পশ্চিম আফ্রিকায় কি আফগানিস্তানের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি করছে আল-কায়েদা?

পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল ক্রমশ আল-কায়েদা শাখা জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিনের (জেএনআইএম) কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে উঠেছে, যা তালিবান মুজাহিদিন কর্তৃক আফগানিস্তান বিজয়ের পূর্বেকার সামরিক কর্যক্রমের চিত্রগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে।
আফগানিস্তানের পরিস্থিতি সাহেল অঞ্চলে পুনরাবৃত্তি হতে পারে কিনা তা মূল্যায়ন করার জন্য, জেএনআইএম-কে আফগান মুজাহিদদের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কেননা দুটি মুজাহিদ দলই ইসলামি ভূমির প্রতিরক্ষা ও শরিয়াহ্ প্রতিষ্ঠার উপর ভিত্তি করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোকে নিজেদের সাথে একীভূত করার কৌশল অবলম্বন করছে।
তালিবান তার প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই সমর্থন প্রসারিত করার লক্ষ্যে যুদ্ধরত বিভিন্ন গ্রুপগুলোকে নিজেদের সাথে একীভূত করে, যার মাধ্যমে ৯০ দশকের শেষের দিকে আফগান গৃহযুদ্ধে তালিবান নিজেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। একইভাবে, ২০১৭ সালে আল-কায়েদা সাহেল অঞ্চলে যুদ্ধরত বেশ কয়েকটি জিহাদি গোষ্ঠীর একীভূতকরণের মাধ্যমে এই অঞ্চলে ‘জেএনআইএম’ গঠন করে, যার আরবি নাম জামাআত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন। আনসার আদ-দ্বীন, আল-মুরাবিতুন, কাতিবা হানিফা ও আনসার আল-ইসলাম হচ্ছে একীভূত হওয়া উক্ত দলগুলোর মধ্যে অন্যতম।
আল-কায়েদা প্রথম দিকে এই অঞ্চলের স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে বিভিন্ন ভাবে সামরিক ও আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে। এরপর স্থানীয় সম্প্রদায়, জাতিগত গোষ্ঠী এবং উপদলের সাথে জোট তৈরি করে। এমনকি তুয়ারেগ (আজওয়াদ) বিদ্রোহীদের কিছু অংশের সাথে মিত্রতা তৈরি করে। ফলে সময়ে সময়ে তুয়ারেগের অনেক নেতাকেই ‘জেএনআইএম’ এর সাথে যোগ দিতে দেখা গেছে। এই সহযোগিতা ও জোট গঠনের মাধ্যমে আল-কায়েদা পশ্চিম আফ্রিকার আঞ্চলিক সরকার এবং বিদেশী দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে তার প্রচেষ্টাকে জোরদার করেছে। আর স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর সহায়তায় সাহেলের শাসনের ফাঁকগুলিকে কাজে লাগিয়ে আল-কায়েদা মালি, বুরকিনা ফাসো এবং নাইজারে তার প্রভাব বিস্তার করে চলছে। সেই সাথে প্রতিবেশি আরও ৫টি দেশে কার্যক্রম সম্প্রসারণের কৌশল অবলম্বন করছে।
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে উভয় বাহিনীর মধ্যে মিল এবং পার্থক্য:
উভয় দলের কৌশল ও লক্ষ্যে মিল থাকা সত্ত্বেও, আফগানিস্তান এবং সাহেলের সামরিক পরিবেশ যথেষ্ট ভিন্ন। পূর্বে এই পার্থক্যটা তেমন না থাকলেও সাহেল অঞ্চলে ঘনঘন সামরিক অভ্যূত্থানের ফলে পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে গেছে। আফগানিস্তানে তালিবানদের যুদ্ধটি ছিলো পশ্চিমা বিশ্ব, ন্যাটো জোট এবং পশ্চিমাদের দ্বারা সমর্থিত রাষ্ট্রীয় বাহিনী বিরুদ্ধে।
অপরদিকে পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল জোট দেশগুলিতে মুজাহিদদের যুদ্ধটি প্রথমে ফ্রান্স, ইউরোপীয় জোট এবং পশ্চিমা বাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু হলেও তা বর্তমানে ভিন্ন শত্রুর দিকে মোড় নিয়েছে। বিশেষ করে একযোগের দীর্ঘ যুদ্ধে মুজাহিদের আক্রমণে যখন অনেকটাই দূর্বল হয়ে পড়ে ইউরোপ ও পশ্চিমা জোট, সেই সাথে কোনঠাসা হয়ে পড়ে তাদের মিত্র সরকারগুলোও। আর এই শক্তিগুলোর দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই অঞ্চলের জান্তা বাহিনীগুলো একেরপর এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে থাকে এবং দেশগুলোর ক্ষমতা নিজেদের কুক্ষিগত করে। এসময় পশ্চিমারা জান্তাকে চাপ দিতে থাকে নির্বাচিত সরকার প্রধানদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। কিন্তু জান্তা বাহিনী বিভিন্ন টালবাহানার মাধ্যমে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে থাকে, ফলে পশ্চিমাদের সাথে ধীরে ধীরে দীর্ঘদিনের মিত্রতার সম্পর্ক বিদ্বেষ ও তিক্ততায় পরিণত হতে থাকে।
