কালের কণ্ঠ পত্রিকা থেকে সংগৃহীত
ঘোলাটে বাদামি চোখের নারী রিটা কাত্জ। অস্থির প্রকৃতির। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অনেকেই তাঁকে নামে চেনেন। তিনি কখনো কখনো টেলিফোনে কথা বলেন, তবে দেখা দেন না। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তাঁকে কদর করে চলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘নিউ ইয়র্কার’ এভাবেই তুলে ধরেছে রিটা কাত্জকে। তিনিই দেশে দেশে জঙ্গিদের ভয়ংকর পরিকল্পনা ও হামলার আগাম তথ্য প্রদানকারী বিস্ময়কর নারী। তিনি কার হয়ে কাজ করেন, কে তাঁর পেছনে রয়েছে এ নিয়ে ধন্ধ রয়েছে ঢের। এখন এই রিটা কাত্জই বাংলাদেশের গোয়েন্দাদেরও দারুণ ঈর্ষার কারণ।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বে যেখানেই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটুক না কেন, সরাসরি চলে আসে রিটা কােজর নাম। জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি ইসরায়েলে কাটিয়েছেন। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীতে চাকরি করা রিটা যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস, এফবিআই, সিআইএ, বিচার বিভাগ, অর্থ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ তথা মার্কিন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগের সঙ্গে কাজ করেছেন। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের চর হিসেবে খ্যাত রিটার যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
রিটা কােজর জন্ম ইরাকের বসরা নগরীতে ১৯৬৩ সালে। তাঁর বাবা সম্পদশালী ইহুদি ব্যবসায়ী ছিলেন। কাত্জরা চার ভাইবোন। ১৯৬৮ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের সময় ইরাকে বাথ পার্টির সরকার ক্ষমতায় ছিল। সাদ্দাম হোসেন তখন ছিলেন ইরাকের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান। কিছু ইহুদি পরিবারকে তখন সরকার আটক করে ইসরাইলের পক্ষে গোপনে গোয়েন্দাগিরি করার অভিযোগে। তাঁদের মধ্যে কােজর বাবাও ছিলেন। তবে তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের বাগদাদের একটি পাথরের বাড়িতে আটকে রাখা হয়।
১৯৬৯ সালে সামরিক আদালতে অন্য আটজন ইহুদি ও পাঁচজন অইহুদির সঙ্গে কােজর বাবারও মৃত্যুদণ্ড হয়। তখন কােজর বয়স ছয় বছর। স্বামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার মাসখানেক পর একদিন কােজর মা পাহারায় থাকা নিরাপত্তাকর্মীকে মদ খাইয়ে সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে যান। কােজর মায়ের চেহারা ছিল ইরাকের একজন বিখ্যাত জেনারেলের স্ত্রীর চেহারার মতো। ফলে তিনি খুব সহজেই সন্তানদের নিয়ে ইরান সীমান্ত দিয়ে ইসরাইলে পালাতে পারেন। সমুদ্রতীরে বাত-য়াম উপশহরে ছোট্ট একটি ঘর তুলে থাকতে শুরু করেন মা ও সন্তানরা।
কাত্জ হাই স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস নিয়ে পড়তে থাকেন। ওই সময় রিটা একজন মেডিক্যালের ছাত্রকে বিয়ে করেন। তাঁর মা কাপড় তৈরি করেন, রিটা সেগুলো বিক্রি করতেন। ১৯৯৭ সালে কােজর স্বামী ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথে এন্ডোক্রোনলোজি বিষয়ে গবেষণার জন্য ফেলোশিপ পেয়ে তিন সন্তানসহ যুক্তরাষ্ট্র চলে যান।
ইরাকে জন্ম হওয়ার কারণে ইরাকি আরবির বিভিন্ন উচ্চারণ ছিল রিটার আয়ত্তে। আরবি ভাষার ওপর এই দক্ষতা তাঁর জীবন বদলাতে সহায়তা করেছে। ১৯৯৫ সালে জাপানের ওকলাহোমা শহরে বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে ইসলামী সন্ত্রাসীরা জড়িত—এমন সংবাদ প্রকাশ করে রাতারাতি পরিচিতি পেয়ে যাওয়া সিবিএস নিউজের সাংবাদিক স্টিভেন ইমারসন ‘ইনভেস্টিগেটিভ প্রজেক্ট’ নামে একটি অফিস স্থাপন করেন, যেখানে আরবি ভাষা জানা একজন সহকারী হিসেবে রিটা চাকরি পান।
১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর আলজেরিয়ার নাগরিক আহমেদ রেসাম যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সীমান্তে গ্রেপ্তার হন। তিনি ট্রাংকভর্তি বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হামলা চালাতে যাচ্ছিলেন। এই আহমেদ রেসাম সম্পর্কে আগাম তথ্য দেন রিটা কাত্জ। তখন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের কাউন্টার টেররিজম উপদেষ্টা রিচার্ড এ ক্লার্ক ইমারসনকে হোয়াইট হাউসে ডেকে নিয়ে তাঁদের গবেষণা সম্পর্কে জানতে চান। তখন থেকেই বিখ্যাত হওয়া শুরু করেন রিটা।
২০০১ সালের নাইন-ইলেভেনের পর রিটা যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ইসলামিক গ্রুপগুলোর আর্থিক লেনদেন অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেন। ওই সময় তিনি সুইস ব্যাংক, সৌদি সরকারের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকেন।
