আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন তিনি রাসুল (সাঃ) কে বলতে শুনেছেন-
কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম এমন এক ব্যক্তির ব্যপারে ফয়সালা হবে যে শহীদ হয়েছিল। তাকে আনা হবে এবং তাকে যেসব সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল তা পেশ করা হবে। সে তা চিনতে পারবে। আল্লাহ তা’য়ালা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘আমি যে সমস্ত নিয়ামত তোমাকে দিয়েছিলাম, তার বিনিময়ে তুমি কি কাজ করেছ?’ সে বলবে, আমি আপনার পথে লড়াই করে শহীদ হয়েছি। তিনি বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এজন্য লড়াই করেছ যে, লোকেরা তোমাকে বীর বাহাদুর বলবে! আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অতঃপর আরেক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, সে ইলম অর্জন করেছে, তা লোকদের শিক্ষা দিয়েছে আর কুরআন পাঠ করেছে। তাকে উপস্থিত করা হবে এবং তাকে দেওয়া সুযোগ সুবিধা গুলোও তার সামনে তুলে ধরা হবে। সে তা দেখে চিনতে পারবে। তুমি তোমার নিয়ামতের কি সদ্ব্যাবহার করেছ? সে বলবে আমি ইলম অর্জন করেছি, লোকদের তা শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন পাঠ করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। বরং তুমি এই উদ্দেশ্যে বিদ্যা অর্জন করেছিলে যে, লোকেরা তোমাকে আলেম না বিদ্বান বলবে, এবং কুরআন এই জন্য পাঠ করেছিলে যে, তোমাকে ‘ক্বারী’ বলা হবে। আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অতঃপর আরেক ব্যক্তিকে আনা হবে, তাকে আল্লাহ অজস্র ধন দৌলত দান করেছেন এবং নানা প্রকারের ধন সম্পদ দিয়েছেন। তাকে দেওয়া সুযোগ সুবিধা গুলোও তার সামনে তুলে ধরা হবে। সে তা দেখে চিনতে পারবে। আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তোমার এ সম্পদ দ্বারা তুমি কি কাজ করেছ? সে বলবে, যেখানে ব্যায় করলে আপনি সন্তুশ্ত হবেন এমন কোন খাত আমি বাদ দেইনি বরং সেখানেই খরচ করেছি আপনার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। মহান আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এই জন্য দান করেছ যে, লোকেরা তোমাকে দাতা বলবে। আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।(সহীহ মুসলিমঃ ৪৭৭১ )
কেবলমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যাবতীয় কাজ সম্পাদন করার নামই হল ইখলাস। কে দেখছে কে দেখছেনা সেটা না ভেবে লোকচক্ষু বা লোকলজ্জাকে অবজ্ঞা করে আল্লাহ্ সর্বক্ষণ আমাদের দেখছেন এই ভয় বা ভাবনা মাথায় রেখে আমাদের প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত সমস্ত কাজগুলো সম্পাদন করবার নামই হল ইখলাস। পবিত্র কোরআনে সুন্দর অনেক আয়াত আছে এই ব্যাপারে। মহান আল্লাহ্-তায়ালা বলেনঃ
يُوفُونَ بِالنَّذْرِ وَيَخَافُونَ يَوْمًا كَانَ شَرُّهُ مُسْتَطِيرًا [٧٦:٧]
وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا [٧٦:٨]
إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا [٧٦:٩]
“তারা মান্নত পূর্ণ করে এবং সেদিনকে ভয় করে, যেদিনের অনিষ্ট হবে সুদূরপ্রসারী। তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে।তারা বলেঃ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।” [সূরা আদ-দাহর, ৭৬:৭-৯]
ইমাম আল-গাজ্জালী (রঃ) বলেন, যদি কেউ জানতে চায় যে সে যা করছে তা কেবলমাত্র আল্লাহ-তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই কিনা, তখন তার উচিত কেউ যখন তার প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তখন তার নিজের অনুভূতি কেমন হয় সেটা লক্ষ্য করা। যদি সে ভেবে বসে যে, “আমি কত নেকবান মানুষ, আমি অন্যকে উপকার করেছি” বা “হু! এত কষ্ট করলাম তাদের জন্য। কিন্তু প্রশংসা তো দূরে থাক, একটা থ্যাংকস পর্যন্ত দিল না কেউ…” এধরনের অনুভূতি যদি হয়ে থাকে আপনার তবে আপনি হয়তো কেবলমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য করেননি কাজটা, আল্লাহ্র সন্তুষ্টির সাথে সাথে মনের অজান্তে অন্যকিছুও হয়তো প্রত্যাশা করছিলেন এই কাজের বিনিময়ে।
