কিছু কথা, যা আগে বলা হয়নি
=================
এটা ছিল না কোনো আনুষ্ঠানিক সাক্ষাত্কার, ছিল না চক্রান্তসদৃশ কোনো গোপন বৈঠক। (আমার কাছে এই সাক্ষাত্কার ইউএন সামিটের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়)। কেননা এই সাক্ষাত্কারের ফলাফল ছিল জন কুসাক, ড্যানিয়েল এলসবার্গ এবং এডওয়ার্ড স্নোডেনকে একসঙ্গে পাওয়া। না, স্নোডেনের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাকে বাড়তি কোনো সতর্কতা বা কূটনৈতিক নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি।
যেটা ফলাফল নয় সেটা হলো, সেই কক্ষ নম্বর ১০০১-এর আনন্দঘন হাস্যরসাত্মক উষ্ণ মেজাজের পরিবেশটা আর কখনোই পুনরায় সৃষ্টি করতে না পারা। যদিও এটা দাবি করে, তবুও আসলে এটা লিখে নিখুঁতভাবে কখনোই প্রকাশ করা যাবে না। কারণ একবার যা ঘটে যায়, তা আবার ঘটানো যায় না। এই পৃথিবীটা যেন একটি সহস্রপদ কেন্নো বিছের মতোই, যার প্রতিটি অংশে প্রতিটি মুহূর্তে কতই না সত্যিকারের কথোপকথন, আলাপন হচ্ছে এবং অবশ্যই এই কথোপকথন সেই সত্যিগুলোর একটি।
সেই কক্ষে আমাদের আলাপের বিষয়বস্তুর চেয়ে সম্ভবত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওই কক্ষে অবস্থানরত মানুষগুলোর উদ্দীপনা। সেখানে ছিল এডওয়ার্ড স্নোডেন! ৯/১১, বুশ, ইরাকযুদ্ধ আর স্নোডেনের ভূমিকা, এর পক্ষে-বিপক্ষে থাকা—এসব নিয়ে এই কথোপকথনের জন্য সময়টা একটু দেরিতেই হলো অবশ্য। কিন্তু তার পরেও ইরাক, যার সব কিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। আর ‘মধ্যপ্রাচ্য’! যাকে এখনো আমরা প্রসন্নচিত্তে ‘মধ্যপ্রাচ্যই’ বলি, তার মানচিত্র আঁকা হয়েছে নতুন করে এবং এখনো হচ্ছে। আমরা একে অন্যের সঙ্গে আলাপ করছিলাম রাশিয়ার এক উদ্ভট হোটেলে। অবশ্যই এটা উদ্ভট ছিল।
আমরা নানা রকম পারচ, চেয়ার, টুল আর জনের (জন কুসাকের রুম) বিছানা ব্যবহার করছিলাম বসার জন্য। ড্যান আর এড খুবই খুশি ছিল একে অপরের সাহচর্য পেয়ে। একে অন্যকে বলার জন্য অনেক কথা জমা ছিল তাদের কাছে। নিজেকে খানিকটা অভব্য মনে হচ্ছিল তাদের মধ্যে অনধিকার প্রবেশে। এই মানুষ দুজন, যারা একসময় ভীষণ গোপনীয় কোড ল্যাংগুয়েজ ভাঙতে পেরেছিল। কে না জানে, সিআইএ আর এনএসএতে নিরাপত্তাজনিত কিসব কিম্ভূতকিমাকার কোড ব্যবহার করা হয়!
