ঘুরে বেড়াচ্ছে মানববোমা
জঙ্গিদের পরিবার-পরিজনকে জেরা করবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। কথা বলা হবে নিখোঁজদের পরিবারের সঙ্গেও। এরই মধ্যে দেশের থানায় থানায় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিখোঁজদের তালিকা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত নিখোঁজের তালিকায় ১৪০ জনের নাম যুক্ত হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এদের সন্ধানে তদন্ত শুরু করেছে। শনিবার প্রাথমিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে ১০ জনের নাম ও ছবি। অন্যদের ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা দেশের নানা নামিদামি ভার্সিটি ও স্কুলের দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের কার্যক্রমও গোপনে পর্যবেক্ষণ চলছে।
সরকারি সূত্র বলছে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তারা জিরো টলারেন্সে। ঘুরে বেড়ানো মানববোমা নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক পর্যায়ে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে। এ ছাড়া জঙ্গিবাদবিরোধী ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাবে সরকার। দেশজুড়ে থাকবে রাজনৈতিক কর্মসূচি।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, জঙ্গিদের নানা ঘোষণায় ‘আত্মঘাতী বোমাবাজ দল’ গড়ে তোলার যে দাবি করা হয়েছে এর নজির পাচ্ছেন গোয়েন্দারা। গুলশান ও শোলাকিয়ায় নিজেদের জীবন দিয়ে হামলা পরিচালনায় উদাহরণ রেখেছে জঙ্গিরা। জঙ্গিদের একেকজন একেকটি মানববোমায় পরিণত হয়েছিল। এ ধরনের মানববোমা খ্যাত আত্মঘাতী জঙ্গি মোকাবিলায় পুলিশকে সর্বোচ্চ সক্রিয় করা হচ্ছে। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে উপযুক্ততা সৃষ্টিতে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হয়েছে। ‘এনেসথেশিয়া গ্যাস’ সাধারণত উন্নত বিশ্বে ব্যবহার হয়ে থাকে। এ গ্যাস ছোড়ার পরে অপরাধী সাময়িকভাবে অচেতন হয়ে পড়বে। একই ধরনের কাজ করে স্মোক গ্রেনেড। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ-জাতীয় সরঞ্জাম দ্রুত আনার পক্ষে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, জঙ্গিবাদ দেশি ও আন্তর্জাতিক সমস্যা। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এদের নির্মূলে যা যা করার দরকার পুলিশ তা-ই করবে। ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘গুলশান ট্র্যাজেডি এবং শোলাকিয়ার ঘটনা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। এটা বাংলাদেশের জন্য প্রথম। এর আগে এ ধরনের ঘটনা আমরা মোকাবিলা করিনি। এরপর আমরা জীবন দিয়ে জননিরাপত্তা রক্ষা করেছি। জীবন বাজি রেখে পুলিশ সদস্যরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে।’ ডিএমপি-প্রধান বলেন, ‘ইতিমধ্যে ডিএমপিতে পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়েছে। বিশেষ করে গুলশান-বারিধারা-বনানীতে পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমরা রিভিউ করেছি এবং নতুনভাবে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে চেকপোস্টের সংখ্যা বৃদ্ধি, তল্লাশি, ব্লক রেইড, পুলিশ পেট্রোল, মোবাইল পেট্রোল, মোটরবাইক পেট্রোলের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশের পাশাপাশি সব প্রতিষ্ঠানের মালিককে এগিয়ে আসতে হবে।’ দায়িত্বশীল একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, গুলশান আক্রমণ মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আগে ছিল না। এমনকি প্রয়োজনীয় সরঞ্জামেরও অভাব রয়েছে। পুলিশ থেকে অনেক দিন আগেই ‘এনেসথেশিয়া গ্যাস’ এবং একই ধরনের স্মোক গ্রেনেড চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এটি আটকে আছে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় পুরোপুরি সক্ষমতা থাকতে হবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। বিশেষ করে পুলিশের। কারণ যে কোনো ধরনের ঘটনা ঘটলেই সবার আগে পুলিশকেই হাজির হতে হয়। পুলিশের জন্য দরকার উন্নত প্রশিক্ষণ, জঙ্গিদের কুপোকাত করতে আধুনিক সরঞ্জাম, সোয়াতের মতো ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করা। অন্যথায় ঘুরে