কল্পনার সব শয়তানি সাধ মিটে যাবে—এমন এক বিনোদন পার্ক থাকলে কেমন হয়? বন্দুক নিয়ে এমন এক দুনিয়ায় নেমে পড়বেন, যেখানে হত্যা-ধর্ষণ-নৃশংসতা কোনো অপরাধ না। এর জন্য আপনাকে কেবল টাকা খরচ করে টিকিট কিনতে হবে। তারপর আপনার জন্য নিজের ভেতরের মানুষ অথবা দানব আবিষ্কারের অবাধ সুযোগ। ইচ্ছামতো ভোগ করুন সেখানকার নারীদের, ছিন্নভিন্ন করে দিন; কিংবা জ্বালিয়ে দিন বসতি। কেউ আপনার কিচ্ছু করতে পারবে না। আপনার গুলি সেখানকার মানুষকে হত্যা করলেও তাদের গুলি আপনার গায়ে লাগবে না।
আমরা জানি, এমন অ্যামিউজমেন্ট পার্ক পৃথিবীতে এখনো হয়নি। কিন্তু এই ধরনের ‘আনন্দ’ বিক্রি করছে ইসরায়েলি এক নিরাপত্তা কোম্পানি। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স, ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য ইনডিপেনডেন্ট, ইসরায়েলি পত্রিকা হারের্টজ এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ক্যালিবার থ্রি নামের এই পার্কের গল্প শোনার আগে আসুন আমরা আরেকটি গল্প শুনি।
হলিউডের এইচবিও স্টুডিও ‘ওয়েস্টওয়ার্ল্ড’ নামে একটা টিভি সিরিজ প্রচার করে গত বছর। ওয়েস্টওয়ার্ল্ড হলো আমেরিকার বুনোপশ্চিমের থিমে নির্মিত বিশাল এক এলাকা। সেখানে পাহাড় আছে, সমুদ্র আছে, বন আছে। আছে সরাইখানা, বারবনিতা ও বন্দুকযুদ্ধ। এলাকাটা ভরে রাখা হয়েছে সত্যিকার মানুষের মতো অ্যান্ড্রয়েড রোবট দিয়ে। তারা ব্যথা পায়। তাদের আবেগ আছে। তারা ভালোবাসে সন্তান ও প্রেমাস্পদ। তারা জানেই না যে তারা আসলে রোবট। মারা গেলে বা অঙ্গহানি হলে ল্যাবরেটরিতে ঠিকঠাক করে তাদের আবার খেলার ভেতর ঢোকানো হয়। এভাবে জন্ম-জন্মান্তরে তারা জীবন দিয়ে পার্কের অতিথিদের আনন্দের খোরাক হয়। প্রতিটি মৃত্যু ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতার স্মৃতি মুছে দেওয়া হয়; এমনকি চরিত্রও বদলে দেওয়া যায়। ধনী অতিথিরা দামি টিকিট কেটে এই পার্কে এহেন আনন্দ উপভোগের সুযোগ পায়। এবং অবশ্যই সম্পূর্ণ গোপনীয়তায়। পার্কের ভেতর তারা কী করেছে তা বাইরের কেউ জানতেই পারে না। ওয়েস্টওয়ার্ল্ডের বিজ্ঞাপনে নিজের ভেতরের দানব বা দেবতাকে বের কের আনার হাতছানি থাকে।
ওয়েস্টওয়ার্ল্ডের সঙ্গে ইসরায়েলি বিনোদনকেন্দ্রের মিলটা বাস্তবতায় নয়, গুণে নয়, কেবল লক্ষণে। রোবটের বদলে তারা ব্যবহার করে মানুষের ছবি বা ডামি; যাদের গায়ে পরানো থাকে ফিলিস্তিনি কেফায়াহ কিংবা আরবদের গলায় পরার স্কার্ফ—ইয়াসির আরাফাত যেমনটা পরতেন। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম আন্তর্জাতিক আইনে ইসরায়েলের দখলীকৃত এলাকা। ওই জমিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাবেক কমান্ডো ও অফিসাররা সন্ত্রাস দমনের টার্গেট হিসেবে যাদের নকল বা ছবি সাজিয়েছে, তারাই ওই জমির ঐতিহাসিক ও আইনসংগত মালিক। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য একটা বিনোদন পার্কও চালানো হয়। সেখানে সাজানো পরিস্থিতিতে আপনি আরব অথবা ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী ‘হত্যা’ করতে পারবেন। চোখের সামনে দেখতে পাবেন সন্ত্রাসীদের পাকড়াও করার মহড়া। পর্যটকদের আনন্দ দিতে শিকারি কুকুর দিয়ে তাদের কামড়ানো হয়। আপনাকে এমন একটি রাস্তায় নিয়ে যাওয়া হবে, যেখানকার আরব অধিবাসীদের মধ্যে আপনি সন্ত্রাসী খুঁজবেন। কানে মোবাইল লাগানো একটি লোককে গুলি করবেন কি করবেন না, তা নিয়ে দ্বিধায় থাকবেন। সত্যিকার গুলি চালাবেন ফায়ারিং রেঞ্জে সার দিয়ে সাজানো আরবদের ফটোতে। শিশুরাও সব খেলায় অংশ নিতে পারলেও সত্যিকার বন্দুক তাদের দেওয়া হয় না।
ইসরায়েলজুড়ে এ রকম ছয়টি বিনোদনকেন্দ্র আছে, নতুন আরেকটি খোলা হচ্ছে আমেরিকায়। আমেরিকান, জাপানি, চীনা, ভারতীয়, দক্ষিণ আমেরিকান, ইতালীয়, রুশ ও ফরাসি পর্যটকেরা বেশি আসেন এখানে। বছরে ২২ থেকে ২৫ হাজার পর্যটককে আনন্দ দেয় ক্যালিবার ৩ নামের এই কোম্পানি। এই সন্ত্রাস দমন প্রশিক্ষণকেন্দ্র কাম বিনোদনকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক শ্যারন গাট ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা। দুই ঘণ্টার একটি টিকিটের দাম বড়দের জন্য ১১৫ ডলার আর শিশুদের জন্য ৮৫ ডলার। কর্নেল শ্যারন গাটের ভাষায় এসবের উদ্দেশ্য, ‘ইসরায়েলি সেনা হতে কেমন লাগে গড়পড়তা পর্যটককে তার ফিলিং দেওয়া। যাঁরা আমাদের প্রোগ্রামে আসেন...তঁারা ইসরায়েলের দূতে পরিণত হন’। আর ফিলিস্তিনিদের চেহারা ও পোশাক ব্যবহারের কারণ? কেবলই বাস্তবের সঙ্গে মিল দেখানোর জন্য!
