১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটন বলেছিলেন, পাকিস্তান ২৪ বছরও টিকবে না। পক্ষান্তরে স্বাধীন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও এর প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, পাকিস্তান হ্যাজ কাম টু স্টে’। লর্ড মাউন্ট ব্যাটনের ভবিষ্যদ্বাণী আংশিক সত্য প্রমাণ হয়েছে। ১৯৪৭ সালের পূর্ণাঙ্গ পাকিস্তান আজ আর নেই।
রক্তক্ষয়ী দেশ ভাগের পর বছর না যেতেই কাশ্মির প্রশ্নে ১৯৪৮ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধে। সেই যুদ্ধ আজো থেমে থেমে চলছে। এরই রেশ ধরে ১৯৭১ সালে অনুকূল রাজনৈতিক বাতাবরণে ভারত পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। ভারত বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। ভারতের সশস্ত্র সহযোগিতা না পেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিফলও হতে পারত কিংবা সে সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হতো এবং অধিক লোক ক্ষয় হতো। তবে এ জন্য বাংলাদেশকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ইউরোপের একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরি। সে সময়ে ফ্রান্সের মাটি থেকে জার্মান সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ফ্রান্সকে সহায়তা করেছিল। এ কারণে ব্রিটিশরা ফরাসিদের প্রতি উন্নাসিক আচরণ করত। যেটা ফরাসি সেনাপ্রধান ও পরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গলের আত্মসম্মানে বাধে। যে কারণে, তিনি যত দিন জীবিত ছিলেন তত দিন ব্রিটিশদের সম্মানের চোখে দেখেননি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। এ জাতীয় উপকারের জন্য বাংলাদেশীরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম পর্যায়েই ভারতকে বেরুবাড়ি ইউনিয়নটি হস্তান্তর করতে হয়েছে। ভারতের সংবিধানের আদলে বাংলাদেশের একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে হয়েছে। এই সংবিধানে ভারতের অসাম্প্রদায়িক নীতিটি অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়ার মদদে বলীয়ান হয়ে ভারত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল বলে সমাজতন্ত্র নীতিটি সংবিধানে সন্নিবেসিত করতে হয়েছে। যদিও যে ৬ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য এ যুদ্ধ, তাতে এ দু’টি মূল নীতির কথা উল্লেখ ছিল না। এর ফল হয়েছে, আজ বাংলাদেশ থেকে ইসলামি রীতিনীতি বিলুপ্ত হতে চলেছে। কারণ, সরকারিপর্যায় থেকে ইসলামি রীতিনীতির প্রতি সমর্থন নেই।
অমুসলিমদের আচার-আচরণ ও রীতিনীতি গণমাধ্যমে দেদারছে প্রচারিত হচ্ছে। ইসলামচর্চা মাদরাসার মধ্যে সীমিত রাখা হচ্ছে। দেশের সার্বিক জনগণের জীবনাচরণে ধর্মের তেমন কোনো প্রতিফলন নেই এবং এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও নেই। এ ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন তুললে তাকে মৌলবাদী বলে আখ্যায়িত ও নিন্দিত করা হয়। মোট কথা, জনজীবনে যেটুকুই ধর্মচর্চা আছে, তা বহুলাংশেই লোক দেখানো এবং ইহজাগতিক কল্যাণ লাভের জন্য এবং পারলৌকিক কল্যাণ কামনা এর মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। যে কারণে, দেশে খুন-গুম-ধর্ষণ-ব্যভিচার-মাদক সেবনের মতো অন-ইসলামিক কার্যকলাপ ব্যাপকহারে বেড়েছে। ধর্মীয় নীতি-বিধান সাধারণত এসব অপকর্ম থেকে একটি জাতিকে বিরত রাখে যা, বহুলাংশেই বাংলাদেশে পালিত হয় না। অথচ বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ যার জনসংখ্যার ৯২ শতাংশ মুসলমান।