ড্যান ও এড মার্কিন নাগরিক হিসেবে পেন্টাগনে ও জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিতে কাজ করার স্মৃতিচারণা করছিল। কিভাবে তারা প্রভাবিত হয়েছে মার্কিন ভুল নীতির বিপক্ষে। বিবেকের দংশনে তাদের গোপন নথি প্রকাশ করা এবং কিভাবেই বা তাদের জীবন পাল্টে গেল ইত্যাদি।
ড্যান একটু সময় নিয়ে বলতে শুরু করল—‘এটি সত্যি দুঃখের বিষয়, একজন আমেরিকান ও শিক্ষিত সচেতন মানুষ হিসেবে পেন্টাগন ও জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিতে কাজ করেও আমেরিকার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা।’ ওদের দুজনের বক্তব্য প্রায়ই মিলে যায় মানবিকতা ও বিবেকের প্রশ্নে। হঠাৎ করেই তাঁদের মধ্যে এসব বিষয়ে বোধোদয় হয়েছে তা কিন্তু না। এটি শুরু হয়েছে সেই সময় থেকেই, ড্যানিয়েল যখন যুক্তরাষ্ট্রকে সমাজতন্ত্র থেকে মুক্ত করার মিশনে লিপ্ত ছিল। আর স্নোডেনের ক্ষেত্রে হয়েছে মুসলিম সন্ত্রাসবাদ থেকে আমেরিকাকে রক্ষা করার কাজে যোগদানের সময় থেকে।
এডের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ওয়াশিংটনের অন্য রাষ্ট্র ধ্বংস করার ক্ষমতা আর যুদ্ধ জয়ের অক্ষমতা সম্পর্কে। ‘প্রশ্নটা হয়তো একটু রূঢ় হয়েই গেল’, সে সময় এমনই মনে হচ্ছিল আমার, ‘মার্কিনরা শেষ কবে যুদ্ধে জয়লাভ করেছে’? আরো জানতে চেয়েছিলাম, ইরাকের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও গণহত্যার বিষয়ে। কিভাবে সিআইএ জেনেছিল যে ‘বিশ্বে একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে শুধু যুদ্ধই করবে না, বরং রাষ্ট্রের ভেতরেও যুদ্ধ করতে হবে, যার জন্য গণনজরদারি প্রয়োজন। আর প্রশিক্ষিত ও দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও একটি দেশের সেনাবাহিনী প্রশাসক হিসেবে পুলিশ বাহিনীর বিকল্প ভূমিকা পালন করে ইত্যাদি সম্পর্কে। স্নোডেন তার উত্তর শুরু করল একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারির বিষয় থেকে। ‘আমরা যদি কিছু না করেও, একটি সম্পূর্ণ নজরদারির রাষ্ট্রের মধ্যে বাস করি, যেখানে রাষ্ট্রটির মানুষের ওপর শক্তি প্রয়োগ ও সব কিছু জানার অতিমাত্রায় ক্ষমতা হাতে থাকে—তাহলে বিষয়টি হবে ভয়াবহ। এটি হলো অন্ধকার ভবিষ্যৎ। এখানে সত্য হলো, একদল লোক আমাদের সব কিছুর খবর রাখবে অথচ তাদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানব না। এর কারণ তারা গোপনীয় ও সুবিধাভোগী, তারা একটি আলাদা শ্রেণি... অনেকটা সমাজের ধনিক শ্রেণি ও রাজনীতিবিদদের মতো উঁচু স্তরের সম্পদশালী—তারা কোথায় থাকে, কী করে, তাদের বন্ধু কারা কিছুই আমরা জানি না। অথচ আমাদের সম্পর্কে সব কিছু জানার সক্ষমতা রয়েছে তাদের। আর এটিই হলো ভবিষ্যতের নির্দেশনা; কিন্তু আমি মনে করি, এ থেকে পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।’
আমি আশ্চর্য হয়েছি, যদিও স্নোডেনকে জিজ্ঞাসা করিনি—যদি তিনি সাদা না হয়ে কালোদের একজন হতেন, তাহলে তাঁর ভাগ্যে কী ঘটত?
