আপনারা শয়তানের পথে, আমরা আল্লাহর পথে
শনিবার সকাল ৯টায় সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শুরুর নয় ঘণ্টা পর সাড়ে ৬টার দিকে উপস্থিত সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান সেনা সদর দপ্তরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান।
ভেতরে জঙ্গিদের অবস্থান রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অভিযান এখনও চলছে।
রাতেও অভিযান চলবে কি না কিংবা আর কতক্ষণ ধরে অভিযান চলতে পারে- সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা দেননি সেনা কর্মকর্তা ফখরুল।
প্রাথমিকভাবে জিম্মিদের উদ্ধারকে তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলে জানান তিনি।
“এক্ষেত্রে আমরা সফল হয়েছি। ৭৮ জনকে বের করে আনতে পেরেছি।”
ফখরুল আহসানের ব্রিফিংয়ের পর ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন নারী ও ২১টি শিশু বেরিয়ে আসেন; যারা বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নয় ঘণ্টার বেশি সময় ছিলেন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঘিরে রাখা ওই এলাকায় একই মালিকের চারতলা ও পাঁচতলা দুটির বাড়ি থেকে এই জিম্মিদের দুপুরে উদ্ধারের পর কাছের একটি ভবনে জড়ো করে রাখা হয়েছিল।
তার একটি বাড়ির নিচতলায় এক জঙ্গি দম্পতি রয়েছেন, ধারণা থেকে পুলিশ অভিযান শুরু করেছিল বৃহস্পতিবার রাতে। এরপর যায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এবং সোয়াট; সবশেষে অভিযানের নেতৃত্ব নেয় সেনাবাহিনী।
ব্রিগেডিয়ার জেনোরেল ফখরুল বলেন, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ঘটনাটি দেখে সোয়াটকে ডেকেছিল, সোয়াট এসে দেখে এই অভিযান চালানো তাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। তখন সেনাবাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়।
সোয়াট শুরুতে এই অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন স্প্রিং রেইন’। কিন্তু সেনাবাহিনী নেতৃত্ব নেওয়ার পর অভিযানের নাম বদলে হয় ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরুল কায়েস।
র*্যাব-পুলিশ প্রায় ৩০ ঘণ্টা ঘিরে রাখার পর শনিবার সকাল ৯টায় শুরু হয় সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অভিযান। তার আগে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে উপস্থিত সংবাদকর্মীসহ সবাইকে এক কিলোমিটার দূরে সরে যেতে বলা হয়।
তখন আইএসপিআরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশেদুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিলেটে জঙ্গি আস্তানায় অপারেশন টোয়াইলাইট পরিচালনা করছে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন।”
দুপুর ২টার আগ পর্যন্ত দুই বার গুলির শব্দ পাওয়া গেলেও এরপর মুহুর্মুহু গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল ভেতর থেকে। বেলা ২টার পরপরই দুটি বোমা বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। এরপর পৌনে এক ঘণ্টায় অন্তত ছয়বার বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়।
ঘণ্টা দুয়েক বিরতি দিয়ে বিকাল ৫টায় আবার দুটি বোমার শব্দ পাওয়া যায়। এরপর শুরু হয় মুহুর্মুহু গুলি, যা ৫টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত চলে। তারপর গুলি ও বোমার শব্দ থেমে যাওয়ার পর ব্রিফিংয়ে আসেন সেনা কর্মকর্তা ফখরুল আহসান।
তিনি বলেন, ভেতরে থাকা জঙ্গিরাই এই আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণ ঘটায়।
ভবনে কতজন জঙ্গি আছে-সাংবাদিকদের প্রশ্নে ব্রিগেডিয়ার আহসান বলেন, “তারা ভবনের উপর নিচ-করছে।”
অর্থাৎ জঙ্গিরা একটি তলায় থাকছে না, স্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন তলায় থাকছে।
অভিযান রাতেও চলবে কি না- প্রশ্ন করা হলে ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন, সেটা অভিযানে নেতৃত্বদানকারী কমান্ডারই ঠিক করবেন।
বেলা আড়াইটার দিকে তিনজন সেনা সদস্যকে আহত অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
বেলা ২টায় মুহুর্মুহু গুলি-বোমার আওয়াজ শোনার আগে অ্যাম্বুলেন্সটি পুলিশ বেষ্টনি অতিক্রম করে ভেতরে ঢোকানো হয়েছিল।
টান টান উত্তেজনার মধ্যে একটি দিন ও একটি রাত পার করে বৃষ্টির মধ্যে সকালে সেনাবাহিনীর এই চূড়ান্ত অভিযান শুরু হয়। ফায়ার ব্রিগেডের দুটি গাড়ি রাতেই ঘটনাস্থলে এনে রাখা হয়। সকালে সাঁজোয়া যান ও অ্যাম্বুলেন্সও আসে।
এলাকাটি এখনও ঘিরে রেখেছে র*্যাব-পুলিশ; সেনাসদস্যরা বাইরেও রয়েছেন।
অভিযানের খবর সরাসরি সম্প্রচার না করতে আইএসপিআরের পক্ষ থেকে সংবাদ মাধ্যমকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
