নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাচ্ছে পুলিশ
বিগত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কারণে নিরাপত্তার কৌশল ঢেলে সাজাচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত, অপরাধীদের চিহ্নিত করতে ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ক্লোজড সার্কিট কামেরা (সিসিটিভি) স্থাপনসহ নিরাপত্তার নতুন কৌশল নিয়েছে ডিএমপি।
ডিএমপি থেকে পুলিশ সদস্যদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, পরিস্থিতি বিবেচনায় সতর্ক থাকতে হবে। দায়িত্ব পালনের সময় কোনো পুলিশ সদস্য যেন এককভাবে চলাফেরা না করেন। বিশেষ করে পুলিশের নির্ধারিত পোশাক পরে দায়িত্ব পালনের সময়।
মিন্টো রোডের ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদর দফতরে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত অপরাধ বিষয়ক নিয়মিত সমাবেশে (ক্রাইম কনফারেন্স) ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এ সব নির্দেশনা দেন।
বৃহস্পতিবারের ওই সমাবেশে উপস্থিত থাকা ডিএমপির একাধিক উপ-কমিশনার (ডিসি) ও বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ওসি) দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
সমাবেশে ঢাকার আটটি জোন ও গোয়েন্দা পুলিশের চারটি বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি), অতিরিক্তি উপ-কমিশনার (এডিসি), সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি-প্রশাসন) এবং প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উপস্থিত ছিলেন।
ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা
ডিএমপির উপ-কমিশনার (ডিসি) পর্যায়ের এক কর্মকর্তা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে অথবা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন, এমন গুরুত্বপূর্ণ ও অগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে থানা পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
তিনি জানান, প্রতিদিনই আমাদের কাছে বিভিন্ন ব্যক্তি নিরাপত্তা চেয়ে সাধারণ ডায়েরি করছেন। এ ছাড়া কেউ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন, সাধারণ ডায়েরি করেননি এমন ব্যক্তিদেরও নিরাপত্তা দিতে বলা হয়েছে।
প্রকাশক-লেখক, ব্লগারদের উপর হামলা ও হুমকি এবং হত্যার লক্ষে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের তালিকা প্রকাশ করেছে। সন্ত্রাসীরা যেন কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটাতে পারে তার জন্য এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ওই তালিকায় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ রয়েছেন।
পুলিশ সদস্যদের একা চলাফেরা করা নিষেধ
ডিএমিপর *উপ-কমিশনার (ডিসি) পর্যায়ের এক কর্মকর্তা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে পুলিশ সদস্যদের ইউনিফর্ম (পোশাক) পরে একা চলাফেরা করতে নিষেধ করা হয়েছে।’
কনফারেন্সে সম্প্রতি ঘটা গাবতলী, সাভার ও ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় মিলিটারি *পুলিশের ওপর হামলার কথা উল্লেখ করা হয়। এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় তার জন্য পুলিশ সদস্যদের সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকতে বলা হয়।
পাঁচ জনের কম পুলিশ সদস্য হলে চেকপোস্ট নয়
গাবতলী, সাভার ও ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে হামলা হওয়ার পর পাঁচ সদস্যের কম হলে তল্লাশি চৌকি না বসাতে নির্দেশ দিয়েছেন কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘যেহেতু কয়েক দিনের ব্যবধানে রাজধানীর কয়েকটি চেকপোস্টে পুলিশের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, তার জন্য আমাদের সতর্ক অবস্থায় থাকতে বলা হয়েছে। এছাড়া ৫ জনের কম পুলিশ সদস্য দিয়ে চেকপোস্ট না বসাতে বলা হয়। প্রয়োজনে চেকপোস্ট কমাতে বলা হয়েছে।’
এ ছাড়া রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নয় নভেম্বর অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহিদুল হক তল্লাশি চৌকি বা ডিউটিরত অবস্থায় মোবাইল ব্যবহার না করার নির্দেশ দেন।
তিন শিফটে পুলিশের ডিউটি
টানা ডিউটি করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা ক্লান্ত হয়ে যান। অনেক সময় তারা অসুস্থও হয়ে পড়েন। এছাড়া ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা ডিউটি করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের হতাশার জন্ম নেয়। এসব বিষয় বিবেচনা করে তিন শিফটে ডিউটি রোস্টার করার পরিকল্পনা করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
