বাংলাদেশ ভারত সীমান্তঃমজলুম মুসলিমদের হাহাকার,আর্ত- চিৎকার শুনার জন্য যেন কেও নেই!!-পর্ব-১
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বনির রজিম।
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম।
ইন্নালহামদুলিল্লাহ। ওসসালতু আসসালাম আলা রাসুলিল্লাহ।
সম্মানিত ভাই ও বোনেরা!
একটি অত্যন্ত গ্রুরুত্বপুর্ন বিষয় নিয়ে আপনাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলার ইচ্ছা থেকে এই লেখাটি শুরু করছি ইনশাআল্লাহ। আশা করছি আপনারা সবাই এটি মনোযোগ দিয়ে পড়বেন এবং এর গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন।
ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করছি।
কোন এক শীতএর এক সকালবেলা। সুর্যের আলো ফুটতে না ফুটতেই তাঁরা কয়েকজন,১০/১২ জনের একটা দল চলে এলেন ফসলের মাঠে, এখানে পাশাপাশি কয়েকটি ক্ষেতে মজুরি খাটেন তাঁরা ।এসেই কাজে নেমে যান তাঁরা।সারাদিন কাজ করবেন, দিন শেষে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর সামান্য যততুকু মজুরি পাবেন সেটা দিয়েই হয়ত চলবে হতদরিদ্র এই মানুষগুলির সংসার।
কিছু বাজার সদাই করবেন, ভালমন্দ কিছু কিনবেন স্ত্রীর জন্য, কলিজার টুকরো সন্তানদের জন্য! যত কস্টই হোক, কাজ যে করতেই হবে। নাস্তা করার সময়টুকুও তাঁরা পাননি। বিরামহীম কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১০ টার দিকে তাঁদের স্ত্রীরা সামান্য কিছু খাবার নিয়ে যান স্বামীরা নাস্তা করবেন বলে। খালি পেটে আর কতক্ষণই বা কাজ করা যায়! ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পাশের একপুকুরে গিয়ে তাঁরা হাতমুখ মুখ ধুয়ে নেন, ছায়ায় বসে কিছুটা খেয়ে নিলে হয়ত একটু চাঙ্গা হওয়া যাবে, হয়ত শরীরে একটু বল পাওয়া যাবে! আবার তুমুলগতিতে কাজ শুরু করা যাবে ইনশাআল্লাহ!
এর মধ্যে ১জন ছিলেন -নজরুল ইসলাম। অন্যদের মত তাঁর স্ত্রীও এসেছিলেন খাবার নিয়ে। হটাত তিনি দেখতে পান উন্মুক্ত রাইফেল তাক করে কয়েকজোড়া ভারী বুট এগিয়ে আসছে। দক্ষিণ দিক থেকে ২জন আর পশ্চিম দিক থেকে আরো ৫জন। এই অবস্থা থেকে গরিব, অসহায় মানুষগুলি ভয়ে তটস্থ হয়ে যায়! কাঁপাকাঁপা গলায় নজরুল ইসলাম শুধু এতটকু জিজ্ঞেস করতে পেরেছিলেন যে- কি চায় তারা!
তার এই সরল প্রশ্নের কোন জবাব দেওয়া হয়নি। বুকবরাবর গুলি চালায় সেই পাষণ্ডের দল এর একজন , আর সেই সাথে তার সঙ্গিরা শুরু করে এলোপাথাড়ি গুলিবর্সন! মুহুর্তেই লুটিয়ে পড়েম নজরুল ইসলাম! তিনি বুঝতেই পারলেন না কি থেকে কি হয়ে গেল! কেন তাঁকে গুলি করা হল, কি ছিল তাঁর অপরাধ!
