পর্ব ১
প্রকাশ : ০৯ মে ২০১৬, ০০:০০ | আপডেট : ০৯ মে ২০১৬, ০১:১১ | প্রিন্ট সংস্করণ
গত দেড়-দু’বছরে বাংলাদেশে যে ধরনের টার্গেট হত্যা সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে তা এখন এ দেশের জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। এসবের দায়-দায়িত্ব নিয়ে রাজনীতিবিদ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্য নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। সাধারণ মানুষের মনে নানা ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কথা হচ্ছে, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হোম গ্রোন ‘জঙ্গি’ বা ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনের কাজ। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, এ ধরনের টার্গেট মিশনের হত্যাকারীদের সঠিক পরিচয় এবং যাদের হত্যা করা হচ্ছে তারাই বা কারা। এতদিনে পরিষ্কার যে, হত্যাকারীদের দৃষ্টিতে এরা ইসলাম ধর্ম থেকে বিচ্যুত গোষ্ঠী। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকার কলাবাগানে দু’জনের হত্যা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তার পেছনের কারণ অত্যন্ত পরিষ্কার এবং এ দু’জন কেন জঙ্গিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে তা আজ অজানা নয়। এ ধরনের হত্যার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে খুব একটা প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে না আর এখানেই দেশের কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
জঙ্গি তৎপরতা বিষয়ে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো এমনিতেই বাংলাদেশের ওপর নজর রাখছে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। আমরা এ নজরদারিকে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে যতটা হালকা করতে চাই বিষয়টা তত সহজ নয়। বাংলাদেশ যে বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তাতে উদ্বিগ্ন এসব দেশ, যারা বিশ্বের দুটি দুর্ধর্ষ জিহাদি সংগঠন বলে পরিচিতদের দ্বারা প্রায়ই মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে ঢাকায় হত্যাকা-ের পর। ওই স্থানে পাহারারত পুলিশ চাপাতির আঘাত খেলেন কিন্তু হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকা সত্ত্বেও তেমন কিছু করতেই পারলেন না উপরন্তু কোপে আহত হলেন। অদ্যাবধি সন্দেহাতীতভাবে কাউকে ধরা গেল না। অতীতেও অনেক ঘটনারই হোতাদের সন্দেহাতীতভাবে ধরা যায়নি, তবুও আমরা সন্ত্রাস দমনে ‘রোল মডেল’ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারি। প্রত্যেক ঘটনার পরই আমাদের একাধিক মন্ত্রী মহোদয়ের কাছ থেকে বিপরীতমুখী মতামত শুনি। এর বেশিরভাগ সময়ই ‘কেষ্ট বেটাকেই চোর’ বলে চালানোর চেষ্টা হয়। আমরা শুনি যে, আমাদের দেশের জঙ্গিরা ‘হোম গ্রোন’ যাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নেই কিন্তু ইতোমধ্যেই সিঙ্গাপুর যোগ হয়েছে। জুলহাজ মান্নানের হত্যার পর এ ধরনের তত্ত্ব মানতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র, সে দেশের জন্য তিনি (জুলহাজ) ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র। এ হত্যা ও পরবর্তী তৎপরতা মানতে পারল না যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। জন কেরির ব্যক্তিগত ফোন এবং মিস নিশ দেশাইয়ের ঢাকা আগমন, বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলোচনা আর বৈঠকের পর তিনি বলে গেলেন, ‘হোম গ্রোন’ জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক গ্রুপের যোগাযোগ রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে। কিন্তু আমাদের জবাব একটাইÑ ‘এই হোম গ্রোন জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের সম্পর্ক নেই। মরদ কা বাত হাতি কা দাঁত।’
