মানবরচিত আইন নয়,
সোমালিদের আস্থা শাবাবের শরিয়াহ কোর্টে
সোমালিদের আস্থা শাবাবের শরিয়াহ কোর্টে
পূর্ব আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ায় ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী হারাকাতুশ শাবাব আল মুজাহিদিন প্রশাসনের উপর জনগণের আস্থা ক্রমাগত দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। বিশেষ করে মুজাহিদদের দ্বারা পরিচালিত শরীয়াহ্ ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে সকল মতাদর্শের মানুষের আস্থার প্রতীক। তথাকথিত গণতান্ত্রিক সোমালি সরকারের আদালতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির শিকার হয়ে মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের বাইরের মানুষজনও আশ-শাবাবের শরিয়াহ কোর্টের দ্বারস্থ হচ্ছে। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে আল-জাযিরার এক রিপোর্টে।
আশ-শাবাবের শরীয়াহ কোর্ট সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন ৫০ বছর বয়সী হালিমা (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, দলিল জাল করে জমি বেদখল সম্পর্কিত একটি নালিশ নিয়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি দীর্ঘ ২ ঘন্টা সফর করে আশ-শাবাবের শরিয়াহ কোর্ট আসেন।
সেখানে মামলা দায়ের করার মাত্র চার দিনের মধ্যেই মামলাটির নিষ্পত্তি ঘটে। উপযুক্ত দলিলপত্র এবং সাক্ষী হালিমার পক্ষে থাকায় এবং তা প্রমাণিত হওয়ায়, শরিয়াহ কোর্ট হালিমার পক্ষে রায় দেয়। বিবাদী পক্ষও আদালতের রায় সম্পূর্ণরূপে মেনে নেয়।
হালিমা আরও বলেন, ইতিপূর্বে মামলাটি নিয়ে তিনি মোগাদিশু প্রশাসনের কাছেও গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সাধারণ গোত্রের হওয়ায় এবং অপর পক্ষ প্রভাবশালী গোত্রের হওয়ায় মোগাদিশু সরকারের কোর্টে তিনি মামলাই করতে পারেননি। তবে শরিয়াহ আদালতের এই রায় তার জন্য একটি বিজয়। কেননা মোগাদিশু প্রশাসনের দূর্নীতিগ্রস্ত ও পক্ষপাতমূলক বিচারব্যবস্থার বিপরীতে শরিয়াহ আদালতে গিয়ে তিনি তার হক ফিরে পেয়েছেন।
সোমালিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতে, পশ্চিমা সমর্থিত গাদ্দার সরকার দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। বিপরীতে আশ-শাবাব ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতীক হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে শেখ আব্দুল্লাহি নামের সোমালিয়ার বানাদির অঞ্চলের স্থানীয় আদালতের এক প্রাক্তন বিচারক আল জাজিরার কাছে তার মতামত ব্যক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, “মোগাদিশু প্রশাসনের আদালতগুলোতে এক একটা মামলা বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকে। সময় মতো বিচারক পাওয়া যায় না কারণ পর্যাপ্ত বিচারক নেই। আবার অনেক সময় মামলা না নিয়ে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সেই সাথে মোগাদিশু প্রশাসনের কোর্টে মামলা কারার অর্থই হচ্ছে আপনাকে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হবে। কখনও কখনও সরকারি কোর্টে শুধুমাত্র একটি সাধারণ মামলা দায়ের করতেই ৫ হাজার ডলারের বেশি খরচ হয়।”
এদিকে আশ-শাবাবের শরীয়াহ কোর্ট অনেক ক্ষেত্রেই বিনামূল্যে বিচার কার্য সমাধান করে থাকে। আর গরিবদের এসব মামলার খরচ বহন করা হয় আশ-শাবাবের যাকাত ফান্ড থেকে।
আশ-শাবাবের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব:
সোমালিয়া থেকে পশ্চিমা ও তাদের মিত্রদের উৎখাত করতে এবং সেখানে ইসলামি হুকুমত কায়েমের লক্ষ্যে ২০০৬ সালে গঠিত হয় হারাকাতুশ শাবাব আল মুজাহিদিন। এরপর থেকে বিগত ১৬ বছর ধরে জনগণের হক রক্ষায় শরীয়াহ আদালতের অধীনে বিচার কার্য পরিচালনা করে আসছেন মুজাহিদগণ। শুধু আশ-শাবাব নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতেই নয়, বরং পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের অধীনস্থ অঞ্চলগুলোর পাশাপাশি সোমালি প্রবাসীরাও বিচারকার্য সমাধায় শরীয়াহ কোর্টে আসছে।
