মালিতে গেরিলা যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্ব শুরু করেছে আল-কায়েদা
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে ২০১১ সালে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা এখন গেরিলা যুদ্ধের তৃতীয় বা চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। গেরিলা যুদ্ধের নতুন এই পর্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন (জেএনআইএম)। নতুন এই পর্ব শেষে দেখা মিলবে আরও একটি ইসলামি ইমারাহ্’এর, ইনশাআল্লাহ্। তবে এই ইমারার সীমানা আফগানিস্তানের মতো কোন একটি দেশের সীমানাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং এই ইমারার ভূমি বিস্তৃতি লাভ করবে মালি, বুরকিনা ফাঁসো, নাইজার, আইভরি কোস্ট, ঘানা, সেনেগাল, বেনিন ও টোগোর মতো দেশগুলোতেও।
মালি যুদ্ধ, যা সময়ের সাথে সাথে দেশের সীমানা অতিক্রম করে সমগ্র পশ্চিম আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এই যুদ্ধ আফ্রিকার ইসলাম বিরোধী সরকারগুলোর পাশাপাশি ইউরোপীয় ক্রুসেডার দেশগুলোর জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। ২০১৩ সাল নাগাদ দেশটিতে প্রতিষ্ঠিত হতে যাওয়া ইসলামি ইমারাহ্’র বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এর অগ্রযাত্রা সাময়িক সময়ের জন্য রুখে দিতে সক্ষম হয় ফ্রান্স এবং তার ইউরোপীয় ও আফ্রিকান মিত্ররা। কিন্তু তাদের এই সামরিক হস্তক্ষেপেই বর্তমানে তাদের জন্য কাল হয়ে দাড়িয়েছে। কেননা ২০১৩ সালের পূর্বে এই প্রতিরোধ যোদ্ধারা শুধু মালিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। তখন তাদের জনপ্রিয়তা এবং আজকের মতো এতো বিপুল সংখ্যক জনগণের সমর্থনও তাদের পক্ষে ছিলো না।
কিন্তু মালিতে দখলদার ফ্রান্সের প্রবেশ এবং ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এই চিত্রকে পুরোপুরিই পাল্টে দেয়। আর ক্রুসেডারদের এই পদক্ষেপই এই অঞ্চলে নতুন যুগের সূচনায় অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে। কেননা এই যুদ্ধের ফলেই আঞ্চলিক ছোটো ছোটো দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃহৎ প্রতিরোধ বাহিনীতে রূপ নেয়। সেই সাথে সাধারণ জনগণের সমর্থনও পুরোপুরিভাবে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পক্ষে চলে আসে।
এই যুদ্ধে ক্রুসেডার ফরাসি সেনাবাহিনীর লক্ষ্য ছিল ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ছত্রভঙ্গ করে রাজধানী বামাকোর পতন ঠেকানো। আর সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে যাওয়া ইসলামি ইমারাহ্কে প্রতিহত করার মাধ্যমে দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। তবে এটি স্পষ্ট যে, তারা এই অঞ্চলের ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন করেছে এবং প্রয়োজনীয় গবেষণা ও প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধের ময়দানে নেমেছে। ক্রুসেডাররা ভেবেছিলো কয়েক দিনের অভিযানে তারা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ছত্রভঙ্গ করে রাজধানীকে অবরোধ থেকে মুক্ত করবে। এবং কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নিঃশেষ করে দিবে। কিন্তু পরে ঘটনা ঘটে এর বিপরীত।
ফ্রান্স যখন মালিতে প্রথম প্রথম সামরিক হস্তক্ষেপের করে, তখন প্রতিরোধ যোদ্ধারা রাজধানী বামাকো এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত শহরগুলি থেকে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রত্যাহার করে ঠিকই। কিন্তু তাদের এই প্রত্যাহার ছিলো একটি নতুন এবং দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের প্রস্তুতি। এই সময়টাতে প্রতিরোধ যোদ্ধারা শহর অঞ্চলগুলো ছেড়ে মরুভূমি, পাহাড় এবং গ্রামীণ এলাকায় গেরিলা যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। এটি ছিলো ক্রুসেডারদের ধারনার বাহিরে।
মালি যুদ্ধের গতিপথ
এই যুদ্ধে ক্রুসেডার ফ্রান্স ছাড়াও পশ্চিম আফ্রিকার প্রতিবেশী দেশগুলি নিয়ে গঠিত “G-5” জোট, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত “তাকুবা” ফোর্স এবং জাতিসংঘের কথিত “শান্তিরক্ষী” বাহিনীর সৈন্যরাও জড়িয়ে পড়েছিল।
