এক মুসলিম রোহিঙ্গা মায়ের সমুদ্রযাত্রার করুণ কাহিনী
এক সন্তান কাঁখে, আরেকটি পিঠে, অন্যটি হাতে। ওদের নিয়ে মা কোমর পানিতে। এভাবে বঙ্গোপসাগর লাগোয়া এক ম্যানগ্রোভ জলাশয়ের পানি ভেঙে তিন সন্তানকে নিয়ে মা এগিয়ে যাচ্ছেন একটি নৌকার দিকে। গোধূলির আলোতে দুলছে সেই নৌকা। এই দুলুনি মায়ের মনেও নাড়া দেয়। যাবেন কি যাবেন না, মন বদলের এটাই সময়। এই পরিস্থিতিতে যিনি পড়েন তিনি ৩৩ বছর বয়সী এ মুসলিম রোহিঙ্গা নারী। নাম হাসিনা ইজহার। নিজ দেশে পরবাসী তারা। কোথায় ঠাঁই নেবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই দোলাচলে খাবি খেতে খেতে এই মা ভাগ্য বদলে মালয়েশিয়া পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভরসা কেবল একটি মাছ ধরার নৌকা। ছোট তিন সন্তানকে নিয়ে যখন বাড়ি থেকে হাসিনা বের হচ্ছিলেন, এ সময় তার ১৩ বছরের বড় সন্তান জুবায়ের রয়েছে পাশের গ্রামে, এক বন্ধুর বাড়িতে। ওকে ওভাবে রেখেই বাড়ি ছাড়েন তিনি। আসলে হঠাৎ করেই হাসিনার কাছে খবর আসে নৌকা এসে গেছে, মালয়েশিয়া যেতে চাইলে এখনই সময়। চটজলদি ছেলেমেয়েদের কিছু কাপড় পুঁটলিতে নিয়ে নেন তিনি। সাগরে তেষ্টা মেটাতে প্লাস্টিকের তিনটি বোতলে নিয়েছেন পানি। এই তার প্রস্তুতি। হাসিনাদের নিয়ে নৌকাটি যতো দূরে যাচ্ছে তার মনের ভেতর ঝড়ের ঝাপটা ততো বেশি লাগছে। তিনি আসলে কী করতে যাচ্ছেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কাই বেশি কাজ করছিল। ফেলে আসা বড় ছেলের জন্য তার বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল তার। মনে হচ্ছিল একবার যদি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারতেন, দেশ ছেড়ে যাওয়ার কারণটা বুঝিয়ে বলতে পারতেন। এ ব্যাপারে হাসিনা বলেন, যদি বেঁচে থাকি তাহলে আমি ওকে মালয়েশিয়া নিয়ে আসব। ছেলেকে ফেলে আসায় আমার মন ভেঙে গেছে। ছোট তিন সন্তানকে সঙ্গে আনতে দালালের হাতে দিতে হয়েছে দুই হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। বাড়িঘর বেচে এই টাকা জোগাড় করেন হাসিনা। জুবায়েরকে আনতে গেলে এর দ্বিগুণ গুনতে হতো। কিন্তু হাতে ছিল আর মাত্র ৫০০ ডলার। মিয়ানমার ছেড়ে যাওয়ার কারণ বলতে গিয়ে হাসিনা বলেন, এখানে থাকব কেমন করে? ছেলে-বুড়ো সবাইকে রোজ রাতে মেয়েদের আগলে রাখতে পাহারা দিতে হয়। সব মেয়েই মালয়েশিয়া যাচ্ছে। তাই আমিও যাই।মিয়ানমারে বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের শিকার হয়ে দুই বছর আগে লাখো মানুষের সঙ্গে তার স্বামী মালয়েশিয়া চলে যান। এবার সেই পথে হাসিনা। তবে স্বামী জানেন না। সমুদ্রপথে যাত্রার প্রায় এক সপ্তাহ পর অনেকের সঙ্গে হাসিনাকে তুলে দেওয়া হয় একটি বড় জাহাজে। এর পরই শুরু হয় দালালদের তা-ব। তারা অভিবাসন-প্রত্যাশীদের স্বজনদের কাছে ফোনে মুক্তিপণ দাবি করে। হাসিনার স্বামীকে ফোন দেওয়া হয়। তখন তার স্বামী রহমান প্রথম জানতে পারেন স্ত্রীর দেশ ছাড়ার খবর। এতে তিনি স্ত্রীর ওপর রাগ করেন। পরে আপসরফায় দালালদের সঙ্গে দর-কষাকষি চলে। কয়েক দিন পর এক হাজার ৭০০ ডলারে ছাড়া পান তারা। এ অর্থ জোগাতে রহমানকে বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনদের কাছে ধারদেনা করতে হয়। রহমান বলেন, আমি কাঁদতে কাঁদতে তাদের পা ধরেছি। বলেছি, আমার সন্তানদের কথা ভেবে আমাকে সাহায্য করেন। আমি এ অর্থ শোধ করে দেব। যদি না পারি তাহলে আপনাদের গোলাম হয়ে থাকব। এক মাসেরও বেশি সময় পর হাসিনা তার সন্তানদের নিয়ে মালয়েশিয়ায় পৌঁছান। সেখানে স্বামী তাদের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু বড় ছেলে জুবায়েরকে না পেয়ে রহমানের ক্ষোভ জানান। পেনাং শহরের গেলুগরে এখন আরও ১৩ জনের সঙ্গে একটি বাড়িতে থাকছে এই পরিবার। রহমান নির্মাণশ্রমিক। বেশির ভাগ দিনই তাঁর কাজ জোটে না। দিনটা ভালো গেলে কিছু জোটে। এরই মধ্যে বাকি পড়েছে তিন মাসের ঘর ভাড়া। তার ওপর রয়েছে বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনদের কাছ থেকে এক হাজার ডলারের ঋণের বোঝাও। এদিকে মা চলে যাওয়ার পর জুবায়ের হয়ে যায় ঠিকানাবিহীন। মা কেন তাকে ছেড়ে চলে গেছেন তখনো সে জানে না। জুবায়ের বলে, মা আমার খোঁজও করেনি। কিছু বলেনি। আমি তখন আরেকজনের বাড়িতে ছিলাম। গত মে মাসে স্থানীয় একটি মুদি দোকানে বসে ছিল জুবায়ের। চিংড়ি ব্যবসায়ী সালিমউল্লাহ তাকে দেখে নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে। তাকে অল্প বেতনে পানি আনার কাজ দেন। সালিমউল্লাহর কথা, যতো দিন খুশি জুবায়ের এখানে থাকতে পারবে। হাসিনা চলে গেলেও জুবায়েরের সঙ্গে এর মধ্যে তার কথা হয়েছে কয়েকবার।
সুত্রঃ
এক সন্তান কাঁখে, আরেকটি পিঠে, অন্যটি হাতে। ওদের নিয়ে মা কোমর পানিতে। এভাবে বঙ্গোপসাগর লাগোয়া এক ম্যানগ্রোভ জলাশয়ের পানি ভেঙে তিন সন্তানকে নিয়ে মা এগিয়ে যাচ্ছেন একটি নৌকার দিকে। গোধূলির আলোতে দুলছে সেই নৌকা। এই দুলুনি মায়ের মনেও নাড়া দেয়। যাবেন কি যাবেন না, মন বদলের এটাই সময়। এই পরিস্থিতিতে যিনি পড়েন তিনি ৩৩ বছর বয়সী এ মুসলিম রোহিঙ্গা নারী। নাম হাসিনা ইজহার। নিজ দেশে পরবাসী তারা। কোথায় ঠাঁই নেবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই দোলাচলে খাবি খেতে খেতে এই মা ভাগ্য বদলে মালয়েশিয়া পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভরসা কেবল একটি মাছ ধরার নৌকা। ছোট তিন সন্তানকে নিয়ে যখন বাড়ি থেকে হাসিনা বের হচ্ছিলেন, এ সময় তার ১৩ বছরের বড় সন্তান জুবায়ের রয়েছে পাশের গ্রামে, এক বন্ধুর বাড়িতে। ওকে ওভাবে রেখেই বাড়ি ছাড়েন তিনি। আসলে হঠাৎ করেই হাসিনার কাছে খবর আসে নৌকা এসে গেছে, মালয়েশিয়া যেতে চাইলে এখনই সময়। চটজলদি ছেলেমেয়েদের কিছু কাপড় পুঁটলিতে নিয়ে নেন তিনি। সাগরে তেষ্টা মেটাতে প্লাস্টিকের তিনটি বোতলে নিয়েছেন পানি। এই তার প্রস্তুতি। হাসিনাদের নিয়ে নৌকাটি যতো দূরে যাচ্ছে তার মনের ভেতর ঝড়ের ঝাপটা ততো বেশি লাগছে। তিনি আসলে কী করতে যাচ্ছেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কাই বেশি কাজ করছিল। ফেলে আসা বড় ছেলের জন্য তার বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল তার। মনে হচ্ছিল একবার যদি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারতেন, দেশ ছেড়ে যাওয়ার কারণটা বুঝিয়ে বলতে পারতেন। এ ব্যাপারে হাসিনা বলেন, যদি বেঁচে থাকি তাহলে আমি ওকে মালয়েশিয়া নিয়ে আসব। ছেলেকে ফেলে আসায় আমার মন ভেঙে গেছে। ছোট তিন সন্তানকে সঙ্গে আনতে দালালের হাতে দিতে হয়েছে দুই হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। বাড়িঘর বেচে এই টাকা জোগাড় করেন হাসিনা। জুবায়েরকে আনতে গেলে এর দ্বিগুণ গুনতে হতো। কিন্তু হাতে ছিল আর মাত্র ৫০০ ডলার। মিয়ানমার ছেড়ে যাওয়ার কারণ বলতে গিয়ে হাসিনা বলেন, এখানে থাকব কেমন করে? ছেলে-বুড়ো সবাইকে রোজ রাতে মেয়েদের আগলে রাখতে পাহারা দিতে হয়। সব মেয়েই মালয়েশিয়া যাচ্ছে। তাই আমিও যাই।মিয়ানমারে বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের শিকার হয়ে দুই বছর আগে লাখো মানুষের সঙ্গে তার স্বামী মালয়েশিয়া চলে যান। এবার সেই পথে হাসিনা। তবে স্বামী জানেন না। সমুদ্রপথে যাত্রার প্রায় এক সপ্তাহ পর অনেকের সঙ্গে হাসিনাকে তুলে দেওয়া হয় একটি বড় জাহাজে। এর পরই শুরু হয় দালালদের তা-ব। তারা অভিবাসন-প্রত্যাশীদের স্বজনদের কাছে ফোনে মুক্তিপণ দাবি করে। হাসিনার স্বামীকে ফোন দেওয়া হয়। তখন তার স্বামী রহমান প্রথম জানতে পারেন স্ত্রীর দেশ ছাড়ার খবর। এতে তিনি স্ত্রীর ওপর রাগ করেন। পরে আপসরফায় দালালদের সঙ্গে দর-কষাকষি চলে। কয়েক দিন পর এক হাজার ৭০০ ডলারে ছাড়া পান তারা। এ অর্থ জোগাতে রহমানকে বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনদের কাছে ধারদেনা করতে হয়। রহমান বলেন, আমি কাঁদতে কাঁদতে তাদের পা ধরেছি। বলেছি, আমার সন্তানদের কথা ভেবে আমাকে সাহায্য করেন। আমি এ অর্থ শোধ করে দেব। যদি না পারি তাহলে আপনাদের গোলাম হয়ে থাকব। এক মাসেরও বেশি সময় পর হাসিনা তার সন্তানদের নিয়ে মালয়েশিয়ায় পৌঁছান। সেখানে স্বামী তাদের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু বড় ছেলে জুবায়েরকে না পেয়ে রহমানের ক্ষোভ জানান। পেনাং শহরের গেলুগরে এখন আরও ১৩ জনের সঙ্গে একটি বাড়িতে থাকছে এই পরিবার। রহমান নির্মাণশ্রমিক। বেশির ভাগ দিনই তাঁর কাজ জোটে না। দিনটা ভালো গেলে কিছু জোটে। এরই মধ্যে বাকি পড়েছে তিন মাসের ঘর ভাড়া। তার ওপর রয়েছে বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনদের কাছ থেকে এক হাজার ডলারের ঋণের বোঝাও। এদিকে মা চলে যাওয়ার পর জুবায়ের হয়ে যায় ঠিকানাবিহীন। মা কেন তাকে ছেড়ে চলে গেছেন তখনো সে জানে না। জুবায়ের বলে, মা আমার খোঁজও করেনি। কিছু বলেনি। আমি তখন আরেকজনের বাড়িতে ছিলাম। গত মে মাসে স্থানীয় একটি মুদি দোকানে বসে ছিল জুবায়ের। চিংড়ি ব্যবসায়ী সালিমউল্লাহ তাকে দেখে নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে। তাকে অল্প বেতনে পানি আনার কাজ দেন। সালিমউল্লাহর কথা, যতো দিন খুশি জুবায়ের এখানে থাকতে পারবে। হাসিনা চলে গেলেও জুবায়েরের সঙ্গে এর মধ্যে তার কথা হয়েছে কয়েকবার।
সুত্রঃ
Comment