যেভাবে হত্যা করা হয় নাজিমুদ্দিন কে
০৮ এপ্রিল ২০১৬, ০২:০৪ পূর্বাহ্ন
ঢাকা: পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাঁটাপথ সূত্রাপুরের হৃষিকেশ দাস রোডে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদকে হত্যা করা হয় বুধবার রাত সাড়ে আটটার দিকে। সন্ধ্যায় ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন আইন বিভাগের এই ছাত্র। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ব্যস্ত রাস্তটির পাশে এবং শুকনো নর্দমায় ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে রয়েছে। জায়গাটুকু ইটের টুকরো দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
হত্যাকান্ডের সময় এই রাস্তার দু’পাশে দোকান পাটের অধিকাংশই খোলা ছিল। সব ধরণের যানবাহন চলাচল করছিল।
ছোট যে দর্জির দোকানের সিঁড়ির কাছেই নাজিম উদ্দিনের নিথর দেহ পড়ে ছিল, দোকানের মালিক হত্যাকান্ডের সময় দোকানে একাই ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “হঠাৎ দেখি রাস্তায় মানুষ ভয়ে ছোটাছুটি করছে আর ঐ যুবকটিকে চার পাঁচ জন মিলে কোপাচ্ছে। পিস্তলের গুলির শব্দও হলো। তখন দেখি, আশে পাশের সব দোকানের সাটার নামাচ্ছে। আমিও সাটার নামিয়ে দোকানের ভিতরে বসে ছিলাম"। আশপাশের মানুষজন যখন আতঙ্কে ছোটাছুটি করছ্নে। আর তখনই হত্যাকারীরা খুব সহজে মানুষের ভিড়ে মধ্যে মিশে পালিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার সারাদিন ধরেই নাজিমুদ্দিনের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী
হৃষিকেশ রোডের চুলকাটার দোকান ও পাশের মিষ্টির দোকানের কর্মচারীরা জানান, আতংকে মানুষ ছোটাছুটি করলে মুহূর্তেই ঐ এলাকা ফাঁকা হয়ে যায়। নাজিম উদ্দিনের মৃতদেহ রাস্তার পাশে নর্দমার কাছে পড়ে থাকে। কাছের এক দোকানদার বলেন, ঘটনা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি তার দোকানের কাছে এসে দেখেন যুবকটির মাথায় গভীর আঘাতের চিহ্ন। সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। আর মানুষটি হা করে আছে। পা পূর্ব দিকে এবং মাথা রয়েছে পশ্চিম দিকে। হামলার পরপরই সে মারা যায় বলে ঐ দোকানদারের ধারণা। ঐ দোকান মালিক জানান, ঘটনার পঁচিশ মিনিট পর পুলিশ এসে মৃতদেহটি মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন ঐ এলাকার সব ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে দ্রুত বাড়িতে চলে যান।
সূত্রাপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তপন চন্দ্র সাহা বলেন, তারা খবর পাওয়ার সাথে সাথেই ঘটনাস্থলে যান। পুলিশ সেখানকার ব্যবসায়ীদের মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনে তদন্ত শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাজিমুদ্দিনের ময়না তদন্ত শেষ হয়। রাতেই নিহতের লন্ডন প্রবাসী ভাই এসে মৃতদেহ সিলেটের বিয়ানীবাজারে তাদের গ্রামে নিয়ে যাবেন বলে জানা গেছে। কট্টর ইসলামকে সমালোচনা করে অনলাইনে লেখালেখি করতেন নাজিমুদ্দিন। লেখালেখির কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে কিনা পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে।
নাজিমুদ্দিনকে নিয়ে পরিবার শংকায় থাকতো
ঢাকা: রাজধানীর পুরান ঢাকায় বুধবার রাতে হত্যাকান্ডের শিকার নাজিমুদ্দিন সামাদের লন্ডন-প্রবাসী বড় ভাই শামিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছেন, ভাইয়ের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের আশঙ্কা ছিল।
শামিম উদ্দিন আরো বলেছেন, ফেসবুকে লেখালেখি না করতে প্রায়ই তাকে বারণ করতেন তিনি। "সে ঠিক কি লিখতো আমি নিজে কখনো পড়েনি, কিন্তু আত্মীয়দের মুখে শুনেছি সে ধর্ম নিয়ে লিখতো। টেলিফোনে কথা হলেই নিষেধ করতাম"।