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ বড় বেকায়দায়। জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত ক্ষুদ্র এই দেশটি তিন দিক থেকে ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত; আংশিক মিয়ানমার দিয়ে। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। সামরিক শক্তির বিবেচনায় ভারত বাংলাদেশ থেকে বহুগুণ এগিয়ে। বাংলাদেশের অসুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান ও সামরিক শক্তির পশ্চাদপদতার সুযোগটি ভারত প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে নেয়। উপরন্তু, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সশস্ত্র সহায়তা বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বিপজ্জনকভাবে সীমাবদ্ধতায় ফেলে রেখেছে। যে কারণে পাকিস্তানসহ অপরাপর মুসলিম দেশ ও ভারতের সাথে বৈরীভাব আছে এমন সব দেশের সাথে বাংলাদেশকে স্বাধীনভাবে সম্পর্ক স্থাপন ও সম্পর্ক উন্নয়ন করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় এবং বাংলাদেশের পক্ষে এ কাজটি প্রায় অসম্ভব। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বহির্বিশ্বে ভারতের একটি আলাদা ইমেজ আছে, যেটা বাংলাদেশের নেই। যদিও ক্ষুদ্রায়তন ব্রিটেনের সেটা আছে।
এ কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের একটি মর্যাদাপূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা আছে। উপরন্তু বিশ্বের মুসলিমঅধ্যুষিত দেশগুলো নয়-এগারোর পর থেকে এমনিতেই নানাভাবে হেনস্তা হচ্ছে। এসব মিলিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে অর্থনৈতিকভাবে গরিব জনবহুল বাংলাদেশের অবস্থান বড় নাজুক এবং উপেক্ষণীয় না হলেও বেশ রকম পশ্চাতপদ। ভারতের মুখামুখি বাংলাদেশের এ জাতীয় নেতিবাচক অবস্থানের কারণে ভারত বাংলাদেশকে সবসময় চাপে রাখার চেষ্টা করে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগের সুবিধার্থে বাংলাদেশকে দিল্লির বড় প্রয়োজন। যে কারণে বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে ভারত সদা ততপর। এই লক্ষ্যে ভারত সফলও হয়েছে। বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে জেগে উঠা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে যেকোনো দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনোমতেই তার ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ দেবে না। এ লক্ষ্যে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিষ্ক্রিয় করতে বাংলাদেশ যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে ভারতকে সহায়তাও করেছে।
বাংলাদেশ ভারতকে তার ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে ট্রানজিট দিয়েছে। ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারতে আশ্রয় নেয়া ভারতের সংখ্যাগুরু ধর্মালম্বীদের যথাযথা নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে যাবতীয় নাগরিক অধিকারসহ সম্মানজনক জীবনযাপনের সুযোগ করে দিয়েছে। শেখ মুজিব বলেছিলেন, এ দেশকে কারো বাজার হতে দেবো না। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সব দেশেরই বাজার; বিশেষ করে ভারতের কালো ও সাদা উভয় বাজার। যে কারণে বাংলাদেশে টেকসই কৃষি ও শিল্প গড়ে তোলা আজ দুরূহ কাজ। বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ভারতে প্রবেশাধিকার পায় না। পক্ষান্তরে ভারতের হেন চ্যানেল নেই যা বাংলাদেশে দেখানো হয় না। বাংলাদেশী চ্যানেলগুলো ভারতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনে সয়লাব; অধিকন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিক্রয়যোগ্য পণ্যসামগ্রীর বিজ্ঞাপনে ভারতীয় মডেলের ব্যবহার দেদার। বাংলাদেশে ভারতীয় সংস্কৃতির অবাধ বিস্তার ঘটছে। আমরা উর্দুকে নাকচ করেছিলাম। এখন আমাদের ছেলেমেয়েরা হিন্দি শিখছে।
সম্প্রতি ভারত আসাম থেকে প্রায় ৪০ লাখ মুসলমানকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। ভারত যুক্তি দেখিয়েছেÑ ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান, যাদের মিয়ানমার সেনাবাহিনী উতপীড়ন করে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে তাদের যদি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ বাংলাদেশ নিতে পারে তবে আসামের ’অবৈধ নাগরিক’ মুসলমানদের বাংলাদেশ ফেরত নেবে না কেন? রোহিঙ্গাদের প্রতি নির্মম আচরণ করে নিজ দেশ ত্যাগে বাধ্য করায় সারা বিশ্ব যেখানে মিয়ানমারের নিন্দা করছে, সেখানে আসামের ৪০ লাখ মুসলমান নাগরিককে বাংলাদেশে পাঠানোর এ যুক্তি মর্মান্তিক। কোনো সভ্য দেশ এ প্রশ্ন তুলতে পারে না। এ ছাড়া ভারতে বসবাসরত মিয়ানমারের নাগরিক ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে নয়; বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায় ভারত। বাংলাদেশ থেকে আরো বিশেষ সুবিধা হাসিল করার ভারতের এটি একটি কঠিন চাল ও চাপ। রোহিঙ্গা প্রশ্নে গোড়া থেকেই ভারত মিয়ানমারের পক্ষে।