অন্যদিকে ড্যান বলছিল ৯/১১-এর পরের অবস্থা নিয়ে। ‘আসলে ৯/১১-এর পর দৃশ্যপটের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আমেরিকা হয়তো এখনো পুরোপুরি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। তবে আরেকটি নাইন ইলেভেন হলে নিশ্চিত পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এখনকার সাদা মানুষরা হয়তো পুলিশি রাষ্ট্রে বাস করছে না, কিন্তু যারা কালো, মিশ্র, মধ্য-পূর্ব ভাগের মানুষ, তারা কিন্তু ঠিকই এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তিনি ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, পরবর্তী সময় নাইন ইলেভেনের মতো কোনো দুর্ঘটনা হলে তার ফলাফল ভয়াবহ হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতোই তখন শত শত ও হাজার ডিটেনশন ক্যাম্প হবে, অজস্র মানুষ গ্রেপ্তার হবে, মুসলিমদের ধরে ধরে ক্যাম্পে ঢোকানো হবে। আর এটি করা হবে কিন্তু বর্তমানে জনগণের ওপর নজরদারি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই। তারা জানে কাকে দূরে রাখতে হবে—কারণ তথ্য তাদের হাতেই আছে।’
প্রসঙ্গক্রমে আমাদের কথা হয়েছে—যুদ্ধ, লোভ, সন্ত্রাসবাদ, রাষ্ট্র, দেশপ্রেম, পতাকা, জনমত, নৈতিকতা, উদ্বাস্তু সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে। স্নোডেনের ভাগ্যে কী আছে? সে কি কখনো আমেরিকায় ফিরতে পারবে? তার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আমেরিকান সরকার, রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি করার জন্য যেকোনো মূল্যে স্নোডেনকে শাস্তি দিতে চায়। তারা তাকে জেলহাজতে নিতে বা হত্যা করতে না পারলেও সে যেন আরো বেশি তথ্য দিতে না পারে বা যতটুকু ক্ষতি করেছে তা পূরণ করা যায়, তার জন্য আমেরিকা কোনো চেষ্টাই বাদ রাখবে না।
পশ্চিমা মিডিয়ায় আমেরিকাকে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে জননিরাপত্তা বনাম গণনজরদারি নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। এটি কি নৈতিক বা অনৈতিক? এটি ভুল না শুদ্ধ, তথ্য ফাঁসকারীরা দেশপ্রেমিক না দেশদ্রোহী? নৈতিকতার এ সংকীর্ণতা মাপার জন্য অন্য দেশ, সংস্কৃতি আবির্ভূত হচ্ছে—এমনকি তারা মার্কিন আগ্রাসনের শিকার হয়েও।
অদ্ভুতভাবে হলেও, আমি যখন মস্কোর রিত্জ কার্লটনে আমাদের সেই আলাপচারিতার কথা চিন্তা করি, আমার মনে ড্যানিয়েল এলসবার্গের ছবিটিই প্রথম ভেসে ওঠে। আমাদের মধ্যে যে কয় ঘণ্টা আলাপ হয়েছে, সে কয় ঘণ্টা ড্যান বিছানায় চিৎ হয়েই শুয়ে ছিল। খ্রিস্টের মতো তার দুটি হাত দুদিকে প্রসারিত ছিল। আনমনে বলছিল আমেরিকার পরিবর্তনের কথা, ‘শ্রেষ্ঠ মানুষদের’ হয় অবশ্যই জেলে যেতে হবে, নয় নির্বাসনে যাও। তার অশ্রু আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিচ্ছিল। এই অশ্রু সেই মানুষের, যার জীবন এখন সায়াহ্নে। যে একদা প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হতো সেসব মানুষের সঙ্গে, যাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছিল। যে ঠাণ্ডা মাথায় পৃথিবীর জীবন প্রধ্বংসী সব পরিকল্পনা করত, ধারণা দিত। সে-ই সব কিছুর ঝুঁকি নিয়ে শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্যই তথ্য ফাঁস করল। ড্যানের কাছে তার বিরুদ্ধে আসা সব যুক্তির বিপরীতে পাল্টা যুক্তিও ছিল। সে আমেরিকার ইতিহাস ও পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে প্রায়ই ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটি বেছে নিচ্ছিল। পেন্টাগন পেপার জনসম্মুখে নিয়ে আসার ৪০ বছর পরও, সে সময়কার বিশেষ বিশেষ অনেক ব্যক্তিরই মৃত্যু ঘটেছে, কিন্তু তার জীবনযন্ত্র এখনো সচল রয়েছে, এটা সে উপলব্ধি করে। ড্যানিয়েল ও স্নোডেনের মতো সাহসী মানুষ আছে বলেই এখনো মানুষের মঙ্গল হয়। কি অপরাধ তারা করেছে? কেন তারা রাষ্ট্রদ্রোহী? তারা নিজের দেশের ও পৃথিবীর লোকদের কল্যাণের জন্য আত্মত্যাগ করেছে বলে?