গত ৯ নভেম্বর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সর্বস্তরের পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। তাদের দীর্ঘ ডিউটির বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহিদুল হককে অবহিত করেন। এরপরে তিন শিফটে ডিউটি করার পরিকল্পনা করে ডিএমপি।
বর্তমানে দুটি শিফটে ১২ ঘণ্টা (কখনো কখনো ১৬ ঘণ্টাও হয়) করে ডিউটি করা হয। তিন শিফটে হলে ডিউটি হলে ৮ ঘণ্টা করে দায়িত্ব পালন করবেন পুলিশ সদস্যরা।
পদস্থ এক পুলিশ কর্মকর্তা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘তিন শিফটে পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব ভাগ করার চিন্তা করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যে পরিমাণ পুলিশ সদস্য আছে, তাতে তিন শিফটে দায়িত্ব দেওয়া একটু কঠিন হবে। কিছু কনেস্টেবল প্রশিক্ষণে রয়েছেন, তারা ফিরলে এবং কিছু চেকপোস্ট কমিয়ে দিয়ে তিন শিফটে ডিউটি ভাগ করা হতে পারে।’
সিসিটিভির আওতায় আসছে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা
যে-সব প্রতিষ্ঠানে লোকজনের গমনাগমন বেশি এবং হুমকি আসতে পারে, এমন সব প্রতিষ্ঠানে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রেস্তরাঁ, হোটেল, শপিংমল ও মার্কেট রয়েছে। এ ছাড়া জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকাতেও সিসিটিভি লাগানো হবে। শুধু তাই নয়, ডিএমপির পক্ষ থেকে প্রতিটা বাসার প্রবেশ মুখেও সিসিটিভি লাগাতে বাসার মালিকদের উদ্বুদ্ধ করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহ
অপারাধীদের শনাক্তে ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহ করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। থানা পুলিশ বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন এলাকার বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহ করছে। ইতোমধ্যে পুলিশ এ কাজ শুরু করেছে। বাসার মালিকদের কাছে ফরম পাঠিয়েছে পুলিশ। ফরমে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ যাবতীয় তথ্য চাওয়া হয়েছে।
তথ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হলেও সম্প্রতি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় তথ্য সংগ্রহের দিকে বেশী নজর দিচ্ছে পুলিশ। গত সপ্তাহ থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারি, লালবাগ জোন থেকে এ কার্যযক্রম শুরু হয়েছে।
ওয়ারি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তপন চন্দ্র সাহা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘অপরাধীদের যাতে খুব সহজে শনাক্ত করা যায় তার জন্য আমার থানা এলাকার সমস্থ বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিযাদের তথ্য সংগ্রহ করছি।’
তিনি জানান, তাদের কাছ থেকে স্থায়ী ঠিকানা, কোথায় চাকরি করেন। মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন তথ্য নেওয়া হচ্ছে।
ক্রাইম কনফারেন্সের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি-মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘কনফারেন্সে বিগত দিনের গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গাবতলী ও সাভারের মতো ঘটনা যেন না ঘটে তার জন্য পুলিশ সদস্যদের সতর্ক করা হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পুলিশের ইউনিটগুলো নির্দেশ দিয়েছেন কমিশনার।’
উল্লেখ্য, রাজধানীর গাবতলী ও সাভারে পুলিশের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় দুজন পুলিশ সদস্য নিহতের ঘটনার পর অনুষ্ঠিত সমাবেশে ডিএমপি কমিশনার ওইসব বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেন।
গত ৪ নভেম্বর সাভারে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে সশস্ত্র কনস্টেবল মুকুল হোসেন নিহত হন। এছাড়া গত ২২ অক্টোবর রাজধানীর গাবতলীতে চেকপোস্টে সন্ত্রাসীদের চুরিকাঘাতে নিহত হন পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক ইব্রাহিম মোল্লা।
গত ৩১ নভেম্বর জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই দিন লালমাটিয়ার শুদ্ধস্বর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের ওপরেও হামলা করে দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া গত ১ নভেম্বর সময় প্রকাশনীর প্রকাশক ফরিদ আহমেদ এবং ১০ নভেম্বর অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
দ্য রিপোর্ট
Comment