পূর্ব আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ায় সংঘাত তীব্র হওয়ার সাথে সাথে, প্রতিরোধ বাহিনী হারাকাতুশ শাবাব রাজধানী মোগাদিশুতে তাদের অভিযানের পরিধিও বৃদ্ধি করছে। সম্প্রতি সোমালি সরকার তাদের ঘোষিত অভিযানের দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে যখন দেশের দক্ষিণে শাবাব নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর দিকে পা বাড়াচ্ছে, ঠিক সেসময় আশ-শাবাব দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলোকে, বিশেষ করে রাজধানী মোগাদিশুকে নিজেদের টার্গেটে পরিণত করছে। আর সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আশ-শাবাবের এই পাল্টা কৌশলকে অধিকতর শক্তিশালী বলেই মনে করা হচ্ছে।
আশ-শাবাবের প্রতিরোধ যোদ্ধারা দীর্ঘদিন ধরে মোগাদিশুতে সামরিক পয়েন্ট এবং সরকারী কেন্দ্রগুলিতে বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে আসছিল। কিন্তু সম্প্রতি এই কৌশলে পরিবর্তন এনে সরাসরি পদাতিক অভিযানের মাধ্যমে মোগাদিশুকে লক্ষ্যবস্তু করতে শুরু করেছে আশ-শাবাব।
সাম্প্রতিক শুরু হওয়া শহরকেন্দ্রীক যুদ্ধাভিযানে আশ-শাবাব সদস্যদের ভারী অস্ত্র নিয়ে রাজধানী মোগাদিশু ও এর বাইরের জেলাগুলোর কৌশলগত কেন্দ্রগুলোকে সরাসরি লক্ষ্যবস্তু করতে দেখা যাচ্ছে। তীব্র লড়াইয়ে সরকারি বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পর শাবাব যোদ্ধারা কৌশলগত কারণে আক্রমণকৃত এই এলাকাগুলো থেকে নিরাপদে সরে আসছেন।
এটাও লক্ষণীয় যে, আশ-শাবাব এখন প্রকাশ্য দিনের আলোতে শহরকেন্দ্রিক এই অভিযানগুলি পরিচালনা করছে। বিষয়টি স্পষ্টতই রাজধানীর আশপাশে শাবাবের শক্ত অবস্থানের জানান দিচ্ছে।
বর্তমানে আশ-শাবাবের সবচাইতে বেশি আক্রমণের শিকার হচ্ছে রাজধানী মোগাদিশু ও এর আশপাশের জেলাগুলো। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ইয়াকশিদ, হাওয়াদলি, আল-মাসিনা, ডেনিল, কাহদা ও ভাদাজিরের মতো জেলা শহর। স্থানীয় সূত্রমতে, গত ২২ ও ২৩ আগস্ট এই জেলাগুলো লক্ষ্য করে আশ-শাবাব যোদ্ধারা ৩টি ইস্তেশহাদী অপারেশন সহ ছোট-বড় অন্তত ১৩টি সামরিক অভিযান পরিচালনা করছেন।
এই অভিযানগুলোতে মোগাদিশু সরকারী বাহিনী ছাড়াও তুরস্ক, আমেরিকা ও আরব-আমিরাত সমর্থিত বাহিনী এবং উগান্ডান সৈন্যদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত হারাকাতুশ শাবাব আল-মুজাহিদিন রাজধানীতে তাদের সর্বশেষ অভিযানটি পরিচালনা করছেন গত ২৩ আগস্ট রাত ০১:৫০ মিনিটের দিকে। অভিযানটি মোগাদিশুর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় কাহদা জেলার সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে শুরু করা হয়েছিল। অভিযানের শুরতেই জেলা নিরাপত্তা কেন্দ্রকে বোমা বোঝাই একটি গাড়ি দ্বারা লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল।