এ পর্যন্ত যেসব হত্যা হয়েছে তার ধরন-কৌশল আর যাদের হত্যা করা হয়েছে তার পেছনের কারণগুলোর বিশ্লেষণ করলে যে চিত্র ফুটে ওঠে তার সঙ্গে বর্তমান বিশ্বের তথাকথিত দুটি জিহাদি গ্রুপের তত্ত্বের সঙ্গে মিল থাকলেও সবচেয়ে দুর্ধর্ষ বলে পরিচিত সংগঠন ইসলামিক স্টেটের দিকেই নজর যুক্তরাষ্ট্রের। তবে জুলহাজ মান্নান যিনি এ দেশের সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফল ইনকোয়ারি নামক বেসরকারি সংস্থার আদর্শের আদলে কাজ করছিলেন তাদের হত্যার দায় স্বীকার করে দায়-দায়িত্ব নিয়েছে আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট, মূল আল কায়েদার উপমহাদেশের কথিত শাখা। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী সন্দেহের তীর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম যারা পক্ষান্তরে আনসার আল ইসলামের একাংশের স্থানীয় সংস্করণ বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই গ্রুপই অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করেছিল বলে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ।
অবশ্য এ পর্যন্ত ছকের মধ্যে ঘটে যাওয়া হত্যাকা-গুলোর বেশিরভাগ, যার মধ্যে টাঙ্গাইলে হালে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী দর্জির হত্যাও রয়েছে, দায়-দায়িত্ব ইসলামিক স্টেট বা সংক্ষেপে আইএস নিয়েছে বলে ‘সাইট’ নামক সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে আমাদের দেশসহ বিশ্বের সিংহভাগ মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। কাজেই আমাদের অঞ্চলেও মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো বিশ্বের দুটি প্রতিযোগী ‘জিহাদিস্ট’ সংগঠনের প্রতিযোগিতার ছাপ প্রতীয়মান হচ্ছে।
যদিও ইসলামিক স্টেট বা আইএস অঞ্চলভিত্তিক সংগঠনের কোনো ঘোষণা দেয়নি, যেমনটা আল কায়েদা এই উপমহাদেশে তাদের শাখা স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। আইএস শাখার কথা বললেও তাদের মুখপত্র ‘দাবিখ’-এর ১৪তম সংস্করণে বাংলাদেশসহ বাংলা অঞ্চলে একজন আমির নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যার নাম শায়েখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। ওই সংস্করণে আইএসের হালের নিযুক্ত আমিরের প্রায় ছয় পৃষ্ঠাব্যাপী একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। ওই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বিস্তারিতভাবে কী ধরনের টার্গেটের প্রতি তাদের নজর রয়েছে তাও বলা হয়েছে। হালে দাবিখের বাংলা সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এই দুই তথাকথিত জিহাদি সংগঠন প্রতিযোগিতায় রয়েছে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়Ñ অন্তত বিভিন্ন সময়ে হত্যা ও আক্রমণের দায়-দায়িত্ব স্বীকারে তেমনই মনে হয়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, বিবিসির সূত্র মতে, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় হত্যা ও হামলার ঘটনাগুলোর মধ্যে প্রায় ১৫টি আইএস তাদের সম্পৃক্ততার কথা বলেছে। অপরদিকে ৪টি হত্যার দায় স্বীকার করেছে আল কায়েদার উপমহাদেশীয় শাখা। তবে এসব দায় স্বীকারকে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নাকচ করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং জেএমবির জড়িত থাকার কথা বলে।
আইএস বা আল কায়েদার কোনো উপস্থিতি বাংলাদেশে আছে কী নেই সে বিতর্ক এখন আন্তর্জাতিক পরিম-লেও ধ্বনিত হচ্ছে, যেমনটা সদ্য সফরকারী যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ফর স্টেট নিশা দেশাই বিসওয়ালের বক্তব্যে উঠে এসেছে। এ পর্যালোচনা থেকে একটি বিষয় অনেকটা পরিষ্কার যে, এতদঞ্চলে এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, যেমনটা অন্যান্য অঞ্চলে প্রতীয়মান।
আল কায়েদা আর আইএসের প্রতিযোগিতা শুরু হয় আল কায়েদার পূর্বতন কৌশল পরিবর্তনের পর। এই কৌশলগত পরিবর্তন শুরু হয় তিউনিসিয়ায় ২০১০ সালে আরব বসন্ত শুরু হওয়ার পর এবং এক বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের মধ্যে সমগ্র আরব বিশ্ব বিশেষ করে লিবিয়া, মিশর, ইয়ামেন এবং সর্বশেষ সিরিয়ায় সরকার হঠাও আন্দোলন শুরু হওয়ার পর। ততদিনে আল কায়েদার অঘোষিত নেতৃত্ব চলে যায় আইমান আল জাওয়াহিরির অনুসারীদের হাতে। আল কায়েদা আরব বসন্তে সমগ্র আরব বিশ্ব তছনছ হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করে শাখা স্থাপন করে আল কায়েদা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা এবং আল কায়েদা ইন ইরাক যার প্রধান হন জারকাওয়ি। ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর আল কায়েদার নতুন নেতৃত্ব তাদের পুরনো খোল পাল্টিয়ে ফেলে যার বাইরে চলে যায় জারকাওয়ি। আল কায়েদা থেকে বের হয়ে আল কায়েদা ইন ইরাক রূপান্তরিত হয় ইসলামি স্টেটরূপে এবং আল কায়েদার কৌশলের বিপরীতে নিজেদের কৌশল তৈরি করে।
২য় পার্ট কমেন্টে