কারণ, রোহিঙ্গারা মুসলমান। বাংলাদেশ নিজেকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র দাবি করে এর অমুসলিম নাগরিকদের যতই সুবিধা দিক না কেন; ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ মুসলিম দেশ। বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের দুর্দশার সুযোগটা ভারত নিতে চাচ্ছে। ভারতকে বাংলাদেশ অনেক কিছু দিয়েছে, যার বিনিময়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত সব ক’টি নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশকে একটি মরুভূমি বানানোর পরিকল্পনা করেছে ভারত। বর্ষাকালে সব বাঁধের গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে বানের পানিতে ভাসায়। ভারত কি বন্ধুত্বের ছদ্মাবরণে বাংলাদেশকে গিলে খেতে চায়? সেটাই ভাবার বিষয়।
প্রতিবেশী কোনো দেশের সাথেই ভারতের সম্পর্ক তেমন ভালো নয়; একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া। সব সরকারের আমলেই বাংলাদেশ ভারতের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখতে চায়; বিশেষত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সম্পর্কটা নিবিড়তর হয়। কারণ, তারা ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আওয়ামী লীগের একটা ভয়, ভারতের সাথে সম্পর্ক খারাপ হলে তাদের সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে; অধিকন্তু নিদানকালে তাদের আশ্রয় নেয়ার জায়গা থাকবে না। আরেকটি ভয়, বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান এবং এর পররাষ্ট্রনীতি এতটাই দুর্বল যে ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মার্চ করে গেলেও কেউ এগিয়ে আসবে না; তেমনটা হয়তো হবে না, হলেও জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের পক্ষে রাশিয়ার ভেটোতে তা নাকচ হয়ে যাবে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে বাংলাদেশে পাঠানোর পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এ দুর্বলতাটি বাস্তবে প্রমাণ হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে একটি প্রভাবশালী শ্রেণী আছে, যারা ভারতের প্রতি নানা কারণে বিশেষত, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালে বিশেষভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত। এরা নস্টালজিয়ায় ভোগেন। ভারতের প্রতি তাদের নাড়ির টান এতটাই প্রবল যে, ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলায় ভারত জিতলে তারা স্বস্তি পান। বাংলাদেশের সব দলের নেতাদেরই সময়ে অসময়ে বিশেষত জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলে ভারতে ধরনা দিতে দেখা যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ভারতকে তুষ্ট করার এ প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা স্বাধীন বাংলাদেশের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। এটা যে তারা শখে করেন তা নয়; ভারতের আধিপত্যসুলভ ও উন্নাসিকতার কারণেই করে থাকেন।
আমি এ নিবন্ধটি শেখ সাদীর জীবন থেকে নেয়া একটি ঘটনা বিবৃত করে শেষ করতে চাই। শেখ সাদীর শ্বশুর তার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে দশ দিরহাম দিয়ে তার প্রভুর দাসত্ব থেকে মুক্ত করে তার কন্যার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন শেখ সাদীর স্ত্রী বলে বসলেন ‘তুমি কি সেই নরাধম নও, যাকে আমার পিতা দশ দিরহাম দিয়ে দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছিলেন’? শেখ সাদী হেসে বললেন ’হে সুন্দরী। আমি সেই নরাধম যাকে তোমার পিতা দশ দিরহাম দিয়ে আমার প্রভুর দাসত্ব থেকে মুক্ত করে তোমার দাসত্বে নিযুক্ত করেছেন’। অবস্থাদৃষ্টে ভারতের মুখামুখি বাংলাদেশের অবস্থা সে রকমই মনে হয় না কি?
