আফগান তালিবান ও পাকিসেনাদের মধ্যকার উত্তেজনা : পটভূমি ও নিকট ভবিষ্যত (প্রথম কিস্তি)
গত আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসেন ইসলামিক ইমারতের তালিবান মুজাহিদিন। দেশটির শাসনভার গ্রহণের পর থেকে পাকিস্তানের গাদ্দার সরকারি বাহিনীর সাথে প্রায়ই সীমান্তে সংঘাত হচ্ছে। এই সংঘাত আজকের নতুন নয়, বরং পূর্বেকার আফগান পুতুল সরকারের সময়ও হয়েছে। তবে এখন তা আরও তীব্রতর হচ্ছে।
পাক-আফগান সীমান্তে বৃটিশদের তৈরী ডুরান্ড (১) লাইনে চলমান এই সংঘাত বাকবিতন্ডার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং সময়ে সময়ে কামানের মতো ভারী সব অস্ত্রের গর্জনও শোনা যাচ্ছে।
এসব সংঘাতে তালিবানদের হাতে কঠিন মারও খাচ্ছে গাদ্দার পাকিস্তান প্রশাসন। সময়ে সময়ে সীমান্তে থেকে কফিন নিয়েও ফিরতে হচ্ছে, আবার বন্দীও হতে হচ্ছে জানবাজ তালিবান যোদ্ধাদের হাতে। তালিবান কর্তৃক জব্দ করা হচ্ছে গাদ্দার সেনাদের বিভিন্ন সরঞ্জামাদিও।
আর বর্তমানে এই সংঘর্ষগুলি মূলত আফগানিস্তানের পাকতিকা, কুনার ও নানগারহার প্রদেশের সীমান্ত রেখায় সবচাইতে বেশি সংঘটিত হচ্ছে।
পাকিস্তানের গাদ্দার সামরিক বাহিনী ও ইমারতে ইসলামিয়ার তালিবান মুজাহিদদের মধ্যকার সীমান্ত সংঘাতগুলি এই অঞ্চলের ভবিষ্যতে কী ধরণের প্রভাব বা পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে- সেটি মূল্যায়ন করার আগে, সংঘাতের পটভূমিতে একবার সংক্ষিপ্ত নজর দেওয়া প্রয়োজন। যাতে গর্তে লুকিয়ে থাকা বিষধর সাপের চেহারাটা সবার সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়।
আফগান তালিবানদের প্রতি পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর মনোভাব:
২০০১ সালে ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায়। সেই থেকে শুরু দেশটিতে নতুন এক যুদ্ধের সূচনা। তখন মিডিয়াগুলোও এই যুদ্ধের সংবাদ বড় বড় শিরোনামে কভার করেছিল। এটি পশ্চিমা দখলদারদের যুদ্ধের প্রচারণা ও মানুষকে সত্য থেকে দূরে রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছে। সেইসাথে এসব মিডিয়াগুলো তাদের সাময়িক বিজয়ের সম্প্রচারক ও সম্প্রসারক হিসাবে কাজ করেছে।
এই প্রতিষ্ঠানগুলি যখন যুদ্ধ প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করছিল, তখন তারা খুব ভালোভাবেই দখলদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা জোটের স্বার্থকে সামনে রেখেই যুদ্ধের মূল্যায়ন করত। আর শ্রোতা ও দর্শকরাও এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর একচেটিয়া মূল্যায়নকেই গ্রহণ করছিল।
যুদ্ধের সময় তালিবানদের প্রতি পাকিস্তান প্রশাসনের মনোভাবের বিশ্লেষণকেও সাধারণত এই প্রেক্ষাপটেই মূল্যায়ন করা হয়। পশ্চিমা মিডিয়াগুলো পুরো যুদ্ধের সময়টা জুড়েই “তালেবানের প্রতি পাকিস্তান সমর্থন” আছে বলে সম্প্রচার করে। মিডিয়ার এই মিথ্যা সম্প্রচারের ফলে দখলদার মার্কিন ফ্রন্টের পক্ষে মূলত দুটি লাভ আবির্ভূত হয়:
১- পশ্চিমা সামরিক জোটকে আরও সমর্থন দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের গাদ্দার প্রশাসনকে রাজনৈতিক চাপের মধ্যে রাখা। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নিশ্চিত করা।
২- পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে তালিবানদের সমর্থনকারী মুস্লিমদের মাঝে এই বীজ রোপণ করা যে, ইসলামাবাদ সরকার তালিবানদের সমর্থন ও সহায়তা করছে। আর এই ধারণা তৈরির প্রধান কারণ হচ্ছে, জনগণের কাছে গাদ্দার সরকারের ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করা। সেইসাথে পশ্চিমাদের সমর্থনকারী এই গাদ্দার সরকারগুলির বিরুদ্ধে যেসব তাওহিদবাদী মুসলিম ও মুজাহিদরা (টিটিপি) আওয়াজ তুলছেন, তাঁদেরকে জনগণ থেকে দূরে রেখে তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতিরোধ করা।
এই উভয় ক্ষেত্রেই পশ্চিমা মিডিয়াগুলো সফলতাও পায়। আর পশ্চিমা মিডিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে পাকিস্তান সরকারি মিডিয়াগুলোও তখন একটি কৌশল অবলম্বন করে। তারা সরকার বিরোধী প্রতিটি আন্দোলন ও তালিবানদের সমর্থনকারী দলগুলোর ব্যাপারে সম্প্রচার করে যে, এরা ভারতের এজেন্ড এবং ‘র’ দ্বারা পরিচালিত। যেমনটি বাংলাদেশ সরকার তাদের বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে জামাত-বিএনপি ও পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার গন্ধ খুঁজে পায়।
যাইহোক, এই দিকে আফগানিস্তানে আক্রমণকারী ন্যাটো জোটের প্রতি পাকিস্তানের সীমাহীন সমর্থন সত্ত্বেও, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে পাকিস্তানকে “তালিবান সমর্থক” হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। অথচ বিষয়টা ছিল একেবারেই বিপরীত।
এই যুদ্ধে আফগান তালিবানরা পাকিস্তানের সীমানার মধ্যে যে সমর্থন পেয়েছিল তা শুধুই জাতিগত, ধর্মীয়। পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করেই দেশটির মুসলিম জনগণ থেকেই পেয়েছিল।
আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের সীমান্তে রয়েছেন প্রচুর পশতুন জনসংখ্যা, দেওবন্দ ধারার অনেক মাদ্রাসা এবং ইসলাম ও শরিয়াহ্ শাসনের প্রতি জনগণের বুকভরা ভালোবাসা। এগুলোর ফলে পাকিস্তানের তাওহিদবাদী মুসলিমরা আদর্শগতভাবে আফগানিস্তানে তালিবানদের যুদ্ধকে তাদের নিজস্ব যুদ্ধ হিসাবে দেখে। এবং এর সম্প্রসারণে সর্বাত্মক সহায়তা করে। আর তালিবানদের সহায়তা ও শুহাদায়ে জামিয়া হাফসার প্রতিশোধ নিতেই পরবর্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি। (২)
অন্যদিকে, পাকিস্তান রাষ্ট্র এই যুদ্ধে তালিবানদের সমর্থন দেওয়া তো দূরের কথা, তারা চোখ বন্ধ করে তালিবানদের ইসলামিক ইমারতকে ধ্বংস করতে আমেরিকা ও ন্যাটোর জন্য পাকিস্তানের ভূখণ্ডকে উঠোনে পরিণত করতে দ্বিধা করেনি। অভিযোগ রয়েছে যে, ২০১১ সালের মে মাসে তালিবানদের সবচাইতে বড় ও কাছের মিত্র তানযিমুল-কায়েদার সর্বোচ্চ আমীর শহীদ শাইখ ওসামা বিন লাদেনের (রহ বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তথ্য দিয়েও সহায়তা করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা। ফলে দেশটির তাওহিদবাদী মুসলিমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে এবিষয়ে সুষ্ঠ তদন্ত করতে বারবার অবহিত করে। কিন্তু অভিযোগ করা সত্যেও এবিষয়ে মাথা ঘামায়নি সরকার। পাকিস্তান এই হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করলে। তবে এসব সমালোচনা কাগজে কলমেই থেকে যায়। পাশাপাশি আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখে।
টীকা:
—-