শুরুর দিকে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের এই যুদ্ধ, দেশের উত্তরের মরুভূমি এলাকা থেকে শুরু হয়ে তা দেশের কেন্দ্রীয় অংশের গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মালির এই যুদ্ধ বুর্কিনা ফাঁসো, আইভরি কোস্ট, নাইজার, বেনিন এবং টোগোর মতো বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আর তা এতটাই যে, এই যুদ্ধের কেন্দ্রস্থল মালির পর প্রতিবেশী বুরকিনা ফাঁসো প্রতিরোধ যুদ্ধের দ্বিতীয় কেন্দ্রস্থ হয়ে উঠে।
এমনকি ২০১৭ সাল নাগাদ পৃথক পৃথকভাবে কাজ করা প্রতিরোধ বাহিনীগুলো এক পতাকাতলে একীভূত হয়ে যায়। যেখানে মালির প্রায় সমস্ত ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনীগুলো একত্রিত হয়ে জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ‘জেএনআইএম’ গঠন করে। এর ফলে তখন গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনাকারী সমস্ত দল এক ছাদের নীচে একত্রিত হওয়ার ঘটনাটি সমস্ত মালিকে গেরিলা বাহিনীর জন্য একচেটিয়া ফ্রন্টে পরিণত করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, যুদ্ধের সময়টাতে প্রতিরোধ বাহিনীগুলোর মাঝে এই ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
প্রতিরোধ বাহিনীগুলোর মাঝে এই ঐক্যই পরে মালির যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো, আলহামদুলিল্লাহ্। কেননা ২০১৭ সালে ‘জেএনআইএম’ প্রতিষ্ঠিত হলে মালিতে বৈশ্বিক কুফ্ফার জোট বাহিনীগুলো পরাজয়ের দারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে থাকে। প্রতিরোধ যোদ্ধারা পাহাড়ি আর গ্রামাঞ্চলগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। তাঁরা এবার শহুরে অঞ্চলগুলোতেও অভিযান চালাতে শুরু করেন। তাঁরা যুদ্ধের ময়দানে ধীরে ধীরে বেশ স্বতন্ত্র এবং দৃশ্যমান পর্যায় অতিক্রম করতে শুরু করেন, যা এখনও চলছে। এবং গেরিলা যুদ্ধের চূড়ান্ত অবস্থায় ঢুকতে শুরু করেন।
মালি যুদ্ধে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ, পুরনো শত্রু নতুন চেহারায়
জেএনআইএম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুজাহিদগণ দুর্বার গতিতে সম্মুখ পানে ছুটতে থাকেন। এসময় ক্রুসেডার জোটগুলোর সৈন্যদের হত্যা করে একে একে মালির বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন। শত্রুর জোট বাহিনীগুলো যখন যুদ্ধের ময়দানে মুজাহিদদের হাতে নাকানিচুবানি খাচ্ছিলো, এবং ২০২০ সাল থেকে ক্রুসেডাররাও পালাতে শুরু করলো, তখন ক্ষমতা লোভী এবং ইসলাম বিরোধী মালির সরকার অনেকটাই ভেঙে পড়ে। ফলে নিজেদের ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে নতুন মিত্র খুঁজতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা মিত্রতা গড়ে তুলে মুসলিমদের পুরনো শত্রু রাশিয়ার সাথে।
এদিকে রাশিয়া ও ইউরোপীয়দের মধ্যে পূর্ব থেকেই কুকুর-বিড়ালের লড়াই চলে আসছে। আর এমন একটি অবস্থায় মালি সরকার রাশিয়ার কাছাকাছি ঘেঁষতে শুরু করে এবং এখানে রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারকে নিয়ে আসে। এর ফলে ফ্রান্সের সাথে জান্তা সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং একের পর এক সামরিক চুক্তি বাতিল হতে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে মালি থেকে ফরাসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেনা প্রত্যাহারের তোড়জোড়। আর কুফ্ফার বাহিনীর মধ্যকার এই টানাপোড়ার সম্পর্ককে সর্বোচ্চ কাজে লাগায় আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধারা। কেননা রাশিয়া এবং ফ্রান্সের মধ্যকার সৃষ্ট দ্বন্দ্বের সময়টা মুজাহিদদেরকে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাছাকাছি নিয়ে আসে, এবং মুজাহিদগণ এই সময়টাতে নিজেদের অবস্থানের মূল্যায়ন করার সুযোগ পেয়ে যান।
ফলে এই অঞ্চলে রাশিয়ার ক্ষমতার ক্ষুধা যখন ফ্রান্স ও ইউরোপীয়দের দূরে ঠেলে দিচ্ছে, তখন মুজাহিদরা ক্রুসেডারদের ছেড়ে যাওয়া অঞ্চলগুলো বিজয়ের মাধ্যমে সেই অঞ্চলগুলোয় তৈরি হওয়া শূণ্যতা পূর্ণ করছেন।