গত বছরের মাঝামাঝিতে গুলশানে অভিযানে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিল। এরপর কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, র*্যাব, সোয়াট বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালালেও এই প্রথম সেনাবাহিনী ডাকা হল।
এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে সীতাকুণ্ডের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের আগে একই ধরনের প্রস্তুতি দেখা গিয়েছিল। তবে ওই অভিযানে প্যারা কমান্ডোদের দেখা যায়নি।
ভেতরে অবস্থানরত জঙ্গি কারা, কোন সংগঠনের, তাদের শক্তিমত্তা কেমন-সে বিষয়ে কোনো ধারণা সেনাবাহিনী কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানাননি।
যেভাবে শুরু
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ কমিশনার আবদুল মান্নান জানান, সিলেটে জঙ্গি আস্তানা থাকার তথ্য পাওয়ার পর তাদের সদস্যরা সিলেট পুলিশকে নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অনুসন্ধান চালাচ্ছিল।
এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার রাতে শিববাড়ির পাঠানপাড়ার ওই ভবনের সন্ধান পান তারা।
বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে পুলিশ সদস্যরা ওই ভবন ঘিরে ফেলে প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। ভোরের দিকে নিচতলার এক বাসার জানালা খুলে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে ছোড়া হয় গ্রেনেড।
পরে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায় এবং পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হয় বলে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রোকনউদ্দিন জানান।
পাঁচতলা ওই বাড়ির পাশের চারতলা ভবনটিরও মালিক ব্যবসায়ী উস্তার আলী। তার দুটি ভবন ঘিরেই বৃহস্পতিবার রাত ৩টা থেকে এই অভিযানের সূচনা।
শুক্রবার বিকালে ঢাকা থেকে এসে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় সোয়াটের একটি দল। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামও মধ্যরাতের পর ঘটনাস্থলে পৌঁছান।
সন্ধ্যার আগে আগে হাতকড়া পরিয়ে লুঙ্গি পড়া এক যুবককে ওই বাড়ির দিক থেকে নিয়ে আসেন পুলিশ সদস্যরা। তার পরিচয় জানতে চাইলে পুলিশ কমিশনার শুধু বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তারা ওই যুবককে আটক করেছেন।
সেনাবাহিনীর একটি প্যারা-কমান্ডো দল রাতে ঘটনাস্থলে যায়। সকালে আরেকটি দল যাওয়ার পর অভিযানের নেতৃত্বে হাতবদল হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ওই আস্তানায় অন্তত একজন নারী ও একজন পুরুষ জঙ্গি রয়েছেন বলে তারা ধারণা করছেন। কাউছার আলী ও মর্জিনা বেগম নামে ওই দুইজন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলেন কয়েক মাস আগে।
পুলিশের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার দুপুরে হ্যান্ড মাইকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হলেও জঙ্গিরা তাতে সাড়া দেয়নি। বরং জানালা ফাঁক করে তারা পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি সোয়াট পাঠাতে বলে।
তখন পাঁচতলা ভবনটির অন্যান্য ফ্ল্যাটে যে পরিবারগুলো আটকে আছে, তাদের দরজা-জানালা বন্ধ করে ভেতর থাকার পরামর্শ দেওয়া হয় পুলিশের হ্যান্ড মাইক থেকে।
‘সোয়াট পাঠাও, সময় কম’
পুরো এলাকা ঘিরে ফেলার কথা জানিয়ে শুক্রবার দুপুরের দিকে ‘জঙ্গিদের’ আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।
সন্দেহভাজন ওই নারী জঙ্গির নাম উল্লেখ করে পুলিশের হ্যান্ড মাইকে বলা হয়, “মর্জিনা বেগম, আপনাদের চারদিক দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করুন।”
এক পর্যায়ে বেলা দেড়টার দিকে পুলিশের একজন এসআই সন্দেহভাজন জঙ্গিদের উদ্দেশে মাইকে বলেন, “আপনারা মুসলমান, আমরাও মুসলমান। আপনাদের কোনো বক্তব্য থাকলে মিডিয়ার ভাইয়েরা আছেন, আপনারা কথা বলুন।”
এ সময় ওই বাড়ি থেকে জানালা ফাঁক করে নারী কণ্ঠ জবাব দেন, “আপনারা শয়তানের পথে, আমরা আল্লাহর পথে।”
এর পরপরই আরেক পুরুষকণ্ঠে পুলিশের উদ্দেশে বলা হয়, “দেরি করছ কেন? আমাদের সময় কম। তাড়াতাড়ি সোয়াট পাঠাও।”
বাড়ির মালিক উস্তার আলী জানান, তিন মাস আগে কাউছার আলী ও মর্জিনা বেগম নামে দুজন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে তার পাঁচ তলা বাড়ির নিচতলার চার নম্বর বাসাটি ভাড়া নেন। সে সময় কাউছার নিজেকে একটি বেসরকারি কোম্পানির অডিট অফিসার হিসেবে পরিচয় দেন।
আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় জড়িত উস্তার বলেন, “সব নিয়ম মেনেই তাদের বাসা ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। দুজনের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপিও রাখা হয়েছে। তারা নিয়মিত ভাড়াও দিয়ে আসছে।”
Comment