ড্যানিয়েলের কান্না আমাকে ভাবিয়েছিল, আমাদের ভালোবাসা, পরাজয়, স্বপ্ন ও সবচেয়ে বেশি আমাদের ব্যর্থতা নিয়ে। দেশের জন্য আমাদের ভালোবাসাটা আসলে কী ধরনের ভালোবাসা? কেমন দেশের স্বপ্ন আমরা সব সময় দেখে এসেছি? কী রকমের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম যে স্বপ্ন ভেঙে গেছে? সর্বোত্তম মহৎ জাতিটির মানবিকতার সক্ষমতা কি ঠিক ততখানি, যতখানি সক্ষমতা তার নিষ্ঠুরতা আর গণহত্যার? একটি দেশের সফলতার উচ্চতা কি এটাই নির্দেশ করে না যে ঠিক ততটুকুই তার নৈতিকতার পতনের গভীরতা? এবং কি আমাদের ব্যর্থতা? লেখক, শিল্পী, মৌলবাদী, বিশ্ব নাগরিক, বাউন্ডুলে, অসন্তুষ্ট বিদ্রোহীরা আমাদের স্বপ্ন আমাদের কল্পনা ব্যর্থতা কি? আমাদের ব্যর্থতায় কী ছিল যে শুধু দেশ ও পতাকার ধারণার সঙ্গে ভালোবাসার মতো নিষ্পাপ ধারণাকে এক করতে পারিনি? সব কিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, মানুষ যুদ্ধ ছাড়া টিকে থাকতে অক্ষম, আবার তারাই ভালোবাসা ছাড়াও বেঁচে থাকতে অক্ষম? সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে—‘কী আমাদের ভালোবাসা উচিত?’
এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন হাজার হাজার রিফিউজি ইউরোপজুড়ে বন্যার মতো প্লাবিত হচ্ছে। যার জন্য দায়ী দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা ও ইউরোপের বিদেশনীতি। তাহলে স্নোডেনও কি রিফিউজি, হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি একজন রিফিউজি। কারণ তিনি যা করেছেন তার জন্য মাতৃভূমিতে ফিরতে পারছেন না। বর্তমানে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া থেকে লাখো কোটি মানুষ তার মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। জীবনযাত্রা পরিবর্তনের এক অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আরেকজন রিফিউজির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, জানামতে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রিফিউজি! জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ! যে চতুর্থ বছরের মতো লন্ডনের ইকুয়েডরিয়ান এমবাসিতে পলাতক অতিথি হিসেবে জীবন যাপন করছে। এখন পর্যন্ত যার দরজার ঠিক সামনে ছোট্ট লবিতে অস্ত্র হাতে পুলিশ মোতায়েন করা আছে, ছাদে আছে স্নাইপার। তাকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে, তাকে গুলি করার অর্ডার নিয়ে। টেনেহিঁচড়ে তাকে বের করে নিয়ে আসা হবে, যদি সে পায়ের বুড়ো আঙুলটাও বাইরে বের করে। হ্যাঁ, এটাই আমাদের আন্তর্জাতিক সীমান্তের প্রচলিত বৈধ আইন!