আমরা অনেকেই হয়ত জান্নাতবাসী পতিতার গল্পটা শুনেছি যে কিনা শুধুমাত্র পিপাসায় ছটফট করতে থাকা একটা কুকুরকে পানি পান করানোর বিনিময়ে জান্নাতে যাবে। এখন আমার প্রশ্ন, এই সামান্য কাজের বিনিময়েই জান্নাত পেয়ে গেল সে??! ব্যাপারটা কি এতই সহজ যে শুধু ওইটুকু কাজের জন্যই জান্নাত পেয়ে গেল সে?? হতেই পারেনা এটা। কেননা একটু আগেই তো জানলাম আমরা, এত সৎকাজ করার পরও এক জ্ঞানী ব্যক্তি, এক শহীদ এবং একজন দানশীল ব্যক্তির জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবার গল্প। আসলে মূল পার্থক্যটা হল ইখলাস। এই সামান্য কাজটা করেই ওই মহিলা জান্নাতে যাবে কেননা সেই কাজটা ছিল কেবলমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করবার জন্য। আর এতসব সৎকাজের পরও উপরোক্ত তিন ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে কেননা সেসব কাজ ছিল লোকের প্রশংসা অর্জনের জন্য। দেখুন নিয়তের এই সামান্য তারতম্যের পরিনতি কি! এজন্যই বিজ্ঞ আলেমগন সবসময় বলে থাকেন আমাদের প্রত্যেকটা কাজের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
ইখলাস আর ইহসান খুব কাছাকাছি। যখন ইবাদত বা বা উপাসনা করবেন তখন মনে করবেন আপনি আল্লাহ্কে দেখছেন আর আল্লাহ্ আপনাকে দেখছেন – এটাই হল ইহসান।
খুর্রাম মুরাদ বলেন, “উদ্দেশ্য বা নিয়ত হল আমাদের আত্মার মত অথবা বীজের ভিতরে থাকা প্রাণশক্তির মত। বেশীরভাগ বীজই দেখতে মোটামুটি একইরকম, কিন্তু লাগানোর পর বীজগুলু যখন চারাগাছ হয়ে বেড়ে উঠে আর ফল দেওয়া শুরু করে তখন আসল পার্থক্যটা পরিষ্কার হয়ে যায় আমাদের কাছে। একইভাবে নিয়ত যত বিশুদ্ধ হবে আমাদের কাজের ফলও তত ভাল হবে।”*
ইখলাস হল যেকোনো কাজের মূলভিত্তি। মূলভিত্তি দুর্বল হলে যেমন বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ে সহজেই, ঠিক তেমনই হবে আমদের কাজের পরিণতি সেটা যদি হয় ইখলাস-বিহীন।
আচ্ছা, ইখলাসের এই ধারনাটি কি শুধুমাত্র কোন বিশেষ ইবাদতের জন্য প্রযোজ্য নাকি আমাদের প্রত্যেকটি কাজের জন্যই প্রযোজ্য এটা?
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ-তায়ালা বলেনঃ
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ [٦:١٦٢]
“আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কোরবাণী এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে।” [সূরা আল আন-আম, ৬:১৬২]
এই আয়াত অনুযায়ী আমাদের সবকিছুই হওয়া উচিত আল্লাহর জন্য। তাছাড়াও খুর্রাম মুরাদ বলেন, “সাধারণত লোকেরা কাজকে দুইভাগে ভাগ করে থাকে- দৈনন্দিন কাজকর্ম ও ধর্মীয় কাজ। কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখা উচিত ধর্মীয় কাজ হল কেবলমাত্র সেগুলোই, যে সকল কাজ কেবল মাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য করা হয়। আর যে সকল কাজ আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয় না তা বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতই “ধর্মীয়” মনে হোক না কেন আসলে তা দুনিয়াবি কাজ।… যখন কেউ তার
পরিবারের জন্য ও আল্লাহর পথে ব্যায় করার জন্য টাকাপয়সা কামাই করে তবে সেটাও অনেক বড় একটা ধর্মীয় (সওয়াবের) কাজ যদি তা করা হয় কেবলমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।”
এমনকি আমাদের ঘুমও হতে পারে কেবলমাত্র আল্লাহ্র জন্য; কেউ যদি ফজরের নামাজ পড়বার উদ্দ্যশ্যে ঘুমিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি তবে সেই ঘুমটা হবে আল্লাহ্র জন্য। একবার ভাবুন শুধু, ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সওয়াব বা নেকী অর্জন করছেন আপনি! পার্থক্যটা কেবল নিয়তের।
ঈখলাসের গুরুত্ব
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ-তায়ালা বলেনঃ