সুত্রঃ http://m.dailynayadiganta.com/detail/news/351869
রক্তক্ষয়ী দেশ ভাগের পর বছর না যেতেই কাশ্মির প্রশ্নে ১৯৪৮ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধে। সেই যুদ্ধ আজো থেমে থেমে চলছে। এরই রেশ ধরে ১৯৭১ সালে অনুকূল রাজনৈতিক বাতাবরণে ভারত পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। ভারত বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। ভারতের সশস্ত্র সহযোগিতা না পেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিফলও হতে পারত কিংবা সে সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হতো এবং অধিক লোক ক্ষয় হতো। তবে এ জন্য বাংলাদেশকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ইউরোপের একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরি। সে সময়ে ফ্রান্সের মাটি থেকে জার্মান সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ফ্রান্সকে সহায়তা করেছিল। এ কারণে ব্রিটিশরা ফরাসিদের প্রতি উন্নাসিক আচরণ করত। যেটা ফরাসি সেনাপ্রধান ও পরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গলের আত্মসম্মানে বাধে। যে কারণে, তিনি যত দিন জীবিত ছিলেন তত দিন ব্রিটিশদের সম্মানের চোখে দেখেননি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। এ জাতীয় উপকারের জন্য বাংলাদেশীরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম পর্যায়েই ভারতকে বেরুবাড়ি ইউনিয়নটি হস্তান্তর করতে হয়েছে। ভারতের সংবিধানের আদলে বাংলাদেশের একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে হয়েছে। এই সংবিধানে ভারতের অসাম্প্রদায়িক নীতিটি অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়ার মদদে বলীয়ান হয়ে ভারত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল বলে সমাজতন্ত্র নীতিটি সংবিধানে সন্নিবেসিত করতে হয়েছে। যদিও যে ৬ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য এ যুদ্ধ, তাতে এ দু’টি মূল নীতির কথা উল্লেখ ছিল না। এর ফল হয়েছে, আজ বাংলাদেশ থেকে ইসলামি রীতিনীতি বিলুপ্ত হতে চলেছে। কারণ, সরকারিপর্যায় থেকে ইসলামি রীতিনীতির প্রতি সমর্থন নেই।
অমুসলিমদের আচার-আচরণ ও রীতিনীতি গণমাধ্যমে দেদারছে প্রচারিত হচ্ছে। ইসলামচর্চা মাদরাসার মধ্যে সীমিত রাখা হচ্ছে। দেশের সার্বিক জনগণের জীবনাচরণে ধর্মের তেমন কোনো প্রতিফলন নেই এবং এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও নেই। এ ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন তুললে তাকে মৌলবাদী বলে আখ্যায়িত ও নিন্দিত করা হয়। মোট কথা, জনজীবনে যেটুকুই ধর্মচর্চা আছে, তা বহুলাংশেই লোক দেখানো এবং ইহজাগতিক কল্যাণ লাভের জন্য এবং পারলৌকিক কল্যাণ কামনা এর মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। যে কারণে, দেশে খুন-গুম-ধর্ষণ-ব্যভিচার-মাদক সেবনের মতো অন-ইসলামিক কার্যকলাপ ব্যাপকহারে বেড়েছে। ধর্মীয় নীতি-বিধান সাধারণত এসব অপকর্ম থেকে একটি জাতিকে বিরত রাখে যা, বহুলাংশেই বাংলাদেশে পালিত হয় না। অথচ বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ যার জনসংখ্যার ৯২ শতাংশ মুসলমান।
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ বড় বেকায়দায়। জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত ক্ষুদ্র এই দেশটি তিন দিক থেকে ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত; আংশিক মিয়ানমার দিয়ে। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। সামরিক শক্তির বিবেচনায় ভারত বাংলাদেশ থেকে বহুগুণ এগিয়ে। বাংলাদেশের অসুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান ও সামরিক শক্তির পশ্চাদপদতার সুযোগটি ভারত প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে নেয়। উপরন্তু, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সশস্ত্র সহায়তা বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বিপজ্জনকভাবে সীমাবদ্ধতায় ফেলে রেখেছে। যে কারণে পাকিস্তানসহ অপরাপর মুসলিম দেশ ও ভারতের সাথে বৈরীভাব আছে এমন সব দেশের সাথে বাংলাদেশকে স্বাধীনভাবে সম্পর্ক স্থাপন ও সম্পর্ক উন্নয়ন করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় এবং বাংলাদেশের পক্ষে এ কাজটি প্রায় অসম্ভব। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বহির্বিশ্বে ভারতের একটি আলাদা ইমেজ আছে, যেটা বাংলাদেশের নেই। যদিও ক্ষুদ্রায়তন ব্রিটেনের সেটা আছে।