নিজের দেশ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের কাছে এই মানুষগুলোর পরিচয় হয়েছে ‘রিফিউজি’ হিসেবে। এটি আমাদের জন্য লজ্জার।
http://www.kalerkantho.com/print-edition/doshdik/2016/01/15/313371
=================
এটা ছিল না কোনো আনুষ্ঠানিক সাক্ষাত্কার, ছিল না চক্রান্তসদৃশ কোনো গোপন বৈঠক। (আমার কাছে এই সাক্ষাত্কার ইউএন সামিটের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়)। কেননা এই সাক্ষাত্কারের ফলাফল ছিল জন কুসাক, ড্যানিয়েল এলসবার্গ এবং এডওয়ার্ড স্নোডেনকে একসঙ্গে পাওয়া। না, স্নোডেনের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাকে বাড়তি কোনো সতর্কতা বা কূটনৈতিক নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি।
যেটা ফলাফল নয় সেটা হলো, সেই কক্ষ নম্বর ১০০১-এর আনন্দঘন হাস্যরসাত্মক উষ্ণ মেজাজের পরিবেশটা আর কখনোই পুনরায় সৃষ্টি করতে না পারা। যদিও এটা দাবি করে, তবুও আসলে এটা লিখে নিখুঁতভাবে কখনোই প্রকাশ করা যাবে না। কারণ একবার যা ঘটে যায়, তা আবার ঘটানো যায় না। এই পৃথিবীটা যেন একটি সহস্রপদ কেন্নো বিছের মতোই, যার প্রতিটি অংশে প্রতিটি মুহূর্তে কতই না সত্যিকারের কথোপকথন, আলাপন হচ্ছে এবং অবশ্যই এই কথোপকথন সেই সত্যিগুলোর একটি।
সেই কক্ষে আমাদের আলাপের বিষয়বস্তুর চেয়ে সম্ভবত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওই কক্ষে অবস্থানরত মানুষগুলোর উদ্দীপনা। সেখানে ছিল এডওয়ার্ড স্নোডেন! ৯/১১, বুশ, ইরাকযুদ্ধ আর স্নোডেনের ভূমিকা, এর পক্ষে-বিপক্ষে থাকা—এসব নিয়ে এই কথোপকথনের জন্য সময়টা একটু দেরিতেই হলো অবশ্য। কিন্তু তার পরেও ইরাক, যার সব কিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। আর ‘মধ্যপ্রাচ্য’! যাকে এখনো আমরা প্রসন্নচিত্তে ‘মধ্যপ্রাচ্যই’ বলি, তার মানচিত্র আঁকা হয়েছে নতুন করে এবং এখনো হচ্ছে। আমরা একে অন্যের সঙ্গে আলাপ করছিলাম রাশিয়ার এক উদ্ভট হোটেলে। অবশ্যই এটা উদ্ভট ছিল।
আমরা নানা রকম পারচ, চেয়ার, টুল আর জনের (জন কুসাকের রুম) বিছানা ব্যবহার করছিলাম বসার জন্য। ড্যান আর এড খুবই খুশি ছিল একে অপরের সাহচর্য পেয়ে। একে অন্যকে বলার জন্য অনেক কথা জমা ছিল তাদের কাছে। নিজেকে খানিকটা অভব্য মনে হচ্ছিল তাদের মধ্যে অনধিকার প্রবেশে। এই মানুষ দুজন, যারা একসময় ভীষণ গোপনীয় কোড ল্যাংগুয়েজ ভাঙতে পেরেছিল। কে না জানে, সিআইএ আর এনএসএতে নিরাপত্তাজনিত কিসব কিম্ভূতকিমাকার কোড ব্যবহার করা হয়!
