শামে চলমান ফেতনায় কেমন আছেন হকপন্থী মুজাহিদিন?
সিরিয়া এখন বহুমুখী যুদ্ধক্ষেত্র। ঘোর অন্ধকারের মতো ফিতনা ছড়িয়ে পড়েছে সেখানে। এমন পরিস্থিতিতেও হক্বের নিভু নিভু ঝাণ্ডা হাতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন আল্লাহভীরু একদল মুজাহিদ। এমনিতেই কাফেরদের নির্মম বোমাবর্ষণে বিপর্যস্ত শাম। এর মধ্যে আবার প্রায় সপ্তাহখানেক আগ থেকে শুরু হয়েছে হকপন্থী মুজাহিদ গ্রুপগুলোর উপর বিদ্রোহী গ্রুপ তাহরিরুশ শাম (এইচটিএস) এর নানারকম জুলুম ও নির্যাতন। এখনো তারা নির্দয়ভাবে মুজাহিদ ভাইদের উপর আঘাত হেনে যাচ্ছেন।
তাহরিরুশ শাম (এইচটিএস) বেশকিছু মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করে মুজাহিদগণের উপর হামলা চালাচ্ছেন। ঐসকল মিথ্যাচার নাকচ করে দিয়ে আল-কায়েদার মুজাহিদগণ তাহরিরুশ শামকে এসব বিষয়ের সমাধানে শরয়ী আদালতে বসার আহ্বান জানান। শুরুতে তাহরিরুশ শাম মুজাহিদগণের এই আহ্বান উপেক্ষা করে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছিলো, তবে পরবর্তীতে সাধারণ জনতা ও আলেমদের প্রতিবাদের মুখে তারা চলমান সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য মুজাহিদদের আহ্বানে সাড়া দেয় এবং আলোচনায় বসতে রাজি হয়। কিন্তু সমাধানের জন্য তারা শরয়ী আদালতে না বসে নিজেদের মধ্যেই সমঝোতা করার কথা জানিয়ে আলোচনায় বসে। এদিকে নিজেদের মধ্যকার এই ফেতনা যেন খুব দ্রুতই নির্মূল হয়ে যায়, সেই আশায় আল-কায়েদা শাখা তানযিম হুররাস আদ-দ্বীন ও তাদের নবগঠিত “ফাসবুতু” অপারেশন রুমে অংশগ্রহণকারী দলগুলোও তাহরিরুশ শামের এই সিদ্ধান্তে রাজি হয়ে যান।
কিন্তু আলোচনায় সমাধানের পথে না হেঁটে বক্রতার পথ বেছে নেন তাহরিরুশ শামের কর্তৃপক্ষ। তারা হক্বপন্থী মুজাহিদগণের উপর অন্যায় শর্ত চাপিয়ে দিতে থাকেন এবং নিজেদের কুৎসিত উদ্দেশ্যগুলো সামনে আনেন। তাহরিরুশ শাম (এইচটিএস) নিম্নোক্ত শর্তগুলোর ভিত্তিতে মুজাহিদগণের উপর হামলা বন্ধ করার কথা জানায়:
১. ইদলিবের আরব সাইদ ও সাহলুর রাউজ এলাকার সড়কগুলো হতে আল-কায়েদা সমর্থিতদের সকল চেকপোস্ট উঠিয়ে ফেলতে হবে।
২. আরব সাইদে হুররাস আদ-দ্বীনের সকল ঘাঁটি বন্ধ করে দিতে হবে এবং সড়ক পথে থাকা তাদের সকল চেকপোস্টগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে।
৩. মুজাহিদগণ তাদের সকল প্রকার ভারী ও হালকা যুদ্ধাস্ত্রগুলো “এইচটিএস” এর কাছে হস্তান্তর করতে হবে। শুধু ব্যক্তিগত একটি অস্ত্রই প্রত্যেক যোদ্ধা এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবেন।
৪. আরব সাইদে “এইচটিএস” এর যোদ্ধারাই কেবল অস্ত্রসহ অবস্থান নিতে পারবেন।