তিনি যেমন বুঝতে পারেননি ঠিক তেমনি বুঝতে পারেননি তাঁর অসহায় স্ত্রী, তাঁর সাথে থাকা অন্য কৃষক ভাইয়েরা! খুব বেশি বয়স ছিলনা, এই নজরুল ইসলামের, মাত্র ৩৪। এই সামান্য বয়সেই প্রানপ্রিয়া স্ত্রী, ছোট্ট দুটি সন্তান জিসান আর সুমাইয়া, সবাইকে ছেড়ে তাঁকে পারি দিতে হল অন্য এক পৃথিবীতে, যেখান থেকে কেও ফিরে আসেনা! আর সেই এলোপাথাড়ি গুলিতে গুরুতর আহত হন অন্য কৃষক ভাই সাহাজুল ইসলাম। টেনে হিচড়ে সেই লাশকে নিয়ে যায় সেই পাষণ্ড হত্যাকারীরা আর সেই সাথে ধরে নিয়ে যায় আরএকজন কৃষকভাইকে।
প্রিয় ভাই এবং বোনেরা! এটি কোন গল্প নয় (নিচে রেফারেন্স দেওয়া আছে), ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় ৪ বছর পুর্বের, ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি, দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার অচিন্তপুর সীমান্ত এলাকায়, বাংলাদেশের ভুসীমানায়, দ্যা বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স অফ ইন্ডিয়া, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাবাহিনি বিএসএফ এর হাতে। আর এই সীমানা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম সীমানা, সবচাইতে বিপদজনক সীমানার মধ্যে একটি। যেখানে নির্বিচারে গুলি করে মানুষকে কীটপতঙ্গের মত গুলি করে মেরে ফেলা যায়!
পরবর্তিতে নজরুল ইসলামের অসহায় পাগলপ্রায় স্ত্রী পলাশি আখতার, তাঁর ছোট্ট সন্তানদের বুকে আঁকড়িয়ে ধরে অশ্রুভরা কন্ঠে মাতম করতে করতে ঘটনাটির বর্ননা দিচ্ছিলেন এরকম- " মুই দৌড়ে গিয়ে মোর গুলিবিদ্ধ স্বামীক জড়িয়ে ধরনু। এডা (একজন) বিএসএফ আসে, মোর বুকত কষি লাথি মারল। মুক ফেলে দিল। তারপর মোর স্বামীর এক হাত ধরে এক বিএসএফ এবং আরেকটা বিএসএফ আসি তাঁর একটা পা ধরল। মোর স্বামীক ছেঁচড়ে কাঁটাতারের বেড়ার কাছত নিয়ে গেল। মুই বিএসএফের পা ধরি কান্নাকাটি করনু, তাও মোক স্বামীক থুয়ে গেল না। হারা গরিব মানুষ। ওরাই (স্বামী) কামাই করার লোক আছিল। কী দোষ আছিল মোর স্বামীটার? হামার দেশত আসে ক্যান তাঁরে গুলি করি মারি কুকুরের মতো ছেঁচড়ে নিয়ে গেল বিএসএফ? মুই বিচার চাও। তোরা মোর স্বামীটাক আনি দাও। ছৌল (সন্তান) দুইটাকে নিয়ে মুই এখন কুটে যান?’"
আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাহাজুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বিএসএফের ছোড়া এডা গুলি মোরা পাওত লাগে। মুই ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে কোনোমতে পালিয়ে আস। না হলে মুক ধরি নিয়া যায়ে মারে ফেলল হয়।’
আজ ২০১৯ এর ১৭ মার্চ । আজ এখন পর্যন্ত পলাশি আখতার কোন বিচার পাননি তাঁর স্বামী হত্যার। বিচার পাননি সাহাজুল ইসলাম। হয়ত আর কোনদিন পাবেনও না বেঁচে থাকতে! -----------(1)
সম্মানিত ভাই এবং বোনেরা, বলছিলাম- বাংলাদেশে এবং ভারতের সীমানা নিয়ে, পৃথিবীর সবাচাইতে ভয়ঙ্কর, কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া বিপদজনক সীমানা নিয়ে। আপনাদের কি ধারনা দুনিয়ার সবচাইতে ভয়ঙ্কর সীমানা কোনটা? এটি কি ফিলিস্তিন- ইসরাইল সীমান্ত? এটা কি চীন-ভারত কিংবা পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত? নাকি এটা উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়া বা আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্ত? এটি নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে।অনেকেই দাবী করতেই পারেন এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডের সঙ্গে ইসরায়েল সীমান্তের কথা। বিশ্বের প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমে প্রতিনিয়ত উঠে এসেছে বছরের পর বছর সীমান্তে চলা ইসরায়েল আর্মি কর্তৃক অসংখ্য ফিলিস্তিনি মুসলিমের নিষ্ঠুর হত্যার খবর। আবার আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রায়শ লিড নিউজ হত, আমেরিকা মহাদেশের যুক্তরাষ্ট্র আর মেক্সিকোর সীমান্তে প্রাণহানির ঘটত সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে। এসব তথ্য জানলেই স্বাভাবিকভাবে সবার মনে ধারণা জন্ম নেবে যে তারা কতইনা নিষ্ঠুর। কিন্তু অবাক করা বিষয় যেটা সেটা কি আপনি জানেন? অনলাইনে থাকা নানা সমীক্ষা, গবেষণা অনুসন্ধান করলে এই প্রশ্নের উত্তরে দেখা যাবে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তই হচ্ছে সবচেয়ে প্রাণঘাতী!!সবচাইতে বিপদজনক! দুনিয়ার বড়বড় সংবাদ সংস্থা,বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলির বক্তব্য এমনই। অন্যান্য সীমান্তে মানুষ মারার জন্য কিছু ইস্যু থাকে, আর সেখানে মারা যায় কিছু চিহ্নিত বিশেষ বৈশিস্টের মানুষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ত তারা থাকে সামরিক বা সীমান্তরক্ষা বাহিনির সদস্য, কিনবা কোন বিদ্রোহি গোষ্ঠী কিনবা কোন মানবপাচারকারী দল! কিন্তু নিরিহ বেসামরিক মানুষকে বিনা কারণে, বিনা প্রস্নে, বিনা জবাবদিহিতায় কুকুর গণ্য করে মারা যায় শুধুমাত্র একটিমাত্র বর্ডারে, সেটি হল, বাংলাদেশ ভারত বর্ডারে! আর বেশিরভাগ সময় নিরীহ বেসসামরিক এসব মুসলিমদের হত্যা করে- গরুরদালাল, চোরাকারবারি বলে ট্যাগ দিয়ে দেওয়া হয়!
হে আমার জাতি! তোমরা ভাল করে শুনে রাখ!
সংখ্যার হিসেবে সীমান্তে প্রাণহানিতে সর্বোচ্চ রেকর্ড এই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেই । দুর্ভাগ্যজনকভাবে যার হতাহতের প্রায় ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশি মুসলিম। এই কথাগুলি আমার নয়। হয়ত এ বিষয়ে এদেশের দালাল মিডিয়া খুব একটা লিড নিউজ করেনা, কিন্তু নিরবে নিভৃতে হরহামেশাই ঘটে যাচ্ছে প্রাণহানি। সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে মাঝেমধ্যে নিউজ হলেও বিষয়টি এখন বিশ্ব রেকর্ডে পৌঁছেছে। কয়েক বছর আগে করা ব্রিটেনের চ্যানেল ফোরের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর সর্ব প্রথম অন্যান্য গণমাধ্যমেরও নজরে আসে বিষয়টি। ‘ইন্ডিয়া’স গ্রেট ওয়াল, দ্য ওয়ার্ল্ডস ডেডলিয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার’ শিরোনামের প্রায় সাড়ে আট মিনিটের এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি প্রচারিত হয় আর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে চ্যানেল ফোরের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সংবাদদাতা জোনাথন রাগম্যান, তিনি তাঁর প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন যে সীমান্তে হতাহত ব্যক্তিদের সবাই গরু পাচারকারী অথবা চোরাকারবারি নন। এসব অবৈধ কারবারে কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারে, কিন্তু তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি দুর্ভোগ এবং বিপদের শিকার হচ্ছেন সীমান্ত এলাকার সাধারণ কৃষক এবং তাঁদের পরিবারগুলো। বেশ কিছু গ্রামবাসীর সাক্ষাৎকার রয়েছে ওই প্রতিবেদনে যারা চাষাবাদের কাজ করার সময় বিএসএফের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন অথবা গুলি খেয়ে বেঁচে গেছেন কিন্তু পঙ্গুত্ববরণ করছেন সারাজীবনের জন্য। সীমান্তের প্রায় দুই হাজার মাইলজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তৈরি করা এক জলন্ত কারাগার যেন এই বাংলাদেশ! ---------- (2)
----------------------------------------------(চলবে ইনশাআল্লাহ.........)