এটি লক্ষণীয় বিষয় যে, রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী অনেক উপাদানের দিক থেকে ফরাসি ক্রুসেডার বাহিনীর চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিমান সহায়তার ক্ষমতা, গোয়েন্দা তথ্যের স্তর এবং সে অঞ্চলে যে দলগুলির সাথে লড়াই করেছে সে সম্পর্কে তথ্য, ওয়াগনারের নিয়মিত সামরিক বাহিনীর অভাব, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের অভাব ইত্যাদি। রুশ বাহিনীর এই সমস্ত শূণ্যতা মালিতে মুজাহিদদের জন্য প্লাস পয়েন্ট হয়ে উঠেছে। ফলে মুজাহিদগণ পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়ায় সর্বদিক থেকে বিশাল এক শূন্যতা পেয়েছেন, যা মুজাহিদগণ জিহাদ ও শরিয়াহ্র আলো দ্বারা পূর্ণ করছেন, আলহামদুলিল্লাহ্।
গেরিলা যুদ্ধের চূড়ান্ত বা নতুন পর্ব
বর্তমানে মালিতে গেরিলা যুদ্ধের একটি নতুন পর্ব চলছে। সম্প্রতি গেরিলা যুদ্ধের এই পর্বে ‘জেএনআইএম’ এর একজন মুখপাত্র শাইখ আবু ইয়াহ্’ইয়া হাফিজাহুল্লাহ্’র ৩ মিনিটের একটি বক্তব্য সামনে এসেছে। তাঁর উক্ত বক্তব্যে গেরিলা যুদ্ধের নতুন পর্বটি সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
ঐ ভিডিও-বার্তায় মুখপাত্র আবু ইয়াহ্’ইয়া বলেছেন যে, “তাঁরা খুব শীঘ্রই মালির রাজধানী বামাকো অবরোধ করবেন, এবং এখানে সম্পূর্ণ শরিয়াহ্ আইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত রাজধানীতে আক্রমণ চালিয়ে যাবেন”। আর এই লক্ষ্যে ‘জেএনআইএম’ তার যোদ্ধাদের রাজধানী বামাকোর চারপাশে মোতায়েন সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে ‘জেএনআইএম’ এর বীর মুজাহিদরা রাজধানী বামাকো সহ দেশের সমস্ত বড় বড় শহরগুলোতে অভিযানের জন্য প্রস্তুত। এরপর থেকে রাজধানীতে উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে সরকার। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়কই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বাকিগুলোতে বসানো হয়েছে অতিরিক্ত নিরাপত্তা চৌকি। সব মিলিয়ে এক আতংকময় সময় পার করছে মালির গাদ্দার সরকার।
গেরিলা যুদ্ধ নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। গেরিলা যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দুটি নাম সবার আগে চলে আসে। তারা হচ্ছেন চে-গুয়েভারা এবং মাও সেতুং। যাদের গেরিলা যুদ্ধের থিওরি আধুনিক যুগে রেফারেন্স হয়ে উঠেছে। তবে চে-গুয়েভারা জাকে তার আদর্শ মনে করে, সেই আব্দুর রহিম (রহ-কে অমুসলিম নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব-ব্যবস্থা স্মরণ করতে বা করতে দিতে চায় না। অথচ আব্দুর রহমান (রহ অনেকটা একাই তৎকালীন বিশ্বের তৃতীয় পরাশক্তি স্পেনকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন বহুকাল। যাইহোক, তাদের মতে, গেরিলা যুদ্ধের তিনটি প্রধান পর্যায় রয়েছে:
১- কৌশলগত প্রতিরক্ষা:
এই পর্যায়ে, গেরিলা যোদ্ধারা নিজেদের কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলিকে সুসংগঠিত, সুরক্ষিত এবং একত্রিত করার উপর ফোকাস করে। এই কেন্দ্রগুলি সাধারণত বিচ্ছিন্ন এলাকা হয়ে থাকে, যেখানে গেরিলাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান। আর এই এলাকাগুলোতে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেন গেরিলা যোদ্ধারা। এরপর এসব এলাকাগুলো থেকে নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করেন গেরিলারা। পরে শত্রু বাহিনীকে গ্রামাঞ্চলগুলো থেকে তাড়াতে শুরু করেন। আর এই এলাকাগুলোকেই নিজেদের সামরিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেন গেরিলা যোদ্ধারা।
মালির গেরিলা গ্রুপগুলিও এই প্রক্রিয়াটি অতিক্রম করেছে, বিশেষ করে ২০১৩ থেকে ২০১৭ এর মধ্যে৷ এই সময়টাতে ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনীর গেরিলারা কৌশলগত প্রতিরক্ষার জন্য শহর অঞ্চল ছেড়ে গ্রাম্য এবং পাহাড়ি এলাকাগুলোতে আশ্রয় নেন। আর পরবর্তী যুদ্ধের জন্য এই এলাকাগুলোকেই নিজেদের জন্য সামরিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেন। সেই সাথে নতুন যুদ্ধের কৌশল, সামরিক শক্তি এবং জনবল তৈরি করতে থাকেন।
২- কৌশলগত অচলাবস্থা বা ভারসাম্য:
গেরিলা যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রতিরোধ যোদ্ধারা গোপন এবং প্রকাশ্য আক্রমণ বৃদ্ধি করতে থাকেন। সেই সাথে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে সামরিক ফাঁড়িগুলিকে লক্ষ্য করে অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সমর্থন অর্জন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। এই পর্যায়ের শত্রু বাহিনীর বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক (মানষিক) শক্তি ক্ষয় এবং যুদ্ধের প্রেরণার ধ্বংস করে দিতে থাকেন গেরিলারা। এইভাবে, শত্রু বাহিনীকে অনেক অঞ্চলে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে যেতে বাধ্য করা হয়। এই সময়টাতে গেরিলারা (প্রতিরোধী বাহিনী) একটি আধা-সামরিক বাহিনীর রূপ পেতে শুরু করে।
আমরা মালির ক্ষেত্রে এই রূপটি দেখেছি ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। যখন মুজাহিদ গেরিলা যোদ্ধারা জনসমর্থন আদায় করতে সক্ষম হন এবং বিচ্ছিন্ন গ্রুপগুলো এক পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘জেএনআইএম’ গঠন করে। যা একটি সামরিক বাহিনীতে রূপ নেয়। এরপর আমরা ‘জেএনআইএম’ কে দেখেছি গ্রাম্য আর পাহাড়ি এলাকাগুলো থেকে বেরিয়ে এসে সম্মুখ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে। আর এই সময়টাতে মালির বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতেও সক্ষম হন ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধারা (জেএনআইএম)। আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট জেএনআইএম যখন এই পর্যায়টি অতিক্রম করছিল, তখন দেশের রাজনৈতিক সংকটকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা গেরিলা যুদ্ধের তৃতীয় পর্যায়ে পা রাখার সুযোগ পেয়ে যান, আলহামদুলিল্লাহ্।
৩- কৌশলগত পাল্টা আক্রমণ:
এই পর্যায়টি হচ্ছে গেরিলা যুদ্ধের তৃতীয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়। এই সময়টাতে গেরিলা যোদ্ধারা যুদ্ধের ময়দান এবং আলোচনার টেবিলে যুদ্ধ শেষ করার জন্য সিদ্ধান্তমূলক সামরিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতে থাকেন। এতে শত্রু বাহিনীর কেন্দ্রীয় পয়েন্টগুলি গেরিলাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। প্রথম দুই ধাপে শত্রু বাহিনীকে গ্রামাঞ্চল থেকে হটিয়ে, তৃতীয় ধাপে কেন্দ্রীয় অঞ্চল ও সামরিক ঘাঁটিগুলোতে শত্রুবাহিনীকে লক্ষ্য করে হামলা চালাতে শুরু করেন গেরিলারা। এই সময়টাতে শত্রুর সামরিক শক্তি ধ্বংস এবং নেতাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। যার মাধ্যমে শত্রুর মেরুদণ্ডকে ধ্বংস করতে তীব্র লড়াই শুরু করেন গেরিলা যোদ্ধারা।
এসব কিছু বিবেচনার পর এটা বলা যায় যে, ‘জেএনআইএম’ এখন গেরিলা যুদ্ধের তৃতীয় বা চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে শুরু করেছে। জেএনআইএম এর বিবৃতি অনুযায়ী, এই পরিস্থিতির জন্য তাঁরা এখন প্রস্তুত। ইতিমধ্যে ‘জেএনআইএম’ যোদ্ধাদের রাজধানী বামাকো সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে মোতায়েন করা হয়েছে বলেও দাবি করেছেন প্রতিরোধ বাহিনীটির মুখপাত্র। আর ২০২২ সালের জুন-জুলাই মাসে বামাকো এবং এর আশেপাশে আক্রমণগুলিও এটাই নির্দেশ করে যে, জেএনআইএম মালিতে গেরিলা যুদ্ধের তৃতীয় বা চূড়ান্ত ধাপে প্রবেশ করেছে।
ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের ইতিহাস দেখলেও এটা স্পষ্ট হয় যে, তাঁরাও এই তিনটি ধাপ অতিক্রম করে রাজধানী কাবুলে বিজয় নিশান উড়িয়েছেন। তালিবান মুজাহিদিনরাও গেরিলা যুদ্ধের এই তিনটি প্রধান পর্যায় অতিক্রম করে এবং চূড়ান্ত আক্রমণের মাধ্যমে গত ১৫ আগস্ট ২০২১-এ রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।
মালিতে চলমান এই যুদ্ধ প্রায় ১২ বছর ধরে চলছে এবং দেশটির ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রায় ১৫ বছরের সাম্প্রতিক ইতিহাস রয়েছে।