পশ্চিমাদের সাথে ক্ষমতা হস্তগত ও ভাগবাটোয়ারার এই টানাপোড়নে জান্তা সরকারগুলো নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করতে নতুন কোনো শক্তিধর মিত্রের প্রয়োজন অনুভব করে। এই লক্ষ্যে জান্তা সরকারগুলো পশ্চিমা শক্তির দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া ও চীনের দিকে ঝুঁকতে থাকে। গোপনে রাশিয়ার ভাড়াটে ওয়াগনার বাহিনীকে নিজেদের ক্ষমতার আশপাশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়ে আসে। এতে পশ্চিমা বিশ্ব ও গণমাধ্যমগুলো আপত্তি জানালেও ওয়াগনারের উপস্থিতির বিষয়টি অস্বীকার করতে থাকে জান্তা বাহিনী। এই ধারাবাহিকতায় জান্তার সাথে তিক্ততা বাড়ে পশ্চিমাদের।
জান্তার সাথে রাগ, অভিমান আর মুজাহিদদের একের পর এক উপর্যুপরি হামলার ফলে পশ্চিমারা সাহেল অঞ্চল থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে থাকে। শুরু হয় সাহেল অঞ্চল থেকে পশ্চিমা বিশ্ব, ইউরোপ ও জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন দেশগুলোর সামরিক বাহিনীর প্রত্যাহারের কার্যক্রম।
এদিকে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যুদ্ধরত পশ্চিমা বাহিনীর শূন্যতাগুলো পূরণ করতে সাহেলের জান্তা সরকারগুলো আরও বেশি করে রাশিয়ার দারস্থ হয়। ফলে রাশিয়া এই যুদ্ধে জান্তা বাহিনীকে সহায়তা করতে ভাড়াটে ওয়াগনার বাহিনীর পাশাপাশি সিরিয়ায় ইতিপূর্বে পতিত আসাদ সরকারের হয়ে যুদ্ধ করা মিলিশিয়াদের নিয়োগ করে, যারা বর্তমানে ফ্রন্টলাইনে মুজাহিদদের মুখোমুখি হচ্ছে এবং ব্যাপকভাবে হতাহতের শিকার হচ্ছে। একই সাথে চীনা কোম্পানিগুলোও এখানে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে জান্তা বাহিনীকে সামরিক স্থাপনা নির্মাণ সহ বিভিন্ন প্রজেক্টে সক্রিয় হওয়ার মাধ্যমে জান্তা সরকারগুলোকে সহায়তা করতে শুরু করে।
এই পরিস্থিতিতে এতোদিন পশ্চিমাদের দিকে তাক করে থাকা আল-কায়েদার বন্দুকের নল ঘুরে যায় সরাসরি এই অঞ্চলের ক্ষমতা দখলকারী সামরিক সরকারগুলি ও রাশিয়ার ভাড়াটে ওয়াগনারের দিকে। কেননা আল-কায়েদার লক্ষ্য শুধু এই অঞ্চলে ক্ষমতার পালাবদল নয়। বরং একটি স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ ইসলামি শরিয়াহ্ ব্যবস্থা চালু করা, যেখানে কোনো দখলদার শক্তির হস্তক্ষেপ থাকবে না এবং গণহত্যাকারী জান্তার আধিপত্যও থাকবে না। যেখানে জনগণ শরিয়ার ছায়াতলে নিরাপত্তার সাথে বসবাস করবে এবং এক আল্লাহর গোলামী করবে। তাই যারাই এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে তারাই মুজাহিদদের হামলার বৈধ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে।
বৈশ্বিক জিহাদি মতাদর্শ ও আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গি:
তালিবান আন্দোলন আফগানিস্তান কেন্দ্রিক শুরু হলেও এর প্রভাব ও মতাদর্শ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে যারা আফগান যুদ্ধ শেষে নিজ দেশে ফিরে যান। অপরদিকে আফগান ইমারাতের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠা আল-কায়েদা (জেএনআইএম) বিশ্বব্যাপী জিহাদের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আল-কুদসের পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনের সমর্থনে পশ্চিমা লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ করা, তা যেখানেই হোক না কেন। এক্ষেত্রে আফগান ফিরত মুজাহিদিনরা নিজ দেশে আল-কায়েদার সাথে সক্রিয় হয়ে কাজ করতে থাকে, সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে সাহেল অঞ্চলে আল-কায়েদা নেতৃত্বে থাকা শীর্ষ ৪ জনের মধ্যে ৩ জন নেতাই আফগান ফেরত মুজাহিদ।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, আফগানিস্তানে ইসলামি ইমারাত প্রতিষ্ঠার পর তালিবান প্রশাসন ঘোষণা করেছে যে, তারা আফগানিস্তানের বাহিরে কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করেন না (অর্থাৎ তারা সরাসরি তালিবান যোদ্ধাদেরকে ব্যবহার করে আফগানিস্তানের বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা করেন না) এবং এক্ষেত্রে কাউকে আফগান ভূমিও ব্যাবহার করার অনুমতিও দেন না। এদিকে কৌশলগত কারণে টিটিপি ও আল-কায়েদার সাথে সম্পর্কের বিষয়টিও প্রকাশ্যে স্বীকার করাকে এড়িয়ে যায় আফগানিস্তানের তালিবান সরকার।
