|| আসিফা বানু: ঝরে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত এক ফুলের নাম ||
এক.
কাশ্মীরের এক ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম রসানা। সবুজ বনানী আর পাখির কলতানে মুখরিত এই গ্রামের প্রতিটি কোণ ছিল স্বর্গের মতো। এই গ্রামেই বসবাস করত ছোট্ট আসিফা বানু। বয়স মাত্র আট বছর। তার বড় বড় চোখে ছিল কৌতূহলের দীপ্তি, আর হৃদয়ে ছিল পৃথিবীজোড়া ভালোবাসা। সে ঘোড়ায় চড়তে ভালোবাসত, পাহাড়ি ছাগলগুলোকে পাহারা দিত আর প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখত অজানা, রঙিন এক জগতের।
১০ জানুয়ারি ২০১৮, বুধবার। সেদিনও অন্য দিনের মতো শুরু হয়েছিল। আসিফা তার প্রিয় ঘোড়াটিকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। কিন্তু সেদিন ছিল ভিন্ন—পাহাড়ের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ছিল অন্ধকার। কয়েকজন দানব, যারা মানুষের চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ওত পেতে ছিল। তাদের মনে করুণা বা দয়া ছিল না, বরং ঘৃণা ও নৃশংসতায় পূর্ণ। প্রভেষ কুমার, সঞ্জি রাম ও তার ভাতিজা আসিফাকে টেনেহিঁচড়ে জঙ্গলের ভিতর নিয়ে যায়। দানবীয় রূপ ধারণ করে সঞ্জি রামের ভাতিজা ঝাপিয়ে পড়ে আসিফার উপর। ধর্ষণের পর তারা আসিফাকে একটি মন্দিরে বন্দি করে রেখে যায়, যেটির দায়িত্বে ছিলো সঞ্জি রাম। যেখানে অন্ধকারের নীচে লুকিয়ে ছিল পৈশাচিক মনোবাসনা।
নিখোঁজ আসিফাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে ছিলেন তার মা-বাবা। তারা কয়েকবার ঐ হিন্দু মন্দিরের পাশদিয়ে যাওয়া-আসাও করেন। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি যে তাদের শিশুকন্যাকে ধর্মীয় উপাসনালয়ে আটকে রেখে ভয়ংকর যৌন নির্যাতন করা হতে পারে।
১১ জানুয়ারিতে আসিফাকে কোথাও দেখেছেন কি না সেটি প্রতিবেশী সঞ্জি রামের কাছে জানতে চাইলে সে তাদেরকে পথভ্রান্ত করে ছেড়ে দেয়। ঐদিন সঞ্জি রামের ভাতিজা উত্তরপ্রদেশে থাকা সঞ্জি রামের ছেলেকে কল করে বলে যে, “তুমি যদি কামেরজ্বালা মেটাতে চাও, তবে দ্রুত চলে আসো।”
১২ জানুয়ারি সঞ্জি রামের পুত্র বিশাল রসানা গ্রামে চলে আসে এবং ১৩ জানুয়ারি বিশাল, তার পিতা সঞ্জি রাম, সঞ্জি রামের ভাতিজা ও প্রভেষ কুমার মন্দিরে যায়। সেখানে বিশাল ও সঞ্জি রামের ভাতিজা আসিফাকে পালাক্রমে পুরোদিন ধর্ষণ করতে থাকে।
ভোরের সূর্য উঠে অস্ত যাওয়ার পথে। কিন্তু দানবদের নৃশংসতা থামার কোনো নামগন্ধ নেই।
কিছুক্ষণ পর সঞ্জি রাম বললো, “এখন ওকে হত্যার সময় হয়েগেছে।” ওরা আসিফার নিথর দেহটি একটি কালভার্টে নিয়ে গেলো। সেখানে সঞ্জি রামের সঙ্গী পুলিশ অফিসার দ্বীপাক খাজুরিয়া উপস্থিত হলে সেও আসিফাকে শেষবারের মতো ধর্ষণের আকাঙ্ক্ষা ব্যাক্ত করে।
দ্বীপাকের পৈশাচিকতা শেষ হতে না হতেই ঝাপিয়ে পড়লো সঞ্জি রামের ভাতিজা। ভয়াবহ এই গণধর্ষণের পর সঞ্জি রামের ভাতিজা ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে আসিফাকে হত্যা করে।
গ্রাম থেকে প্রায় এক-কিলোমিটার দূরে জঙ্গলে পড়ে রইলো কাঁটাহীন একটি ছোট্ট ফুলের ছিন্নভিন্ন নিস্তেজ দেহ।
দুই.