প্রবাসী মুহাম্মাদ (ছদ্মনাম) উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি সংক্রান্ত একটি অভিযোগ নিয়ে সুদূর সুইডেন থেকে সোমালিয়ায় আসেন ন্যায় বিচার পাবার জন্য। প্রথমে তিনি মোগাদিশু প্রশাসনের আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। কিন্তু মামলার বিবাদী পক্ষ ঘুষ দিয়ে মামলার কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। ফলে মামলাটি ৬ মাস ধরে চলতেই থাকে, কোন অগ্রগতি হয় না। এতে অর্থনৈতিকভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হন মুহাম্মাদ।
এই পর্যায়ে, মোগাদিশুর সরকারি আদালতে ন্যায় বিচার পাবার আশা ছেড়ে দিয়ে মুহাম্মাদ আশ-শাবাবের শরিয়াহ আদালতের দ্বারস্থ হন। সেখানে মামলা দায়ের করার পর মাত্র ১৮ দিনের মধ্যেই মামলাটি নিষ্পত্তি হয়। মুহাম্মাদ তার হক ফিরে পান।
মুহাম্মাদ আরও বলেন, “যখন আমি শরিয়াহ আদালতে গিয়েছি, তখন দেখেছি যে, অভিযোগ দায়ের করতে শত শত মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।”
ইসলাম বিরোধী থিংক-ট্যাংক International Crisis Group (আইসিজি) এর এক উর্ধ্বতন গবেষক ওমর মাহমুদ বাধ্য হয়েছে এটা স্বীকার করতে যে, আশ-শাবাব নৈতিকতার ব্যাপারে আপোসহীন। তার মতে, বিচারের ক্ষেত্রে আশ-শাবাব দুর্নীতির আশ্রয় নেয় না। গোত্রীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে গিয়ে শরিয়াহ আইনের সামনে সকলের সাম্য নিশ্চিত করে তাঁরা। তাঁদের এই বৈশিষ্ট্য তাঁদেরকে জনসাধারণের মাঝে “নৈতিকভাবে উচ্চতর” অবস্থানে নিয়ে গেছে। ওমর মাহমুদ আরও বলেছে, “আমি মনে করি, আশ-শাবাব বিচার ব্যবস্থাকে উন্নত করতে অনেক বিনিয়োগ করেছে।”
স্থানীয় সূত্র থেকে জানা যায়, বিচারকার্য সমাধার জন্য আশ-শাবাবের শরিয়াহ আদালতে বাদী বা বিবাদী কারো পক্ষেই আইনজীবী নিয়োগ করার সুজোগ নেই। বরং আদালতের পক্ষ থেকেই বিশ্বস্ত দুই-তিনজন কর্মকর্তা বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষের দাবি, মতামত ও প্রমাণাদি তদন্ত করে যাচাই করেন। এরপর তারা তাদের তদন্ত রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপন করেন। নিরপেক্ষ এই তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে কাজী সাহেব কুরআন-সুন্নাহ ও ফিকহের আলোকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছান।
বিচারের শাস্তির মধ্যে রয়েছে: যিনার জন্য বেত্রাঘাত, খুনের জন্য মৃত্যুদণ্ড, চুরির জন্য হাত কর্তন, ইত্যাদি। আবার কোনো ক্ষেত্রে রায়ে সন্তুষ্ট না হলে কয়েকদিনের মধ্যেই পুনরায় আপিলের সুযোগ দেয়া হয়। আর এসময়ের মধ্যে কারো অভিযোগ না আসলে আশ-শাবাব প্রশাসন দ্রুতই আদালতের রায় কার্যকর করে।
বিপরীতে মোগাদিশু কেন্দ্রিক সোমালি আদালতগুলোর বিচার ব্যবস্থায় রয়েছে নানান অনিয়ম। তার উপর রয়েছে রায় বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শিথিলতা। এক কথায়, মোগাদিশু সরকার পশ্চিমাদের দাঁড় করিয়ে রাখা একটি পুতুল মাত্র। আদালতের রায় কার্যকর করার মত ক্ষমতাও নেই এই পুতুল সরকারের। এদিকে, শরিয়াহ সম্মত বিচার ব্যবস্থার জনপ্রিয়তা ও জনগণের আস্থার ফলে আশ-শাবাব প্রশাসন দেশের দক্ষিণ ও কেন্দ্রীয় অংশে তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় গড়ে তুলেছেন স্থায়ী আদালত।
মোটকথা, আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট আশ-শাবাব প্রশাসনের কার্যক্রম শুধু সামরিক অভিযানের মাধ্যমে অঞ্চল জয় কিংবা জালিম সরকারের উচ্চপদস্থ রাঘববোয়ালদের টার্গেট করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং মুজাহিদগণ দক্ষতা দেখাচ্ছেন জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহায়ক প্রতিটি কাজেও। আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই আশ-শাবাব প্রশাসন সোমালি ভূখন্ডসহ পূর্ব আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি সম্বলিত একটি ইসলামি ইমারাহ কায়েম করতে পারবেন, ইনশাআল্লাহ।
ত্বহা আলী আদনান
তথ্যসূত্রঃ
১। In Somalia, al-Shabab’s courts win more converts – https://tinyurl.com/5n6vjjkn
Comment