পরিবারের চাপে ফেসবুক একাউন্ট কিছুদিন বন্ধও রেখেছিলেন নাজিমউদ্দিন। তবে বড় ভাইদের কাছে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে কখনো তেমন কোনো শঙ্কা প্রকাশ করেননি। সিলেটে তার ছেলেবেলার একজন বন্ধু গোলাম রাব্বি চৌধুরীও জানিয়েছেন, নাজিমুদ্দিন কিছুদিন তার ফেসবুক একাউন্ট 'ডি-অ্যাকটিভেট' করে রেখেছিলো।
"ফেব্রুয়ারি মাসে তার সাথে আমার শেষ দেখা হয়, তখন আমি, তাকে ঠাট্টা করে বলেছিলাম কি রে তোর বিপ্লব বন্ধ হয়ে গেল...সে বলেছিলো তাড়াতাড়ি আবার ফেসবুকে ফিরে আসবে।"
নাজিমুদ্দিন কোনো ব্লগ সাইটে নিয়মিত লেখালেখি করতেন না। তার লেখালেখি ছিল মূলত তার ফেসবুক পাতায়। ফেসবুকে সাম্প্রতি তার কিছু স্টেটাসে দেখা গেছে ধর্মান্ধতা এবং ইসলামের কট্টর ব্যাখ্যা নিয়ে খোলাখুলি সমালোচনা রয়েছে। অনেক লেখায় জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিয়ে ও সমালোচনা করেছেন তিনি।
মার্চের ২৮ তারিখে একটি স্টেটাসে নাজিমুদ্দিন লিখেছিলেন, " রাষ্ট্রধর্ম দেখে কেউ করিস না ভয়, আড়ালে তার ইসলামী জঙ্গি হাসে।" ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করার বিরুদ্ধে পিটিশনটি সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তিনি সম্ভবত এই স্টেটাসটি লিখেছিলেন।
মার্চের ৩০ তারিখে দীর্ঘ একটি স্টেটাসের অংশবিশেষ ছিল এরকম :"শুধু একবার পাঁচ বছরের জন্য পরীক্ষামুলকভাবে দেশে শারিয়াহ আইন চালু করা হোক....গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি পাঁচ বছর পর কোনো মুসলিম ইহজীবনে আর ইসলামের নাম মুখে আনবে না...।
সিলেটে বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ নামে একটি সংগঠনের সাথে নাজিম উদ্দিন জড়িত ছিলেন। এছাড়া, সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের সাথেও সক্রিয় ছিলেন তিনি।
নাজিমুদ্দিনের ভাই শামিম উদ্দিন জানান, গত মঙ্গলবার টেলিফোনে তিনি জানিয়ে ছিলেন বুধবার অসুস্থ মাকে দেখতে তিনি গ্রামে যাবেন। "আমাদের বাবা নাই, আমরা দুই ভাই লন্ডনে। দুই বোন এবং অসুস্থ মাকে দেখাশোনার জন্য তার ওপরই আমরা ভরসা করতাম।"
ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য কাকে দায়ী করেন তিনি? এই প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শামিম উদ্দিন বলেন, "যারা মেরেছে তাদেরই দায়ী করবো...ইসলাম তো নষ্ট হয়না, মানুষ নষ্ট হয়।"
নাজিমুদ্দিনের বড় দুই ভাইয়ের এক ভাই বুধবার রাতেই বাংলাদেশ রওয়ানা হয়ে গেছেন। মা এবং বোনরা থাকেন সিলেটের বিয়ানীবাজারের মাটিজুয়া গ্রাম। ময়দা তদন্তের পর পরিবারে সেখানেই তাকে দাফনের পরিকল্পনা করেছে। সূত্র বিবিসি।
খুনীদের গ্রেপ্তারে আল্টিমেটাম, জবিতে রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের ছাত্রধর্মঘটের ডাক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদের হত্যাকারীদের গ্রেফতারে আল্টিমেটাম দিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শনিবার রাত ১২টার মধ্যে হত্যাকারীদেরকে গ্রেফতার না করলে রোববার রোববার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়। সকাল ৯টা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বর থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মিছিল নিয়ে তারা ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন। এরপর দুপুর ১২টার দিকে তারা মিছিল নিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক, রায়সাহেব বাজার, লক্ষ্মীবাজার ঘুরে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে জড়ো হন। এসময় তারা সদরঘাট-গুলিস্তান সড়ক অবরোধ করে আগুন জালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। দুপুর ২টা পর্যন্ত তারা এ কর্মসূচি পালন করেন। এতে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দেন। তারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ ও হত্যাকারীদেরকে গ্রেফতারের দাবি জানান। বিক্ষোভ শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতারা হত্যাকারীদের গ্রেফতারে শনিবার রাত ১২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। এর মধ্যে তাদেরকে গ্রেফতার না করা হলে রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক ছাত্রধর্মঘট এবং পরবর্তীতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথাও বলেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হামলাকারীদেরকে শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশের প্রতি আহবান জানিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অফিস থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
নাজিম হত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র নিন্দা
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যার ঘটনাকে নৃশংস ও বর্বরোচিত উল্লেখ করে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বৃহস্পতিবার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি স্পোকসপারসন মার্ক টেনার এ নিন্দার কথা জানান।
নাজিম হত্যার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মার্ক টেনার বলেন, বাংলাদেশে সংঘটিত অতীতের ঘটনাগুলোর দায় ভারতীয় উপমহাদেশের আল কায়েদা স্বীকার করেছে। নাজিম হত্যায় কারা জড়িত সে তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ হত্যার দায় এখনও কেউ স্বীকার করেনি। তাই, এ মুহূর্তে আমরা পরিস্কার করে কিছু বলতে পারছি না।
নাজিমুদ্দিন হত্যার নিন্দায় জাতিসঙ্ঘ-ইইউ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে হত্যার নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাতিসঙ্ঘের আবাসিক প্রতিনিধি।
বৃহস্পতিবার দেয়া এক বিবৃতিতে ইইউ রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু এই হত্যাকাণ্ডকে নৃশংস হিসাবে আখ্যায়িত করে ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।
তিনি বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। এই অধিকার রক্ষায় সহিষ্ণুতা ও ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। ভয়ভীতির ঊর্দ্ধে উঠে মুক্তভাবে মত প্রকাশের বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতাকে ইইউ সমর্থন করে।
রাষ্ট্রদূত মায়াদু নিহত নাজিমুদ্দিন সামাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। এ ঘটনার তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
জাতিসঙ্ঘের আবাসিক প্রতিনিধির পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, তিন বছর আগে অনলাইন অক্টিভিস্ট হত্যার শুরু থেকে জাতিসঙ্ঘ এ ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। এসব ঘটনা পুঙ্খনাপুঙ্খ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার আহবান জাতিসঙ্ঘ অব্যাহত রেখেছে।
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট হত্যাকাণ্ড সাময়িকভাবে বিরতির পর নাজিমুদ্দিন সামাদ খুনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার বিষয়টি প্রতীয়মান হললো। রাজিব হায়দার হত্যার দুই বছর পর আদালত চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি রায় দিয়েছে, যা জাতিসঙ্ঘের নজরে এসেছে। ঝুঁকিতে থাকা অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের যথাযথ সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের প্রতি জাতিসঙ্ঘ আবারো আহবান জানাচ্ছে।