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ ۚ وَذَٰلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ [٩٨:٥]
“তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদত করবে…।” [সূরা বাইয়্যিনাহ, ৯৮:৫]
কোরআনে বর্ণিত হযরত ইউসুফ (আঃ) এর কাহিনীটি লক্ষ্য করলে বুঝতে পারব আমরা কেবলমাত্র ইখলাসের কারণেই বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। সূরা ইউসুফে আল্লাহ-তায়ালা বলেনঃ
وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ ۖ وَهَمَّ بِهَا لَوْلَا أَن رَّأَىٰ بُرْهَانَ رَبِّهِ ۚ كَذَٰلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ ۚ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ [١٢:٢٤]
“আর সে নারী নিশ্চয়ই তার প্রতি আসক্ত হয়েছিল, আর সেও [ইউসুফ(আঃ)] তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ত যদি না সে তার পালনকর্তার স্পষ্ট-প্রমাণ প্রত্যক্ষ করতে। এইভাবে আমরা যেন তার কাছ থেকে হটিয়ে দিতে পারি মন্দকাজ ও অশ্লীলতা। নিঃসন্দেহে সে ছিল আমার একান্ত অনুরক্ত বান্দাদের একজন।” [সূরা ইউসূফ, ১২:২৪]
সুবহানাল্লাহ! অধিকন্তু, শয়তান সবাইকেই আক্রমণ করতে পারে কেবলমাত্র তাদের ব্যতীত যাদের রয়েছে ইখলাস। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ-তায়ালা বলেনঃ
قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ [١٥:٣٩]
إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ [١٥:٤٠]
“সে [শয়তান] বললঃ হে আমার পলনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথ ভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ঠ করে দেব।আপনার মনোনীত বান্দাদের ব্যতীত।” [সূরা হিজর, ১৫:৩৯-৪০]
এই মুহূর্তে উমর (রাদিআল্লাহু আনহু) এর ব্যাপারে বলা নবী করিম(সাঃ ) এর একটা কথা মনে পড়ে গেল আমারঃ “উমর(রাদিআল্লাহু আনহু) যে পথে আছে শয়তান সে পথ পরিহার করে চলবে কেননা সে তাকে ভয় পায়।”(বুখারী-কিতাবুল আদাবঃ ১০৮)
ভেবে দেখুন তাহলে একবার কত মজবুত আর কত বিশুদ্ধ ছিল উনাদের ইখলাস, আর আমরা কোথায় আছি আজ!
যার ইখলাস যত বিশুদ্ধ, সে আল্লাহ্র কাছে তত প্রিয়। যেহেতু মানুষ আমরা, ভুল আমাদের হয়েই যায়, তাই মাঝেমধ্যে আমাদের ইখলাসের সাথে অন্যসব দুনিয়াবি উদ্দেশ্যও ঢুকে পড়ে আমদের মনের মধ্যে। আর মাঝে মধ্যে এমনও হয় যে ঠিক কি উদ্দ্যশ্যে কাজগুলো করছি সেটা নিজেরাই জানি না আমরা। আর তাই নিয়তের পরিশুদ্ধতার সবসময় সতর্ক থাকা উচিত আমাদের। আর যতক্ষণ পর্যন্ত একমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য কাজ করার ব্যপারে সর্বদা সচেতন থাকতে চেষ্টা করব আমারা ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সেই প্রচেষ্টার জন্যও আল্লাহ্র কাছ থেকে উত্তম বিনিময় পাব আমরা ইনশাআল্লাহ্।
তবে আমাদের শঙ্কিত বা হতাশ হবার কিছু নেই। আম্র বিন আল-আ’স থেকে বর্ণিত, রসুল(সঃ) বলেছেন, “বিচার দিবসে আমার উম্মতদের মধ্যথেকে একজনকে সমস্ত সৃষ্টিকুলের সামনে ডেকে তার নিরানব্বইটা আমল (যার প্রত্যেকটিই দুচোখে যতদূর দেখা যায় তার চাইতেও অধিক) তার সামনে উপস্থিত করে বলা হবেঃ ‘এর মধ্যে কোন আমল কি অস্বীকার করতে পারবে তুমি?’ সে বলবেঃ ‘না, আমার প্রভু।’ তখন তাকে বলা হবে, ‘তোমার কি ওজর বা ভাল আমল আছে কোন?’ সে বলবে, “না, নেই।” তখন তাকে বলা হবে, ‘না, কিছু ভাল কাজ তোমার আছে বটে, অবিচার করা হবেনা আজ তোমার প্রতি কোন।’ তাকে তখন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লা, মুহাম্মদুর রসুল্লাল্লাহ” লেখা দেখানো হবে একটা। তখন সে বলবে, ও আল্লাহ্! কিসের লেখা এটা?’ তখন তাকে বলা হবে, ‘তোমার প্রতি কোন অবিচার করা হবেনা আজ।’ এরপর তার নিরানব্বইটা (মন্দ) আমল রাখা হবে নিক্তির এক পাশে আর অন্যপাশে রাখা হবে লেখাটা। তখন দেখা যাবে ওই লেখার ওজন হবে ওইসব মন্দ আমলের চাইতেও বেশি।” [তিরমিযি]