ড্যান ও এড মার্কিন নাগরিক হিসেবে পেন্টাগনে ও জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিতে কাজ করার স্মৃতিচারণা করছিল। কিভাবে তারা প্রভাবিত হয়েছে মার্কিন ভুল নীতির বিপক্ষে। বিবেকের দংশনে তাদের গোপন নথি প্রকাশ করা এবং কিভাবেই বা তাদের জীবন পাল্টে গেল ইত্যাদি।
ড্যান একটু সময় নিয়ে বলতে শুরু করল—‘এটি সত্যি দুঃখের বিষয়, একজন আমেরিকান ও শিক্ষিত সচেতন মানুষ হিসেবে পেন্টাগন ও জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিতে কাজ করেও আমেরিকার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা।’ ওদের দুজনের বক্তব্য প্রায়ই মিলে যায় মানবিকতা ও বিবেকের প্রশ্নে। হঠাৎ করেই তাঁদের মধ্যে এসব বিষয়ে বোধোদয় হয়েছে তা কিন্তু না। এটি শুরু হয়েছে সেই সময় থেকেই, ড্যানিয়েল যখন যুক্তরাষ্ট্রকে সমাজতন্ত্র থেকে মুক্ত করার মিশনে লিপ্ত ছিল। আর স্নোডেনের ক্ষেত্রে হয়েছে মুসলিম সন্ত্রাসবাদ থেকে আমেরিকাকে রক্ষা করার কাজে যোগদানের সময় থেকে।
এডের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ওয়াশিংটনের অন্য রাষ্ট্র ধ্বংস করার ক্ষমতা আর যুদ্ধ জয়ের অক্ষমতা সম্পর্কে। ‘প্রশ্নটা হয়তো একটু রূঢ় হয়েই গেল’, সে সময় এমনই মনে হচ্ছিল আমার, ‘মার্কিনরা শেষ কবে যুদ্ধে জয়লাভ করেছে’? আরো জানতে চেয়েছিলাম, ইরাকের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও গণহত্যার বিষয়ে। কিভাবে সিআইএ জেনেছিল যে ‘বিশ্বে একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে শুধু যুদ্ধই করবে না, বরং রাষ্ট্রের ভেতরেও যুদ্ধ করতে হবে, যার জন্য গণনজরদারি প্রয়োজন। আর প্রশিক্ষিত ও দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও একটি দেশের সেনাবাহিনী প্রশাসক হিসেবে পুলিশ বাহিনীর বিকল্প ভূমিকা পালন করে ইত্যাদি সম্পর্কে। স্নোডেন তার উত্তর শুরু করল একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারির বিষয় থেকে। ‘আমরা যদি কিছু না করেও, একটি সম্পূর্ণ নজরদারির রাষ্ট্রের মধ্যে বাস করি, যেখানে রাষ্ট্রটির মানুষের ওপর শক্তি প্রয়োগ ও সব কিছু জানার অতিমাত্রায় ক্ষমতা হাতে থাকে—তাহলে বিষয়টি হবে ভয়াবহ। এটি হলো অন্ধকার ভবিষ্যৎ। এখানে সত্য হলো, একদল লোক আমাদের সব কিছুর খবর রাখবে অথচ তাদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানব না। এর কারণ তারা গোপনীয় ও সুবিধাভোগী, তারা একটি আলাদা শ্রেণি... অনেকটা সমাজের ধনিক শ্রেণি ও রাজনীতিবিদদের মতো উঁচু স্তরের সম্পদশালী—তারা কোথায় থাকে, কী করে, তাদের বন্ধু কারা কিছুই আমরা জানি না। অথচ আমাদের সম্পর্কে সব কিছু জানার সক্ষমতা রয়েছে তাদের। আর এটিই হলো ভবিষ্যতের নির্দেশনা; কিন্তু আমি মনে করি, এ থেকে পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।’
আমি আশ্চর্য হয়েছি, যদিও স্নোডেনকে জিজ্ঞাসা করিনি—যদি তিনি সাদা না হয়ে কালোদের একজন হতেন, তাহলে তাঁর ভাগ্যে কী ঘটত?