২৭ বছর বয়সী নাজিমুদ্দিন সামাদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বুধবার রাত ৯টার দিকে বাসায় ফেরার সময় সূত্রাপুরের একরামপুরে দুর্বৃত্তরা তাকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে
ব্লগারদের আশ্রয় দেয়ার চিন্তা করছে মার্কিন সরকার
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদকে হত্যার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এমন কয়েকজন বেছে নেয়া ব্লগারকে আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে মার্কিন সরকার। এ খবর দিয়েছে বার্তাসংস্থা এপি।
ডিসেম্বরে আমেরিকা ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো মার্কিন সরকারের কাছে বাংলাদেশি লেখকদের মানবিক আশ্রয় প্রদানের আহ্বান জানিয়েছিল।
সামাদ হত্যাকাণ্ডের পর পেন আমেরিকার কারিন ডয়েচ কারলেকার আবারও মার্কিন সরকারের কাছে তার আবেদন পুনর্ব্যক্ত করেন।
সামাদের ‘বর্বর হত্যাকাণ্ডের’ তীব্র নিন্দা জানান মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মার্ক টোনার। তিনি সাংবাদিকদের জানান, ‘সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশী জনগণের লড়াইয়ে অকৃত্তিম সমর্থন থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের। তিনি বলেন, ‘তাৎক্ষণিক বিপদে’র মুখোমুখি, এমন বেছে নেয়া কয়েকজন ব্লগারকে মানবিক আশ্রয়ের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এ ধরণের প্রশ্ন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টকে করার জন্য বলেন তিনি। মার্কিন সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসের প্রেস সেক্রেটারি শিন ইনোয়ে মানবিক আশ্রয়ের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট অনুরোধের বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। এ ক্ষেত্রে গোপনীয়তা নীতির বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি। প্রসঙ্গত, ভীষণ জরুরি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে কোন ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া ও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে ‘হিউম্যান প্যারোল’ ব্যবহৃত হয়।
শেষ স্ট্যাটাসে যা লিখেছিলেন নাজিম
সামাদ হত্যার আগ পর্যন্ত তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন। দেশ ও সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সব সময়ই সরব ছিলেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের ধারণা, সমাজের বিভিন্ন প্রতিবাদী পোস্ট ও স্ট্যাটাসের কারণেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এ হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তার হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)। গতকাল সংগঠনের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রাকিবের স্বারিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়।
নাজিমের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ৫ এপ্রিল মঙ্গলবার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করেন নাজিমুদ্দিন। সেখানে তিনি লিখেন, ‘সরকার, এবার একটু নড়েচড়ে বসো বাবা। দেশের যা অবস্থা, আইনশৃঙ্খলার যা অবনতি, তাতে গদিতে বেশি দিন থাকা সম্ভব হবে না। জনরোষ বলে একটা কথা আছে। এটার চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে না চাইলে এুনি কঠোর পদপে নেয়া দরকার সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। নতুবা দিন ফুরিয়ে আসবে খুব দ্রুত।’
এই পোস্টের বিষয়ে সেখানে সামাদের এক বন্ধু প্রশ্ন করেন, ‘আদৌ কি কিছু হবে?’ জবাবে নাজিমুদ্দিন বলেন, ‘সেটাই প্রশ্ন। আদৌ কি সরকারের টনক নড়বে!’