এ কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের একটি মর্যাদাপূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা আছে। উপরন্তু বিশ্বের মুসলিমঅধ্যুষিত দেশগুলো নয়-এগারোর পর থেকে এমনিতেই নানাভাবে হেনস্তা হচ্ছে। এসব মিলিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে অর্থনৈতিকভাবে গরিব জনবহুল বাংলাদেশের অবস্থান বড় নাজুক এবং উপেক্ষণীয় না হলেও বেশ রকম পশ্চাতপদ। ভারতের মুখামুখি বাংলাদেশের এ জাতীয় নেতিবাচক অবস্থানের কারণে ভারত বাংলাদেশকে সবসময় চাপে রাখার চেষ্টা করে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগের সুবিধার্থে বাংলাদেশকে দিল্লির বড় প্রয়োজন। যে কারণে বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে ভারত সদা ততপর। এই লক্ষ্যে ভারত সফলও হয়েছে। বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে জেগে উঠা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে যেকোনো দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনোমতেই তার ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ দেবে না। এ লক্ষ্যে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিষ্ক্রিয় করতে বাংলাদেশ যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে ভারতকে সহায়তাও করেছে।
বাংলাদেশ ভারতকে তার ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে ট্রানজিট দিয়েছে। ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারতে আশ্রয় নেয়া ভারতের সংখ্যাগুরু ধর্মালম্বীদের যথাযথা নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে যাবতীয় নাগরিক অধিকারসহ সম্মানজনক জীবনযাপনের সুযোগ করে দিয়েছে। শেখ মুজিব বলেছিলেন, এ দেশকে কারো বাজার হতে দেবো না। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সব দেশেরই বাজার; বিশেষ করে ভারতের কালো ও সাদা উভয় বাজার। যে কারণে বাংলাদেশে টেকসই কৃষি ও শিল্প গড়ে তোলা আজ দুরূহ কাজ। বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ভারতে প্রবেশাধিকার পায় না। পক্ষান্তরে ভারতের হেন চ্যানেল নেই যা বাংলাদেশে দেখানো হয় না। বাংলাদেশী চ্যানেলগুলো ভারতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনে সয়লাব; অধিকন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিক্রয়যোগ্য পণ্যসামগ্রীর বিজ্ঞাপনে ভারতীয় মডেলের ব্যবহার দেদার। বাংলাদেশে ভারতীয় সংস্কৃতির অবাধ বিস্তার ঘটছে। আমরা উর্দুকে নাকচ করেছিলাম। এখন আমাদের ছেলেমেয়েরা হিন্দি শিখছে।
সম্প্রতি ভারত আসাম থেকে প্রায় ৪০ লাখ মুসলমানকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। ভারত যুক্তি দেখিয়েছেÑ ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান, যাদের মিয়ানমার সেনাবাহিনী উতপীড়ন করে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে তাদের যদি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ বাংলাদেশ নিতে পারে তবে আসামের ’অবৈধ নাগরিক’ মুসলমানদের বাংলাদেশ ফেরত নেবে না কেন? রোহিঙ্গাদের প্রতি নির্মম আচরণ করে নিজ দেশ ত্যাগে বাধ্য করায় সারা বিশ্ব যেখানে মিয়ানমারের নিন্দা করছে, সেখানে আসামের ৪০ লাখ মুসলমান নাগরিককে বাংলাদেশে পাঠানোর এ যুক্তি মর্মান্তিক। কোনো সভ্য দেশ এ প্রশ্ন তুলতে পারে না। এ ছাড়া ভারতে বসবাসরত মিয়ানমারের নাগরিক ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে নয়; বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায় ভারত। বাংলাদেশ থেকে আরো বিশেষ সুবিধা হাসিল করার ভারতের এটি একটি কঠিন চাল ও চাপ। রোহিঙ্গা প্রশ্নে গোড়া থেকেই ভারত মিয়ানমারের পক্ষে।
