পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়া। সোমালিয়ার পর বর্তমানে এই দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৪টি রাজ্যের ৫০ শতাংশেরও বেশি এলাকার নিয়ন্ত্রণ এখন প্রতিরোধ বাহিনী হারাকাতুশ শাবাবের হাতে। ফলে রাজ্য প্রশাসন শহরের কেন্দ্রগুলিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি দ্য স্ট্যান্ডার্ডে কেনিয়ার মান্দেরা রাজ্যের ততকালীন গভর্নর আলী রোবার একটি মতামত প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, আশ-শাবাব দিন দিন এই অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে।
রোবা আল-কায়েদার পূর্ব আফ্রিকান শাখা আশ-শাবাবের অত্র অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের ব্যপারে জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, এই অঞ্চলের পরিস্থিতি উৎসাহজনক নয়। সরকার উত্তর কেনিয়াকে পুরোপুরি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর কুৎসিত সত্য এটাই যে, শাবাব উত্তর কেনিয়ার (৪টি রাজ্য) ৫০ শতাংশেরও বেশি ভূমির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। সোমালিয়া সীমান্তবর্তী কেনিয়ার লামু, গারিসা, ওয়াজির এবং মান্দেরা অঞ্চলে আশ-শাবাব এখন সক্রিয়।
প্রতিরোধ বাহিনী হারাকাতুশ শাবাব আল-মুজাহিদিন
মান্দেরার গভর্নর রোবা এও বলেছে যে, আশ-শাবাব ইতিমধ্যে মান্দেরা অঞ্চলের ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। আর একাজে তাদেরকে সর্বাত্মক সমর্থন দিচ্ছে স্থানীয় জনসাধারণ। রোবার এমন মন্তব্যের পর দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার তখন এই দাবির বিরোধিতা করে; কিন্তু গভর্নরের উদ্বেগের সমাধানকল্পে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি সরকার।
সম্প্রতি দেশটির প্রশাসনিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের এক নিরাপত্তা সভায় ফের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শাবাবের উপস্থিতি ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা উঠেছে। তারা জানিয়েছেন, আশ-শাবাবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ও আন্তর্জাতিক মিত্র দেশগুলোর আরও অধিক সহায়তা না পেলে খুব শীগ্রই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পতন ঘটবে।
চলতি বছরের ২০ জুলাই অনুষ্ঠিত এই নিরাপত্তা সভায় উপস্থিত ছিলেন উত্তরাঞ্চলীয় চারটি রাজ্যের আঞ্চলিক কমিশনার, সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সভায় উপস্থিত কর্মকর্তারা মান্দেরা, ওয়াজির, গারিসা এবং লামু রাজ্যে শাবাবের অবস্থান ও ক্রমবর্ধমান অভিযান নিয়ে আলোচনা করে।
এসময় মান্দেরা রাজ্যের রানিং গভর্নর মোহাম্মদ আদান খলিফ বলেন, আমরা বর্তমানে এই রাজ্যগুলোর কেন্দ্রীয় শহরে সীমাবদ্ধ হয়ে আছি। আমরা শহরের বাহিরে কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছি না। উদাহরণস্বরূপ, শুধু আমার (মান্দেরা) রাজ্যের ৬০ শতাংশ এলাকাই এখন আশ-শাবাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এমন পরিস্থিতিতে আমরা শুধুমাত্র শহর এলাকাতে অবরুদ্ধ হয়ে আছি।
একইভাবে ওয়াজির, লামু ও গারিসা রাজ্যের গভর্নররাও জানিয়েছেন যে, তাদের রাজ্যগুলিও শাবাবের হামলার উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। তবে নিজেদের অঞ্চলের কত শতাংশ এলাকা শাবাবের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেই তথ্য তারা এড়িয়ে গেছেন। এসব রাজ্যে নিয়মিত হামলা জোরদার করছে আশ-শাবাব।
কেনিয়ায় শাবাবের নিয়ন্ত্রিত চার রাজ্যের অবস্থান
