তখন সে চাইলেও সঠিক ভাবে চিন্তা করতে পারবে না, সঠিক ভাবে জিহা -দ করতে পারবে না। সে তার হিসাব বার বার কষবে। আপনাকে বলবে, আপনি আমাকে রক্ষা করছেন না, আমি জিহা -দের আগে খেতে চাই ......
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, ডানপন্থীরা বামপন্থীদের মতই আমাদের শত্রু। আমাদের দাওয়াতে উভয় দলকেই রদ করতে হবে। উভয় দলই চরমপন্থি, আর ইসলাম হচ্ছে মধ্যমপন্থা। ইসলামকে সঠিকভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করলে বাম ও ডান-উভয় পন্থাই মুখ থুবড়ে পড়বে, ইনশাআল্লাহ। সামনে কোন দিন সম্ভব হলে ডানপন্থীদের রদ করার উপর লেখার ইচ্ছা রইলো। ওয়া মা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ।
Comment