তালিবান শাসনামলে ইমারতে ইসলামিয়ার জাতীয় উন্নয়ন কর্পোরেশনের অবিস্মরণীয় কয়েকটি অবদান

দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও উন্নয়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (NDC)। এই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান প্রধানত আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে কাজ করে থাকে।
NDC-এর মূল লক্ষ্য হল দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্প উৎপাদন বাড়ানো, বিভিন্ন যান্ত্রিক ও অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। বাস, ট্রাক, রেল ইঞ্জিনের মত যানবাহন তৈরির মাধ্যমে আফগানিস্তানে প্রযুক্তি ও শিল্পকৌশলের বিকাশ ঘটাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি দেশের শিক্ষা, কৃষি এবং জ্বালানি খাতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
ইমারতে ইসলামিয়া সরকারের শাসনামলে জাতীয় উন্নয়ন কর্পোরেশনের (এনডিসি) বাস্তবায়িত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ও সাফল্য এখানে উপস্থাপন করা হল:
১. দেশে তৈরি প্রথম রেলওয়ে ইঞ্জিন:
ইমারতে ইসলামিয়ার জাতীয় উন্নয়ন কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে সফলভাবে দেশের প্রথম রেলওয়ে ইঞ্জিন তৈরি সম্পন্ন হয়েছে। বিগত ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ একটি এক্স পোস্টের বিবৃতিতে এই তথ্য জানিয়েছেন তালিবান মুখপাত্র মৌলভী জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ।
উক্ত পোস্টে পরীক্ষামূলকভাবে চালিত ৩টি বগি বহনকারী একটি ট্রেনের ভিডিও শেয়ার করেছেন তালেবান মুখপাত্র। স্বদেশে নির্মিত এই ট্রেন শীঘ্রই অভ্যন্তরীণ রেলপথে পরিচালনা করা হবে বলে উক্ত বিবৃতিতে জানানো হয়।
২. আফগানিস্তানে নির্মিত প্রথম পণ্যবাহী ডাম্পট্রাক:
এছাড়া আফগানিস্তানের প্রথম পণ্যবাহী ডাম্পট্রাক তৈরি করেছে ইমারতে ইসলামিয়া সরকারের জাতীয় উন্নয়ন কর্পোরেশন। শীঘ্রই তা দেশের অভ্যন্তরীণ সড়কে চালু করা হবে। এই ট্রাক মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হবে।
বিগত ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ ইমারতে ইসলামিয়ার মুখপাত্র মৌলভী জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ তার এক্স পোস্টের বার্তায় এই ঘোষণা জানান। জাতীয় উন্নয়ন কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে নির্মিত অন্যান্য পণ্যসমূহ শীঘ্রই প্রদর্শিত হবে বলেও সেই বার্তায় উল্লেখ করা হয়েছিল।
৩. স্বদেশে তৈরি প্রথম বাস নির্মাণ শেষে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন:
সফলভাবে একটি যাত্রীবাহী বাস তৈরি সম্পন্ন করেছে ইমারতে ইসলামিয়া সরকার, আফগানিস্তানের ইতিহাসে নিজ দেশে নির্মিত এটিই প্রথম বাস। সদ্য নির্মিত এই বাস দেশের নগর পরিবহন সেবায় ব্যবহৃত হবে। ১৭ অক্টোবর ২০২৪ সালে ইমারতে ইসলামিয়া সরকারের মুখপাত্র মৌলভী জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ এক্স পোস্টের এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানিয়েছেন। উক্ত পোস্টে নতুন তৈরিকৃত এই বাসের ছবিও শেয়ার করেছেন তিনি। দেশটির ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (NDC) বাসটি তৈরি করেছে।
আফগানিস্তানের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে এটি অন্যতম মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেছেন মৌলভী মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ।
