কারাগারে জঙ্গিবাদের চর্চা
জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাঁরা গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি কারাগারে যাচ্ছেন, তাঁদের সংশোধনের কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও জঙ্গিবাদ চর্চার সুযোগ আছে। এতে করে গ্রেপ্তার হয়ে সাজা খাটার পরও অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না।
গতকাল শনিবার পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটি) উদ্যোগে পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত ও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের স্বজনেরা একটি কর্মশালায় অংশ নেন। জঙ্গিবাদের ঝুঁকি থেকে দেশকে রক্ষার জন্য তাঁরা নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা সবাই কারাগারের সমস্যার কথা বলেছেন।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা কারাগারের ভেতরে সংশোধনের
ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছেন। তাঁরা চান যাঁরা উগ্র মতবাদে দীক্ষা পেয়েছেন, তাঁরা কারাগারেই ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা পাক এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক।
জামিনে মুক্ত ও পেশায় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা গতকালের সভায় বলেন, জঙ্গিবাদে যুক্ত ব্যক্তিদের কারাগারের একটি ভবনে একসঙ্গে রাখা হয়। তাঁরা অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্তদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ যেন না পান, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু এক ভবনে থেকে আসলে তাঁরা উগ্রবাদ নিয়ে সুন্দরভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা করেন এবং জঙ্গিবাদকে জিইয়ে রাখেন। তিনি আরও বলেন, জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের বেশ কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে মারাত্মক নির্যাতনের অভিযোগ আছে। নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনো ব্যক্তি যখন কারাগারে আসেন, তখন জঙ্গিবাদের পক্ষে অনেকের মনে সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। তাঁর মতে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা মতাদর্শ দিয়ে করতে হবে। নির্যাতন করে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করা যাবে না।
আশকোনার সূর্যভিলা থেকে মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিনিও হাই সিকিউরিটি কারাগারে আছেন তাঁর দুই বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে। তাঁর এক স্বজন গতকাল বলেন, ‘যখন আমরা কারাগারে গিয়ে ওকে কাউন্সেলিং করি, ও বোঝে। কিন্তু ওখানে আরও কেউ কেউ আছে, যারা আবার মিসগাইড করে।’
জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত ও গ্রেপ্তারকৃতদের অভিভাবকেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের তাগিদ দেন এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব কমিয়ে আনার অনুরোধ করেন। একজন বলেন, বাহিনীগুলো প্রায়ই প্রতিযোগিতা করছে। এক বাহিনী দুজনকে গ্রেপ্তার করলে, অন্য একটি বাহিনী চারজনকে গ্রেপ্তার করে। যে অপরাধে লঘু দণ্ড হওয়ার কথা, সেই অপরাধের কঠোর সাজা হয়। এতে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা নষ্ট হয়।
গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে কমান্ডো অভিযানে নিহত এক তরুণের মা বলেন, ‘আমার ছেলে যখন নিখোঁজ হয়, তখনই আমরা জানিয়েছিলাম। তখন যদি বাহিনীগুলো তৎপর হতো, তাহলে হোলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটত না।’
জামিনে মুক্ত একজন চিকিৎসকের মা বলেন, ‘অনেক অভিভাবকই জানেন না সন্তানেরা বিপথগামী হলে তাঁরা কী করবেন। আমরা আপনাদের ওপর নির্ভর করতে চাই। আমরা সমস্যায় পড়লে মন খুলে কথা বলতে চাই, আপনাদের সহযোগিতা চাই।’
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম পরিবারগুলোকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
যে কারণে কর্মশালা
জঙ্গিবাদ দমনে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা বেশ আগেই নিয়েছিল কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম। গতকাল ১৪টি পরিবার এ কাজে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কাউন্টার টেররিজমের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, যাঁরা সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন এবং যাঁরা অভিযানে নিহত হয়েছেন, সবার বাবা-মায়েরই সন্তানের জন্য কষ্টের ধরন একই। সে কারণেই পুলিশ তাঁদের কথা শুনতে চেয়েছে। তাঁরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের আদলে এই বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে জঙ্গিবিরোধী প্রচারাভিযান চালাতে চান।
অভিভাবক ও স্বজনদের প্রত্যেকে বলেছেন, তাঁদের স্বজনেরা লম্বা সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন, ভিডিও দেখতেন এবং ওয়াজ শুনতেন। কেউ কেউ বলেছেন, ধর্মের নামে মিথ্যা বলা, অন্যায় করাকেও তাঁরা জায়েজ বলে দাবি করতেন।
কর্মশালায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাউন্টার টেররিজমের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার আবদুল মান্নান। বহু আসামির জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘র*্যাডিকালাইজেশন হলো জঙ্গিবাদের শুরু। ঐতিহ্যগতভাবে যেসব ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করা হয়, সেটা যদি হঠাৎ কেউ ভুল বলে, তাহলে বুঝতে হবে সমস্যা আছে। উগ্রবাদে দীক্ষিতরা খুব সহজে তার মতের বিরোধীদের কাফির বলে। এটা একটা লক্ষণ।’
গাইবান্ধা থেকে আসা তানভীর কাদেরীর স্বজন বলেন, সুদের কারবার বলে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন তানভীর। ধর্মকর্ম পালনে কড়াকড়ি করছিলেন, তারপর হঠাৎ একদিন পরিবারকে জানান, তিনি সপরিবার মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর তাঁরা পত্রিকায় তানভীরের মৃত্যুর খবর পান।
মেজর (অব.) জাহিদুলের আত্মীয়রাও বলেন, তিনি কানাডায় একটি কোর্স থেকে ফেরার পর ধর্ম নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। সারা জীবন যেভাবে তাঁরা ধর্মকর্ম করে এসেছেন, সেগুলোকে ভুল বলতে শুরু করেন। তারপর বিদেশে চলে যাচ্ছেন বলে আত্মগোপনে যান।
হোলি আর্টিজানে হামলাকারী খায়রুল ইসলামের (পায়েল) স্বজন বলেন, তাঁর ছেলে তাবলিগ জামাতে যাওয়ার কথা বলে নিখোঁজ হন। নিখোঁজ হওয়ার আগে বাবা-মাকে নামাজ পড়ার নতুন রীতি শেখানোর চেষ্টা করেন। বাবাকে লম্বা দাড়ি রাখতে বলেন। অপর এক অভিভাবক বলেন, তাঁর ছেলে তাঁকে হিজাব পরতে পীড়াপীড়ি করতেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, ছেলে বদলে যাচ্ছে।
পুলিশ ও অভিভাবকেরা বলেছেন, জঙ্গিবাদ দমনে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আলেম সম্প্রদায়ের জোরালো ভূমিকা থাকা দরকার।
সূত্র:
Comment