পূর্ব আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া; যার পশ্চিমে ইথিওপিয়া, উত্তরপশ্চিমে জিবূতী, উত্তরে ইয়েমেন ও আদন উপসাগর। পূর্বদিকে ভারত মহাসাগর এবং দক্ষিণপশ্চিমে কেনিয়া।
উপনিবেশবাদের পতনের পর ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দেশটির সিংহভাগ এলাকা এবং ২০০৪ সালে রাজধানী মোগাদিশু সহ পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন আলেম ও মুজাহিদদের দ্বারা পরিচালিত ইসলামিক কোর্টস ইউনিয়ন (আইসিইউ) সরকার। দেশটির শাসনভার ইসলামি ভাবধারার সরকারের হাতে আসলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে কয়েক দশক পর প্রথমবারের মতো শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে। নতুন এই ইসলামি সরকারের তৎপরতায় যুদ্ধরত গোত্রগুলো একতাবদ্ধ হয়, দেশটিতে ইসলামি আইন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সোমালিয়া ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ বিনির্মানে মনোযোগী হয় সরকার ও জনগণ।
তবে ইসলামি অনুশাসন মেনে চলা আইসিইউ সরকারের এই সফলতায় সোমালিরা সন্তুষ্ট থাকলেও, সন্তুষ্ট হতে পারেনি ইথিওপিয়ার মতো প্রতিবেশী দেশগুলো এবং পশ্চিমারা। এর জেরে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ এবং পশ্চিমাদের সর্বাত্মক সহায়তায় স্বাধীন একটি দেশে সামরিক আগ্রাসন চালায় ইথিওপিয়া। ফলে কয়েক মাসের মধ্যেই আইসিইউ’র প্রশাসন ভেঙে পড়ে।
আইসিইউ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়লেও কার্যক্রম থেকে হাত গুটিয়ে থাকেনি আইসিইউ’র সামরিক শাখা আশ-শাবাব। তাঁরা তাদের সবটুকু দিয়ে সোমালিয়াকে দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। যুদ্ধের পরবর্তি বছরগুলোতে বৈশ্বিক ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী আল-কায়েদার সহায়তায় ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠে আশ-শাবাব। শুরু হয় সোমালিয়ায় দখলদার শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়।
প্রাদেশিক রাজধানীর পথে আশ-শাবাব:
দীর্ঘ ১৭ বছরের এই যুদ্ধে অনেক উত্থান-পতনের পর হারাকাতুশ শাবাব আল-মুজাহিদিন এখন পূণরায় সোমালিয়ার শাসনভার গ্রহন করার দিকে আগ্রসর হচ্ছেন। এই লক্ষ্য অর্জনে আশ-শাবাব অনুসরণ করছে আফগানিস্তানে তালিবান সরকারের প্রতিরোধ যুদ্ধের সময়কার সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল। শাবাব এই যুদ্ধের প্রথম দিকে গেরিলা আক্রমণের পর দ্বিতীয় পর্বে দেশটির গ্রামঅঞ্চল, সমুদ্র বন্দর ও উপ-শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দিকে মনযোগী হয়। আর এখন শাবাবের নজর দেশটির শহরাঞ্চল ও প্রাদেশিক রাজধানীসমূহের দিকে।
স্থানীয় সূত্রমতে, আশ-শাবাবের প্রতিরোধ যোদ্ধারা ইতিমধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলের অধিকাংশ প্রদেশের প্রধান সড়কগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। সেই সাথে এসকল অঞ্চলের ৮০-৮৫% এলাকার নিয়ন্ত্রণও এখন আশ-শাবাবের হাতে। ফলে বর্তমানে আশ-শাবাব কেন্দ্রীয় শহর ও প্রাদেশিক রাজধানীগুলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।
এই লক্ষ্যে গুরত্বপূর্ণ সড়ক ও কৌশলগত এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার মাধ্যমে প্রতিরোধ যোদ্ধারা প্রাদেশিক রাজধানী ও গুরত্বপূর্ণ শহরগুলোকে দেশটির কেন্দ্রীয় রাজধানী মোগাদিশু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। আর যে কয়েকটি সড়ক ও এলাকা এখনো আশ-শাবাবের নিয়ন্ত্রণে আসেনি, সেগুলোও শাবাবের অভিযান থেকে নিরাপদ নয়। ফলশ্রুতিতে পশ্চিমা সমর্থিত মোগাদিশু সরকারের সাথে এখন এসব প্রাদেশিক সরকারের যোগাযোগের একমাত্র নিরাপদ মাধ্যম হচ্ছে আকাশ পথ, যা খুবই ব্যয়বহুল।
স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, শাবাব যোদ্ধারা সম্প্রতি দেশটির প্রাদেশিক রাজধানীগুলো অবরোধের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলের একাধিক রাজ্যের প্রাদেশিক রাজধানী অবরোধের দ্বারপ্রান্তে। ইতিমধ্যে প্রতিরোধ যোদ্ধারা বে রাজ্যের প্রাদেশিক রাজধানী বাইদোয়া অবরোধ করে ফেলেছেন।
সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট প্যালেসের চিফ অফ স্টাফের দেওয়া তথ্যমতে, গত ১১ জুলাই বুধবার সকাল থেকে রাজ্যটির কেন্দ্রীয় শহর বাইদোয়া শাবাবের অবরোধে রয়েছে। এই অবরোধ ভাঙতে ৫টি স্থল অভিযান চালানোর পাশাপাশি বিমান হামলার আশ্রয় নিয়েছে পশ্চিমা সমর্থিত সামরিক বাহিনী, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে তারা।
আশ-শাবাবের প্রতিরোধ যোদ্ধারা প্রাদেশিক রাজধানীতে ঢুকার পথগুলোয় অতিরিক্ত চেকপোস্ট বসিয়েছেন। এসব স্থানে শহরে ঢুকা ও বের হওয়া প্রতিটি যানবাহন চেকিং করছেন তাঁরা। জনসাধারণের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও চিকিৎসা সামগ্রী ছাড়া শহরে অন্য কোনো বস্তু এবং নতুন কোনো লোককে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকা ও প্রশাসনিক ভবনগুলোতে বিদ্যুৎ, পানি ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
জানা যায় যে, গত ১৭ জুলাই প্রাদেশিক রাজধানীতে আটকা পড়া সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সহায়তার জন্য পাঠানো একটি সরবরাহ কনভয়েও আগুন দিয়েছে আশ-শাবাব।
অপরদিকে দেশের কেন্দ্রীয় হিরান রাজ্য এবং মধ্য ও নিম্ন শাবেলি রাজ্যের প্রাদেশিক রাজধানীগুলোও অবরোধের হুমকিতে আছে।
সূত্রমতে, আশ-শাবাব যোদ্ধারা হিরান রাজ্যের গুরত্বপূর্ণ ৪টি জেলা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। বাকি ৩টি জেলার কেন্দ্রীয় শহর ব্যতিত সমস্ত এলাকা ইতিমধ্যে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রদেশিক রাজধানী বালদাওয়েইন যাওয়ার ২-১টি রাস্তা ব্যতীত সকল রাস্তারই নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আশ-শাবাব। ফলে বে রাজ্যের মতো হিরান রাজ্যও খুব শীগ্রই আশ-শাবাবের অবরোধে পড়তে যাচ্ছে।
গত বছরের মার্চে ক্ষমতায় আসার পর হাসান শেখ সরকার মে মাস থেকে আশ-শাবাবের বিরুদ্ধে নতুন যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তার সিংহভাগই সংঘটিত হয় এই হিরান রাজ্যে। সরকারি দাবি অনুযায়ী, এই যুদ্ধের মাধ্যমে তারা হিরান রাজ্যের গুরত্বপূর্ণ সমস্ত শহর আশ-শাবাবের কাছ থেকে দখলে নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আশ-শাবাবের কাছ থেকে রাজ্যটির সামান্য কিছু এলাকাই তারা দখল করতে পেরেছিল, তাও কয়েকমাসের ব্যবধানে সেসব এলাকা পুনরুদ্ধার করে আশ-শাবাব, সাথে লাভ করে শত্রুর ফেলে যাওয়া প্রচুর যুদ্ধযান, যুদ্ধাস্ত্র ও গোলাবারুদ।
শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি ও শাবাবের অর্জন:
আশ-শাবাবের সামরিক নেতৃত্বের তথ্যমতে, হাসান শেখ কর্তৃক ঘোষিত নতুন যুদ্ধের প্রথম ৮ মাসে (২০২২ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) শাবাব মুজাহিদিন অন্তত ৯২১টি অভিযান পরিচালনা করছেন। এসব অভিযানে সোমালি বাহিনীর উচ্চপদস্থ ৩০০ সামরিক কর্মকর্তা, ২৭৪ উপজাতীয় মিলিশিয়া নেতা এবং ৫৩৪৬ সৈন্য নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও অসংখ্য সৈন্য। আর নিহতদের বড় একটি সংখ্যাই হিরান রাজ্যের যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে।
হিরান যুদ্ধে শুধুমাত্র মার্কিন প্রশিক্ষিত সোমালি কমান্ডো ফোর্সের নিহত সদস্য সংখ্যাই সাড়ে ৫ শতাধিক; আর ইথিওপিয়া, উগান্ডা, জিবুতি ও কেনিয়ার নিহত সৈন্য সংখ্যা ছিলো ৭ শতাধিক।
অপরদিকে সোমালিয়ায় আফ্রিকান ইউনিয়ন কমিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলামিন সোয়েফ ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে কিছুটা হলেও স্বীকার করেছে যে, ২০০৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সোমালিয়ায় আশ-শাবাবের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে ‘এইউ’র ১০ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে।
হারাকাতুশ শাবাবের আমীর শাইখ আবু উবাইদাহর (হাফি.) ভাষ্যমতে, ২০২২ সালের শেষ কয়েক মাসের যুদ্ধে মুজাহিদগণ শত্রু বাহিনী থেকে এতো বিপুল সংখ্যক সামরিক যান ও এতো অগণিত অস্ত্র লাভ করেছেন যে, তা আইসিইউ প্রশাসনের যুগ থেকে শুরু করে আজ অবধি শত্রুদের থেকে যা জব্দ করা হয়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
বাস্তবিকই, সোমালিয়ার যুদ্ধের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখন আশ-শাবাবের হাতে। ২০২০-২১ সালে বিজয়ের পূর্বে আফগানিস্তানে তালিবানের যে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, সোমালিয়ায় শাবাবের বর্তমান অবস্থাকে তার সাথেই তুলনা করা যেতে পারে।
Comment