প্রকাশ : ০৯ মে ২০১৬, ০০:০০ | আপডেট : ০৯ মে ২০১৬, ০১:১১ | প্রিন্ট সংস্করণ
গত দেড়-দু’বছরে বাংলাদেশে যে ধরনের টার্গেট হত্যা সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে তা এখন এ দেশের জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। এসবের দায়-দায়িত্ব নিয়ে রাজনীতিবিদ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্য নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। সাধারণ মানুষের মনে নানা ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কথা হচ্ছে, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হোম গ্রোন ‘জঙ্গি’ বা ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনের কাজ। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, এ ধরনের টার্গেট মিশনের হত্যাকারীদের সঠিক পরিচয় এবং যাদের হত্যা করা হচ্ছে তারাই বা কারা। এতদিনে পরিষ্কার যে, হত্যাকারীদের দৃষ্টিতে এরা ইসলাম ধর্ম থেকে বিচ্যুত গোষ্ঠী। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকার কলাবাগানে দু’জনের হত্যা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তার পেছনের কারণ অত্যন্ত পরিষ্কার এবং এ দু’জন কেন জঙ্গিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে তা আজ অজানা নয়। এ ধরনের হত্যার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে খুব একটা প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে না আর এখানেই দেশের কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
জঙ্গি তৎপরতা বিষয়ে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো এমনিতেই বাংলাদেশের ওপর নজর রাখছে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। আমরা এ নজরদারিকে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে যতটা হালকা করতে চাই বিষয়টা তত সহজ নয়। বাংলাদেশ যে বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তাতে উদ্বিগ্ন এসব দেশ, যারা বিশ্বের দুটি দুর্ধর্ষ জিহাদি সংগঠন বলে পরিচিতদের দ্বারা প্রায়ই মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে ঢাকায় হত্যাকা-ের পর। ওই স্থানে পাহারারত পুলিশ চাপাতির আঘাত খেলেন কিন্তু হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকা সত্ত্বেও তেমন কিছু করতেই পারলেন না উপরন্তু কোপে আহত হলেন। অদ্যাবধি সন্দেহাতীতভাবে কাউকে ধরা গেল না। অতীতেও অনেক ঘটনারই হোতাদের সন্দেহাতীতভাবে ধরা যায়নি, তবুও আমরা সন্ত্রাস দমনে ‘রোল মডেল’ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারি। প্রত্যেক ঘটনার পরই আমাদের একাধিক মন্ত্রী মহোদয়ের কাছ থেকে বিপরীতমুখী মতামত শুনি। এর বেশিরভাগ সময়ই ‘কেষ্ট বেটাকেই চোর’ বলে চালানোর চেষ্টা হয়। আমরা শুনি যে, আমাদের দেশের জঙ্গিরা ‘হোম গ্রোন’ যাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নেই কিন্তু ইতোমধ্যেই সিঙ্গাপুর যোগ হয়েছে। জুলহাজ মান্নানের হত্যার পর এ ধরনের তত্ত্ব মানতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র, সে দেশের জন্য তিনি (জুলহাজ) ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র। এ হত্যা ও পরবর্তী তৎপরতা মানতে পারল না যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। জন কেরির ব্যক্তিগত ফোন এবং মিস নিশ দেশাইয়ের ঢাকা আগমন, বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলোচনা আর বৈঠকের পর তিনি বলে গেলেন, ‘হোম গ্রোন’ জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক গ্রুপের যোগাযোগ রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে। কিন্তু আমাদের জবাব একটাইÑ ‘এই হোম গ্রোন জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের সম্পর্ক নেই। মরদ কা বাত হাতি কা দাঁত।’
এ পর্যন্ত যেসব হত্যা হয়েছে তার ধরন-কৌশল আর যাদের হত্যা করা হয়েছে তার পেছনের কারণগুলোর বিশ্লেষণ করলে যে চিত্র ফুটে ওঠে তার সঙ্গে বর্তমান বিশ্বের তথাকথিত দুটি জিহাদি গ্রুপের তত্ত্বের সঙ্গে মিল থাকলেও সবচেয়ে দুর্ধর্ষ বলে পরিচিত সংগঠন ইসলামিক স্টেটের দিকেই নজর যুক্তরাষ্ট্রের। তবে জুলহাজ মান্নান যিনি এ দেশের সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফল ইনকোয়ারি নামক বেসরকারি সংস্থার আদর্শের আদলে কাজ করছিলেন তাদের হত্যার দায় স্বীকার করে দায়-দায়িত্ব নিয়েছে আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট, মূল আল কায়েদার উপমহাদেশের কথিত শাখা। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী সন্দেহের তীর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম যারা পক্ষান্তরে আনসার আল ইসলামের একাংশের স্থানীয় সংস্করণ বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই গ্রুপই অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করেছিল বলে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ।