অন্যদিকে ড্যান বলছিল ৯/১১-এর পরের অবস্থা নিয়ে। ‘আসলে ৯/১১-এর পর দৃশ্যপটের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আমেরিকা হয়তো এখনো পুরোপুরি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। তবে আরেকটি নাইন ইলেভেন হলে নিশ্চিত পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এখনকার সাদা মানুষরা হয়তো পুলিশি রাষ্ট্রে বাস করছে না, কিন্তু যারা কালো, মিশ্র, মধ্য-পূর্ব ভাগের মানুষ, তারা কিন্তু ঠিকই এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তিনি ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, পরবর্তী সময় নাইন ইলেভেনের মতো কোনো দুর্ঘটনা হলে তার ফলাফল ভয়াবহ হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতোই তখন শত শত ও হাজার ডিটেনশন ক্যাম্প হবে, অজস্র মানুষ গ্রেপ্তার হবে, মুসলিমদের ধরে ধরে ক্যাম্পে ঢোকানো হবে। আর এটি করা হবে কিন্তু বর্তমানে জনগণের ওপর নজরদারি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই। তারা জানে কাকে দূরে রাখতে হবে—কারণ তথ্য তাদের হাতেই আছে।’
প্রসঙ্গক্রমে আমাদের কথা হয়েছে—যুদ্ধ, লোভ, সন্ত্রাসবাদ, রাষ্ট্র, দেশপ্রেম, পতাকা, জনমত, নৈতিকতা, উদ্বাস্তু সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে। স্নোডেনের ভাগ্যে কী আছে? সে কি কখনো আমেরিকায় ফিরতে পারবে? তার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আমেরিকান সরকার, রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি করার জন্য যেকোনো মূল্যে স্নোডেনকে শাস্তি দিতে চায়। তারা তাকে জেলহাজতে নিতে বা হত্যা করতে না পারলেও সে যেন আরো বেশি তথ্য দিতে না পারে বা যতটুকু ক্ষতি করেছে তা পূরণ করা যায়, তার জন্য আমেরিকা কোনো চেষ্টাই বাদ রাখবে না।
পশ্চিমা মিডিয়ায় আমেরিকাকে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে জননিরাপত্তা বনাম গণনজরদারি নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। এটি কি নৈতিক বা অনৈতিক? এটি ভুল না শুদ্ধ, তথ্য ফাঁসকারীরা দেশপ্রেমিক না দেশদ্রোহী? নৈতিকতার এ সংকীর্ণতা মাপার জন্য অন্য দেশ, সংস্কৃতি আবির্ভূত হচ্ছে—এমনকি তারা মার্কিন আগ্রাসনের শিকার হয়েও।
অদ্ভুতভাবে হলেও, আমি যখন মস্কোর রিত্জ কার্লটনে আমাদের সেই আলাপচারিতার কথা চিন্তা করি, আমার মনে ড্যানিয়েল এলসবার্গের ছবিটিই প্রথম ভেসে ওঠে। আমাদের মধ্যে যে কয় ঘণ্টা আলাপ হয়েছে, সে কয় ঘণ্টা ড্যান বিছানায় চিৎ হয়েই শুয়ে ছিল। খ্রিস্টের মতো তার দুটি হাত দুদিকে প্রসারিত ছিল। আনমনে বলছিল আমেরিকার পরিবর্তনের কথা, ‘শ্রেষ্ঠ মানুষদের’ হয় অবশ্যই জেলে যেতে হবে, নয় নির্বাসনে যাও। তার অশ্রু আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিচ্ছিল। এই অশ্রু সেই মানুষের, যার জীবন এখন সায়াহ্নে। যে একদা প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হতো সেসব মানুষের সঙ্গে, যাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছিল। যে ঠাণ্ডা মাথায় পৃথিবীর জীবন প্রধ্বংসী সব পরিকল্পনা করত, ধারণা দিত। সে-ই সব কিছুর ঝুঁকি নিয়ে শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্যই তথ্য ফাঁস করল। ড্যানের কাছে তার বিরুদ্ধে আসা সব যুক্তির বিপরীতে পাল্টা যুক্তিও ছিল। সে আমেরিকার ইতিহাস ও পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে প্রায়ই ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটি বেছে নিচ্ছিল। পেন্টাগন পেপার জনসম্মুখে নিয়ে আসার ৪০ বছর পরও, সে সময়কার বিশেষ বিশেষ অনেক ব্যক্তিরই মৃত্যু ঘটেছে, কিন্তু তার জীবনযন্ত্র এখনো সচল রয়েছে, এটা সে উপলব্ধি করে। ড্যানিয়েল ও স্নোডেনের মতো সাহসী মানুষ আছে বলেই এখনো মানুষের মঙ্গল হয়। কি অপরাধ তারা করেছে? কেন তারা রাষ্ট্রদ্রোহী? তারা নিজের দেশের ও পৃথিবীর লোকদের কল্যাণের জন্য আত্মত্যাগ করেছে বলে?