কারণ, রোহিঙ্গারা মুসলমান। বাংলাদেশ নিজেকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র দাবি করে এর অমুসলিম নাগরিকদের যতই সুবিধা দিক না কেন; ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ মুসলিম দেশ। বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের দুর্দশার সুযোগটা ভারত নিতে চাচ্ছে। ভারতকে বাংলাদেশ অনেক কিছু দিয়েছে, যার বিনিময়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত সব ক’টি নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশকে একটি মরুভূমি বানানোর পরিকল্পনা করেছে ভারত। বর্ষাকালে সব বাঁধের গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে বানের পানিতে ভাসায়। ভারত কি বন্ধুত্বের ছদ্মাবরণে বাংলাদেশকে গিলে খেতে চায়? সেটাই ভাবার বিষয়।
প্রতিবেশী কোনো দেশের সাথেই ভারতের সম্পর্ক তেমন ভালো নয়; একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া। সব সরকারের আমলেই বাংলাদেশ ভারতের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখতে চায়; বিশেষত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সম্পর্কটা নিবিড়তর হয়। কারণ, তারা ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আওয়ামী লীগের একটা ভয়, ভারতের সাথে সম্পর্ক খারাপ হলে তাদের সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে; অধিকন্তু নিদানকালে তাদের আশ্রয় নেয়ার জায়গা থাকবে না। আরেকটি ভয়, বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান এবং এর পররাষ্ট্রনীতি এতটাই দুর্বল যে ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মার্চ করে গেলেও কেউ এগিয়ে আসবে না; তেমনটা হয়তো হবে না, হলেও জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের পক্ষে রাশিয়ার ভেটোতে তা নাকচ হয়ে যাবে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে বাংলাদেশে পাঠানোর পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এ দুর্বলতাটি বাস্তবে প্রমাণ হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে একটি প্রভাবশালী শ্রেণী আছে, যারা ভারতের প্রতি নানা কারণে বিশেষত, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালে বিশেষভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত। এরা নস্টালজিয়ায় ভোগেন। ভারতের প্রতি তাদের নাড়ির টান এতটাই প্রবল যে, ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলায় ভারত জিতলে তারা স্বস্তি পান। বাংলাদেশের সব দলের নেতাদেরই সময়ে অসময়ে বিশেষত জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলে ভারতে ধরনা দিতে দেখা যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ভারতকে তুষ্ট করার এ প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা স্বাধীন বাংলাদেশের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। এটা যে তারা শখে করেন তা নয়; ভারতের আধিপত্যসুলভ ও উন্নাসিকতার কারণেই করে থাকেন।
আমি এ নিবন্ধটি শেখ সাদীর জীবন থেকে নেয়া একটি ঘটনা বিবৃত করে শেষ করতে চাই। শেখ সাদীর শ্বশুর তার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে দশ দিরহাম দিয়ে তার প্রভুর দাসত্ব থেকে মুক্ত করে তার কন্যার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন শেখ সাদীর স্ত্রী বলে বসলেন ‘তুমি কি সেই নরাধম নও, যাকে আমার পিতা দশ দিরহাম দিয়ে দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছিলেন’? শেখ সাদী হেসে বললেন ’হে সুন্দরী। আমি সেই নরাধম যাকে তোমার পিতা দশ দিরহাম দিয়ে আমার প্রভুর দাসত্ব থেকে মুক্ত করে তোমার দাসত্বে নিযুক্ত করেছেন’। অবস্থাদৃষ্টে ভারতের মুখামুখি বাংলাদেশের অবস্থা সে রকমই মনে হয় না কি?
সুত্রঃ http://m.dailynayadiganta.com/detail/news/351869
Comment