১৮টি প্রদেশ ও ৩টি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত পূর্ব আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটির উত্তরে রয়েছে এডেন উপসাগর, পূর্বে রয়েছে আরব সাগর ও দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। এছাড়া উত্তরে জিবুতির সাথে, পশ্চিমে ইথিওপিয়ার সাথে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কেনিয়ার সাথে স্থল সীমান্ত রয়েছে। এই তিনটি দেশই সোমালিয়ায় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে, তারা মুজাহিদদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত।
২০০৬ সালে পশ্চিমা ও তাদের মিত্র দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত জোট বাহিনী সোমালি ইসলামি ইমারাত সরকারকে হটিয়ে রাজধানীর মোগাদিশুর দখল নেয়। সেই থেকে প্রতিরোধ বাহিনী হারাকাতুশ শাবাব আল মুজাহিদিন ও পশ্চিমা বাহিনীগুলোর মাঝে টানা ১৭ বছর ধরে চলছে তীব্র যুদ্ধ। বর্তমানে এই যুদ্ধে মুজাহিদগণ পশ্চিমা আগ্রাসী বাহিনী ও তাদের মিত্রদের প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছেন।
তীব্র এই সামরিক তৎপরতার মাঝেও হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসন তাদের নিয়ন্ত্রিত ইসলামি প্রদেশগুলোতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, উন্নয়ন ও জনগণের বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে ব্যাপক আকারে কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন।হারাকাতুশ শাবাব আল-মুজাহিদিন বৈশ্বিক ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী আল কায়েদার পূর্ব আফ্রিকা শাখা হিসাবেই পরিচিত।
পশ্চিমা সমর্থিত মিডিয়া ও বিশ্লেষকদের তথ্যমতে, আশ-শাবাব বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনীগুলোর মাঝে সবচেয়ে সক্রিয়, সফল, বৃহৎ এবং সামরিক ও অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী।আল-শাবাবের রয়েছে হাজার হাজার মুজাহিদ, মিলিয়ন মিলিয়ন রাজস্ব আয়, বিস্তৃত অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ, সেখানকার জনগণের একনিষ্ঠ সমর্থন, এবং নিয়মতান্ত্রিক একটি প্রশাসন। বলা হয় যে, প্রতিরোধ বাহিনীটির বাৎসরিক রাজস্ব আয় সোমালিয়ার পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের চাইতে তিন গুণ বেশি। পাশাপাশি, শাবাব নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের জনগণ পশ্চিমা সমর্থিত সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের জনগণের চাইতে নিরাপত্তা, শান্তি-শৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক ভালো অবস্থানে আছেন।
বিশ্লেষকদের তথ্যমতে, হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসন তাদের বাৎসরিক বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশই খরচ করে সামরিক ও প্রশাসনিক খাতে। এমনিভাবে আরও ৪০ শতাংশ খরচ করছে দরিদ্র জনগণের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ, সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে। এছাড়াও দলটি তাদের বাৎসরিক রাজস্বের একটি অংশ ব্যয় করছে বৈশ্বিকভাবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে শক্তিশালী করতে।আল-আন্দালুস রেডিওর তথ্যমতে, হারাকাতুশ শাবাব আল-মুজাহিদিন গত এপ্রিল মাসে তাদের বাৎসরিক বাজেট থেকে হাজার হাজার দরিদ্র পরিবারের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ ও নগদ অর্থ প্রদান করেছেন।
হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসনের আল-ইহসান অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক প্রতিটি দরিদ্র পরিবারকে নগদ অর্থ, চাল, আটা, চিনি, দুধ, তেল এবং খেজুর দেওয়া হয়েছে।প্রতিটি পরিবারের জন্য ছিলো ২৫ কেজি চাল, ২৫ কেজি আটা, ১০ কেজি চিনি, দুধের ২টি বড় বাক্স, ৬ লিটার তেল, একটি বড় কার্টুন ভর্তি খেজুর এবং শিশুদের জন্য খেলনা ও ঈদের পোশাক। বাংলাদেশী মুদ্রায় এই প্যাকেজের শুধু চাল, আটা, চিনি আর তেলের দামই আসে কমপক্ষে ৫০০০ টাকা।
শাহাদাহ এজেন্সির সূত্রমতে, গত মাসে হারাকাতুশ শাবাব মুজাহিদিন শুধু কুনিয়া-ব্রু, জামামি, জিলিব ও লুক শহরেই প্রায় ৫১৫০টি দরিদ্র পরিবারের মাঝে এ ধরনের সহায়তা বিতরণ করছেন। অন্যান্য শহরগুলোতেও আরও হাজার হাজার দরিদ্র পরিবারকে সাহায্য করেছেন মুজাহিদগণ। এদিকে সম্প্রতি দলটির অফিসিয়াল আল-কাতাইব মিডিয়া ফাউন্ডেশন থেকে ৩৫ মিনিটের একটি ভিডিও রিলিজ করা হয়েছে। এতে হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসনের উন্নয়ন প্রকল্পগুলির কিছু অংশ নথিভুক্ত করা হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে পাকা রাস্তা নির্মাণ, নদী ও কূপ খনন, বাঁধ নির্মাণ, ব্রিজ ও পানির ট্যাঙ্ক তৈরি এবং আরও অন্যান্য উন্নয়নমূলক প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলি হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসনকে অর্থনৈতিকভাবে যেমন শক্তিশালী করছে, একইভাবে জনগণও বেশ উপকৃত হচ্ছেন। সকল প্রকল্প সম্পন্ন হলে হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসন আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থানে উন্নীত হবে ইনশাআল্লাহ।
প্রকাশনাটিতে শাবেলি নদীর বেশ কয়েকটি সেচ খাল পুনরুদ্ধার ও খনন কাজও নথিভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল শিনহা খাল, যা দক্ষিণ সোমালিয়ার কেন্দ্রীয় শাবেলি রাজ্যের কয়েক হাজার কৃষক, খামারি এবং ফল বাগানের মালিকদের উপকৃত করছে।মধ্য শাবেলি রাজ্যের ইউসুফ নামক একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি শাবাব কর্তৃক পুনরুদ্ধার করা একটি সেচ খালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বলেন, “আল্লাহর রহমতে আজ এই সেচ খালটি সফলভাবে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।
আমরা হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই, যারা এই খালটি পুনরুদ্ধার করার জন্য দুর্দান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি এই খালের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এটি একটি মহান অর্জন, যা থেকে এই অঞ্চলের লোকেরা উপকৃত হবেন।”ভিডিওটিতে শাবেলি নদী খনন এবং এর পানি দক্ষিণ সোমালিয়ার নিম্ন শাবেলি রাজ্য হয়ে সুবালি জেলায় পৌঁছে দেওয়ার প্রকল্পও উপস্থাপন করা হয়েছে। সুবালি জেলায় এই নদীর পানি ৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে পৌঁছায়নি।
সুবালি জেলার একজন বাসিন্দা বলেন, “আমরা গত সাড়ে ৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে পানির অভাবে ভুগছি। অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে এখানকার বাসিন্দারা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা এখন শাবেলি নদীর খনন প্রকল্প দেখেছি। আমরা আশা করি এই প্রকল্পটি সফল হলে আমরা পর্যাপ্ত পানি পাবো। আর যারা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তারা আবারও এই এলাকায় ফিরে আসবেন এবং বসতি স্থাপন করবেন।
প্রতিরোধ বাহিনী হারাকাতুশ শাবাবের আমির শাইখ আবু উবাইদাহ আহমেদ ওমর (হাফিজাহুল্লাহ্) বলেন, সমস্ত প্রশংসা মহান রব্বুল আলামিনের, যিনি ইসলামী রাষ্ট্রকে এমন বড় প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন করার তাওফিক দিয়েছেন। এগুলো এমন কিছু প্রকল্প, যা দেশে খরা মোকাবেলায় বাস্তবিকই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আর এই প্রকল্পগুলির মধ্যে কিছু এলাকায় পানির ট্যাঙ্ক তৈরি, কূপ খনন করা এবং শিক্ষাকেন্দ্র তৈরিসহ অন্যান্য প্রকল্পগুলি চলমান রয়েছে।