অপরদিকে আল-কায়েদা সাহেল শাখা ‘জেএনআইএম’ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে সম্পর্ক রেখেই পশ্চিম আফ্রিকা কেন্দ্রীক কার্যক্রম সম্প্রচার করছে। তবে সম্প্রতি দলটি শত্রুর পরিধি কমিয়ে এনে কার্যক্রমের পরিধি প্রসারিত করার কৌশল অবলম্বন করছে। ফলে ফ্রান্স 24-এর এক প্রশ্নের জবাবে আল-কায়েদা ইসলামিক মাগরিবের নেতা আল-আন্নাবিকে বলতে দেখা যায় যে, ‘জেএনআইএম’ একচেটিয়াভাবে সাহেল অঞ্চলে কাজ করে এবং এই ভৌগোলিক অঞ্চলের বাইরে এটি পশ্চিমা দেশগুলির জন্য কোনও হুমকি তৈরি করে না। কিন্তু ‘জেএনআইএম’ সরাসরি পশ্চিমা দেশগুলোতে আক্রমণ না করলেও সাহেল অঞ্চলের ৩টি জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পাশাপাশি এই অঞ্চলে পশ্চিমা সমর্থিত কয়েকটি দেশে সামরিক অপারেশন পরিচালনা করছে।
সাহেলে আফগানিস্তানের মতো পরিস্থিতির সম্ভাবনা:
আফগানিস্তানের গতিপথ অনুসরণ করে সাহেলের সম্ভাবনা বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করে। প্রথমত ‘জেএনআইএম’ যদি স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে তার সম্পর্ক জোরদার করতে থাকে এবং আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করতে থাকে, তাহলে আশা করা যায় এটি আগামী সময়গুলোতে বুরকিনা ফাসো এবং মালির বিস্তীর্ণ ভূমির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া, সাহেলের সামরিক সরকারগুলো যদি আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার সম্পর্ক খুবদ্রুত সময়ের মধ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জোরদার করতে অক্ষম হয়, তাহলে ‘জেএনআইএম’ আগামী দিনগুলোতে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তখন সাহেলের জান্তা সরকারগুলোর জন্য ‘জেএনআইএম’ এর বিরুদ্ধে লড়াই করা বর্তমান থেকে আরও বেশি জটিল হয়ে উঠবে। আর এই প্রক্রিয়া যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আশা করা যায় সাহেলে আগামীর দিনগুলো হবে ‘জেএনআইএম’ মুজাহিদদের, যা মালি ও বুরকিনা ফাসোর কর্তৃত্ব অর্জনে ‘জেএনআইএম’এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

দেখা যাক! সাহেলের (পশ্চিম আফ্রিকার একাংশ) বিশাল ভৌগোলিক ভূদৃশ্য এবং বৈচিত্র্যময় সামাজিক-রাজনৈতিক ভূদৃশ্যকে কিভাবে কাজে লাগায় ‘জেএনআইএম’। কেননা এর উপর নির্ভর করছে ‘জেএনআইএম’ এর আগামীদিনের ইসলামি শরিয়াহ্ দ্বারা শাসিত বৃহত্তর সাহেল অঞ্চল। তবে ‘জেএনআইএম’ এর সাম্প্রতিক কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে, দলটি বৃহত্তর সাহেলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জনসংখ্যা, বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়গুলোকে এক পতাকা ও লক্ষ্যের নিচে একীভূত করার জন্য জোরদার কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
উপসংহার
সাহেলে জেএনআইএমের কার্যকলাপ এবং আফগানিস্তানে তালিবানদের কার্যকলাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিল রয়েছে। প্রেক্ষাপট এবং পরিবেশের উল্লেখযোগ্য পার্থক্যের কারণে সাহেলে খুব দ্রুতই আফগানিস্তানের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হবে কিনা তা সামনের দিনগুলোতে ‘জেএনআইএম’ এর সামরিক, রাজনৈতিক ও দাওয়াতি কর্মকাণ্ডই বলে দিবে।
তবে, সাহেল অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা এবং সাম্প্রতিক সময়ে ‘জেএনআইএম’ কর্তৃক কেন্দ্রীয় শহর বিজয় ও অবরোধ চিত্রগুলো বলে দিচ্ছে, আগামী দিনগুলো সাহেলের জান্তা সরকারগুলোর জন্য খুবই ভয়াবহ হতে যাচ্ছে।
Comment