গত ২১ জুলাই ২০২৫ আফগান গণমাধ্যম হুররিয়াত নিউজের তথ্যে জানা যায়, স্থানীয়ভাবে নির্মিত এই বাস আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছে ইমারতে ইসলামিয়া প্রশাসন। এই সংক্রান্ত একটি পোস্টের ভিডিওতে দেখা যায়, উদ্বোধনের সময় ইমারতে ইসলামিয়ার উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। তারা বাসে চড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সদ্য নির্মিত বাসটির যাত্রা আরম্ভ করেন।
৪. বিস্তৃত কারখানা কমপ্লেক্স পুনপ্রতিষ্ঠা:
গত ২১ জুলাই ২০২৫ এনডিসি এর তত্ত্বাবধানে একটি বহুমুখী কারখানা কমপ্লেক্স উদ্বোধন করেছেন ইমারতে ইসলামিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী মোল্লা আব্দুল গণি বারাদার আখুন্দ হাফিযাহুল্লাহ। এই কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হল স্বদেশের সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে উৎপাদন সুবিধা বাড়ানো। এই কমপ্লেক্সে প্রায় ১০৫ প্রকারের পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করা হবে। এই সকল পণ্যের মধ্য রয়েছে কৃষি যন্ত্রপাতি, ফসল শুকানোর যন্ত্রপাতি, যানবাহনের খুচরা যন্ত্রাংশ, শিল্প সরঞ্জাম, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের সরঞ্জমাদি এবং অন্যান্য।।
এনডিসি’র কর্মকর্তাগণ জানান, তৈরিকৃত পণ্য দেশীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিশেষত ফসল শুকানোর যন্ত্র কম দামে বিদেশে রপ্তানির সক্ষমতা অর্জনের কথা জানিয়েছে কোম্পানিটি।
প্রায় ৬০ বছর ধরে এই কমপ্লেক্সের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ইমারতে ইসলামিয়ার শাসনামলে এই কমপ্লেক্সের পুনপ্রতিষ্ঠা দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আমদানি নির্ভরতা হ্রাস, শিল্পের বিকাশের পথে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এটি শিল্প ও প্রযুক্তিতে দেশীয় দক্ষতার একটি অনন্য উদাহরণ।
৫. কুশতেপা খাল খনন মেগাপ্রকল্প:
দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম খাল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে আফগানিস্তানের সর্ববৃহৎ কুশতেপা খাল। জাতীয় উন্নয়ন কর্পোরেশন (এনডিসি) এর তত্ত্বাবধানে এবং নিজস্ব বাজেটের আওতায় খালটি নির্মিত হচ্ছে। এটির পানির প্রধান উৎস হল আমু দরিয়া নদী।
কুশতেপা মূল খালের দৈর্ঘ্য ২৮৫ কিলোমিটার, যা আফগানিস্তানের বালখ প্রদেশের কালদার জেলা থেকে শুরু হয়েছে। অতঃপর জাওযান প্রদেশের মধ্য দিয়ে ফারিয়াব প্রদেশের আন্দোখই জেলায় সমাপ্ত হয়েছে। এটির প্রস্থ ১০৮ মিটার এবং গভীরতা ৮.৫ মিটার। খালটি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৬৫০ ঘনমিটার পানি পরিবহনের সক্ষমতা সম্পন্ন হবে। এটি আমু নদী থেকে বছরে প্রায় ২০.৫ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি স্থানান্তর করবে। ফলে এই খালের আওতায় প্রায় ৫ লক্ষ ৫০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
গত ৩০ জুলাই প্রকাশিত ইমারতে ইসলামিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের বার্ষিক কর্মসম্পাদন প্রতিবেদন হতে জানা যায়, কুশতেপা খাল খনন প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, এছাড়া ২য় পর্যায়ের কাজ ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে ইমারতে ইসলামিয়ার মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আগামী জানুয়ারি ২০২৬ মাসের মধ্যেই ২য় পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন হবে।
৬. আফগানিস্তানের অন্যতম বৃহৎ ঘোরি সিমেন্টের ৩য় কারখানার নির্মাণ কাজ উদ্বোধন:
গত ৩১ আগস্ট ২০২৫ আফগানিস্তানের বাগলান প্রদেশে ঘোরি সিমেন্টের ৩য় কারখানার নির্মাণ কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন উপপ্রধানমন্ত্রী মোল্লা আবদুল গনি বারাদার আখুন্দ হাফিযাহুল্লাহ। এটি জাতীয় উন্নয়ন কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত আফগানিস্তানের অন্যতম বৃহত্তম সিমেন্ট কারখানা।
উক্ত প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৬.৮ মিলিয়ন ডলার। আগামী ১৮ মাসের মধ্যে এটির নির্মাণ সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্মাণ সমাপ্ত হলে কারখানাটি প্রতিদিন ৫ হাজার টন সিমেন্ট উৎপাদন করতে সক্ষম হবে।
উল্লেখ্য যে, ১৯৬২ সালে বাগলান প্রদেশে ১ম ঘোরি সিমেন্ট কারখানার যাত্রা আরম্ভ হয়। সেই সময় এর দৈনিক সিমেন্ট উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪০০ টন। অতঃপর ২০১১ সালে বাগলান প্রদেশে ২য় ঘোরি সিমেন্ট কারখানা নির্মিত হলে এর দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় ১২০০ মেট্রিক টনে। তবে তালিবান শাসনামলেই সক্ষমতা অনুযায়ী উক্ত প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ সিমেন্ট তৈরি নিশ্চিত হয়। আর চলতি বছর আরও বড় পরিসরে ৩য় ঘোরি সিমেন্ট কারখানা নির্মাণ শুরু করল ইমারতে ইসলামিয়া প্রশাসন।
৭. উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে এনডিসি’র চুক্তি স্বাক্ষর:
বিগত ১৫ জুলাই ২০২৪ তারিখ ইমারতে ইসলামিয়ার উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে একটি দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে জাতীয় উন্নয়ন কর্পোরেশন (এনডিসি)। এই চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্দেশ্য হল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দের বৈজ্ঞানিক ও ব্যবহারিক দক্ষতা দেশের উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে প্রয়োগ করা। এছাড়া এই চুক্তির ফলে এনডিসি’র পরিচালিত প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ লাভ করছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীগণ।
একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা চালিয়ে যেতে চুক্তিটি এনডিসি’র সদস্যদের সুবিধা প্রদান করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণা সম্মেলনে অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন এনডিসি’র কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ। ফলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ ও এনডিসি’র কার্যক্রমের মধ্যে একটি সুন্দর সমন্বয় গড়ে উঠছে।
এছাড়া দেশব্যাপী বড় পরিসরে বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন, খনিজ সম্পদ আহরণ, আবাসিক কমপ্লেক্স ও বাণিজ্যিক মার্কেট প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে তালিবান নেতৃত্বাধীন জাতীয় উন্নয়ন কর্পোরেশন (এনডিসি)।
তথ্যসূত্র:
1. https://tinyurl.com/4p53b2xw
2. https://tinyurl.com/4edsw96d
3. https://tinyurl.com/2a3shu6z
4. https://tinyurl.com/2v7k55up
5. https://tinyurl.com/6bnwc3ur
6. https://tinyurl.com/yypd63z9
7. https://tinyurl.com/3j92kkcf
8. https://tinyurl.com/yrtphkah
9. https://tinyurl.com/t6va3sep
10. https://tinyurl.com/3retb5jh
11. https://tinyurl.com/ynv8myr2
12. https://tinyurl.com/yxuyp9mr
13. https://tinyurl.com/bdcpbn35
14. https://tinyurl.com/mu9kbxck
15. https://tinyurl.com/4jbz7rms
16. https://tinyurl.com/mpaw75px
17. https://tinyurl.com/3ny2davr
18. https://tinyurl.com/bdt38v79
19. https://tinyurl.com/d4y9safa
20. https://tinyurl.com/y67a27rx
21. https://tinyurl.com/2pnk3zdn
Comment