বুঝতেই তো পারছেন কারণটা কি এর। কারণ আর কিছুই নয়; এটা হল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লা’ অর্থাৎ আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন ইলাহ্ নেই- এই কথায় পরিপূর্ণ, বিশুদ্ধ ও একাগ্র আস্থার ফল।
ইখলাসের গোপন রহস্য
ইখলাস হল এমন একটা জিনিস যা আল্লাহ্ তার সেই সব বান্দাদের অন্তরে প্রতিস্থাপন করে দেন যারা এটা মনে প্রানে কামনা করে। শেখ ওমর আব্দেল-কাফীর মতে ইখলাসের তিনটি গোপন রহস্য হলঃ
১. যে ব্যক্তির অন্তরে ইখলাস আছে তা নিয়ে সে গর্ব বা অহংকার করে না কখনোই। উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, যদি কেউ লোকচক্ষু পরিহার করে একান্তে বা গোপনে সালাত আদায় করে কিন্তু মনে মনে ভেবে নেয় যে তার ইখলাস অন্যদের চাইতে বেশী (তাই সে এটা করতে পারে) তবে অহংকারের ফাঁদে পড়ে গেল সে। কেননা একমাত্র আল্লাহ্ই জানেন কার ইখলাস বেশী।
২. ইখলাস হল একমাত্র আল্লাহ্ও তার বান্দার মধ্যকার ব্যাপার; এমনকি ফেরেশতারাও জানতে পারেনা এটা, তাই লিখেও রাখেনা এটা তারা। উপরে বর্ণিত শহীদ, আলেম ও দানশীল ব্যক্তির ঘটনা থেকেও এটা পরিষ্কার বুঝা যায়- ফেরেশতারা শুধু তাদের সৎকাজগুলুই লিপিবদ্ধ করে রেখেছিল, কিন্তু সেসব কাজের পিছনে সত্যিকারের উদ্দেশ্য কি ছিল তা একমাত্র আল্লাহ-তায়ালাই প্রকাশ করেছিলেন।
৩. কারো ইখলাস যদি বিশুদ্ধ হয় তবে শয়তান তাকে কখনোই আক্রমণ করতে পারেনা ।
বিশুদ্ধ ইখলাসের ব্যক্তিদের উদাহারন
বিশুদ্ধ ইখলাসের একটা সুন্দর উদাহারন হল মরিয়ম(আঃ) এর মা,
إِذْ قَالَتِ امْرَأَتُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي ۖ إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ [٣:٣٥]
“এমরানের স্ত্রী যখন বললো-হে আমার পালনকর্তা! আমার গর্ভে যা রয়েছে আমি তাকে তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত রেখে। আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও, নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞাত।” [সূরা আল ইমরান, ৩:৩৫]
তিনি আল্লাহর সাথে এক অপূর্ব একান্ত আলাপচারিতা করছিলেন। তিনি আল্লাহ্কে বলছেন তার গর্ভের সন্তান কেবলমাত্র আল্লাহ্র জন্য উৎসর্গ করেছেন তিনি। অর্থাৎ তিনি তার সন্তানকে এমনভাবে লালনপালন করবেন যেন সে হয় আল্লাহভক্ত—শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য। আর সেই একাগ্র, বিশুদ্ধচিত্তের কথোপকথনে খুশি হয়ে আল্লাহ্ তাকে উপহার দিলেন সর্বকালের সর্বোত্তম কন্যাদের (নারীদের) একজনঃ মরিয়ম(আঃ)।
যিনি আল্লাহ্র অনুগ্রহে আল্লাহ্র কাছে করা তার মায়ের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অন্য একটা উদাহারন হল খালিদ বিন আল-ওয়ালিদ (রাদিআল্লাহু আনহু)-
একদিন উমর (রাদিআল্লাহু আনহু) হঠাৎ তাকে তার সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করে নিলেন। নিজেকে একবার তার জায়গায় ভেবে দেখুন। আপনি কোন দলের দলপতি, অথবা কোন প্রতিষ্ঠানের ম্যনেজার। হঠাৎ করে ম্যানেজমেন্ট এ রদবদল হল, আর আপনাকে আপনার পদ থেকে অপসারন করা হল বা নিচের সাধারন কর্মীদের স্তরে নামিয়ে দেওয়া হল। আপনার প্রতিক্রিয়া কি হবে? আপনার কাজে তার কি প্রভাব পড়বে? ক্ষোভ, অপমান আর রাগে সে চাকরি বা কাজ কি করতে ইচ্ছে করবে আর আপনার?? কিন্তু খালিদ (রাদিআল্লাহু আনহু) কি করেছিলেন জানেন? অপমানিত বোধ করা বা যুদ্ধ করতে অসম্মতি জানানো তো দূরে থাক, উল্টো তিনি আরও বেশী অনুপ্রেরণা আর প্রাণশক্তি নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যখন থাকে জিজ্ঞাস করা হয়েছিল কেন, তিনি বলেছিলেন, “আমি আল্লাহ্র জন্য যুদ্ধ করি, উমরের জন্য নয়।” তিনি এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে কোন বিশেষ পদমর্যাদার জন্য নয়, কেবলমাত্র আল্লাহ-তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য যুদ্ধ করছেন তিনি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইখলাস অর্জনের তৌফিক দান করুক!
