বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ: শঙ্কা এখনও আনসার আল ইসলামকে নিয়ে
বাংলাদেশে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই কোণঠাসা অবস্থায় থাকলেও শঙ্কা এখনও আনসার আল ইসলামকে নিয়ে। আন্তর্জাতিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার অনুসারী আনসার আল ইসলামকে ভারতীয় উপমহাদেশের আল-কায়েদার শাখা একিউআইএস (আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট) হিসেবেও বলা হয়। বিগত কয়েক বছর ধরে এই সংগঠনের সহিংস কর্মকাণ্ড না থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আনসার আল ইসলাম ভেতরে ভেতরে সুসংগঠিত হওয়ার কাজ করছে। তারা যদি আবারও সহিংস কর্মকাণ্ডে ফিরে আসে তবে বাংলাদেশের জন্য তা বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদিও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের শীর্ষ কর্মকর্তা ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, বাংলাদেশে সক্রিয় জঙ্গিবাদ এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ধারাবাহিক অভিযানের কারণে সক্রিয় সংগঠনগুলো এখন কোণঠাসা অবস্থায় আছে। তাদের অর্থায়ন থেকে শুরু করে হামলার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ, সদস্য রিক্রুটমেন্ট সবকিছুতেই ভাটা পড়েছে। ফলে কোনও জঙ্গি সংগঠনেরই এখন আর আগের মতো সহিংসভাবে ফেরার মতো অবস্থায় নেই। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, নব্য জেএমবি নামে যে সংগঠনটি ছিল তার শীর্ষ নেতাসহ প্রায় সব সদস্যকেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আনসার আল ইসলাম ও পুরানো জেএমবির দু’জন শীর্ষ নেতা এখনও পলাতক। আমরা তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। আমাদের নজরদারির কারণে তারা সক্রিয় হতেও পারছে না। এছাড়া জঙ্গি সংগঠনগুলো যে অল্প-বিস্তর অনলাইনে কার্যক্রম চালাচ্ছে, সেখানেও আমরা নিয়মিত সাইবার পেট্রোলিং করছি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণ করে আসা বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে আনসার আল ইসলামের সদস্যরা অন্যান্য সংগঠনের তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত। এই দলের সদস্যরা অন্যদের তুলনায় শিক্ষিত ও প্রযুক্তি সম্পর্কে অধিক জ্ঞানসম্পন্ন। এই দলের শীর্ষ নেতা পলাতক সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়াও অনেক বেশি প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞানসম্পন্ন। ফলে সংগঠনের সদস্যদেরও সে সেভাবেই তৈরি করেছে। একসময় সেনাবাহিনীর চৌকস কমান্ডো অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকা জিয়া নিজের দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগ করে তার সদস্যদেরও অনেক বেশি দক্ষ করার চেষ্টা করছে। ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর ২০১১ সালের ডিসেম্বরে জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করার পর থেকেই সে পলাতক রয়েছে। প্রথম দিকে জিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের আরেক নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা শোনা গেলেও তিনি ২০১৩ সাল থেকে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। জিয়ার নির্দেশনা এবং শেখানো কৌশলেই ওই বছর থেকে দেশে ‘টার্গেটেড কিলিং’ শুরু হয়েছিল। আনসার আল ইসলাম আগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৫ সালের ২৬ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা থেকে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর সংগঠনটি আনসার আল ইসলাম নামে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১৭ সালের ৫ মার্চ আনসার আল ইসলামের কার্যক্রমকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এই সংগঠনের টার্গেট গ্রুপ হলো ব্লগার, নাস্তিক, সেক্যুলার, রাজনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল ঢাকার কলাবাগানের বাসায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএস এইড কর্মকর্তা ও সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী তনয়কে হত্যার পর এই সংগঠনকে আর কোনও সহিংস কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে দেখা যায়নি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আনসার আল ইসলাম সাংগঠনিকভাবে এখন সহিংস কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সদস্য সংগ্রহ, সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও সংগঠিত করার কাজ করছে। আগে তারা ‘টার্গেটেড কিলিং’ পরিচালনা করলেও ভবিষ্যতে আরও বেশি ধ্বংসাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্লিপার সেল গঠন করে চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম তাদের কার্যক্রমের পুরোটাই এখন চালাচ্ছে স্লিপার সেল গঠন করে। একেকটি স্লিপার সেলের সদস্য সংখ্যা ৪-৬ জন। শীর্ষ নেতা জিয়া নিজের সামরিক প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে সদস্যদের ‘গেরিলা যোদ্ধা’ হিসেবে প্রস্তুত করছে। প্রতিটি স্লিপার সেলের সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনও তথ্য শেয়ার করে না। যাতে কেউ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও সহযোগী কারও ক্ষতি না হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আনসার আল ইসলাম কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে সংগঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দাওয়াহ বিভাগের কাজ হলো সংগঠনের জন্য নতুন সদস্য সংগ্রহ করা। এছাড়া এই বিভাগের কাজ হলো সংগঠনের সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা। তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষদের মিডিয়া শাখায় নিয়োগ দেওয়া হয়। মতাদর্শ প্রচার চালানো ছাড়াও তাদের কাজ হলো সদস্যদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়াদি দেখা। আনসার আল ইসলামের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিভাগ হলো আসকারী শাখা। এই শাখার সদস্যরা সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে হামলায় অংশ নেয়। আসকারী শাখায় মাশুল ও মামুর নামে দুটি গ্রুপ থাকে। মাশুল সদস্যরা হামলার পরিকল্পনা সাজায়। এর উপশাখার সদস্যদের ইন্টেল গ্রুপ বলা হয়। তারা আগে থেকেই টার্গেট সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। সবশেষে মামুর গ্রুপের সদস্যরা সরাসরি হামলায় অংশ নেয়। অ্যান্টি-টেরোরিজম ইউনিটের গোয়েন্দা শাখার পুলিশ সুপার হাসপানুল জাহিদ বলছেন, আনসার আল ইসলাম সম্পর্কে যতটা শঙ্কার কথা বলা হচ্ছে ততটা শক্তি তাদের নেই। তারা অন্য সংগঠনের চেয়ে একটু বেশি সংগঠিত এটা ঠিক। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে তারা ছন্নছাড়া অবস্থা হয়ে আছে। তাদের এখন সুরা কমিটিই নেই। শীর্ষ নেতৃত্ব পলাতক। এই অবস্থায় নতুন করে আনসার আল ইসলাম পুরানো চেহারা নিয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনা কম।
সূত্র: https://www.banglatribune.com/others...A6%95%E0%A7%87
Comment