রেফারেন্সঃ
(1)
(2)
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বনির রজিম।
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম।
ইন্নালহামদুলিল্লাহ। ওসসালতু আসসালাম আলা রাসুলিল্লাহ।
সম্মানিত ভাই ও বোনেরা!
একটি অত্যন্ত গ্রুরুত্বপুর্ন বিষয় নিয়ে আপনাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলার ইচ্ছা থেকে এই লেখাটি শুরু করছি ইনশাআল্লাহ। আশা করছি আপনারা সবাই এটি মনোযোগ দিয়ে পড়বেন এবং এর গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন।
ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করছি।
কোন এক শীতএর এক সকালবেলা। সুর্যের আলো ফুটতে না ফুটতেই তাঁরা কয়েকজন,১০/১২ জনের একটা দল চলে এলেন ফসলের মাঠে, এখানে পাশাপাশি কয়েকটি ক্ষেতে মজুরি খাটেন তাঁরা ।এসেই কাজে নেমে যান তাঁরা।সারাদিন কাজ করবেন, দিন শেষে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর সামান্য যততুকু মজুরি পাবেন সেটা দিয়েই হয়ত চলবে হতদরিদ্র এই মানুষগুলির সংসার।
কিছু বাজার সদাই করবেন, ভালমন্দ কিছু কিনবেন স্ত্রীর জন্য, কলিজার টুকরো সন্তানদের জন্য! যত কস্টই হোক, কাজ যে করতেই হবে। নাস্তা করার সময়টুকুও তাঁরা পাননি। বিরামহীম কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১০ টার দিকে তাঁদের স্ত্রীরা সামান্য কিছু খাবার নিয়ে যান স্বামীরা নাস্তা করবেন বলে। খালি পেটে আর কতক্ষণই বা কাজ করা যায়! ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পাশের একপুকুরে গিয়ে তাঁরা হাতমুখ মুখ ধুয়ে নেন, ছায়ায় বসে কিছুটা খেয়ে নিলে হয়ত একটু চাঙ্গা হওয়া যাবে, হয়ত শরীরে একটু বল পাওয়া যাবে! আবার তুমুলগতিতে কাজ শুরু করা যাবে ইনশাআল্লাহ!
এর মধ্যে ১জন ছিলেন -নজরুল ইসলাম। অন্যদের মত তাঁর স্ত্রীও এসেছিলেন খাবার নিয়ে। হটাত তিনি দেখতে পান উন্মুক্ত রাইফেল তাক করে কয়েকজোড়া ভারী বুট এগিয়ে আসছে। দক্ষিণ দিক থেকে ২জন আর পশ্চিম দিক থেকে আরো ৫জন। এই অবস্থা থেকে গরিব, অসহায় মানুষগুলি ভয়ে তটস্থ হয়ে যায়! কাঁপাকাঁপা গলায় নজরুল ইসলাম শুধু এতটকু জিজ্ঞেস করতে পেরেছিলেন যে- কি চায় তারা!
তার এই সরল প্রশ্নের কোন জবাব দেওয়া হয়নি। বুকবরাবর গুলি চালায় সেই পাষণ্ডের দল এর একজন , আর সেই সাথে তার সঙ্গিরা শুরু করে এলোপাথাড়ি গুলিবর্সন! মুহুর্তেই লুটিয়ে পড়েম নজরুল ইসলাম! তিনি বুঝতেই পারলেন না কি থেকে কি হয়ে গেল! কেন তাঁকে গুলি করা হল, কি ছিল তাঁর অপরাধ!