collected
কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম এমন এক ব্যক্তির ব্যপারে ফয়সালা হবে যে শহীদ হয়েছিল। তাকে আনা হবে এবং তাকে যেসব সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল তা পেশ করা হবে। সে তা চিনতে পারবে। আল্লাহ তা’য়ালা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘আমি যে সমস্ত নিয়ামত তোমাকে দিয়েছিলাম, তার বিনিময়ে তুমি কি কাজ করেছ?’ সে বলবে, আমি আপনার পথে লড়াই করে শহীদ হয়েছি। তিনি বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এজন্য লড়াই করেছ যে, লোকেরা তোমাকে বীর বাহাদুর বলবে! আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অতঃপর আরেক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, সে ইলম অর্জন করেছে, তা লোকদের শিক্ষা দিয়েছে আর কুরআন পাঠ করেছে। তাকে উপস্থিত করা হবে এবং তাকে দেওয়া সুযোগ সুবিধা গুলোও তার সামনে তুলে ধরা হবে। সে তা দেখে চিনতে পারবে। তুমি তোমার নিয়ামতের কি সদ্ব্যাবহার করেছ? সে বলবে আমি ইলম অর্জন করেছি, লোকদের তা শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন পাঠ করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। বরং তুমি এই উদ্দেশ্যে বিদ্যা অর্জন করেছিলে যে, লোকেরা তোমাকে আলেম না বিদ্বান বলবে, এবং কুরআন এই জন্য পাঠ করেছিলে যে, তোমাকে ‘ক্বারী’ বলা হবে। আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অতঃপর আরেক ব্যক্তিকে আনা হবে, তাকে আল্লাহ অজস্র ধন দৌলত দান করেছেন এবং নানা প্রকারের ধন সম্পদ দিয়েছেন। তাকে দেওয়া সুযোগ সুবিধা গুলোও তার সামনে তুলে ধরা হবে। সে তা দেখে চিনতে পারবে। আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তোমার এ সম্পদ দ্বারা তুমি কি কাজ করেছ? সে বলবে, যেখানে ব্যায় করলে আপনি সন্তুশ্ত হবেন এমন কোন খাত আমি বাদ দেইনি বরং সেখানেই খরচ করেছি আপনার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। মহান আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এই জন্য দান করেছ যে, লোকেরা তোমাকে দাতা বলবে। আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।(সহীহ মুসলিমঃ ৪৭৭১ )
কেবলমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যাবতীয় কাজ সম্পাদন করার নামই হল ইখলাস। কে দেখছে কে দেখছেনা সেটা না ভেবে লোকচক্ষু বা লোকলজ্জাকে অবজ্ঞা করে আল্লাহ্ সর্বক্ষণ আমাদের দেখছেন এই ভয় বা ভাবনা মাথায় রেখে আমাদের প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত সমস্ত কাজগুলো সম্পাদন করবার নামই হল ইখলাস। পবিত্র কোরআনে সুন্দর অনেক আয়াত আছে এই ব্যাপারে। মহান আল্লাহ্-তায়ালা বলেনঃ
يُوفُونَ بِالنَّذْرِ وَيَخَافُونَ يَوْمًا كَانَ شَرُّهُ مُسْتَطِيرًا [٧٦:٧]
وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا [٧٦:٨]
إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا [٧٦:٩]
“তারা মান্নত পূর্ণ করে এবং সেদিনকে ভয় করে, যেদিনের অনিষ্ট হবে সুদূরপ্রসারী। তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে।তারা বলেঃ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।” [সূরা আদ-দাহর, ৭৬:৭-৯]
ইমাম আল-গাজ্জালী (রঃ) বলেন, যদি কেউ জানতে চায় যে সে যা করছে তা কেবলমাত্র আল্লাহ-তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই কিনা, তখন তার উচিত কেউ যখন তার প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তখন তার নিজের অনুভূতি কেমন হয় সেটা লক্ষ্য করা। যদি সে ভেবে বসে যে, “আমি কত নেকবান মানুষ, আমি অন্যকে উপকার করেছি” বা “হু! এত কষ্ট করলাম তাদের জন্য। কিন্তু প্রশংসা তো দূরে থাক, একটা থ্যাংকস পর্যন্ত দিল না কেউ…” এধরনের অনুভূতি যদি হয়ে থাকে আপনার তবে আপনি হয়তো কেবলমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য করেননি কাজটা, আল্লাহ্র সন্তুষ্টির সাথে সাথে মনের অজান্তে অন্যকিছুও হয়তো প্রত্যাশা করছিলেন এই কাজের বিনিময়ে।