ইনশাআল্লাহ, আমরা চেষ্টা করবো আফগানিস্তান ও সোমালিয়ার মতো মালি যুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও সিরাজ আকারে লিখা প্রকাশ করার, আপনাদের জন্য সাম্প্রতিক সময়ের উল্লেখযোগ্য একটি জিহাদী ময়দানের উত্থান-পতন ও বিজয়ের ইতিহাস তুলে ধরার।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে ২০১১ সালে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা এখন গেরিলা যুদ্ধের তৃতীয় বা চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। গেরিলা যুদ্ধের নতুন এই পর্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন (জেএনআইএম)। নতুন এই পর্ব শেষে দেখা মিলবে আরও একটি ইসলামি ইমারাহ্’এর, ইনশাআল্লাহ্। তবে এই ইমারার সীমানা আফগানিস্তানের মতো কোন একটি দেশের সীমানাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং এই ইমারার ভূমি বিস্তৃতি লাভ করবে মালি, বুরকিনা ফাঁসো, নাইজার, আইভরি কোস্ট, ঘানা, সেনেগাল, বেনিন ও টোগোর মতো দেশগুলোতেও।
মালি যুদ্ধ, যা সময়ের সাথে সাথে দেশের সীমানা অতিক্রম করে সমগ্র পশ্চিম আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এই যুদ্ধ আফ্রিকার ইসলাম বিরোধী সরকারগুলোর পাশাপাশি ইউরোপীয় ক্রুসেডার দেশগুলোর জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। ২০১৩ সাল নাগাদ দেশটিতে প্রতিষ্ঠিত হতে যাওয়া ইসলামি ইমারাহ্’র বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এর অগ্রযাত্রা সাময়িক সময়ের জন্য রুখে দিতে সক্ষম হয় ফ্রান্স এবং তার ইউরোপীয় ও আফ্রিকান মিত্ররা। কিন্তু তাদের এই সামরিক হস্তক্ষেপেই বর্তমানে তাদের জন্য কাল হয়ে দাড়িয়েছে। কেননা ২০১৩ সালের পূর্বে এই প্রতিরোধ যোদ্ধারা শুধু মালিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। তখন তাদের জনপ্রিয়তা এবং আজকের মতো এতো বিপুল সংখ্যক জনগণের সমর্থনও তাদের পক্ষে ছিলো না।
কিন্তু মালিতে দখলদার ফ্রান্সের প্রবেশ এবং ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এই চিত্রকে পুরোপুরিই পাল্টে দেয়। আর ক্রুসেডারদের এই পদক্ষেপই এই অঞ্চলে নতুন যুগের সূচনায় অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে। কেননা এই যুদ্ধের ফলেই আঞ্চলিক ছোটো ছোটো দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃহৎ প্রতিরোধ বাহিনীতে রূপ নেয়। সেই সাথে সাধারণ জনগণের সমর্থনও পুরোপুরিভাবে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পক্ষে চলে আসে।
এই যুদ্ধে ক্রুসেডার ফরাসি সেনাবাহিনীর লক্ষ্য ছিল ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ছত্রভঙ্গ করে রাজধানী বামাকোর পতন ঠেকানো। আর সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে যাওয়া ইসলামি ইমারাহ্কে প্রতিহত করার মাধ্যমে দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। তবে এটি স্পষ্ট যে, তারা এই অঞ্চলের ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন করেছে এবং প্রয়োজনীয় গবেষণা ও প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধের ময়দানে নেমেছে। ক্রুসেডাররা ভেবেছিলো কয়েক দিনের অভিযানে তারা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ছত্রভঙ্গ করে রাজধানীকে অবরোধ থেকে মুক্ত করবে। এবং কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নিঃশেষ করে দিবে। কিন্তু পরে ঘটনা ঘটে এর বিপরীত।
ফ্রান্স যখন মালিতে প্রথম প্রথম সামরিক হস্তক্ষেপের করে, তখন প্রতিরোধ যোদ্ধারা রাজধানী বামাকো এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত শহরগুলি থেকে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রত্যাহার করে ঠিকই। কিন্তু তাদের এই প্রত্যাহার ছিলো একটি নতুন এবং দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের প্রস্তুতি। এই সময়টাতে প্রতিরোধ যোদ্ধারা শহর অঞ্চলগুলো ছেড়ে মরুভূমি, পাহাড় এবং গ্রামীণ এলাকায় গেরিলা যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। এটি ছিলো ক্রুসেডারদের ধারনার বাহিরে।
মালি যুদ্ধের গতিপথ
এই যুদ্ধে ক্রুসেডার ফ্রান্স ছাড়াও পশ্চিম আফ্রিকার প্রতিবেশী দেশগুলি নিয়ে গঠিত “G-5” জোট, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত “তাকুবা” ফোর্স এবং জাতিসংঘের কথিত “শান্তিরক্ষী” বাহিনীর সৈন্যরাও জড়িয়ে পড়েছিল।
