Announcement

Collapse
No announcement yet.

বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ | | পর্ব-১ | | সারিয়্যায়ে হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব: ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিযান

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ | | পর্ব-১ | | সারিয়্যায়ে হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব: ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিযান

    বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ | | পর্ব-১ | |
    সারিয়্যায়ে হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব: ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিযান


    সিরিজের ভূমিকা
    মহিমান্বিত মাহে রমাদান আমাদের সামনে উপস্থিত। এ মাস সিয়াম-সাধনার মাস; ত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মাস। এ মাস জিহাদ ও নুসরতের, বীরত্ব ও সাহসিকতার; এ মাস বিজয় ও বিজয়ের চেতনাবাহী মাস। বদর যুদ্ধে কুফরের বিরুদ্ধে ইসলামের প্রথম বিজয় এ মাসের-ই অর্জন। এ মাস ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের মাস। সে থেকেই এ মাস “বিজয়ের মাস” নামে পরিচিত। প্রত্যেক যুগেই উম্মাহর বীর সন্তানেরা এ পরিচয়ের যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। যুগের পর যুগ এ মাস মুমিনদের উজ্জীবিত করেছে বিজয়ের চেতনায়। গাযওয়ায়ে বদর আর ফাতহে মক্কার ঐতিহাসিক শিক্ষা যুগে যুগে অনুপ্রাণিত করেছে দ্বীন কায়েমের পথে আত্মনিবেদিত বীর মুজাহিদদের। তাই তো ইতিহাসের পাতা উল্টালেই দেখতে পাই- এ মাসকে কেন্দ্র করে মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কাফের-মুশরিকদের দম্ভ-অহঙ্কার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করার লড়াইয়ে আত্মনিয়োগ করেছেন৷ মুসলিমরা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সুরক্ষিত ও দুর্ভেদ্য “আমুরিয়া” দুর্গ পবিত্র রমাদান মাসেই বিজয় করেছে। শাকহাব ও আইনে জালুতের মত ঐতিহাসিক যুদ্ধগুলোও এই মাসেই সংঘটিত হয়েছে। মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়, তারেক বিন যিয়াদের স্পেন বিজয় এ মাসের-ই অর্জন ছিল। এ ছাড়াও ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে জানা অজানা হাজারো যুদ্ধের লোমহর্ষক উপাখ্যান।
    মহিমান্বিত এ মাস এমন অসংখ্য যুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আছে যেগুলোর নামও হয়তো জানা নেই আমাদের অনেকেরই। এ মাসকে কেন্দ্র করে উম্মতে মুসলিমাহর বিজয়ের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার সে ধারা আজও বিদ্যমান। সোমালিয়া, মালি, ইয়েমেন ও সিরিয়াতে লড়াইরত মুজাহিদ ভাইয়েরা অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসকে আলাদা মূল্যায়ন করে থাকেন। শত্রুর উপর তাদের আক্রমণগুলো রমাদান মাসে তুলনামূলক বেশিই হয়ে থাকে। ইমারাতে ইসলামিয়ার তালিবানদের বেলায়ও আমরা এমনটিই লক্ষ্য করেছি। উম্মতে মুসলিমাহর এই দুর্দিনে আমরা আশা করি, বিজয়ের এ মাস আমাদের জেগে ওঠার অন্যতম একটি উপলক্ষ্য হয়ে কাজ করবে ইনশাআল্লাহ। সেই আশা আর ভাবনা থেকেই চেয়েছি, আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থেকে এ মাসে অর্জিত বিজয়ের কিছু চিত্র পাঠকের সামনে তুলে ধরতে। এ মাসে ঘটে যাওয়া ইসলামী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিব ইতিহাসের সোনালী দিনগুলির সাথে। আগত বিজয়ের মাসকে কেন্দ্র করে আমাদের এ প্রয়াস ধারাবাহিক চলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ।

    ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিযান “সারিয়্যায়ে হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব”
    প্রাককথনঃ
    কাফেরদের নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সাহাবায়ে কেরাম হিজরত করেন মদীনার পথে। পেছনে ফেলে আসেন নিজেদের পরিবার-পরিজন,আত্মীয়-স্বজন,সহায়-সম্পত্তি- সবকিছু। এসে উঠেছেন অপরিচিত এলাকায়। এখানে পূর্বপরিচিত কেউ নেই, আছে শুধু ঈমানী ভ্রাতৃত্ব।
    রাসূল ﷺ এক একজন আনসারী সাহাবীর সাথে একজন করে মুহাজির সাহাবির ভ্রাতৃত্ব গড়ে দেন। মদীনার আনসার সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের পরিবারের চেয়েও বেশি আপন করে নেন মুহাজির সাহাবীদের। পরোপকারিতার এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন পৃথিবীর বুকে, ইতিহাসে যার নজির সত্যিই বিরল। নিজের উপর, নিজের স্ত্রীর উপর, এমনকি নিজের সন্তানের উপরও প্রাধান্য দেন নিজের মুহাজির ভাইকে।
    নির্ভয়ে দ্বীন প্রচারঃ
    হিজরতের পর মুহাজির সাহাবায়ে কেরাম রাসূলের ﷺ সোহবতে থেকে একনিষ্ঠভাবে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করতে থাকেন। এখানে তাদেরকে দ্বীনের পথে বাধা দানকারী কেউ নেই। লুকিয়ে লুকিয়ে ইবাদাত করারও কোনো প্রয়োজন নাই। তাই কোনো রাখঢাক ছাড়া, প্রকাশ্যেই চলতে থাকে ইসলামের প্রচার প্রসার। মদীনার প্রধান দুটি গোত্র আউস ও খাজরাজের অধিবাসীরা দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকেন। যুগের পর যুগ ধরে চলমান গোত্রীয় ভেদাভেদ ভুলে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন ইসলামের পতাকাতলে। এভাবেই দিন দিন ব্যাপক হতে থাকে ইসলামের দাওয়াত। পারষ্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, দ্বীনের জন্য কঠোর ত্যাগ ও সাধনা এবং পরোপকারিতার তুলনাহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এগিয়ে চলে ইসলামের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা।
    এভাবে কেটে যায় হিজরতের পর ছয়টি মাস। এতদিনে পবিত্র কুরআনে জিহাদের বিধান সংক্রান্ত আয়াতও চলে আসে। চলতে থাকে জিহাদের প্রস্তুতিও।
    আবু জাহলের বাণিজ্যিক কাফেলাঃ
    হিজরতের সপ্তম মাস ছিল মাহে রমাদান। রাসূল ﷺ জানতে পারলেন, আবু জাহলের নেতৃত্বে কুরাইশদের ৩০০ সদস্যের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা শাম থেকে ফিরছে। যেহেতু মক্কাবাসী শাম দেশে ব্যবসা করে নিজেদের অর্থের যোগান দিত, আর ভৌগোলিকভাবে মদীনার অবস্থান ছিল মক্কা ও শামের মাঝপথেই, তাই মক্কার বাণিজ্যিক কাফেলাগুলো অনিবার্যভাবেই মদীনার পাশ কেটে আসা-যাওয়া করত। রাসূল ﷺ আবু জাহলের এই বাণিজ্যিক কাফেলার পথ রোধ করার সিন্ধান্ত নিলেন। যাদের অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মুসলিমরা আপন মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তাদের পাশ দিয়েই মক্কার মুশরিকরা নিজেদের বাণিজ্যিক কাফেলা নিয়ে নির্বিঘ্নে আসা-যাওয়া করবে- এটা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? রাসূল ﷺ এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। তিনি ৩০ জন মুহাজির সাহাবীর একটি বাহিনী গঠন করলেন।
    ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিযানের প্রথম কমাণ্ডারঃ
    ইসলামের প্রথম এই যুদ্ধাভিযানের কমাণ্ডার কে হবে? ৩০ জনকে নিয়ে ৩০০ জনের মোকাবিলা করার হিম্মত কার বুকে আছে?