লক্ষ্য হচ্ছে খরায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা, অর্থনৈতিক ভাবে জনগণকে শক্তিশালী করা, সমাজকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেওয়া। সেই সাথে সুদ, ঘুষ ও দুর্নীতি মুক্ত অর্থনীতি, ধর্মীয় শিক্ষা, লেনদেন, বিচার বিভাগ ও উন্নত চিকিৎসালয় গড়ে তোলা।এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হচ্ছে হারাকাতুশ শাবাব নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বাঁধ ও হ্রদ তৈরি করা। এর ধারাবাহিকতায় হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসন দক্ষিণ-পশ্চিম সোমালিয়ার বে রাজ্যে বোলোভলে বাঁধ ও হ্রদ নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন।
প্রকৌশলী ড. হুসেন হাজী আবেদী বলেন, “এই হ্রদটির আয়তন ৫০০ বর্গ মিটার। আমরা যখন এই প্রকল্পটি শুরু করছিলাম, তখন এই এলাকাটি একটি বন ছিল, তাই আমরা গাছ কাটা শুরু করি, এবং পরে খনন করতে চলে যাই। বর্ষা শুরুর আগে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দিনরাত কাজ চলেছে, যেন এই মৌসুমেই এই হ্রদ থেকে জনগণ উপকৃত হতে পারেন।”হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসনের এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি প্রকল্প হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা।
মুজাহিদগণ ইসলামি প্রদেশগুলোতে এলাকা ভিত্তিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, জেলা ভিত্তিক অন্তত ১০টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং অঞ্চল ভিত্তিক একটি করে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে কাজ করছেন। এই লক্ষ্যে অনেকটা সফলও হয়েছে হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসন। আর এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা সিলেবাস ও পাঠ্যবইও ছাপিয়েছে আশ-শাবাব কর্তৃপক্ষের শিক্ষা বোর্ড।
আল-কাতাইব ফাউন্ডেশনের প্রকাশনায় দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার ছাত্র কুরআন, হাদিস ও ফিকাহ (আইন শাস্ত্র) সহ বিভিন্ন শাস্ত্রের উপর স্নাতক হচ্ছেন। তারা পরবর্তিতে প্রদেশ ভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগতায়ও অংশ নিচ্ছেন। হারাকাতুশ শাবাবের শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকে বিজয়ী ও স্নাতকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে সার্টিফিকেট ও শিক্ষা বৃত্তি।
উল্লেখ্য যে, হারাকাতুশ শাবাব আল-মুজাহিদিন বর্তমানে এমন একটি প্রাশাসনিক অবকাঠামো দাঁড় করিয়েছেন, যার অধীনে নিয়মতান্ত্রিক সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ, শিক্ষা বোর্ড, চিকিৎসালয়, অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়নমূলক বিভাগসহ প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর বিদ্যমান রয়েছে। ফলশ্রুতিতে, এরকম আরও অনেক ক্ষেত্রেই পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের চাইতে কয়েকগুণ এগিয়ে আছে হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসন।এমতাবস্থায়, প্রতিরোধ বাহিনীটি বিভিন্ন বিবৃতিতে তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলকে ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসনের অঘোষিত এই রাষ্ট্রের রাজধানী হচ্ছে দক্ষিণ সোমালিয়ার জিলিব শহর, যা পশ্চিমাদের তাঁবেদার সরকারের রাজধানী মোগাদিসু থেকে মাত্র ৩৩০কিমি দূরে। এ থেকে মুজাহিদদের সামর্থ্য এবং পশ্চিমাদের তাঁবেদার সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্বলতা খুব সহজেই অনুধাবন করা যায়।
Comment