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আঞ্চলিক কমিশনার দাবি করেছেন যে, আন্তঃসীমান্তে শাবাবের আক্রমণের পিছনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে স্থানীয় জনগণ। তাই এই অঞ্চলে শাবাবকে রুখতে হলে আমাদেরকে প্রথমে সম্প্রদায়গুলির সাথে সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে, তাদের মধ্যে আশ-শাবাব বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর এটিই হবে এই অঞ্চলে আমাদের সফলতার চাবিকাঠি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কেনিয়া ও ইথিওপিয়া সরকার পশ্চিমাদের উস্কানিতে যে যুদ্ধ সোমালি মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল, আজ সেই যুদ্ধ তাদের নিজ ভূমিতেই ফিরিয়ে দিয়েছেন প্রতিরোধ যোদ্ধারা। ইতিপূর্বে হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসন বারবার কেনিয়া সরকারকে সোমালিয়ায় তাদের অন্যায় আগ্রাসন বন্ধের জন্য সতর্ক করেছিল। কিন্তু তারা পশ্চিমাদের সন্তুষ্ট করতেই বেশি মনযোগী ছিলো। ফলে এই অঞ্চলের সরকারগুলো বর্তমানে ভারী আর্থিক ও অবকাঠামোগত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে; পাশাপাশি আশ-শাবাবের অভিযানে সামরিক বাহিনীতেও বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা।
পলায়নরত ইথিওপিয়ান বাহিনীকে তাড়া করেছে আশ-শাবাব যোদ্ধা
বিশ্লেষকদের মতে, পূর্ব আফ্রিকার যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ এখন আশ-শাবাবের হাতে, ফলে তাঁরা এই অঞ্চলে যুদ্ধ এখনই থামাবে না। বর্তমানে তাদের লক্ষ্য শুধু সোমালিয়াই নয়, বরং তাদের লক্ষ্য এখন সোমালিয়ার পশ্চিম ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ঐসব এলাকাও, যা বৃহত্তর সোমালিয়া থেকে ইতিপূর্বে পৃথক করা হয়েছিল। এর বৃহৎ একটি অংশ দখল করে আছে ইথিওপিয়া, অন্য অংশ দখল করে আছে কেনিয়া।
আশ-শাবাব সোমালিয়ার হারিয়ে যাওয়া এসব অঞ্চলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেবে বা এই অঞ্চলগুলিকে বাফার জোন করে তুলবে। আর যতক্ষণ না তাঁরা এই অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত আশ-শাবাব যোদ্ধারা আদ্দিস-আবাবা এবং নাইরোবির নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে থাকবেন।
শাবাবের লক্ষ্ হিসেবে থাকা বৃহত্তর সোমালিয়ার ম্যাপ
আশ-শাবাব তাদের এই পরিকল্পনাকে প্রকাশ্যে আনতে মিডিয়ায় বৃহত্তর সোমালিয়ার একটি মানচিত্রও প্রকাশ করেছে। নতুন এই মানচিত্রে হারিয়ে যাওয়া সোমালিয়ার অঞ্চলগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ইথিওপিয়া, কেনিয়া ও জিবুতির দখলে থাকা বৃহত্তর সোমালিয়ার প্রাচীন সীমানার ৬টি বৃহৎ অঞ্চল। আর এই অঞ্চলগুলোকে বর্তমানে অনেকগুলো রাজ্যে ভাগ করে রেখেছে দখলদার রাষ্ট্রগুলো।
যাইহোক, কেনিয়ার অভ্যন্তরে আশ-শাবাব আসলে কতটা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে তা স্পষ্ট নয়। তবে এবিষয়ে কেনিয়ার প্রাদেশিক প্রশাসকদের মূল্যায়ন যদি সঠিক হয়, তাহলে এর অর্থ হবে আশ-শাবাব বর্তমানে দক্ষিণ সোমালিয়া এবং উত্তর কেনিয়া জুড়ে কয়েক লক্ষ বর্গকিলোমিটারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই সাথে ইথিওপিয়ার ওরমিয়া অঞ্চলেও রয়েছে দলটির উপস্থিতি। গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, এই অঞ্চলের ১৭৫ কিলোমিটার ভিতরে পর্যন্ত শাবাবের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
শাবাবের একটি শরিয়াহ্ আদালতে সমস্যা সমাধানে অপেক্ষারত সাধারণ মানুষ
আর এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিরাপত্তায় রয়েছে শাবাবের নিয়মিত সামরিক বাহিনী। এছাড়া কার্যকর রয়েছে শিক্ষা বোর্ড, চিকিৎসালয় এবং বিচার বিভাগ। অর্থাৎ একটি প্রশাসনকে পূর্ণতা দিতে যা কিছু লাগে সবই রয়েছে হারাকাতুশ শাবাবের। নতুন ইসলামি ইমারত বা চূড়ান্ত বিজয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া আশ-শাবাবের জন্য তাই সময়ের ব্যাপার বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে।
Comment