    অনেক চিন্তাভাবনার পর রাসূল ﷺ স্বীয় চাচা, দুধ ভাই ও বাল্যবন্ধু হযরত হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বাহিনীর কমাণ্ডার নিযুক্ত করলেন৷ তিনি যেমন ছিলেন বাহাদুর তেমনি ছিলেন সাহসী-তেজস্বী। অশ্ব চালনা, তীর চালনা ও বর্শা চালনায় তাঁর সমকক্ষ খুঁজে পাওয়া ছিল দুরূহ ব্যাপার। আল্লাহ তা’আলা নেতৃত্বদানেরও অসীম দক্ষতা দান করেছিলেন তাকে। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মক্কার সর্দার ছিলেন তিনি। তার সাহসিকতা আর বাহাদুরি কারো অজানা ছিল না। ইসলামের বিরোধিতা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না। রাসূল ﷺ তাকে খুব ভালোবাসতেন। [১]
    ইসলামের প্রথম ঝাণ্ডাঃ
    বাহিনী তৈরী হয়ে গেলে আল্লাহ্‌র রাসূল ﷺ তাদেরকে মুলত আবু জাহলের খোঁজ-খবর নিতে পাঠান। রাসূলুল্লাহ ﷺ মোকাবিলার সুযোগ হলে মোকাবিলা করার অনুমতি দেন এবং জরুরী কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে বাহিনী রওয়ানা করেন। দীর্ঘ ১৩ বছরে জুলুম-নির্যাতনের যত পাওনা জমা হয়েছে হিসেবের খাতায়, আজ সেই পাওনা চুকিয়ে দেওয়া হবে কড়ায়-গণ্ডায়। প্রতিশোধ স্পৃহায় ত্রিশজনের প্রত্যেকেই ছিল অগ্নিমানব।
    বাহিনী মদীনা থেকে বের হওয়ার প্রক্কালে রাসূল ﷺ পরম যত্নের সঙ্গে হযরত হামজা (রাঃ) এর হাতে একটি কালিমা খচিত সাদা ঝাণ্ডা তুলে দেন। ঐতিহাসিকদের মতে এটিই ছিল ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিযান ও প্রথম ঝাণ্ডা উত্তোলন, যা সংঘটিত হয়েছিল বিজয়ের মাসে, মাহে রমাদানে।
    ঝাণ্ডা বহন করার দায়িত্ব পান হযরত আবু মারসাদ কান্নায ইবনে হুসাইন (রাঃ)।
    উভয় বাহিনীর মুখোমুখি অবস্থানঃ
    ঐদিকে আবু জাহল তার ৩০০ সদস্যের বাণিজ্যিক কাফেলা নিয়ে লোহিত সাগরের তীর ঘেঁষে মক্কার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। মুসলিম বাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে সে কিছুটা উদাসীন-ই ছিল। সে ভাবতেও পারেনি যে, যে দুর্বল লোকগুলিকে তারা মক্কা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে তাদের দ্বারাই সে আক্রমণের শিকার হবে। তদুপরি সে হলো মক্কার সর্দার। তার কাফেলাকে আক্রমণ করবে-মুহাম্মাদের ﷺ সে সাহস কোথায়? তাই সে নিশ্চিন্তেই পথ চলছিল। সমুদ্র-উপকূলীয় ঈস নামক অঞ্চলে ছাউনি ফেলে সে অবস্থান করছিল- এমন সময় হঠাৎ মুসলিম বাহিনী সেখানে উপস্থিত। ঘটনার আকস্মিকতায় সে হকচকিয়ে যায়। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তারপর মুসলিম বাহিনীর কমাণ্ডার হিসেবে হামজাকে দেখে সে আরো ঘাবড়ে যায়। তথাপিও সে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয় এবং উভয় বাহিনী সারিবদ্ধ হয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায়।
    প্রথম হিজরির রমাদান মাস মোতাবেক ৬২৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস। উভয় বাহিনীই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। একদিকে ৩০০ মুশরিক অপরদিকে ৩০ জন সাহাবী, যাঁদের প্রত্যেকেই বুকভরা সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ইস্পাত কঠিন প্রাচীরের ন্যায়। মুসলিম সেনাদের এরকম দৃঢ়তা আবু জাহলের জন্য সীমাহীন উদ্বেগের কারণ ছিল। কেননা, এটাই প্রথম ঘটনা যেখানে শক্তিশালী কুরাইশদের বিরুদ্ধে দুর্বল মুসলিমরা তীর-ধনুক আর তরবারি নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। তাদের অন্তরে কোনো ভয় নেই। চেহারায় দুশ্চিন্তার কোনো ছাপ নাই।