শুরুর দিকে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের এই যুদ্ধ, দেশের উত্তরের মরুভূমি এলাকা থেকে শুরু হয়ে তা দেশের কেন্দ্রীয় অংশের গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মালির এই যুদ্ধ বুর্কিনা ফাঁসো, আইভরি কোস্ট, নাইজার, বেনিন এবং টোগোর মতো বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আর তা এতটাই যে, এই যুদ্ধের কেন্দ্রস্থল মালির পর প্রতিবেশী বুরকিনা ফাঁসো প্রতিরোধ যুদ্ধের দ্বিতীয় কেন্দ্রস্থ হয়ে উঠে।
এমনকি ২০১৭ সাল নাগাদ পৃথক পৃথকভাবে কাজ করা প্রতিরোধ বাহিনীগুলো এক পতাকাতলে একীভূত হয়ে যায়। যেখানে মালির প্রায় সমস্ত ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনীগুলো একত্রিত হয়ে জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ‘জেএনআইএম’ গঠন করে। এর ফলে তখন গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনাকারী সমস্ত দল এক ছাদের নীচে একত্রিত হওয়ার ঘটনাটি সমস্ত মালিকে গেরিলা বাহিনীর জন্য একচেটিয়া ফ্রন্টে পরিণত করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, যুদ্ধের সময়টাতে প্রতিরোধ বাহিনীগুলোর মাঝে এই ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
প্রতিরোধ বাহিনীগুলোর মাঝে এই ঐক্যই পরে মালির যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো, আলহামদুলিল্লাহ্। কেননা ২০১৭ সালে ‘জেএনআইএম’ প্রতিষ্ঠিত হলে মালিতে বৈশ্বিক কুফ্ফার জোট বাহিনীগুলো পরাজয়ের দারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে থাকে। প্রতিরোধ যোদ্ধারা পাহাড়ি আর গ্রামাঞ্চলগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। তাঁরা এবার শহুরে অঞ্চলগুলোতেও অভিযান চালাতে শুরু করেন। তাঁরা যুদ্ধের ময়দানে ধীরে ধীরে বেশ স্বতন্ত্র এবং দৃশ্যমান পর্যায় অতিক্রম করতে শুরু করেন, যা এখনও চলছে। এবং গেরিলা যুদ্ধের চূড়ান্ত অবস্থায় ঢুকতে শুরু করেন।
মালি যুদ্ধে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ, পুরনো শত্রু নতুন চেহারায়
জেএনআইএম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুজাহিদগণ দুর্বার গতিতে সম্মুখ পানে ছুটতে থাকেন। এসময় ক্রুসেডার জোটগুলোর সৈন্যদের হত্যা করে একে একে মালির বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন। শত্রুর জোট বাহিনীগুলো যখন যুদ্ধের ময়দানে মুজাহিদদের হাতে নাকানিচুবানি খাচ্ছিলো, এবং ২০২০ সাল থেকে ক্রুসেডাররাও পালাতে শুরু করলো, তখন ক্ষমতা লোভী এবং ইসলাম বিরোধী মালির সরকার অনেকটাই ভেঙে পড়ে। ফলে নিজেদের ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে নতুন মিত্র খুঁজতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা মিত্রতা গড়ে তুলে মুসলিমদের পুরনো শত্রু রাশিয়ার সাথে।
এদিকে রাশিয়া ও ইউরোপীয়দের মধ্যে পূর্ব থেকেই কুকুর-বিড়ালের লড়াই চলে আসছে। আর এমন একটি অবস্থায় মালি সরকার রাশিয়ার কাছাকাছি ঘেঁষতে শুরু করে এবং এখানে রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারকে নিয়ে আসে। এর ফলে ফ্রান্সের সাথে জান্তা সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং একের পর এক সামরিক চুক্তি বাতিল হতে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে মালি থেকে ফরাসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেনা প্রত্যাহারের তোড়জোড়। আর কুফ্ফার বাহিনীর মধ্যকার এই টানাপোড়ার সম্পর্ককে সর্বোচ্চ কাজে লাগায় আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধারা। কেননা রাশিয়া এবং ফ্রান্সের মধ্যকার সৃষ্ট দ্বন্দ্বের সময়টা মুজাহিদদেরকে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাছাকাছি নিয়ে আসে, এবং মুজাহিদগণ এই সময়টাতে নিজেদের অবস্থানের মূল্যায়ন করার সুযোগ পেয়ে যান।
ফলে এই অঞ্চলে রাশিয়ার ক্ষমতার ক্ষুধা যখন ফ্রান্স ও ইউরোপীয়দের দূরে ঠেলে দিচ্ছে, তখন মুজাহিদরা ক্রুসেডারদের ছেড়ে যাওয়া অঞ্চলগুলো বিজয়ের মাধ্যমে সেই অঞ্চলগুলোয় তৈরি হওয়া শূণ্যতা পূর্ণ করছেন।