আমরা অনেকেই হয়ত জান্নাতবাসী পতিতার গল্পটা শুনেছি যে কিনা শুধুমাত্র পিপাসায় ছটফট করতে থাকা একটা কুকুরকে পানি পান করানোর বিনিময়ে জান্নাতে যাবে। এখন আমার প্রশ্ন, এই সামান্য কাজের বিনিময়েই জান্নাত পেয়ে গেল সে??! ব্যাপারটা কি এতই সহজ যে শুধু ওইটুকু কাজের জন্যই জান্নাত পেয়ে গেল সে?? হতেই পারেনা এটা। কেননা একটু আগেই তো জানলাম আমরা, এত সৎকাজ করার পরও এক জ্ঞানী ব্যক্তি, এক শহীদ এবং একজন দানশীল ব্যক্তির জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবার গল্প। আসলে মূল পার্থক্যটা হল ইখলাস। এই সামান্য কাজটা করেই ওই মহিলা জান্নাতে যাবে কেননা সেই কাজটা ছিল কেবলমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করবার জন্য। আর এতসব সৎকাজের পরও উপরোক্ত তিন ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে কেননা সেসব কাজ ছিল লোকের প্রশংসা অর্জনের জন্য। দেখুন নিয়তের এই সামান্য তারতম্যের পরিনতি কি! এজন্যই বিজ্ঞ আলেমগন সবসময় বলে থাকেন আমাদের প্রত্যেকটা কাজের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
ইখলাস আর ইহসান খুব কাছাকাছি। যখন ইবাদত বা বা উপাসনা করবেন তখন মনে করবেন আপনি আল্লাহ্কে দেখছেন আর আল্লাহ্ আপনাকে দেখছেন – এটাই হল ইহসান।
খুর্রাম মুরাদ বলেন, “উদ্দেশ্য বা নিয়ত হল আমাদের আত্মার মত অথবা বীজের ভিতরে থাকা প্রাণশক্তির মত। বেশীরভাগ বীজই দেখতে মোটামুটি একইরকম, কিন্তু লাগানোর পর বীজগুলু যখন চারাগাছ হয়ে বেড়ে উঠে আর ফল দেওয়া শুরু করে তখন আসল পার্থক্যটা পরিষ্কার হয়ে যায় আমাদের কাছে। একইভাবে নিয়ত যত বিশুদ্ধ হবে আমাদের কাজের ফলও তত ভাল হবে।”*
ইখলাস হল যেকোনো কাজের মূলভিত্তি। মূলভিত্তি দুর্বল হলে যেমন বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ে সহজেই, ঠিক তেমনই হবে আমদের কাজের পরিণতি সেটা যদি হয় ইখলাস-বিহীন।
আচ্ছা, ইখলাসের এই ধারনাটি কি শুধুমাত্র কোন বিশেষ ইবাদতের জন্য প্রযোজ্য নাকি আমাদের প্রত্যেকটি কাজের জন্যই প্রযোজ্য এটা?
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ-তায়ালা বলেনঃ
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ [٦:١٦٢]
“আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কোরবাণী এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে।” [সূরা আল আন-আম, ৬:১৬২]
এই আয়াত অনুযায়ী আমাদের সবকিছুই হওয়া উচিত আল্লাহর জন্য। তাছাড়াও খুর্রাম মুরাদ বলেন, “সাধারণত লোকেরা কাজকে দুইভাগে ভাগ করে থাকে- দৈনন্দিন কাজকর্ম ও ধর্মীয় কাজ। কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখা উচিত ধর্মীয় কাজ হল কেবলমাত্র সেগুলোই, যে সকল কাজ কেবল মাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য করা হয়। আর যে সকল কাজ আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয় না তা বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতই “ধর্মীয়” মনে হোক না কেন আসলে তা দুনিয়াবি কাজ।… যখন কেউ তার
পরিবারের জন্য ও আল্লাহর পথে ব্যায় করার জন্য টাকাপয়সা কামাই করে তবে সেটাও অনেক বড় একটা ধর্মীয় (সওয়াবের) কাজ যদি তা করা হয় কেবলমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।”
এমনকি আমাদের ঘুমও হতে পারে কেবলমাত্র আল্লাহ্র জন্য; কেউ যদি ফজরের নামাজ পড়বার উদ্দ্যশ্যে ঘুমিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি তবে সেই ঘুমটা হবে আল্লাহ্র জন্য। একবার ভাবুন শুধু, ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সওয়াব বা নেকী অর্জন করছেন আপনি! পার্থক্যটা কেবল নিয়তের।
ঈখলাসের গুরুত্ব
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ-তায়ালা বলেনঃ