অবশ্য এ পর্যন্ত ছকের মধ্যে ঘটে যাওয়া হত্যাকা-গুলোর বেশিরভাগ, যার মধ্যে টাঙ্গাইলে হালে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী দর্জির হত্যাও রয়েছে, দায়-দায়িত্ব ইসলামিক স্টেট বা সংক্ষেপে আইএস নিয়েছে বলে ‘সাইট’ নামক সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে আমাদের দেশসহ বিশ্বের সিংহভাগ মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। কাজেই আমাদের অঞ্চলেও মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো বিশ্বের দুটি প্রতিযোগী ‘জিহাদিস্ট’ সংগঠনের প্রতিযোগিতার ছাপ প্রতীয়মান হচ্ছে।
যদিও ইসলামিক স্টেট বা আইএস অঞ্চলভিত্তিক সংগঠনের কোনো ঘোষণা দেয়নি, যেমনটা আল কায়েদা এই উপমহাদেশে তাদের শাখা স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। আইএস শাখার কথা বললেও তাদের মুখপত্র ‘দাবিখ’-এর ১৪তম সংস্করণে বাংলাদেশসহ বাংলা অঞ্চলে একজন আমির নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যার নাম শায়েখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। ওই সংস্করণে আইএসের হালের নিযুক্ত আমিরের প্রায় ছয় পৃষ্ঠাব্যাপী একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। ওই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বিস্তারিতভাবে কী ধরনের টার্গেটের প্রতি তাদের নজর রয়েছে তাও বলা হয়েছে। হালে দাবিখের বাংলা সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এই দুই তথাকথিত জিহাদি সংগঠন প্রতিযোগিতায় রয়েছে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়Ñ অন্তত বিভিন্ন সময়ে হত্যা ও আক্রমণের দায়-দায়িত্ব স্বীকারে তেমনই মনে হয়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, বিবিসির সূত্র মতে, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় হত্যা ও হামলার ঘটনাগুলোর মধ্যে প্রায় ১৫টি আইএস তাদের সম্পৃক্ততার কথা বলেছে। অপরদিকে ৪টি হত্যার দায় স্বীকার করেছে আল কায়েদার উপমহাদেশীয় শাখা। তবে এসব দায় স্বীকারকে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নাকচ করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং জেএমবির জড়িত থাকার কথা বলে।
আইএস বা আল কায়েদার কোনো উপস্থিতি বাংলাদেশে আছে কী নেই সে বিতর্ক এখন আন্তর্জাতিক পরিম-লেও ধ্বনিত হচ্ছে, যেমনটা সদ্য সফরকারী যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ফর স্টেট নিশা দেশাই বিসওয়ালের বক্তব্যে উঠে এসেছে। এ পর্যালোচনা থেকে একটি বিষয় অনেকটা পরিষ্কার যে, এতদঞ্চলে এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, যেমনটা অন্যান্য অঞ্চলে প্রতীয়মান।
আল কায়েদা আর আইএসের প্রতিযোগিতা শুরু হয় আল কায়েদার পূর্বতন কৌশল পরিবর্তনের পর। এই কৌশলগত পরিবর্তন শুরু হয় তিউনিসিয়ায় ২০১০ সালে আরব বসন্ত শুরু হওয়ার পর এবং এক বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের মধ্যে সমগ্র আরব বিশ্ব বিশেষ করে লিবিয়া, মিশর, ইয়ামেন এবং সর্বশেষ সিরিয়ায় সরকার হঠাও আন্দোলন শুরু হওয়ার পর। ততদিনে আল কায়েদার অঘোষিত নেতৃত্ব চলে যায় আইমান আল জাওয়াহিরির অনুসারীদের হাতে। আল কায়েদা আরব বসন্তে সমগ্র আরব বিশ্ব তছনছ হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করে শাখা স্থাপন করে আল কায়েদা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা এবং আল কায়েদা ইন ইরাক যার প্রধান হন জারকাওয়ি। ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর আল কায়েদার নতুন নেতৃত্ব তাদের পুরনো খোল পাল্টিয়ে ফেলে যার বাইরে চলে যায় জারকাওয়ি। আল কায়েদা থেকে বের হয়ে আল কায়েদা ইন ইরাক রূপান্তরিত হয় ইসলামি স্টেটরূপে এবং আল কায়েদার কৌশলের বিপরীতে নিজেদের কৌশল তৈরি করে।
২য় পার্ট কমেন্টে
Comment