    সন্ধির মাধ্যমে যুদ্ধের যবনিকাপাতঃ
    উভয় বাহিনীই যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত তখন মাঝখানে এসে দাঁড়ায় জুহাইনাহ গোত্রের সর্দার মাজদী ইবনে আমর জুহানী। যেহেতু সে উভয় পক্ষের হালীফ (মৈত্রীচুক্তিবদ্ধ) ছিল, তাই সে উভয় বাহিনীকে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানায়। তৎকালীন যুগে হালীফদের সিন্ধান্ত মেনে নেওয়ার মজবুত রীতি ছিল। সে রীতি অনুসারেই উভয় বাহিনী সন্ধির জন্য প্রস্তুত হয় এবং তার মধ্যস্থতায় সন্ধি হয়ে যুদ্ধ বন্ধ হয়। আবু জাহল তার কাফেলা নিয়ে মক্কা ফিরে যায় আর হামজা (রাঃ) মুসলিম বাহিনী নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন।
    যুদ্ধ না করেও উদ্দেশ্য সফলঃ
    আবু জাহলের বিরুদ্ধে উক্ত বাহিনী প্রেরণের দ্বারা রাসূলুল্লাহর ﷺ উদ্দেশ্য কেবল যুদ্ধ করাই ছিল না৷ বরং আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল। তা হলো, আবু জাহলসহ মক্কার মুশরিকদের নিকট এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে, আমরা এখন দুর্বল নই। আমরা শক্তিশালী হয়েছি। আল্লাহর ইচ্ছায় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস ও সামর্থ আমাদের আছে। আর বলাই বাহুল্য যে, এই উদ্দেশ্যে তিনি সফল হয়েছেন। কুফর জগত এটা বুঝতে পেরেছিল যে, মুসলিমরা মাত্র ৬/৭ মাসের মধ্যেই এমন শক্তি সঞ্চয় করেছে যে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস দেখাচ্ছে।
    প্রথম হিজরির সেই দিনটির প্রায় দেড় হাজার বছর পর, একই উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় নাইন ইলিভেনের বরকতময় হামলা। নাইন ইলিভেনের মূল উদ্দেশ্য এটাই ছিল যে, কুফুরী জগতকে যুদ্ধের জন্য আহ্বান করা এবং নিজেদের শক্তির কিছুটা জানান দেওয়া। আলহামদুলিল্লাহ, নববী মানহাজের সেই নববী সফলতার আত্ম-প্রশান্তিকর দৃশ্য আমরা প্রায় দেড় হাজার বছর পরেও শতভাগ সফলতার সাথেই প্রত্যক্ষ করেছি।
    “মুহাম্মাদ তার দলবল নিয়ে মরুভূমিতে ডাকাতি করত”– ইসলামের উপর উত্থাপিত একটি আপত্তির যৌক্তিক খণ্ডনঃ
    বাণিজ্যবহরে হামলা করে তাদের সম্পদ লুট করা ডাকাতদের কাজ। ইসলামের নবী মুহাম্মাদ ﷺ এমন একটি জঘন্য কাজ কীভাবে করতো?- এমন প্রশ্ন আজ অনেকের মনেই। বিশেষত যারা পশ্চিমাদের থেকে ধার করা বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে চলে, ভাবে ও চিন্তা করে!
    কুরাইশদের বাণিজ্যবহরে রাসূলুল্লাহ ﷺ কেনো আক্রমণ করতেন?
    বিষয়টি গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে; হিজরতের পূর্বে।
    রাসূল ﷺ-এর মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করা কোনো সুখকর ঘটনা ছিল না। তিনি সদলবলে ঢাকঢোল পিটিয়ে আনন্দ ভ্রমণ করে মদীনায় পৌঁছেননি। কুরাইশ নেতারা খুব সহজেই তাঁকে হিজরত করতে দেয়নি। বরং তাঁকে হত্যা করার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল৷ রাসূলের রাসূল ﷺ ঘরের চারপাশে একদল ঘাতক রাত্রি জেগে পাহারা দিচ্ছিল। তাদের উদ্দেশ্য সফল হলে সে রাতেই তিনি ইহকাল ত্যাগ করতেন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমাদের পিতা-মাতা তাঁর জন্য উৎসর্গ হোক!)