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ ۚ وَذَٰلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ [٩٨:٥]
“তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদত করবে…।” [সূরা বাইয়্যিনাহ, ৯৮:৫]
কোরআনে বর্ণিত হযরত ইউসুফ (আঃ) এর কাহিনীটি লক্ষ্য করলে বুঝতে পারব আমরা কেবলমাত্র ইখলাসের কারণেই বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। সূরা ইউসুফে আল্লাহ-তায়ালা বলেনঃ
وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ ۖ وَهَمَّ بِهَا لَوْلَا أَن رَّأَىٰ بُرْهَانَ رَبِّهِ ۚ كَذَٰلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ ۚ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ [١٢:٢٤]
“আর সে নারী নিশ্চয়ই তার প্রতি আসক্ত হয়েছিল, আর সেও [ইউসুফ(আঃ)] তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ত যদি না সে তার পালনকর্তার স্পষ্ট-প্রমাণ প্রত্যক্ষ করতে। এইভাবে আমরা যেন তার কাছ থেকে হটিয়ে দিতে পারি মন্দকাজ ও অশ্লীলতা। নিঃসন্দেহে সে ছিল আমার একান্ত অনুরক্ত বান্দাদের একজন।” [সূরা ইউসূফ, ১২:২৪]
সুবহানাল্লাহ! অধিকন্তু, শয়তান সবাইকেই আক্রমণ করতে পারে কেবলমাত্র তাদের ব্যতীত যাদের রয়েছে ইখলাস। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ-তায়ালা বলেনঃ
قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ [١٥:٣٩]
إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ [١٥:٤٠]
“সে [শয়তান] বললঃ হে আমার পলনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথ ভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ঠ করে দেব।আপনার মনোনীত বান্দাদের ব্যতীত।” [সূরা হিজর, ১৫:৩৯-৪০]
এই মুহূর্তে উমর (রাদিআল্লাহু আনহু) এর ব্যাপারে বলা নবী করিম(সাঃ ) এর একটা কথা মনে পড়ে গেল আমারঃ “উমর(রাদিআল্লাহু আনহু) যে পথে আছে শয়তান সে পথ পরিহার করে চলবে কেননা সে তাকে ভয় পায়।”(বুখারী-কিতাবুল আদাবঃ ১০৮)
ভেবে দেখুন তাহলে একবার কত মজবুত আর কত বিশুদ্ধ ছিল উনাদের ইখলাস, আর আমরা কোথায় আছি আজ!
যার ইখলাস যত বিশুদ্ধ, সে আল্লাহ্র কাছে তত প্রিয়। যেহেতু মানুষ আমরা, ভুল আমাদের হয়েই যায়, তাই মাঝেমধ্যে আমাদের ইখলাসের সাথে অন্যসব দুনিয়াবি উদ্দেশ্যও ঢুকে পড়ে আমদের মনের মধ্যে। আর মাঝে মধ্যে এমনও হয় যে ঠিক কি উদ্দ্যশ্যে কাজগুলো করছি সেটা নিজেরাই জানি না আমরা। আর তাই নিয়তের পরিশুদ্ধতার সবসময় সতর্ক থাকা উচিত আমাদের। আর যতক্ষণ পর্যন্ত একমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য কাজ করার ব্যপারে সর্বদা সচেতন থাকতে চেষ্টা করব আমারা ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সেই প্রচেষ্টার জন্যও আল্লাহ্র কাছ থেকে উত্তম বিনিময় পাব আমরা ইনশাআল্লাহ্।
তবে আমাদের শঙ্কিত বা হতাশ হবার কিছু নেই। আম্র বিন আল-আ’স থেকে বর্ণিত, রসুল(সঃ) বলেছেন, “বিচার দিবসে আমার উম্মতদের মধ্যথেকে একজনকে সমস্ত সৃষ্টিকুলের সামনে ডেকে তার নিরানব্বইটা আমল (যার প্রত্যেকটিই দুচোখে যতদূর দেখা যায় তার চাইতেও অধিক) তার সামনে উপস্থিত করে বলা হবেঃ ‘এর মধ্যে কোন আমল কি অস্বীকার করতে পারবে তুমি?’ সে বলবেঃ ‘না, আমার প্রভু।’ তখন তাকে বলা হবে, ‘তোমার কি ওজর বা ভাল আমল আছে কোন?’ সে বলবে, “না, নেই।” তখন তাকে বলা হবে, ‘না, কিছু ভাল কাজ তোমার আছে বটে, অবিচার করা হবেনা আজ তোমার প্রতি কোন।’ তাকে তখন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লা, মুহাম্মদুর রসুল্লাল্লাহ” লেখা দেখানো হবে একটা। তখন সে বলবে, ও আল্লাহ্! কিসের লেখা এটা?’ তখন তাকে বলা হবে, ‘তোমার প্রতি কোন অবিচার করা হবেনা আজ।’ এরপর তার নিরানব্বইটা (মন্দ) আমল রাখা হবে নিক্তির এক পাশে আর অন্যপাশে রাখা হবে লেখাটা। তখন দেখা যাবে ওই লেখার ওজন হবে ওইসব মন্দ আমলের চাইতেও বেশি।” [তিরমিযি]