‘ওয়েস্টওয়ার্ল্ড’ সিরিজটা দেখার পর মনে শুধু এটুকু আশ্বাস ছিল যে পৃথিবীর প্রযুক্তি এখনো এই জায়গায় আসেনি। কিন্তু ইসরায়েলের বিনোদন পার্কের খবর পড়ে আশ্বাস ভেঙে গিয়ে আতঙ্ক জেগেছে। মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল, ভিডিও গেমের আদলে এই ধরনের প্রায়-বাস্তব অ্যাডভেঞ্চার কি মানুষের মধ্যে বিকৃত ভোগ ও খুনপিপাসা জাগায় না? রোবটদের স্মৃতি মুছে ফেলা গেলেও পার্কের অতিথিদের মন থেকে এসব ছাপ কি মুছে যাবে? তার একটা উত্তর পেয়েছি ওই থিম পার্ক ভ্রমণকারী এক আমেরিকানের জবানিতে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আসা রাবাই মোশে ব্রাইস্কি রয়টার্সকে যা বলেন তার সারমর্ম এই, আগে সন্ত্রাসী হামলার মধ্যে পড়লে নির্ঘাত পালাতাম বা লুকাতাম। কিন্তু এখানে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর বুঝতে পারলাম সিকিউরিটি ইন্ডাস্ট্রির লোকজন কী পরিস্থিতি মোকাবিলা করে।
আমেরিকায় প্রায়ই নির্বিচার গুলিবর্ষণে নিরীহ মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটে। আগ্নেয়াস্ত্র সবই কিনতে পারে সে দেশে। ইসরায়েলি বিনোদনকেন্দ্রে আরব ও ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাসী হিসেবে দেখা এবং তাদের হত্যায় মন মজানো কেউ যদি বন্দুক হাতে আরব পোশাক পরা মানুষ হত্যায় নেমে পড়ে, তার দায় কি এই ইসরায়েলিরা নেবে? মোদ্দা কথা, এটা কতটা বিনোদন পার্ক আর কতটা ঘৃণার কারখানা?
শিশুদের এমন বিনোদনে মাতানোই-বা কতটা সুস্থ কাজ? কিন্তু বর্ণবাদীদের কাছে এসবই স্বাভাবিক। ২০০৬ সালে গাজায় ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে হাজারো ফিলিস্তিনি শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। জাতিসংঘ সেই হামলাকে যুদ্ধাপরাধ বলে অভিযুক্তও করেছিল। সেই হামলার সময় গাজার শিশুদের হত্যার জন্য যে বোমা ফেলা হয়েছিল, সেসবের গায়ে ইসরায়েলি শিশুদের দিয়ে লেখানো হয়েছিল ঘৃণার বাণী। একটি বোমার গায়ে লেখা ছিল, ‘আমাদের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়াবে, তাদের পরিণতি মৃত্যু’। শুধু তা-ই নয়, ‘ওয়ান্ডারউওম্যান’ চরিত্রে অভিনয় করে যিনি বিখ্যাত হয়েছেন, সেই গল গ্যাডট আদতে ছিলেন ইসরায়েলি নারী সেনা। গাজায় বোমাবর্ষণের সময় তিনি উল্লাস প্রকাশ করে টুইট করতেন। ইসরায়েল রাষ্ট্রের চোখে ফিলিস্তিনিরা মানুষ পদবাচ্য নয়। ‘ওয়েস্টওয়ার্ল্ড’ সিনেমার বর্বর থিম পার্কের সঙ্গে অবরুদ্ধ ও নির্যাতিত গাজা উপত্যকার পার্থক্য আসলে কতটা?
গাজা বিশ্বের বৃহত্তম ছাদ-খোলা কারাগার। এটা বিশ্বের বৃহত্তম নির্যাতন ও নিয়ন্ত্রণের গবেষণাগারও, গিনিপিগের বদলে এখানে ব্যবহৃত হয় আরবরা। আরব ও ফিলিস্তিনিদের জমি দখল, তাদের নিয়ন্ত্রণ ও নির্যাতনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ইসরায়েল বড় জনগোষ্ঠী দমন, সন্ত্রাস দমন, গণনজরদারি, মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ ও নির্যাতনের মারাত্মক সব অস্ত্র ও কৌশল উদ্ভাবন করেছে। এগুলো তারা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে আয়ও করে। বিভিন্ন সরকার এসব অস্ত্র কেনে এবং সেসব কৌশল জনগণের করের টাকার বিনিময়ে শেখে।
ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও অস্ত্র-বাণিজ্যের আরব গিনিপিগদের দেখার পর, ক্যালিবার থ্রি নামের বিনোদন ব্যবসা জানার পর, ওয়েস্টওয়ার্ল্ডের ভয়াবহ পৃথিবী আর দূরের মনে হয় না।
Comment