গণহত্যার দশ স্তর
নোট ১ঃ বর্তমান যুগের জাতিরাষ্ট্রগুলোতে কীভাবে গণহত্যা সংঘটিত হয় তার একটি রূপরেখা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখ্য, নিম্নোক্ত স্তরগুলো নির্ধারণে বর্তমান জাতীয়তাবাদী আদর্শ লালনকারী জাতিরাষ্ট্রকে মূল ধরা হয়েছে।
নোট ২ঃ নিচের স্তরগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পেতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। কোথাও এক সাথেই সব স্তর বাস্তবায়িত হতে পারে। কোথাও কোনো স্তর নাও তৈরি হতে পারে।
নোট ৩ঃ স্তরগুলো নেওয়া হয়েছে জেনোসাইড ওয়াচের টেন স্টেজস অফ জেনোসাইড থেকে। (১)
১। ক্লাসিফিকেশন। (বিভক্ত করা)
প্রথম স্তরে বিশেষ কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে মূলধারা থেকে আলাদা করে বিভক্ত করে ফেলা হয়। আমরা ও তারা-র সীমারেখা তৈরি করা হয়।
যেমনঃ নাৎসিরা করেছিল ইহুদিদের ক্ষেত্রে। ভারতে হিন্দুরা করেছে মুসলমানদের ক্ষেত্রে। মুসলিমদেরকে বহিরাগত, লুটেরা বলে ভারতীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।
২। সিম্বলাইজেশন। (চিহ্ন নির্ধারণ করা)
দ্বিতীয় স্তরে জাতীয় পরিচয় বাদ দিয়ে বিশেষ গোষ্ঠীকে ভিন্ন কোনো নাম বা চিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত করা।
যেমনঃ ভারতে মুসলমানদেরকে জিহাদি, সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করা হয়। নাৎসিরা ইহুদিদের জন্য ডেভিড স্টার ঝুলিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক করেছিল।
বিঃদ্রঃ উল্লিখিত প্রথম দুই স্তর স্বভাবিকভাবে গণহত্যার স্তর নয়। বিভিন্ন কারণে এই দুই স্তর দেশে বাস্তবায়িত হতে পারে। এই দুই স্তর গণহত্যার স্তর তখনই হবে যখন এই দুই স্তরের উপর ভিত্তি করে গণহত্যার তৃতীয় স্তর কার্যকর হবে।
৩। ডিসক্রিমিনেশন। (বৈষম্য)
তৃতীয় স্তরে বিশেষ জাতিগোষ্ঠীকে মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। মৌলিক মানবধিকারের ক্ষেত্রে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়।
যেমনঃ ভারতে এনআরসি, সিএএ ইত্যাদির মাধ্যমে মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়েছে। ১৯৩৫ সালে নাৎসিরা ইহুদিদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল।
৪। ডিহিউম্যানিজেশন। (মানুষ মনে না করা)
এই স্তরে এসে বিশেষ জাতিগোষ্ঠীকে মানুষ মনে করা হয় না। তাদেরকে পোকামাকড়, সমাজের ব্যাধি হিসেবে উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হয়।
যেমনঃ ভারতে মুসলিমদেরকে উঁইপোকার সাথে তুলনা করা হয়। কেউ কেউ মুসলিমদেরকে ভারতের জন্য ক্যান্সার মনে করে। যা উগ্র হিন্দুত্ববাদী অনেক নেতা তাদের বক্তব্যে বলে থাকে।
৫। অর্গানাইজেশন। ( সংঘবদ্ধ হওয়া)
গণহত্যা সাধারণত সঙ্ঘবদ্ধ শক্তির মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এই স্তরে এসে রাষ্ট্র বা বিশেষ আদর্শ লালনকারী দল টার্গেটেড গ্রুপের বিরুদ্ধে দল গঠন করা, শক্তি সঞ্চয় করা, প্রশিক্ষণ প্রদান করার মাধ্যমে সঙ্ঘবদ্ধ হয়।