বুঝতেই তো পারছেন কারণটা কি এর। কারণ আর কিছুই নয়; এটা হল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লা’ অর্থাৎ আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন ইলাহ্ নেই- এই কথায় পরিপূর্ণ, বিশুদ্ধ ও একাগ্র আস্থার ফল।
ইখলাসের গোপন রহস্য
ইখলাস হল এমন একটা জিনিস যা আল্লাহ্ তার সেই সব বান্দাদের অন্তরে প্রতিস্থাপন করে দেন যারা এটা মনে প্রানে কামনা করে। শেখ ওমর আব্দেল-কাফীর মতে ইখলাসের তিনটি গোপন রহস্য হলঃ
১. যে ব্যক্তির অন্তরে ইখলাস আছে তা নিয়ে সে গর্ব বা অহংকার করে না কখনোই। উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, যদি কেউ লোকচক্ষু পরিহার করে একান্তে বা গোপনে সালাত আদায় করে কিন্তু মনে মনে ভেবে নেয় যে তার ইখলাস অন্যদের চাইতে বেশী (তাই সে এটা করতে পারে) তবে অহংকারের ফাঁদে পড়ে গেল সে। কেননা একমাত্র আল্লাহ্ই জানেন কার ইখলাস বেশী।
২. ইখলাস হল একমাত্র আল্লাহ্ও তার বান্দার মধ্যকার ব্যাপার; এমনকি ফেরেশতারাও জানতে পারেনা এটা, তাই লিখেও রাখেনা এটা তারা। উপরে বর্ণিত শহীদ, আলেম ও দানশীল ব্যক্তির ঘটনা থেকেও এটা পরিষ্কার বুঝা যায়- ফেরেশতারা শুধু তাদের সৎকাজগুলুই লিপিবদ্ধ করে রেখেছিল, কিন্তু সেসব কাজের পিছনে সত্যিকারের উদ্দেশ্য কি ছিল তা একমাত্র আল্লাহ-তায়ালাই প্রকাশ করেছিলেন।
৩. কারো ইখলাস যদি বিশুদ্ধ হয় তবে শয়তান তাকে কখনোই আক্রমণ করতে পারেনা ।
বিশুদ্ধ ইখলাসের ব্যক্তিদের উদাহারন
বিশুদ্ধ ইখলাসের একটা সুন্দর উদাহারন হল মরিয়ম(আঃ) এর মা,
إِذْ قَالَتِ امْرَأَتُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي ۖ إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ [٣:٣٥]
“এমরানের স্ত্রী যখন বললো-হে আমার পালনকর্তা! আমার গর্ভে যা রয়েছে আমি তাকে তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত রেখে। আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও, নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞাত।” [সূরা আল ইমরান, ৩:৩৫]
তিনি আল্লাহর সাথে এক অপূর্ব একান্ত আলাপচারিতা করছিলেন। তিনি আল্লাহ্কে বলছেন তার গর্ভের সন্তান কেবলমাত্র আল্লাহ্র জন্য উৎসর্গ করেছেন তিনি। অর্থাৎ তিনি তার সন্তানকে এমনভাবে লালনপালন করবেন যেন সে হয় আল্লাহভক্ত—শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য। আর সেই একাগ্র, বিশুদ্ধচিত্তের কথোপকথনে খুশি হয়ে আল্লাহ্ তাকে উপহার দিলেন সর্বকালের সর্বোত্তম কন্যাদের (নারীদের) একজনঃ মরিয়ম(আঃ)।
যিনি আল্লাহ্র অনুগ্রহে আল্লাহ্র কাছে করা তার মায়ের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অন্য একটা উদাহারন হল খালিদ বিন আল-ওয়ালিদ (রাদিআল্লাহু আনহু)-
একদিন উমর (রাদিআল্লাহু আনহু) হঠাৎ তাকে তার সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করে নিলেন। নিজেকে একবার তার জায়গায় ভেবে দেখুন। আপনি কোন দলের দলপতি, অথবা কোন প্রতিষ্ঠানের ম্যনেজার। হঠাৎ করে ম্যানেজমেন্ট এ রদবদল হল, আর আপনাকে আপনার পদ থেকে অপসারন করা হল বা নিচের সাধারন কর্মীদের স্তরে নামিয়ে দেওয়া হল। আপনার প্রতিক্রিয়া কি হবে? আপনার কাজে তার কি প্রভাব পড়বে? ক্ষোভ, অপমান আর রাগে সে চাকরি বা কাজ কি করতে ইচ্ছে করবে আর আপনার?? কিন্তু খালিদ (রাদিআল্লাহু আনহু) কি করেছিলেন জানেন? অপমানিত বোধ করা বা যুদ্ধ করতে অসম্মতি জানানো তো দূরে থাক, উল্টো তিনি আরও বেশী অনুপ্রেরণা আর প্রাণশক্তি নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যখন থাকে জিজ্ঞাস করা হয়েছিল কেন, তিনি বলেছিলেন, “আমি আল্লাহ্র জন্য যুদ্ধ করি, উমরের জন্য নয়।” তিনি এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে কোন বিশেষ পদমর্যাদার জন্য নয়, কেবলমাত্র আল্লাহ-তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য যুদ্ধ করছেন তিনি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইখলাস অর্জনের তৌফিক দান করুক!
collected
Comment