২০০২ সালের জুনে ইনভেস্টিগেটিভ প্রজেক্টের চাকরি ছেড়ে দিয়ে রিটা জস ডেভন নামে একজন সহকর্মীকে নিয়ে সাইট ইনস্টিটিউট নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ২০০৮ সালে তা বন্ধ হয়ে গেলে সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনা করতে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, শত শত সন্ত্রাসী সাইট পর্যবেক্ষণ করে সাইট ইনটেলিজেন্স, যেখানে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ভিডিও, তথ্য, বক্তব্য, বিবৃতি ও ছবি প্রকাশ করে। রিটা ও তাঁর কর্মীদের কাজ হলো কিছু পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড চ্যাট রুমে সার্বক্ষণিক বার্তা আদান-প্রদান করা, যেখানে জিহাদে যেতে ইচ্ছুক বা জিহাদের ময়দানে উপস্থিত লোকজন কথা বলে। হামলার ধরন, হামলার স্থান, হামলায় ব্যবহৃত বিস্ফোরক, হামলাকারীদের পোশাকসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে চ্যাট করার সময় রিটা কাত্জ একজন মুসলিম পরিচয়ে জঙ্গিদের সমর্থক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। ফলে জঙ্গিরা তাঁকে বিশ্বাস করে সব তথ্য শেয়ার করে।
২০০৩ সালে কাত্জ ‘টেররিস্ট হান্টার’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। ওই বইয়ে তিনি বলেন, তিনি জঙ্গি মুসলিমদের অনেক বৈঠকে পরিচয় গোপন করে উপস্থিত হয়েছিলেন। বইতে তিনি আরো বলেছেন, জর্জিয়ার পোল্ট্রি ফার্ম ‘মার-জ্যাক পোল্ট্রি’ সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন করছে। অবশ্য ওই তথ্য চ্যালেঞ্জ করে পরবর্তী সময়ে মার-জ্যাক কাত্জ ও সিবিএসের বিরুদ্ধে মামলা করে। ২০০৪ সালে ইউনিভার্সিটি অব ইদাহুর কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র সামি ওমর আল-হুসাইনের বিরুদ্ধে মামলায় ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসকে মাসখানেক ধরে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন রিটা।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রিটা কাত্জ ও সাইট ইনটেলিজেন্সের সম্পর্ক বেশ গভীর। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের পরামর্শক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয় সাইট ইনটেলিজেন্স। সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপে দুই পরামর্শকের একজন ব্রুস হাফম্যান, যিনি র*্যান্ড করপোরেশনের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড কাউন্টার ইনসারজেন্সি বিভাগের করপোরেট চেয়ারম্যান। করপোরেশনটি ইসরায়েলপন্থী এবং আরববিরোধী যুদ্ধে উসকানিদাতা সংগঠন হিসেবে পরিচিত। রিটা নিজেও কট্টর ইসরায়েলপন্থী। নিজেকে জায়নবাদী বলে পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করেন।
২০১৪ সালের মধ্য আগস্টে ইরাকে আইসিসের আবির্ভাবের সময় থেকেই সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপ বিশ্বজুড়ে আলোচিত হতে থাকে। ওই সময় বেশ কটি এক্সক্লুসিভ ভিডিও প্রকাশ করে তারা, যেখানে দুজন মার্কিন সাংবাদিকের শিরশ্ছেদের ভিডিও ছিল। সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপ প্রকাশিত ওই ভিডিও প্রথম প্রচার করে ইসরায়েলপন্থী গণমাধ্যম ফক্স নিউজ। পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম তা ফলাও করে প্রচার করে। তবে সাইটের অনেক তথ্যেরই বাস্তবে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
২০০৭ সালে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইট ওসামা বিন লাদেনের একটি ভিডিও সংগ্রহ করেছে, যা আল-কায়েদা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের এক মাস আগেই সংগৃহীত। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে বহু গোয়েন্দা সংস্থা সাইট থেকে ভিডিওটি ডাউনলোড করে। ওই দিনই বিকেলে ভিডিও এবং অডিওর ট্রান্সক্রিপ্ট বুশ প্রশাসনের ভেতর থেকে ফাঁস হয়ে বিভিন্ন টিভি মিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পরে দেখা গেল, ওই ভিডিওটি ভুয়া। সিরিয়ায় মার্কিন ও তার মিত্রদের হস্তক্ষেপ ত্বরান্বিত করতে সাইট অনেক ভুয়া ভিডিও প্রকাশ করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জর্দানের এক পাইলটকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ভিডিও প্রকাশ করে সাইট। এ ঘটনার পরই জর্দান সিরিয়ায় আইএসবিরোধী যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়। প্রকৃত ঘটনা হলো, ২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর জর্দানের একটি বিমান সিরিয়ার রাক্কাতে বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু পাইলট মুয়াজ আল কাসাবেহ বেঁচে গিয়ে আইসিসের হাতে ধরা পড়েন। পরের বছর ৩ জানুয়ারি তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। খবরটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ পায় এক মাস পর ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু সাইট দাবি করে, কাসাবেহকে এক মাস আগেই জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তবে নিউ ইয়র্কারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রিটা কাত্জ তাঁর তথ্যের সঠিকতার ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘তাঁর সব তথ্য সঠিক। তবে প্রচার ব্যবস্থা ভালো নয়।’
----------------------------
Comment