(১) ১৮৯৩ সালের ১২ নভেম্বর ডুরান্ড লাইন প্রণয়ন করা হয়। ততকালীন ব্রিটিশ কূটনীতিক ‘মর্টিমার ডুরান্ড’ থেকে এর নামকরণ করা হয়। তখন মর্টিমার ডুরান্ড এবং আফগানিস্তানের তৎকালীন আমীর আবদুর রহমান খানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যেকার বেশ কিছু এলাকা নিয়ে সীমান্ত রেখা নির্ধারিত হয়। রেখাটি আফগানিস্তানকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করলেও, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সাথে সাথে জন্ম নেওয়া পাকিস্তান এই রেখাটিকে নিজেদের সীমান্ত হিসেবে নির্ধারণ করে। এদিকে কোনো আফগান প্রশাসন এই রেখাকে আনুষ্ঠানিক সীমান্ত হিসেবে স্বীকার করেনি। কারণ ব্রিটিশরা ভারত দখলের সময় সামরিক অভিযানের মাধ্যমে আফগান সীমান্তেরও অনেক এলাকা দখল করে, আর ব্রিটিশরা ডুরান্ড লাইন তৈরির সময় সেই এলাকাগুলোকেও ভারতের সাথে যুক্ত করে দেয়, যা মুলত আফগানিস্তানের মুল ভূখন্ডের অংশ। এছাড়াও ব্রিটিশদের তৈরি ডুরান্ড লাইন এই অঞ্চলের সবচেয়ে জনবহুল জাতিগোষ্ঠী পশতুন ও বেলুচদের দুই ভাগে বিভক্ত করে, যারা নিজেদেরকে পাকিস্তানি বলার চাইতেই আফগানি পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করেন। আফগান সীমান্তে পাকিস্তানে বসবাসকারী এই দুই জনগোষ্ঠীর আনুমানিক সংখ্যা ৫২ মিলিয়ন। এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানি শাসনের অধীনে থাকতে চান না। বিশেষ করে এই অঞ্চলের পশতুনরা সাংস্কৃতিক ও জাতিগতভাবে আফগানিস্তানের ইতিহাসের সাথে জড়িত এবং তারা আফগানিস্তানকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
ডুরান্ড লাইন সম্পর্কে আফগানরা যুক্তি দেয় যে, ডুরান্ড লাইন বৈধ নয়। এখানে প্রশাসনের সিদ্ধান্তের অগ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, এবং শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দখলকৃত অঞ্চলের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় ভুল রয়েছে।
অন্যদিকে, পাকিস্তান যুক্তি দেয় যে বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্র এই অঞ্চলে (দখলদার) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি, তাই ডুরান্ড লাইন চুক্তিগুলি বৈধ থাকবে।
(২) ২০০৭ সাল, পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও কালো একটি অধ্যায়। ঐবছরের ৩ জুলাই শুরু হওয়া লাল মসজিদ অবরোধ এমন একটি ঘটনা, যা মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তান প্রশাসনের কালো চেহারাটিকে জনগণের সামনে উন্মোচন করে দিয়েছিল।
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত ঐতিহাসিক লাল মসজিদ। ২০০৭ সালে আমেরিকার হুকুমের গোলাম পাকিস্তান সরকার লাল মসজিদ ও তৎসংশ্লিষ্ট জামিয়া হাফসা মহিলা মাদ্রাসাটিকে ঘেরাও করে। তাদের দাবি ছিল যে, ” প্রতিষ্ঠানটি পাকিস্তানি প্রশাসনের বিরুদ্ধে কার্যকলাপে লিপ্ত এবং মসজিদের নিচে বিস্ফোরক মজুদ করা হচ্ছে।” আর এমন একটি অভিযোগের উপর ভিত্তি করেই শেষ পর্যন্ত মোশাররফের পাকিস্তানি গাদ্দার বাহিনী মসজিদ ও মাদ্রাসাটিকে ঘেরাও করে। এসময় ৬,০০০ এরও বেশি পাকিস্তানি সৈন্য ছাত্রীদের উপর হামলা চালায়। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে হামলা চালানোর পর মসজিদ কমপ্লেক্স দখল করে গাদ্দার প্রশাসন। এই অবরোধে কয়েক শতাধিক ছাত্রী প্রাণ হারান এবং বহু ছাত্রীকে নিখোঁজ করা হয়। লাল মসজিদে যা ঘটেছিল তা পাকিস্তানের তাওহিদবাদী মুসলিম জনতা, বিশেষ করে উপজাতীয় অঞ্চলের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
এই ঘটনার পর আল-কায়েদার পরামর্শে কয়েক ডজন স্থানীয় মুজাহিদ গ্রুপ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান নামে নতুন একটি প্রতিরোধ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন।