৫. হারাম, আরমানায, কু’কু ও শাইখ বাহার এই এলাকাগুলো থেকে হুররাস আদ-দ্বীন তাদের সকল চেকপোস্টগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে।
৬. এই অঞ্চলগুলোতে অবস্থিত হুররাস আদ-দ্বীনের উভয় ঘাঁটি খুব দ্রুত তাহরিরুশ শামের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
৭. হুররাস আদ-দ্বীন এই এলাকাগুলোতে পরবর্তীতে কোন ঘাঁটি গড়তে পারবেন না।
মুজাহিদদের রক্ত যেন অন্যায়ভাবে আর প্রবাহিত না হয়, এ কারণে আল-কায়েদা সমর্থিত মুজাহিদগণ তাহরিরুশ শাম (এইচটিএস) এর এই একচেটিয়া শর্তগুলোও মেনে নিয়েছেন। শর্তগুলো মেনে নেয়ার ৩টি চুক্তিপত্র প্রকাশ করেছে ওজিএন, ইবা নিউজ ও তানযিম হুররাস আদ-দ্বীনের কয়েকটি অফিসিয়াল ব্যক্তিগত টেলিগ্রাম চ্যানেল।
কিন্তু এতেও তাহরিরুশ শাম অন্যায়ভাবে মুজাহিদদের রক্তপাত বন্ধ করেননি, তারা মুজাহিদদের অন্যান্য এলাকাগুলোতেও হামলা চালাতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে ইদলিবে অবস্থিত আল-কায়েদার নবগঠিত “ফাসবুতু” অপারেশন রুমে যুক্ত আনসার আল-ইসলাম ও আনসারুত তাওহীদের ২টি সামরিক হেডকোয়ার্টারে হামলা করে বসেছেন “এইচটিএস”-এর যোদ্ধারা। এসময় তারা আনসার আল-ইসলামের সামরিক হেডকোয়ার্টারে অবস্থানরত সকল মুজাহিদকে বন্দী করে নিয়ে গেছেন। একইভাবে আনসারুত তাওহীদের সামরিক হেডকোয়ার্টার অবরুদ্ধ করে হামলা চালাতে থাকেন “এইচটিএস” এর যোদ্ধারা।
এছাড়াও ইদলিবে আনসার আল-ইসলামের অন্য একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পেও ২৮ জুন সকাল বেলায় হামলা চালান এইচটিএস যোদ্ধারা এবং তা অবরুদ্ধ করে রাখেন। অপরদিকে “এইচটিএস” এরই একসময়ের আলেপ্পো (হলব) এর সামরিক বিভাগের প্রধান শাইখ আবুল আব্দ আল-আশদা হাফিজাহুল্লাহ্ এর গঠিত “তানসিকিয়াতুল জিহাদ” গ্রুপের মুজাহিদদের উপরেও গত ২৭ জুন থেকে হামলা চালাতে শুরু করেছে “এইচটিএস”। কিছুদিন পূর্বে “তানসিকিয়াতুল জিহাদ” আল-কায়েদার নবগঠিত অপারেশন রুমে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু “এইচটিএস” এর পক্ষ থেকে “তানসিকিয়াতুল জিহাদ”-কে হুমকি দিয়ে বলা হয়, তারা যেন “এইচটিএস” এর দ্বারা পরিচালিত অপারেশন রুমে যুক্ত হন। তারা এইচটিএস এর পরিচালিত “ফাতহুল মু’বীন” অপারেশন রুমে যুক্ত হলে তাদের সর্বাত্মক সহায়তা করবে বলেও জানায় এইচটিএস। অন্যথায় “তানসিকিয়াতুল জিহাদ” কে আল-কায়েদার নবগঠিত অপারেশন রুম ত্যাগ করে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে হবে। আর এর কোনোটাই যদি “তানসিকিয়াতুল জিহাদ” মেনে না নেয়, তাহলে বলা হয়েছে তাদের সকল কার্যক্রম আলেপ্পোতে বন্ধ করে দিতে হবে এবং তাদের চেকপোস্টগুলো এইচটিএস এর কাছে হস্তান্তর করে আলেপ্পো ছাড়তে হবে। আর এই সংবাদটি প্রচার করে এইচটিএন এর অফিসিয়াল মিডিয়া “ইবা নিউজ”। তাহরিরুশ শামের এমন এক চেটিয়া সিদ্ধান্তের পর “তানসিকিয়াতুল জিহাদ” তাদের চেকপোস্টগুলো ২৮ জুন বিকাল হতে তাহরিরুশ শামের কাছে হস্তান্তর করে এবং তারা আল-কায়েদার সাথে থাকার অঙ্গীকার করেন।