১০ জানুয়ারি নিখোঁজ হওয়ার পর ১২ জানুয়ারি আসিফার পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। কিন্তু তার বাবার মতে পুলিশ সাহায্য করেনি। উল্টো একজন পুলিশ অফিসার ৮ বছরের শিশুর ব্যাপারে ঠাট্টা করে বলেছিলো, আসিফা নিশ্চয় কোনো ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে।
পাঁচ দিন পর ১৭ জানুয়ারি অবশেষে আসিফার মৃতদেহ স্থানীয় লোকজন খুঁজে পায়। হাড়গোড় ভাঙ্গা, ক্ষতবিক্ষত, রক্তে ঢাকা ছোট্ট একটি লাশ। আসিফার মা রাজিফা, যিনি তার মেয়েকে দেখতে জঙ্গলে ছুটে এসেছিলেন, তিনি বলেন যে, "তাকে (আসিফাকে) নির্যাতন করা হয়েছিলো, তার পা দুটি ভাঙা ছিলো,... তার নখ কালো হয়ে গিয়েছিলো এবং তার হাত ও আঙ্গুলে নীল ও কালো দাগ ছিলো।”
ঐ দিনই আসিফার ময়নাতদন্ত করা হয়। অটোপসি রিপোর্ট অনুযায়ী আসিফাকে ধর্ষণ ও হত্যার পূর্বে ডোপিং পদার্থ (যা শরীরের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়) ও সেডেটিভ ট্যাবলেট (যা স্নায়ু শান্ত করে এবং ঘুম আনতে সাহায্য করে) খাওয়ানো হয়েছিলো। এমনকি আসিফাকে অভুক্ত রেখে ৪ দিন ধরে টানা গণ-ধর্ষণ করা হয়।
যখন আসিফার মৃতদেহ প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিলো, তখন ধরে নেয়া হয়েছিলো যে এটি যৌন সহিংসতার আরেকটি ঘটনা যা ভারতে নিয়মিতই ঘটে। সম্ভবত যৌন শিকারীরা এখন ভারতীয় উপনিবেশিত কাশ্মীরেও চলে এসেছে। যদিও গত তিন দশক ধরে কাশ্মীরি নারী ও মেয়েরা ধর্ষিত হয়ে আসতেছে উপনিবেশিক সেনাবাহিনীর হাতে।
আসিফার লাশ পাওয়ার পরবর্তী তিন মাস ধরে পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ ঘটনাটি তদন্ত করে এবং গভীর এক বর্বর চক্রান্তের ঘনকালো অধ্যায় আবিষ্কার করে।
ক্রাইম ব্রাঞ্চের তদন্তের ১৬ পৃষ্ঠার চার্জশিট থেকে জানা যায় যে এটি ভারতের নিয়মিত আর দশটি ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার মতো নয়। বরং আসিফার অপহরণ, গণধর্ষণ ও হত্যা ছিলো পূর্বপরিকল্পিত। সঞ্জি রাম নামের উগ্র হিন্দুত্ববাদী লোকটি কাশ্মীরের বৃহৎ মুসলিম গোত্রগুলোর একটি- বাকরওয়াল সম্প্রদায়ের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করতো। এই জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয়ে তার সহযোগীদের সাথে মিলে সঞ্জি রাম ভীতি সৃষ্টি করে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে হিন্দু প্রধান গ্রাম থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলো।
তিন.