তিনি যেমন বুঝতে পারেননি ঠিক তেমনি বুঝতে পারেননি তাঁর অসহায় স্ত্রী, তাঁর সাথে থাকা অন্য কৃষক ভাইয়েরা! খুব বেশি বয়স ছিলনা, এই নজরুল ইসলামের, মাত্র ৩৪। এই সামান্য বয়সেই প্রানপ্রিয়া স্ত্রী, ছোট্ট দুটি সন্তান জিসান আর সুমাইয়া, সবাইকে ছেড়ে তাঁকে পারি দিতে হল অন্য এক পৃথিবীতে, যেখান থেকে কেও ফিরে আসেনা! আর সেই এলোপাথাড়ি গুলিতে গুরুতর আহত হন অন্য কৃষক ভাই সাহাজুল ইসলাম। টেনে হিচড়ে সেই লাশকে নিয়ে যায় সেই পাষণ্ড হত্যাকারীরা আর সেই সাথে ধরে নিয়ে যায় আরএকজন কৃষকভাইকে।
প্রিয় ভাই এবং বোনেরা! এটি কোন গল্প নয় (নিচে রেফারেন্স দেওয়া আছে), ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় ৪ বছর পুর্বের, ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি, দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার অচিন্তপুর সীমান্ত এলাকায়, বাংলাদেশের ভুসীমানায়, দ্যা বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স অফ ইন্ডিয়া, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাবাহিনি বিএসএফ এর হাতে। আর এই সীমানা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম সীমানা, সবচাইতে বিপদজনক সীমানার মধ্যে একটি। যেখানে নির্বিচারে গুলি করে মানুষকে কীটপতঙ্গের মত গুলি করে মেরে ফেলা যায়!
পরবর্তিতে নজরুল ইসলামের অসহায় পাগলপ্রায় স্ত্রী পলাশি আখতার, তাঁর ছোট্ট সন্তানদের বুকে আঁকড়িয়ে ধরে অশ্রুভরা কন্ঠে মাতম করতে করতে ঘটনাটির বর্ননা দিচ্ছিলেন এরকম- " মুই দৌড়ে গিয়ে মোর গুলিবিদ্ধ স্বামীক জড়িয়ে ধরনু। এডা (একজন) বিএসএফ আসে, মোর বুকত কষি লাথি মারল। মুক ফেলে দিল। তারপর মোর স্বামীর এক হাত ধরে এক বিএসএফ এবং আরেকটা বিএসএফ আসি তাঁর একটা পা ধরল। মোর স্বামীক ছেঁচড়ে কাঁটাতারের বেড়ার কাছত নিয়ে গেল। মুই বিএসএফের পা ধরি কান্নাকাটি করনু, তাও মোক স্বামীক থুয়ে গেল না। হারা গরিব মানুষ। ওরাই (স্বামী) কামাই করার লোক আছিল। কী দোষ আছিল মোর স্বামীটার? হামার দেশত আসে ক্যান তাঁরে গুলি করি মারি কুকুরের মতো ছেঁচড়ে নিয়ে গেল বিএসএফ? মুই বিচার চাও। তোরা মোর স্বামীটাক আনি দাও। ছৌল (সন্তান) দুইটাকে নিয়ে মুই এখন কুটে যান?’"
আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাহাজুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বিএসএফের ছোড়া এডা গুলি মোরা পাওত লাগে। মুই ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে কোনোমতে পালিয়ে আস। না হলে মুক ধরি নিয়া যায়ে মারে ফেলল হয়।’
আজ ২০১৯ এর ১৭ মার্চ । আজ এখন পর্যন্ত পলাশি আখতার কোন বিচার পাননি তাঁর স্বামী হত্যার। বিচার পাননি সাহাজুল ইসলাম। হয়ত আর কোনদিন পাবেনও না বেঁচে থাকতে! -----------(1)
সম্মানিত ভাই এবং বোনেরা, বলছিলাম- বাংলাদেশে এবং ভারতের সীমানা নিয়ে, পৃথিবীর সবাচাইতে ভয়ঙ্কর, কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া বিপদজনক সীমানা নিয়ে। আপনাদের কি ধারনা দুনিয়ার সবচাইতে ভয়ঙ্কর সীমানা কোনটা? এটি কি ফিলিস্তিন- ইসরাইল সীমান্ত? এটা কি চীন-ভারত কিংবা পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত? নাকি এটা উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়া বা আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্ত? এটি নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে।অনেকেই দাবী করতেই পারেন এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডের সঙ্গে ইসরায়েল সীমান্তের কথা। বিশ্বের প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমে প্রতিনিয়ত উঠে এসেছে বছরের পর বছর সীমান্তে চলা ইসরায়েল আর্মি কর্তৃক অসংখ্য ফিলিস্তিনি মুসলিমের নিষ্ঠুর হত্যার খবর। আবার আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রায়শ লিড নিউজ হত, আমেরিকা মহাদেশের যুক্তরাষ্ট্র আর মেক্সিকোর সীমান্তে প্রাণহানির ঘটত সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে। এসব তথ্য জানলেই স্বাভাবিকভাবে সবার মনে ধারণা জন্ম নেবে যে তারা কতইনা নিষ্ঠুর। কিন্তু অবাক করা বিষয় যেটা সেটা কি আপনি জানেন? অনলাইনে থাকা নানা সমীক্ষা, গবেষণা অনুসন্ধান করলে এই প্রশ্নের উত্তরে দেখা যাবে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তই হচ্ছে সবচেয়ে প্রাণঘাতী!!সবচাইতে বিপদজনক! দুনিয়ার বড়বড় সংবাদ সংস্থা,বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলির বক্তব্য এমনই। অন্যান্য সীমান্তে মানুষ মারার জন্য কিছু ইস্যু থাকে, আর সেখানে মারা যায় কিছু চিহ্নিত বিশেষ বৈশিস্টের মানুষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ত তারা থাকে সামরিক বা সীমান্তরক্ষা বাহিনির সদস্য, কিনবা কোন বিদ্রোহি গোষ্ঠী কিনবা কোন মানবপাচারকারী দল! কিন্তু নিরিহ বেসামরিক মানুষকে বিনা কারণে, বিনা প্রস্নে, বিনা জবাবদিহিতায় কুকুর গণ্য করে মারা যায় শুধুমাত্র একটিমাত্র বর্ডারে, সেটি হল, বাংলাদেশ ভারত বর্ডারে! আর বেশিরভাগ সময় নিরীহ বেসসামরিক এসব মুসলিমদের হত্যা করে- গরুরদালাল, চোরাকারবারি বলে ট্যাগ দিয়ে দেওয়া হয়!
হে আমার জাতি! তোমরা ভাল করে শুনে রাখ!
সংখ্যার হিসেবে সীমান্তে প্রাণহানিতে সর্বোচ্চ রেকর্ড এই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেই । দুর্ভাগ্যজনকভাবে যার হতাহতের প্রায় ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশি মুসলিম। এই কথাগুলি আমার নয়। হয়ত এ বিষয়ে এদেশের দালাল মিডিয়া খুব একটা লিড নিউজ করেনা, কিন্তু নিরবে নিভৃতে হরহামেশাই ঘটে যাচ্ছে প্রাণহানি। সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে মাঝেমধ্যে নিউজ হলেও বিষয়টি এখন বিশ্ব রেকর্ডে পৌঁছেছে। কয়েক বছর আগে করা ব্রিটেনের চ্যানেল ফোরের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর সর্ব প্রথম অন্যান্য গণমাধ্যমেরও নজরে আসে বিষয়টি। ‘ইন্ডিয়া’স গ্রেট ওয়াল, দ্য ওয়ার্ল্ডস ডেডলিয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার’ শিরোনামের প্রায় সাড়ে আট মিনিটের এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি প্রচারিত হয় আর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে চ্যানেল ফোরের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সংবাদদাতা জোনাথন রাগম্যান, তিনি তাঁর প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন যে সীমান্তে হতাহত ব্যক্তিদের সবাই গরু পাচারকারী অথবা চোরাকারবারি নন। এসব অবৈধ কারবারে কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারে, কিন্তু তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি দুর্ভোগ এবং বিপদের শিকার হচ্ছেন সীমান্ত এলাকার সাধারণ কৃষক এবং তাঁদের পরিবারগুলো। বেশ কিছু গ্রামবাসীর সাক্ষাৎকার রয়েছে ওই প্রতিবেদনে যারা চাষাবাদের কাজ করার সময় বিএসএফের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন অথবা গুলি খেয়ে বেঁচে গেছেন কিন্তু পঙ্গুত্ববরণ করছেন সারাজীবনের জন্য। সীমান্তের প্রায় দুই হাজার মাইলজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তৈরি করা এক জলন্ত কারাগার যেন এই বাংলাদেশ! ---------- (2)
----------------------------------------------(চলবে ইনশাআল্লাহ.........)
রেফারেন্সঃ
(1)
(2)
Comment