এরপর আশ-শাবাবের অন্য সদস্যরা ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এতে পশ্চিমা সমর্থিত মোগাদিশু সরকারী বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং শেষপর্যন্ত আশ-শাবাব সামরিক ঘাঁটি ও এই জেলার নিয়ন্ত্রণ নেয়। শাহাদাহ নিউজ এজেন্সির তথ্যমতে, জেলা শহরটিতে অভিযান পরিচালনার সময় আশ-শাবাব যোদ্ধারা একযোগে রাজধানীর হেলনি সামরিক ঘাঁটি, আশপাশের সামরিক ব্যারাক, সোমালি সরকারের রাষ্ট্রপতি প্রাসাদ এবং দাজার ও ওয়ারদিকলি জেলা ছাড়াও এর আশপাশের আরও ৩টি এলাকায় আক্রমণ চালিয়েছেন।
এসময় সোমালি বাহিনীকে সহায়তা করতে আসা সামরিক কনভয়গুলোকেও অতর্কিত আক্রমণের মাধ্যমে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন করেন শাবাব যোদ্ধারা। সাহায্য কনভয়গুলো পরে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। স্থানীয় সূত্রমতে, আশ-শাবাব যোদ্ধারা কাহদা জেলা বিজয়ের সময় সামরিকভাবে পুরো মোগাদিশুকে ঘেরাও করে ফেলেছিলেন। ফলে কাহদা জেলার দিকে কোন সামরিক সহায়তাও পাঠাতে পারেনি সরকার।
শুধু তাই নয়, পুরো রাজধানীকেই যেনো এই রাতে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে রূপান্তর করেছিল আশ-শাবাব। সরকারি বাহিনীর তথ্যমতে, আশ-শাবাবের কাহদা জেলা অভিযানে সোমালি সামরিক বাহিনীর ১৯ সদস্য নিহত এবং আরও ১৭ সদস্য আহত হয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জন স্পেশাল ফোর্সের সদস্য ও ২ জন কমান্ডার সহ এই জেলার কারাগারের প্রধান রয়েছেন। এছাড়াও আরো ২০ জন সেনা সদস্য নিখোঁজ রয়েছে বলে জানা গেছে।
সোমালি সরকারি বাহিনীর ৩টি সাঁজোয়া যান ধ্বংস হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। তবে বেসামরিক সূত্রগুলো বলছে, ক্ষয়ক্ষতি আর হতাহতের বাস্তব সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। তাছাড়া এদিন রাজধানীর আরও অন্তত ৬টি জায়গায় অভিযান পরিচালনা করেছে দলটি, ফলে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে আশ-শাবাব সংশ্লিষ্ট মিডিয়া সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, রাজধানীতে এদিন রাতের অভিযানে মুজাহিদগণ কারাগারে বন্দী থাকা অনেক মুজাহিদ ও নিরপরাধ বেসরকারি নাগরিককে মুক্ত করেছেন।
এটি লক্ষণীয় যে, পশ্চিমা সমর্থন ও আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে সম্প্রতি মোগাদিশু সরকার দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আশ-শাবাব নিয়ন্ত্রিত ৩টি রাজ্যে সামরিক অভিযানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু করেছে। সরকারি বাহিনী ও আন্তর্জাতিক দখলদার বাহিনী যখন দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লড়ছে, তখন আশ-শাবাব দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে নিজেদের শক্তির জানান দিচ্ছে। তাঁরা রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ শহর ও জেলাগুলোতে ব্যাপক অভিযান চালাতে শুরু করেছেন।
সামরিক বিশ্লেষকরা রাজধানীতে শাবাবের সামরিক সক্ষমতাকে পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, শাবাবের সাম্প্রতিক অভিযান যেন এই বার্তা দিচ্ছে যে, যদি শাবাবের শরিয়াহ্ শাসিত এলাকাগুলো আক্রান্ত হয়, তাহলে পশ্চিমা সমর্থিত সোমালি সরকার ও তৎসংশ্লিষ্টরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে মোগাদিশু বা এর আশেপাশে কোথাও জায়গা পাবে না।
Comment