গত আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসেন ইসলামিক ইমারতের তালিবান মুজাহিদিন। দেশটির শাসনভার গ্রহণের পর থেকে পাকিস্তানের গাদ্দার সরকারি বাহিনীর সাথে প্রায়ই সীমান্তে সংঘাত হচ্ছে। এই সংঘাত আজকের নতুন নয়, বরং পূর্বেকার আফগান পুতুল সরকারের সময়ও হয়েছে। তবে এখন তা আরও তীব্রতর হচ্ছে।
পাক-আফগান সীমান্তে বৃটিশদের তৈরী ডুরান্ড (১) লাইনে চলমান এই সংঘাত বাকবিতন্ডার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং সময়ে সময়ে কামানের মতো ভারী সব অস্ত্রের গর্জনও শোনা যাচ্ছে।
এসব সংঘাতে তালিবানদের হাতে কঠিন মারও খাচ্ছে গাদ্দার পাকিস্তান প্রশাসন। সময়ে সময়ে সীমান্তে থেকে কফিন নিয়েও ফিরতে হচ্ছে, আবার বন্দীও হতে হচ্ছে জানবাজ তালিবান যোদ্ধাদের হাতে। তালিবান কর্তৃক জব্দ করা হচ্ছে গাদ্দার সেনাদের বিভিন্ন সরঞ্জামাদিও।
আর বর্তমানে এই সংঘর্ষগুলি মূলত আফগানিস্তানের পাকতিকা, কুনার ও নানগারহার প্রদেশের সীমান্ত রেখায় সবচাইতে বেশি সংঘটিত হচ্ছে।
পাকিস্তানের গাদ্দার সামরিক বাহিনী ও ইমারতে ইসলামিয়ার তালিবান মুজাহিদদের মধ্যকার সীমান্ত সংঘাতগুলি এই অঞ্চলের ভবিষ্যতে কী ধরণের প্রভাব বা পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে- সেটি মূল্যায়ন করার আগে, সংঘাতের পটভূমিতে একবার সংক্ষিপ্ত নজর দেওয়া প্রয়োজন। যাতে গর্তে লুকিয়ে থাকা বিষধর সাপের চেহারাটা সবার সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়।
আফগান তালিবানদের প্রতি পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর মনোভাব:
২০০১ সালে ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায়। সেই থেকে শুরু দেশটিতে নতুন এক যুদ্ধের সূচনা। তখন মিডিয়াগুলোও এই যুদ্ধের সংবাদ বড় বড় শিরোনামে কভার করেছিল। এটি পশ্চিমা দখলদারদের যুদ্ধের প্রচারণা ও মানুষকে সত্য থেকে দূরে রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছে। সেইসাথে এসব মিডিয়াগুলো তাদের সাময়িক বিজয়ের সম্প্রচারক ও সম্প্রসারক হিসাবে কাজ করেছে।
এই প্রতিষ্ঠানগুলি যখন যুদ্ধ প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করছিল, তখন তারা খুব ভালোভাবেই দখলদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা জোটের স্বার্থকে সামনে রেখেই যুদ্ধের মূল্যায়ন করত। আর শ্রোতা ও দর্শকরাও এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর একচেটিয়া মূল্যায়নকেই গ্রহণ করছিল।
যুদ্ধের সময় তালিবানদের প্রতি পাকিস্তান প্রশাসনের মনোভাবের বিশ্লেষণকেও সাধারণত এই প্রেক্ষাপটেই মূল্যায়ন করা হয়। পশ্চিমা মিডিয়াগুলো পুরো যুদ্ধের সময়টা জুড়েই “তালেবানের প্রতি পাকিস্তান সমর্থন” আছে বলে সম্প্রচার করে। মিডিয়ার এই মিথ্যা সম্প্রচারের ফলে দখলদার মার্কিন ফ্রন্টের পক্ষে মূলত দুটি লাভ আবির্ভূত হয়:
১- পশ্চিমা সামরিক জোটকে আরও সমর্থন দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের গাদ্দার প্রশাসনকে রাজনৈতিক চাপের মধ্যে রাখা। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নিশ্চিত করা।
২- পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে তালিবানদের সমর্থনকারী মুস্লিমদের মাঝে এই বীজ রোপণ করা যে, ইসলামাবাদ সরকার তালিবানদের সমর্থন ও সহায়তা করছে। আর এই ধারণা তৈরির প্রধান কারণ হচ্ছে, জনগণের কাছে গাদ্দার সরকারের ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করা। সেইসাথে পশ্চিমাদের সমর্থনকারী এই গাদ্দার সরকারগুলির বিরুদ্ধে যেসব তাওহিদবাদী মুসলিম ও মুজাহিদরা (টিটিপি) আওয়াজ তুলছেন, তাঁদেরকে জনগণ থেকে দূরে রেখে তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতিরোধ করা।
এই উভয় ক্ষেত্রেই পশ্চিমা মিডিয়াগুলো সফলতাও পায়। আর পশ্চিমা মিডিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে পাকিস্তান সরকারি মিডিয়াগুলোও তখন একটি কৌশল অবলম্বন করে। তারা সরকার বিরোধী প্রতিটি আন্দোলন ও তালিবানদের সমর্থনকারী দলগুলোর ব্যাপারে সম্প্রচার করে যে, এরা ভারতের এজেন্ড এবং ‘র’ দ্বারা পরিচালিত। যেমনটি বাংলাদেশ সরকার তাদের বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে জামাত-বিএনপি ও পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার গন্ধ খুঁজে পায়।
যাইহোক, এই দিকে আফগানিস্তানে আক্রমণকারী ন্যাটো জোটের প্রতি পাকিস্তানের সীমাহীন সমর্থন সত্ত্বেও, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে পাকিস্তানকে “তালিবান সমর্থক” হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। অথচ বিষয়টা ছিল একেবারেই বিপরীত।
এই যুদ্ধে আফগান তালিবানরা পাকিস্তানের সীমানার মধ্যে যে সমর্থন পেয়েছিল তা শুধুই জাতিগত, ধর্মীয়। পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করেই দেশটির মুসলিম জনগণ থেকেই পেয়েছিল।
আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের সীমান্তে রয়েছেন প্রচুর পশতুন জনসংখ্যা, দেওবন্দ ধারার অনেক মাদ্রাসা এবং ইসলাম ও শরিয়াহ্ শাসনের প্রতি জনগণের বুকভরা ভালোবাসা। এগুলোর ফলে পাকিস্তানের তাওহিদবাদী মুসলিমরা আদর্শগতভাবে আফগানিস্তানে তালিবানদের যুদ্ধকে তাদের নিজস্ব যুদ্ধ হিসাবে দেখে। এবং এর সম্প্রসারণে সর্বাত্মক সহায়তা করে। আর তালিবানদের সহায়তা ও শুহাদায়ে জামিয়া হাফসার প্রতিশোধ নিতেই পরবর্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি। (২)
অন্যদিকে, পাকিস্তান রাষ্ট্র এই যুদ্ধে তালিবানদের সমর্থন দেওয়া তো দূরের কথা, তারা চোখ বন্ধ করে তালিবানদের ইসলামিক ইমারতকে ধ্বংস করতে আমেরিকা ও ন্যাটোর জন্য পাকিস্তানের ভূখণ্ডকে উঠোনে পরিণত করতে দ্বিধা করেনি। অভিযোগ রয়েছে যে, ২০১১ সালের মে মাসে তালিবানদের সবচাইতে বড় ও কাছের মিত্র তানযিমুল-কায়েদার সর্বোচ্চ আমীর শহীদ শাইখ ওসামা বিন লাদেনের (রহ বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তথ্য দিয়েও সহায়তা করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা। ফলে দেশটির তাওহিদবাদী মুসলিমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে এবিষয়ে সুষ্ঠ তদন্ত করতে বারবার অবহিত করে। কিন্তু অভিযোগ করা সত্যেও এবিষয়ে মাথা ঘামায়নি সরকার। পাকিস্তান এই হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করলে। তবে এসব সমালোচনা কাগজে কলমেই থেকে যায়। পাশাপাশি আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখে।
টীকা:
—-