এভাবেই আল-কায়েদার সাথে যুক্ত এবং আল-কায়েদার সাথে যুক্ত হতে চান এমন প্রতিটি দলকেই বিভিন্নভাবে চাপ দিচ্ছে এইচটিএস। সর্বশেষ তাহরিরুশ শাম (এইচটিএস) তাদের অফিসিয়াল বার্তায় ঘোষণা করেছে যে, এইচটিএস এর পরিচালিত “ফাতহুল মুবীন” অপারেশন রুম ছাড়া নতুন কোন অপারেশন রুমকে শামের ভূমিতে কাজ করতে দেওয়া হবে না, কেউ যদি কাজ করতে চায় তাহলে তাকে এইচটিএস এর অপারেশন রুমের অধীনেই কাজ করতে হবে। বার্তাটি “এইচটিএস” এর অফিসিয়াল “ইবা নিউজ” সহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমগুলোতেও প্রচারিত হয়।
নতুন এই বিবৃতিটির দ্বারা মূলত তাহরিরুশ শাম বৈশ্বিক জিহাদী সংগঠন আল-কায়েদার নবগঠিত “ফাসবুতু” অপারেশন রুমের মুজাহিদদের কার্যক্রমকে বন্ধ করার জন্য অফিসিয়ালভাবে হুমকি দিল।
এদিকে তাহরিরুশ শামের হাতে অন্যায়ভাবে শাহাদাতবরণকারী মুজাহিদদের মৃতদেহ দাফনের জন্য মুজাহিদদের কাছে হস্তান্তর করছে না এই বিদ্রোহী গ্রুপটি। শাহাদাতবরণকারী মুজাহিদগণের মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শহিদ কমান্ডার আবু জায়েদ জর্ডানী রহিমাহুল্লাহ্। তাঁর লাশ চারদিন যাবত দাফন না দিয়ে ফেলে রেখেছে তাহরিরুশ শাম। হুররাস আদ-দ্বীনের পক্ষ থেকে তাঁর লাশ চাওয়ার পরেও মুজাহিদদের কাছে লাশ হস্তান্তর করছেন না তাহরিরুশ শামের যোদ্ধারা। তাদের এমন নির্লজ্জ কাজের প্রতিবাদ করেছেন শামের সচেতন আলেমগণ ও ইদলিবের সাধারণ জনতা। বিপরীতে প্রতিবাদকারী সাধারণ জনতাকে লক্ষ্য করে ফাঁকা গুলি ছুড়ে তাহরিরুশ শাম। আর এর ভিডিও চিত্রও সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু তাহরিরুশ শাম সবকিছুকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের শক্তি আর সংখ্যাধিক্যের অহংকারে নিজেদের এক চেটিয়া অবস্থার উপরই অটল রয়েছে, যেমনটি আমরা ইতিপূর্বে ইরাক থেকে বের হওয়া আইএসদের ক্ষেত্রেও দেখেছি।
আল্লাহ মুসলিমদের মাঝে ঐক্য গড়ে দিন, শামসহ সারাবিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় চলমান জিহাদকে সকল প্রকারের ফিতনা থেকে হেফাজতে রাখুন। আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।
লেখক: ত্বহা আলী আদনান, প্রতিবেদক, আল-ফিরদাউস নিউজ।
সূত্র: https://alfirdaws.org/2020/06/29/39239/
Comment