আসিফার ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েকদিনের মাথায় হিন্দু-জাতীয়তাবাদীরা "হিন্দু একতা মঞ্চ" গঠন করে, যার প্রথম সমাবেশটি ১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। এটি নেতৃত্ব দেয় বিজয় শর্মা, যে একসময় "রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (rss)" এর সদস্য ছিলো। সেই সমাবেশে তারা "ভারত মাতা কি জয়" স্লোগান দিয়ে, ভারতীয় ত্রিরঙা পতাকা হাতে নিয়ে ধর্ষকদের পক্ষে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে আরেকটি সমাবেশে কাশ্মীরের আসিফা বানুর বাকরওয়াল মুসলিম সম্প্রদায়কে বয়কটের আহ্বান জানানো হয়। যেখানে স্থানীয় বিজেপির মন্ত্রী রশপাল ভার্মা, বিধায়ক কুলদীপ ভার্মা এবং এক স্থানীয় কংগ্রেস নেতা উপস্থিত ছিলো।
ধর্ষকদের পক্ষে আয়োজন করা অন্য আরেকটি সমাবেশে বিজেপির সাবেক দুই মন্ত্রী- লাল সিং ও চন্দ্র প্রকাশ অংশগ্রহণ করে। লাল সিং আসিফার ব্যাপারে বলে যে, “তো কি হয়েছে যে ঐ মেয়েটি মরেছে, অনেক মেয়েই প্রতিদিন মরে।"
অন্যদিকে, জম্মু বার অ্যাসোসিয়েশনের হিন্দু আইনজীবীরা স্থানীয় আদালতের প্রবেশপথ অবরোধ করে দেয়, যাতে পুলিশ অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করতে না পারে।
হিন্দুত্ববাদীরা নরেন্দ্র মোদির বিজেপির আশীর্বাদ পেয়ে এতোটাই উগ্র হয়ে উঠেছে যে, আসিফা বানুর পরিবারের পক্ষের আইনজীবী দীপিকা রাজাওয়াতকে তারা ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেয়।
এতকিছুর পরও বাস্তবতা হলো, সঞ্জি রাম ও তার হিন্দু সঙ্গীরা নিজেদের জঘন্য সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য সাধনে সফল হয়েছে। অনেক মুসলিম পরিবারই নিজেদের মেয়েদের নিরাপত্তার ভয়ে আসিফার ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর কাশ্মীরের গ্রামটি ছেড়ে চলে যায়। আসিফার পরিবারটিও এর ব্যাতিক্রম নয়। এখন তারা গ্রাম থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের মধ্যে খোলা আকাশের নীচে থাকেন।
আসিফার মৃতদেহ পাওয়ার পর হিন্দুত্ববাদীরা তার পরিবারকে এসে হুমকি দিয়েছিলো, যদি তাদের লোকদের (ধর্ষকদের) ফাঁসি হয়, তাহলে পরিবারের সবাইকে এক এক করে হত্যা করবে।
উগ্র হিন্দু সন্ত্রাসীরা এতোটা নিচে নেমেছিলো যে আসিফার মৃতদেহ তার নিজের গ্রামে দাফন পর্যন্ত করতে দেয়নি।
চার.
৮ বছর বয়সী ছোট্ট আসিফার ধর্ষণ ও হত্যা যুদ্ধ ও সংঘাতের অস্ত্র হিসেবে নারীদের দেহ ব্যাবহারের প্রতীক। মুসলিম বাকরওয়াল সম্প্রদায়কে শিক্ষা দিতে এবং তাদেরকে গ্রাম ছেড়ে যেতে বাধ্য করতে আসিফাকে ধর্ষণের পথ বেছে নিয়েছিলো সঞ্জি রামের মতো হিন্দুত্ববাদীরা।
নিষ্পাপ একটি শিশুর ধর্ষকদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে হিন্দু-জাতীয়তাবাদীরা আরও একবার নিজেদের নগ্ন হিংস্রতার প্রকাশ ঘটালো।
আসিফা হয়তো আর নেই, কিন্তু তার স্মৃতি, তার গল্প, তার আকাশে ছড়ানো কষ্টের রং রয়ে গেছে প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ে। আসিফা এক ঝরে যাওয়া ফুল, তবে তার সুবাস আমাদের বিবেককে জাগিয়ে রেখেছে—যতদিন না সব ফুলের জন্য পৃথিবী নিরাপদ হয়।
[কালেক্টেড]
Comment