    কিন্তু মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা’আলা তাদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে, প্রিয় হাবীবকে সম্পূর্ণ অক্ষত বের করে নেন৷ নিজের বিছানায় চাচাতো ভাই হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে শুইয়ে রেখে তিনি বের হন মদীনার উদ্দেশ্যে। আলীকে রেখে আসেন গচ্ছিত সম্পদগুলো মালিকদের নিকট পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে।
    শিকার যখন হাতছাড়া হয়ে যায়, কুরাইশদের তখন পাগলপারা অবস্থা। তারা মক্কার অলিতে গলিতে, পাহাড়ের গুহায় গুহায় ও রস্তার পাশে ঝোপঝাড়গুলোতে তন্ন-তন্ন করে খুঁজতে থাকে প্রিয় রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর প্রিয় সহচর আবু বকরকে।
    রাসূলের ﷺ রক্ত নেশায় তারা এতটা উন্মাদ কেনো ছিল?- এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
    কিন্তু এর উত্তরটা একদম সোজা। কারণ হলো, তারা এটা ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল যে, মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর অনুসারীদের নিয়ে যেখানেই হিজরত করুক, ভবিষ্যতে তাঁরা তাদের জন্য হুমকির কারণ হবে; কৃত জুলুম-নির্যাতনের হিসেব নিবে। কিন্তু তাদের নেতা মুহাম্মাদ ﷺ-কে কতল করতে পারলে তাদের এই মিশন মুখ থুবড়ে পড়বে। তাদেরও আর কোনো শত্রু থাকবে না। তাই মুহাম্মাদ ﷺ-কে কোনোভাবেই ছেড়ে দেওয়া যায় না। যে কোনো মূল্যেই হোক, তাকে কতল করতেই হবে!
    কিন্তু তাদের সকল ষড়যন্ত্রকে একপাশ করে তিনি যখন হিজরত করে নিরাপদে মদীনায় পৌঁছে যান, কুরাইশরা তখন মুহাম্মাদ ﷺ-কে শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ না দিয়েই মদীনায় আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মদীনার ইহুদী গোত্রগুলো বাহ্যিকভাবে রাসূলুল্লাহর ﷺ সাথে চুক্তিবদ্ধ হলেও, গোপনে গোপনে তারা কুরাইশদের সাথেই আঁতাত করছিল এবং তাদের মদীনা আক্রমণের ব্যাপারে ইন্ধন যোগাচ্ছিল। সুতরাং, হিজরত করার পরও মুসলিমরা কুরাইশদের থেকে নিরাপদ হয়ে যাননি। যে কোনো সময় মদীনা আক্রমণের একটা অশনি সংকেত তাদেরকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।
    এদিকে মদীনা আক্রমণের আর্থিক প্রস্তুতি হিসেবে কুরাইশদের বাণিজ্যবহর ঘনঘন সিরিয়া সফর করতে শুরু করল। সেটাও আবার মুসলিমদের ফেলে আসা সহায়-সম্পত্তিকে পুঁজি করে। তারা এটা কীভাবে মেনে নিতে পারেন যে, তাদেরই সম্পদ দিয়ে ব্যবসা করে তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নেওয়া হবে, আর তারা চুপচাপ বসে থাকবেন? অথচ একটা যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে আর্থিক সাপোর্ট-ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বদর যুদ্ধের সময়, কুরাইশ বাহিনী মক্কা থেকে বের হওয়ার পর যুদ্ধ শেষে পুনরায় মক্কা ফেরা পর্যন্ত, তাদের খাবারের প্রয়োজন মেটাতে প্রত্যহ ১০টি করে উট জবাই করা হতো। এ থেকে এটা খুব সহজেই অনুমেয় যে, এ যুদ্ধে তাদের কী বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছিল। সেই অর্থের যোগান দিতেই তাদের একের পর এক বাণিজ্যবহর সিরিয়া যাচ্ছিল বাণিজ্য করতে।
    বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হযরত মুহাম্মাদ ﷺ যখন বুঝতে পারলেন যে, কুরাইশরা বড় ধরনের একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এ বাণিজ্যিক কাফেলাগুলি সেই প্রস্তুতির-ই একটা অংশ, তখন তাঁর পক্ষে কীভাবে সম্ভব ছিল শত্রুকে প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ দেওয়ার? তিনি ছাড়া অন্য কেউ হলে কি দিতেন? আপনি যখন জানবেন যে একটি শক্তিশালী ফান্ড তৈরী হচ্ছে- যা আপনার নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে, আপনাকে নিশ্চিহ্ন করবে, তখন কি আপনি সেই ফান্ডগঠন প্রক্রিয়াকে বাধা দিবেন না?