যেমনঃ ভারতে আরএসএস, শিবসেনা সহ অসংখ্য উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল মুসলিমদেরকে গণহত্যার উদ্দেশ্যে সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে। নিজেদের কর্মীদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বিজেপি সরকারের মদদেই এইসব হছে। নাৎসিরাও ইহুদিদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবেই গণহত্যা পরিচালনা করেছে।
৬। পোলারাইজেশন। (মেরুকরণ ও কোণঠাসা করা)
এই স্তরে এসে প্রভাবশালী গোষ্ঠী টার্গেটেড গোষ্ঠীকে ধীরে ধীরে কোণঠাসা করে ফেলে। টার্গেটেড গোষ্ঠীর প্রতিবাদী ব্যক্তি ও নেতাদেরকে খুন, গুম ও ভয় দেখিয়ে নিশ্চুপ করিয়ে দেয়। জাতীয় পর্যায়ে এমন আইন পাশ করা হয় যা টার্গেটেড গোষ্ঠীর উপর প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ক্ষমতার অপপ্রয়োগকে বৈধতা দেয়। টার্গেটেড গোষ্ঠীকে নিরস্ত্র করা, তাদের মাঝে অধিকার আদায়ের মানসিকতা নষ্ট করে দেওয়া হয়। পরাজিত মানসিকতা ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর তাবেদারি করাকেই তাদের আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়।
যেমনঃ চীনের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মাধ্যমে উইঘুর মুসলিমদেরকে অধিকারের জন্য ল ড়া ই করার চেতনা মুছে ফেলা হচ্ছে। ভারতে মুসলিম গণহত্যার প্রস্তুতির পাশাপাশি প্রতিবাদী মুসলিমদেরকে গুপ্তহত্যা করা হচ্ছে। তাদেরকে সাধারণ মুসলিমদের কাছে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। "ভারতীয় সংবিধান ও রাষ্ট্র মুসলিমদের অভিভাবক" এমন চেতনা মুসলিমদের মাঝে ঢুকিয়ে দিয়ে মুসলিমদেরকে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন সম্পর্কে ভুলিয়ে রাখা হচ্ছে।
৭। প্রিপারেশন। (গণহত্যার প্রস্তুতি)
এই স্তরে প্রভাবশালী গ্রুপের নেতারা টার্গেটেড গ্রুপের গণহত্যাকেই নিজেদের একমাত্র সমাধান বলে উল্লেখ করে মানুষকে গণহত্যার প্রস্তুতি নিতে বলে। কখনো কখনো তারা নিজেদেরকে দুর্বল ও নির্দোষ হিসেবে উপস্থাপন করে মানুষের সমর্থন ও সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করে। গণহত্যাকে নিজেদের আত্মরক্ষার একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করে বলে "আমরা যদি তাদেরকে হত্যা না করি তাহলে তারা আমাদেরকে হত্যা করবে।"
যেমনটা আমরা কিছুদিন পূর্বেই ভারতে দেখেছি। ভারতের গুরুদুয়ারের একটি ধর্মীয় সেমিনারে কয়েকটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী দলের নীতিনির্ধারক ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হুবহু এভাবেই গণহত্যার বৈধতা তৈরি করেছে। যে সেমিনারে ক্ষমতাসীন বিজেপির লোকও উপস্থিত ছিল।
৮। পারসিকিউশন। (নির্যাতন)
এই স্তরে পরিকল্পমামাফিক নির্যাতন শুরু হয়। টার্গেটেড গোষ্ঠীর বিভিন্ন সদস্যকে হত্যা করা হয়, অকারণে গ্রেফতার করা হয়, আইন বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়, নিজ ভূমি থেকে বহিষ্কার করা হয়, হঠাৎ কোনো গ্রামে আক্রমণ করে অভিযান চালানো হয়, নারীদের ধর্ষণ করা হয়, মানবিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়, ইন্টারনেটসেবা বন্ধ করে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়, খাবার, পানি থেকে বঞ্চিত করা হয়, পুরোপুরি আইসোলেটেড করে ফেলা হয়।