বেড়ানো মানববোমা মোকাবিলা জটিল হয়ে পড়বে। গুলশানের ঘটনায় শুরুতেই পুলিশ সাহসী ভূমিকা রাখে। ২০ প্লাটুন পুলিশ ঘিরে রাখে পুরো এলাকা। এরপর আইন প্রয়োগকারী প্রতিটি সংস্থা যৌথভাবে পুরো অপারেশন পরিচালনা করে। শোলাকিয়ার ক্ষেত্রেও সাহসী ভূমিকা রাখে পুলিশ। নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে নির্বিঘ্ন করে ঈদের জামাত। সূত্র জানায়, দেশে আত্মঘাতী বা মানববোমার সংখ্যা এবং তাদের অবস্থান জানতে গোয়েন্দারা ইতিপূর্বে গ্রেফতার জঙ্গি নেতাদের ফের জিজ্ঞাসাবাদের পরিকল্পনা নিয়েছে। তাদের পরিবার-পরিজনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত যারা নিখোঁজ হয়েছে, তাদের মা-বাবাকেও গোয়েন্দাদের জেরার মুখে পড়তে হবে। পুলিশ ও গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, এক বছরে ১৪০ জন যুবক নিখোঁজ হয়েছে। এদের বেশির ভাগই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংলিশ মিডিয়াম এবং বিদেশি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত একটি কলেজের ছাত্র। আবার এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ছাত্রও রয়েছে বলে জানা গেছে। এই নিখোঁজদের ৮৫ ভাগই উচ্চবিত্ত পরিবারের— আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিংবা অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সন্তান। অভিভাবকরা বিভিন্ন সময় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। যারা করেননি, গুলশান হামলার পর সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করতে শুরু করেন। সূত্র জানায়, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হন যে নিখোঁজ এই যুবকরা জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে। নিখোঁজ সন্তানদের মধ্যে অনেকে টেলিফোন ও ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের মা-বাবাকে জানিয়েছেন, ‘এ পথ থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়।’ কোনো কোনো বাবা-মা তাদের সন্তানদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। ওই সন্তানরা বাবা-মাকে এক কথায় জানিয়ে দেয় যে, ‘আমাদের সন্ধান কোরো না। আমরা আর কোনো দিন ফিরে আসব না। পরকালে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে।’
পদস্থ একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, সন্তানরা কাদের সঙ্গে মিশত, নিখোঁজ হওয়ার পর তারা কোন উপায়ে যোগাযোগ করেছে, বা ঢাকায় কাদের সঙ্গে মেলামেশা করত— এর সবকিছুই জানবেন বাবা-মা। যে কারণে তাদের সন্তানদের অবস্থান জানার জন্য বাবা-মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। নিখোঁজ যুবকদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। তাদের বাবা-মাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। র*্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র*্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘তরুণদের কেউ যাতে মগজ ধোলাই না করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে বেশ কিছু সন্দেহভাজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। একটানা ১০ দিন অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকা চাওয়া হবে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে।
পুলিশকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের চিঠি : সারা দেশে নিখোঁজ যুবকদের একটি তালিকা তৈরি করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে। গত সপ্তাহে গুলশানে হামলাকারীরা কয়েক মাস নিখোঁজ থাকার পর হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে এমন তথ্য পাওয়ার পর এই নির্দেশ দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বার্তা সংস্থা বাসসকে বলেন, ‘সারা দেশের সব থানায় নিখোঁজ যুবকদের একটি তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দিতে আজ আমি পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) একটি চিঠি পাঠিয়েছি।’
বর্তমানে ১৫০ যুবক নিখোঁজ রয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এ রিপোর্ট ধারণাপ্রসূত।’
- See more at: http://www.bd-pratidin.com/first-pag....TokINo2b.dpuf
Comment