এর মধ্যে গত ২ এপ্রিল নাজিমুদ্দিন সামাদ লিখেন, ‘আওয়ামী ওলামা লীগ আর বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দুই বিপরীত মেরুর দুই বাসিন্দা। ওলামা লীগ কখনোই বাহাত্তরের ধর্মনিরপে সংবিধান চায়নি এবং চাইবে না।’ ফেসবুকে দেখা যায়, সামাদের পরিচিত ও বন্ধুরা সেখানে তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিজেদের মন্তব্য দিচ্ছেন। তাদের বেশির ভাগেরই দাবি, বিভিন্ন সময়ে সামাদের করা সত্যভাষণই তার বেঁচে থাকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাজিম তার ফেসবুক পেইজে দেশের আইনশৃঙ্খলা অবনতি নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। তার স্ট্যাটাসের নিচে আজহারুল ইসলাম নামে এক স্যার লিখেছেন, ‘তোমার জন্য ভয় হয় নাজিম। একটু সাবধানে থাকো। দেখতেই তো পাচ্ছ কী হচ্ছে। সাবধানে থেকো।’ জবাবে নাজিমুদ্দিন লিখেছে, ‘ভয় আমার নিজেরও হয় স্যার। অকালে মরে যাওয়ার ভয়। কিন্তু কী করবো স্যার। মাথা নত করে চুপ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে এ মরণই বোধ হয় ভালো।’
ফেসবুকে আইনশৃঙ্খলা অবনতির বিষয়ে সরকারের কঠোর পদপে চেয়ে স্ট্যাটাস দেয়ার ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই খুন হন নাজিমুদ্দিন। তার খুন হওয়ার খবর শুনে স্ট্যাটাসে অগ্নি সারথি নামে এক ফেসবুক বন্ধু লিখেছেন, ‘নাজিমুদ্দিন ভাইয়ের সাথে গত কয়েক দিন আগে চ্যাটিং হলো। উনার আশঙ্কাই আজ নির্মমভাবে সত্যি হলো। আর কত?’
বোয়াফের সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময় বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, রাষ্ট্রযন্ত্রের নাকের ডগায় একের পর এক দেশের মেধাবী নতুন প্রজন্মকে হত্যার যে অপসংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে তা দেশ, জাতি ও আগামী প্রজন্মের জন্য অশুভ সঙ্কেত। এই ধরনের ঘটনা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখানে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন হত্যা, সেখানে তনু হত্যা, ও ওইখানে মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী হত্যা, কৃষ্ণকলির বাসায় জান্নাত হত্যা, ছাত্রলীগকর্মী হত্যাকাণ্ড, হত্যার এই মহোৎসব অচিরেই বন্ধ ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে হয়তো এই লাশের মিছিলে আমাদের কারো না কারো মরদেহ কোনো এক সময় খুঁজে পাওয়া যাবে। অন্যথায় আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হবে নতুন প্রজন্ম।
নাজিমুদ্দিন সামাদের হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেফতার এবং এই হত্যার মহোৎসব নির্মূল করার ল্েয সরকারসহ সমাজের সচেতন মহলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান বোয়াফ সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময়।
সূত্রঃ
০৮ এপ্রিল ২০১৬, ০২:০৪ পূর্বাহ্ন
ঢাকা: পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাঁটাপথ সূত্রাপুরের হৃষিকেশ দাস রোডে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদকে হত্যা করা হয় বুধবার রাত সাড়ে আটটার দিকে। সন্ধ্যায় ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন আইন বিভাগের এই ছাত্র। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ব্যস্ত রাস্তটির পাশে এবং শুকনো নর্দমায় ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে রয়েছে। জায়গাটুকু ইটের টুকরো দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