যেমনঃ কাশ্মীরে বহুবার ঘটেছে। ফিলিস্তিনে এটা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। রোহিঙ্গাদের উপর এই পরিস্থিতি সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে।
৯। এক্সটারমিনেশন। (চূড়ান্ত গণহত্যা)
এই স্তরে চূড়ান্ত গণহত্যা সংঘঠিত হয়। গণহত্যা সাধারণত টার্গেটেড গোষ্ঠীর সকল সদস্যকে হত্যা করার ইচ্ছায় শুরু করা হয়। কিন্তু সাধারণত এটার বাস্তবায়ন হয় টার্গেটেড গোষ্ঠীর বিশেষ অংশকে হত্যার মাধ্যমে। কখনো টার্গেটেড গোষ্ঠীর সকল প্রতিবাদী, শিক্ষিত লোকদেরকে হত্যা করা হয় যেমন বুরুন্ডিতে ১৯৭২ সালে হয়েছে। কখনো যুদ্ধ করতে সক্ষম পুরুষ ও ছেলেদের হত্যা করা হয়, যেমন হয়েছে বসনিয়ায় ১৯৯৫ সালে। এছাড়াও নারীদেরকে ব্যাপকহারে ধর্ষণ (যেমন দারফুর ও মিয়ানমারে হয়েছে) ও টার্গেটেড গোষ্ঠীকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় (যেমন মিয়ানমারে হয়েছে)। কখনো কখনো পুরো গোষ্ঠীকে বাছ বিচার ছাড়াই হত্যা করা হয়।
১০। ডিনায়াল। (প্রত্যাখ্যান)
এটি গণহত্যার সর্বশেষ স্তর। এই স্তরে এসে গণহত্যা পরিচালনাকারী গোষ্ঠী গণহত্যার সকল প্রমাণ মুছে ফেলতে চেষ্টা করে। লাশ দাফন করে বা পুড়িয়ে দেয়। সাক্ষীদেরকে গুম করে বা হত্যা করে। সব ধরণের অভিযোগ তারা অস্বীকার করে। মাঝে মাঝে যা ঘটিয়েছে তার পুরো দোষ টার্গেটেড গোষ্ঠীর উপরেই চাপিয়ে দেয়। কখনোবা সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার অজুহাত দেখায়। দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে বাধ্য হয়ে এই কাজ করতে হয়েছে এমন কারণ দেখায়। অনুসন্ধানী মিডিয়া ও ব্যক্তিদেরকে অনুসন্ধানে বাঁধা দেয়। মিডিয়ার মাধ্যমে গণহত্যার যথার্থতার পক্ষে সাফাই গেয়ে প্রোপাগান্ডা চালায়। কখনোবা টার্গেটেড গোষ্ঠীর সাধারণ বা বিক্রি হয়ে যাওয়া সদস্যদের প্রতি নিজেদের সহায়তা ও সহানুভূতি দেখিয়ে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদেরকে আপন বানিয়ে নেয়।
যেমনঃ রোহিঙ্গা গণহত্যার পর এর পুরো দোষ আরসার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইহুদিদের গণহত্যার পরে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের দোহাই দেওয়া হয়েছে। ৫ই মে গণহত্যার পর ২০১৮তে সরকার কওমি অঙ্গনের কিছু মানুষকে নিজের দলে টেনে নেয়।
ভারতে কি মুসলিমরা গণহত্যার সম্মুখীন??
জেনোসাইড ওয়াচ- এর বিশ্লেষণ বলছে ভারতে এই মূহূর্তে গণহত্যার ৮ম স্তর চলছে। এবং তারা ২০২১ এর আগস্টে জেনোসাইড এলার্ট জারি করে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে -
Genocide Watch recognizes the B J P government's state-sponsored attack on the Muslim and Dalit commuity as Stage 6: polarization, Stage 7: preparation, and Stage 8: Persecution.
"মুসলিম ও দলিত সম্প্রদায়ের উপর বিজেপি সরকার সমর্থিত আক্রমণকে জেনোসাইড ওয়াচ গণহত্যার ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম স্তর মনে করে।" (২)
(১) - https://www.genocidewatch.com/tenstages
(২) - https://www.genocidewatch.com/country-pages/india
Comment