এটি লক্ষণীয় বিষয় যে, রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী অনেক উপাদানের দিক থেকে ফরাসি ক্রুসেডার বাহিনীর চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিমান সহায়তার ক্ষমতা, গোয়েন্দা তথ্যের স্তর এবং সে অঞ্চলে যে দলগুলির সাথে লড়াই করেছে সে সম্পর্কে তথ্য, ওয়াগনারের নিয়মিত সামরিক বাহিনীর অভাব, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের অভাব ইত্যাদি। রুশ বাহিনীর এই সমস্ত শূণ্যতা মালিতে মুজাহিদদের জন্য প্লাস পয়েন্ট হয়ে উঠেছে। ফলে মুজাহিদগণ পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়ায় সর্বদিক থেকে বিশাল এক শূন্যতা পেয়েছেন, যা মুজাহিদগণ জিহাদ ও শরিয়াহ্র আলো দ্বারা পূর্ণ করছেন, আলহামদুলিল্লাহ্।
গেরিলা যুদ্ধের চূড়ান্ত বা নতুন পর্ব
বর্তমানে মালিতে গেরিলা যুদ্ধের একটি নতুন পর্ব চলছে। সম্প্রতি গেরিলা যুদ্ধের এই পর্বে ‘জেএনআইএম’ এর একজন মুখপাত্র শাইখ আবু ইয়াহ্’ইয়া হাফিজাহুল্লাহ্’র ৩ মিনিটের একটি বক্তব্য সামনে এসেছে। তাঁর উক্ত বক্তব্যে গেরিলা যুদ্ধের নতুন পর্বটি সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
ঐ ভিডিও-বার্তায় মুখপাত্র আবু ইয়াহ্’ইয়া বলেছেন যে, “তাঁরা খুব শীঘ্রই মালির রাজধানী বামাকো অবরোধ করবেন, এবং এখানে সম্পূর্ণ শরিয়াহ্ আইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত রাজধানীতে আক্রমণ চালিয়ে যাবেন”। আর এই লক্ষ্যে ‘জেএনআইএম’ তার যোদ্ধাদের রাজধানী বামাকোর চারপাশে মোতায়েন সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে ‘জেএনআইএম’ এর বীর মুজাহিদরা রাজধানী বামাকো সহ দেশের সমস্ত বড় বড় শহরগুলোতে অভিযানের জন্য প্রস্তুত। এরপর থেকে রাজধানীতে উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে সরকার। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়কই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বাকিগুলোতে বসানো হয়েছে অতিরিক্ত নিরাপত্তা চৌকি। সব মিলিয়ে এক আতংকময় সময় পার করছে মালির গাদ্দার সরকার।
গেরিলা যুদ্ধ নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। গেরিলা যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দুটি নাম সবার আগে চলে আসে। তারা হচ্ছেন চে-গুয়েভারা এবং মাও সেতুং। যাদের গেরিলা যুদ্ধের থিওরি আধুনিক যুগে রেফারেন্স হয়ে উঠেছে। তবে চে-গুয়েভারা জাকে তার আদর্শ মনে করে, সেই আব্দুর রহিম (রহ-কে অমুসলিম নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব-ব্যবস্থা স্মরণ করতে বা করতে দিতে চায় না। অথচ আব্দুর রহমান (রহ অনেকটা একাই তৎকালীন বিশ্বের তৃতীয় পরাশক্তি স্পেনকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন বহুকাল। যাইহোক, তাদের মতে, গেরিলা যুদ্ধের তিনটি প্রধান পর্যায় রয়েছে:
১- কৌশলগত প্রতিরক্ষা:
এই পর্যায়ে, গেরিলা যোদ্ধারা নিজেদের কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলিকে সুসংগঠিত, সুরক্ষিত এবং একত্রিত করার উপর ফোকাস করে। এই কেন্দ্রগুলি সাধারণত বিচ্ছিন্ন এলাকা হয়ে থাকে, যেখানে গেরিলাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান। আর এই এলাকাগুলোতে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেন গেরিলা যোদ্ধারা। এরপর এসব এলাকাগুলো থেকে নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করেন গেরিলারা। পরে শত্রু বাহিনীকে গ্রামাঞ্চলগুলো থেকে তাড়াতে শুরু করেন। আর এই এলাকাগুলোকেই নিজেদের সামরিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেন গেরিলা যোদ্ধারা।
মালির গেরিলা গ্রুপগুলিও এই প্রক্রিয়াটি অতিক্রম করেছে, বিশেষ করে ২০১৩ থেকে ২০১৭ এর মধ্যে৷ এই সময়টাতে ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনীর গেরিলারা কৌশলগত প্রতিরক্ষার জন্য শহর অঞ্চল ছেড়ে গ্রাম্য এবং পাহাড়ি এলাকাগুলোতে আশ্রয় নেন। আর পরবর্তী যুদ্ধের জন্য এই এলাকাগুলোকেই নিজেদের জন্য সামরিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেন। সেই সাথে নতুন যুদ্ধের কৌশল, সামরিক শক্তি এবং জনবল তৈরি করতে থাকেন।
২- কৌশলগত অচলাবস্থা বা ভারসাম্য:
গেরিলা যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রতিরোধ যোদ্ধারা গোপন এবং প্রকাশ্য আক্রমণ বৃদ্ধি করতে থাকেন। সেই সাথে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে সামরিক ফাঁড়িগুলিকে লক্ষ্য করে অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সমর্থন অর্জন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। এই পর্যায়ের শত্রু বাহিনীর বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক (মানষিক) শক্তি ক্ষয় এবং যুদ্ধের প্রেরণার ধ্বংস করে দিতে থাকেন গেরিলারা। এইভাবে, শত্রু বাহিনীকে অনেক অঞ্চলে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে যেতে বাধ্য করা হয়। এই সময়টাতে গেরিলারা (প্রতিরোধী বাহিনী) একটি আধা-সামরিক বাহিনীর রূপ পেতে শুরু করে।
আমরা মালির ক্ষেত্রে এই রূপটি দেখেছি ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। যখন মুজাহিদ গেরিলা যোদ্ধারা জনসমর্থন আদায় করতে সক্ষম হন এবং বিচ্ছিন্ন গ্রুপগুলো এক পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘জেএনআইএম’ গঠন করে। যা একটি সামরিক বাহিনীতে রূপ নেয়। এরপর আমরা ‘জেএনআইএম’ কে দেখেছি গ্রাম্য আর পাহাড়ি এলাকাগুলো থেকে বেরিয়ে এসে সম্মুখ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে। আর এই সময়টাতে মালির বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতেও সক্ষম হন ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধারা (জেএনআইএম)। আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট জেএনআইএম যখন এই পর্যায়টি অতিক্রম করছিল, তখন দেশের রাজনৈতিক সংকটকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা গেরিলা যুদ্ধের তৃতীয় পর্যায়ে পা রাখার সুযোগ পেয়ে যান, আলহামদুলিল্লাহ্।
৩- কৌশলগত পাল্টা আক্রমণ:
এই পর্যায়টি হচ্ছে গেরিলা যুদ্ধের তৃতীয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়। এই সময়টাতে গেরিলা যোদ্ধারা যুদ্ধের ময়দান এবং আলোচনার টেবিলে যুদ্ধ শেষ করার জন্য সিদ্ধান্তমূলক সামরিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতে থাকেন। এতে শত্রু বাহিনীর কেন্দ্রীয় পয়েন্টগুলি গেরিলাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। প্রথম দুই ধাপে শত্রু বাহিনীকে গ্রামাঞ্চল থেকে হটিয়ে, তৃতীয় ধাপে কেন্দ্রীয় অঞ্চল ও সামরিক ঘাঁটিগুলোতে শত্রুবাহিনীকে লক্ষ্য করে হামলা চালাতে শুরু করেন গেরিলারা। এই সময়টাতে শত্রুর সামরিক শক্তি ধ্বংস এবং নেতাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। যার মাধ্যমে শত্রুর মেরুদণ্ডকে ধ্বংস করতে তীব্র লড়াই শুরু করেন গেরিলা যোদ্ধারা।
এসব কিছু বিবেচনার পর এটা বলা যায় যে, ‘জেএনআইএম’ এখন গেরিলা যুদ্ধের তৃতীয় বা চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে শুরু করেছে। জেএনআইএম এর বিবৃতি অনুযায়ী, এই পরিস্থিতির জন্য তাঁরা এখন প্রস্তুত। ইতিমধ্যে ‘জেএনআইএম’ যোদ্ধাদের রাজধানী বামাকো সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে মোতায়েন করা হয়েছে বলেও দাবি করেছেন প্রতিরোধ বাহিনীটির মুখপাত্র। আর ২০২২ সালের জুন-জুলাই মাসে বামাকো এবং এর আশেপাশে আক্রমণগুলিও এটাই নির্দেশ করে যে, জেএনআইএম মালিতে গেরিলা যুদ্ধের তৃতীয় বা চূড়ান্ত ধাপে প্রবেশ করেছে।
ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের ইতিহাস দেখলেও এটা স্পষ্ট হয় যে, তাঁরাও এই তিনটি ধাপ অতিক্রম করে রাজধানী কাবুলে বিজয় নিশান উড়িয়েছেন। তালিবান মুজাহিদিনরাও গেরিলা যুদ্ধের এই তিনটি প্রধান পর্যায় অতিক্রম করে এবং চূড়ান্ত আক্রমণের মাধ্যমে গত ১৫ আগস্ট ২০২১-এ রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।
মালিতে চলমান এই যুদ্ধ প্রায় ১২ বছর ধরে চলছে এবং দেশটির ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রায় ১৫ বছরের সাম্প্রতিক ইতিহাস রয়েছে।
ইনশাআল্লাহ, আমরা চেষ্টা করবো আফগানিস্তান ও সোমালিয়ার মতো মালি যুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও সিরাজ আকারে লিখা প্রকাশ করার, আপনাদের জন্য সাম্প্রতিক সময়ের উল্লেখযোগ্য একটি জিহাদী ময়দানের উত্থান-পতন ও বিজয়ের ইতিহাস তুলে ধরার।
লেখক : ত্বহা আলী আদনান
Comment