    আধুনিক বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র কি অন্য কোনো রাষ্ট্রকে নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে জেনেও তাকে ছাড় দেবে? নিশ্চয়ই দেবে না।
    চলুন, সাম্প্রতিককালের একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা আরেকটু খোলাসা করি!
    রাশিয়ার নাকের ডগায় বাস করে ইউক্রেন। একটা সময় রাশিয়ার উপনিবেশ ছিল দেশটি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে দীর্ঘ প্রায় ৭০ বছরের উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি। ২০১৯ সালে ইহুদী বংশদ্ভূত ভলোদিমির জেলেনস্কি দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই দেশটিকে সে ন্যাটোর আওতাভুক্ত করতে মরিয়া হয়ে যায়। কিন্তু রাশিয়া তার নাকের ডগায় চির শত্রু ন্যাটোর ঘাঁটি দেখতে কিছুতেই প্রস্তুত ছিল না। কারণ, শত্রু এতটা কাছে আসার সুযোগ পেলে তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। যে কোনো সময় তার দেশ ন্যাটোর দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু ঐ জেলেনস্কি যখন তার সিন্ধান্তে অটল ছিল, তখন রাশিয়া ইউক্রেনে সেনা অভিযান চালিয়ে দেশটি প্রায় দখল করে নেয়। [২]
    লক্ষ করার বিষয় হলো, রাশিয়া কিন্তু শত্রুকে ছাড় দেয়নি। তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে- এমন পদক্ষেপ শত্রুকে নিতে দেখে সে কিন্তু চুপ করে বসে থাকেনি। শুধু রাশিয়া কেনো, শত্রুকে এই সুযোগ কেউ দিবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। এবং এটাই একজন বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়কের করণীয় ছিল।
    যদি লুটপাট করাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য হত, তাহলে মদীনার পাশ দিয়ে কুরাইশদের ছাড়া অন্য গোত্রের বাণিজ্যিক কাফেলাও তো চলাচল করত, তাদের উপর তো তিনি আক্রমণ করতেন না! ইতিহাসে এরকম কোনো ঘটনার অস্তিত্ব নাই।
    তাছাড়া, কুরাইশদের চোখে মুসলিমরা নিতান্তই ক্ষুদ্র বৈ কিছুই ছিল না। বর্তমান কুফুরী বিশ্ব মুসলিমদের যেমন একটা নিরীহ জাতি হিসেবে গণ্য করে, সে যুগের কুরাইশরাও মুসলিমদের তাই গণ্য করত। ইসলামের দাওয়াতকে গতিশীল করতে মুসলিমদের ব্যাপারে কুরাইশদের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অপরিহার্য ছিল। কুরাইশদের বাণিজ্যবহরে আক্রমণ করে তাদের অন্তরে মুসলিম-ভীতি সৃষ্টি করাও একটা অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। [৩]
    সুতরাং, আমরা বলতে পারি, কুরাইশদের বাণিজ্যবহরে আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্য ডাকাতি বা লুটপাট ছিল না, বরং প্রধান তিনটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই আক্রমণগুলি চালান হত।
    ১। নিজেদের ফেলে আসা সহায়-সম্পত্তির যথাসম্ভব পুনরুদ্ধার।
    ২। মদীনাকে কুরাইশদের বড় ধরনের আক্রমণ থেকে রক্ষার তাগিদে, যুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি কুরাইশদের অর্থনীতির মূলোৎপাটন।
    ৩। কুরাইশদের বাণিজ্যবহরে ছোট ছোট আক্রমণ পরিচালনা করে মুসলিমদের দুর্বল ভাবার সুযোগ না দেওয়া এবং যুদ্ধের ময়দানে আসার পূর্বেই তাদের অন্তরে ভীতি সৃষ্টি করা। সর্বোপরি ইসলামের দাওয়াতকে গতিশীল করা।