(১) ১৮৯৩ সালের ১২ নভেম্বর ডুরান্ড লাইন প্রণয়ন করা হয়। ততকালীন ব্রিটিশ কূটনীতিক ‘মর্টিমার ডুরান্ড’ থেকে এর নামকরণ করা হয়। তখন মর্টিমার ডুরান্ড এবং আফগানিস্তানের তৎকালীন আমীর আবদুর রহমান খানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যেকার বেশ কিছু এলাকা নিয়ে সীমান্ত রেখা নির্ধারিত হয়। রেখাটি আফগানিস্তানকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করলেও, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সাথে সাথে জন্ম নেওয়া পাকিস্তান এই রেখাটিকে নিজেদের সীমান্ত হিসেবে নির্ধারণ করে। এদিকে কোনো আফগান প্রশাসন এই রেখাকে আনুষ্ঠানিক সীমান্ত হিসেবে স্বীকার করেনি। কারণ ব্রিটিশরা ভারত দখলের সময় সামরিক অভিযানের মাধ্যমে আফগান সীমান্তেরও অনেক এলাকা দখল করে, আর ব্রিটিশরা ডুরান্ড লাইন তৈরির সময় সেই এলাকাগুলোকেও ভারতের সাথে যুক্ত করে দেয়, যা মুলত আফগানিস্তানের মুল ভূখন্ডের অংশ। এছাড়াও ব্রিটিশদের তৈরি ডুরান্ড লাইন এই অঞ্চলের সবচেয়ে জনবহুল জাতিগোষ্ঠী পশতুন ও বেলুচদের দুই ভাগে বিভক্ত করে, যারা নিজেদেরকে পাকিস্তানি বলার চাইতেই আফগানি পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করেন। আফগান সীমান্তে পাকিস্তানে বসবাসকারী এই দুই জনগোষ্ঠীর আনুমানিক সংখ্যা ৫২ মিলিয়ন। এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানি শাসনের অধীনে থাকতে চান না। বিশেষ করে এই অঞ্চলের পশতুনরা সাংস্কৃতিক ও জাতিগতভাবে আফগানিস্তানের ইতিহাসের সাথে জড়িত এবং তারা আফগানিস্তানকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
ডুরান্ড লাইন সম্পর্কে আফগানরা যুক্তি দেয় যে, ডুরান্ড লাইন বৈধ নয়। এখানে প্রশাসনের সিদ্ধান্তের অগ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, এবং শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দখলকৃত অঞ্চলের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় ভুল রয়েছে।
অন্যদিকে, পাকিস্তান যুক্তি দেয় যে বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্র এই অঞ্চলে (দখলদার) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি, তাই ডুরান্ড লাইন চুক্তিগুলি বৈধ থাকবে।
(২) ২০০৭ সাল, পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও কালো একটি অধ্যায়। ঐবছরের ৩ জুলাই শুরু হওয়া লাল মসজিদ অবরোধ এমন একটি ঘটনা, যা মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তান প্রশাসনের কালো চেহারাটিকে জনগণের সামনে উন্মোচন করে দিয়েছিল।
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত ঐতিহাসিক লাল মসজিদ। ২০০৭ সালে আমেরিকার হুকুমের গোলাম পাকিস্তান সরকার লাল মসজিদ ও তৎসংশ্লিষ্ট জামিয়া হাফসা মহিলা মাদ্রাসাটিকে ঘেরাও করে। তাদের দাবি ছিল যে, ” প্রতিষ্ঠানটি পাকিস্তানি প্রশাসনের বিরুদ্ধে কার্যকলাপে লিপ্ত এবং মসজিদের নিচে বিস্ফোরক মজুদ করা হচ্ছে।” আর এমন একটি অভিযোগের উপর ভিত্তি করেই শেষ পর্যন্ত মোশাররফের পাকিস্তানি গাদ্দার বাহিনী মসজিদ ও মাদ্রাসাটিকে ঘেরাও করে। এসময় ৬,০০০ এরও বেশি পাকিস্তানি সৈন্য ছাত্রীদের উপর হামলা চালায়। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে হামলা চালানোর পর মসজিদ কমপ্লেক্স দখল করে গাদ্দার প্রশাসন। এই অবরোধে কয়েক শতাধিক ছাত্রী প্রাণ হারান এবং বহু ছাত্রীকে নিখোঁজ করা হয়। লাল মসজিদে যা ঘটেছিল তা পাকিস্তানের তাওহিদবাদী মুসলিম জনতা, বিশেষ করে উপজাতীয় অঞ্চলের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
এই ঘটনার পর আল-কায়েদার পরামর্শে কয়েক ডজন স্থানীয় মুজাহিদ গ্রুপ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান নামে নতুন একটি প্রতিরোধ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন।
Comment