ড্যানিয়েলের কান্না আমাকে ভাবিয়েছিল, আমাদের ভালোবাসা, পরাজয়, স্বপ্ন ও সবচেয়ে বেশি আমাদের ব্যর্থতা নিয়ে। দেশের জন্য আমাদের ভালোবাসাটা আসলে কী ধরনের ভালোবাসা? কেমন দেশের স্বপ্ন আমরা সব সময় দেখে এসেছি? কী রকমের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম যে স্বপ্ন ভেঙে গেছে? সর্বোত্তম মহৎ জাতিটির মানবিকতার সক্ষমতা কি ঠিক ততখানি, যতখানি সক্ষমতা তার নিষ্ঠুরতা আর গণহত্যার? একটি দেশের সফলতার উচ্চতা কি এটাই নির্দেশ করে না যে ঠিক ততটুকুই তার নৈতিকতার পতনের গভীরতা? এবং কি আমাদের ব্যর্থতা? লেখক, শিল্পী, মৌলবাদী, বিশ্ব নাগরিক, বাউন্ডুলে, অসন্তুষ্ট বিদ্রোহীরা আমাদের স্বপ্ন আমাদের কল্পনা ব্যর্থতা কি? আমাদের ব্যর্থতায় কী ছিল যে শুধু দেশ ও পতাকার ধারণার সঙ্গে ভালোবাসার মতো নিষ্পাপ ধারণাকে এক করতে পারিনি? সব কিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, মানুষ যুদ্ধ ছাড়া টিকে থাকতে অক্ষম, আবার তারাই ভালোবাসা ছাড়াও বেঁচে থাকতে অক্ষম? সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে—‘কী আমাদের ভালোবাসা উচিত?’
এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন হাজার হাজার রিফিউজি ইউরোপজুড়ে বন্যার মতো প্লাবিত হচ্ছে। যার জন্য দায়ী দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা ও ইউরোপের বিদেশনীতি। তাহলে স্নোডেনও কি রিফিউজি, হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি একজন রিফিউজি। কারণ তিনি যা করেছেন তার জন্য মাতৃভূমিতে ফিরতে পারছেন না। বর্তমানে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া থেকে লাখো কোটি মানুষ তার মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। জীবনযাত্রা পরিবর্তনের এক অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আরেকজন রিফিউজির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, জানামতে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রিফিউজি! জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ! যে চতুর্থ বছরের মতো লন্ডনের ইকুয়েডরিয়ান এমবাসিতে পলাতক অতিথি হিসেবে জীবন যাপন করছে। এখন পর্যন্ত যার দরজার ঠিক সামনে ছোট্ট লবিতে অস্ত্র হাতে পুলিশ মোতায়েন করা আছে, ছাদে আছে স্নাইপার। তাকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে, তাকে গুলি করার অর্ডার নিয়ে। টেনেহিঁচড়ে তাকে বের করে নিয়ে আসা হবে, যদি সে পায়ের বুড়ো আঙুলটাও বাইরে বের করে। হ্যাঁ, এটাই আমাদের আন্তর্জাতিক সীমান্তের প্রচলিত বৈধ আইন!
নিজের দেশ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের কাছে এই মানুষগুলোর পরিচয় হয়েছে ‘রিফিউজি’ হিসেবে। এটি আমাদের জন্য লজ্জার।
http://www.kalerkantho.com/print-edition/doshdik/2016/01/15/313371
Comment