    নোট
    [১] তাঁর বিস্তারিত জীবনী জানতে আগ্রহী পাঠক ইসলামের তারকাগণ এর ১৬তম পর্বটি পড়তে পারেন।
    লিংক : https://alfirdaws.org/2022/02/16/55695/
    [২] এখানে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধটা টেনে শুধু এতটুকুই বোঝানো উদ্দেশ্য যে, শত্রুকে সুসংগঠিত ও সুসংহত হওয়ার সুযোগ কেউ দেয় না। এছাড়া অন্যকিছু বোঝানো উদ্দেশ্য না। সুতরাং, কেউ আবার মু্হাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে মিলানোর চেষ্টা করবে না!
    [৩] শত্রুর অন্তরে ভীতি সৃষ্টি করা ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাংঘর্ষিক না। যখন মুসলিমদের খিলাফত ব্যবস্থা শক্তিশালী থাকে এবং মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় থাকে তখনও বছরে দু’একবার শত্রুর উপর আক্রমণ পরিচালনা করা শুধু এ জন্যই ফরজে কিফায়া করা হয়েছে, যেনো শত্রুরা মুসলিমদের দুর্বল ভাবতে না পারে। মুসলিম ভূখণ্ডে আক্রমণ করার সাহস দেখাতে না পারে।
    লেখক : মুফতি আব্দুল্লাহ মুনতাসির

    তথ্যসূত্র:
    ১. সীরাতে ইবনে হিশাম।
    ২. যাদুল মা’আদ।
    ৩. সীরাতে মুস্তফা।

    আপনাদের নেক দোয়ায় আমাদের ভুলবেন না। ভিজিট করুন আমাদের ওয়েবসাইট: alfirdaws.org

  • #2
    মাশা-আল্লাহ !
    ​​​​​​ভাই অনেক ইতিহাস অজানা ছিল!
    আপনাদের মধ্যেমে জানতে পারলাম

    জাযাকাল্লাহ খাইরান

    Comment


    • #3
      ডাকাতি হল নিরিহ মানুষের উপর আক্রমণ করা। কোন ঘাতক সংগঠনের উপর আক্রমণ করা এবং তাদেরকে নির্মূল করা কিছুতেই ডাকাতি হতে পারে না বরং এটি হল অন্যায়ের প্রতিবাদ।
      পৃথিবীর রঙ্গে রঙ্গিন না হয়ে পৃথিবীকে আখেরাতের রঙ্গে রাঙ্গাই।

      Comment

      Working...
      X