হত্যাকান্ডের সময় এই রাস্তার দু’পাশে দোকান পাটের অধিকাংশই খোলা ছিল। সব ধরণের যানবাহন চলাচল করছিল।
ছোট যে দর্জির দোকানের সিঁড়ির কাছেই নাজিম উদ্দিনের নিথর দেহ পড়ে ছিল, দোকানের মালিক হত্যাকান্ডের সময় দোকানে একাই ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “হঠাৎ দেখি রাস্তায় মানুষ ভয়ে ছোটাছুটি করছে আর ঐ যুবকটিকে চার পাঁচ জন মিলে কোপাচ্ছে। পিস্তলের গুলির শব্দও হলো। তখন দেখি, আশে পাশের সব দোকানের সাটার নামাচ্ছে। আমিও সাটার নামিয়ে দোকানের ভিতরে বসে ছিলাম"। আশপাশের মানুষজন যখন আতঙ্কে ছোটাছুটি করছ্নে। আর তখনই হত্যাকারীরা খুব সহজে মানুষের ভিড়ে মধ্যে মিশে পালিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার সারাদিন ধরেই নাজিমুদ্দিনের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী
হৃষিকেশ রোডের চুলকাটার দোকান ও পাশের মিষ্টির দোকানের কর্মচারীরা জানান, আতংকে মানুষ ছোটাছুটি করলে মুহূর্তেই ঐ এলাকা ফাঁকা হয়ে যায়। নাজিম উদ্দিনের মৃতদেহ রাস্তার পাশে নর্দমার কাছে পড়ে থাকে। কাছের এক দোকানদার বলেন, ঘটনা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি তার দোকানের কাছে এসে দেখেন যুবকটির মাথায় গভীর আঘাতের চিহ্ন। সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। আর মানুষটি হা করে আছে। পা পূর্ব দিকে এবং মাথা রয়েছে পশ্চিম দিকে। হামলার পরপরই সে মারা যায় বলে ঐ দোকানদারের ধারণা। ঐ দোকান মালিক জানান, ঘটনার পঁচিশ মিনিট পর পুলিশ এসে মৃতদেহটি মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন ঐ এলাকার সব ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে দ্রুত বাড়িতে চলে যান।
সূত্রাপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তপন চন্দ্র সাহা বলেন, তারা খবর পাওয়ার সাথে সাথেই ঘটনাস্থলে যান। পুলিশ সেখানকার ব্যবসায়ীদের মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনে তদন্ত শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাজিমুদ্দিনের ময়না তদন্ত শেষ হয়। রাতেই নিহতের লন্ডন প্রবাসী ভাই এসে মৃতদেহ সিলেটের বিয়ানীবাজারে তাদের গ্রামে নিয়ে যাবেন বলে জানা গেছে। কট্টর ইসলামকে সমালোচনা করে অনলাইনে লেখালেখি করতেন নাজিমুদ্দিন। লেখালেখির কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে কিনা পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে।
নাজিমুদ্দিনকে নিয়ে পরিবার শংকায় থাকতো
ঢাকা: রাজধানীর পুরান ঢাকায় বুধবার রাতে হত্যাকান্ডের শিকার নাজিমুদ্দিন সামাদের লন্ডন-প্রবাসী বড় ভাই শামিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছেন, ভাইয়ের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের আশঙ্কা ছিল।
শামিম উদ্দিন আরো বলেছেন, ফেসবুকে লেখালেখি না করতে প্রায়ই তাকে বারণ করতেন তিনি। "সে ঠিক কি লিখতো আমি নিজে কখনো পড়েনি, কিন্তু আত্মীয়দের মুখে শুনেছি সে ধর্ম নিয়ে লিখতো। টেলিফোনে কথা হলেই নিষেধ করতাম"।
পরিবারের চাপে ফেসবুক একাউন্ট কিছুদিন বন্ধও রেখেছিলেন নাজিমউদ্দিন। তবে বড় ভাইদের কাছে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে কখনো তেমন কোনো শঙ্কা প্রকাশ করেননি। সিলেটে তার ছেলেবেলার একজন বন্ধু গোলাম রাব্বি চৌধুরীও জানিয়েছেন, নাজিমুদ্দিন কিছুদিন তার ফেসবুক একাউন্ট 'ডি-অ্যাকটিভেট' করে রেখেছিলো।
"ফেব্রুয়ারি মাসে তার সাথে আমার শেষ দেখা হয়, তখন আমি, তাকে ঠাট্টা করে বলেছিলাম কি রে তোর বিপ্লব বন্ধ হয়ে গেল...সে বলেছিলো তাড়াতাড়ি আবার ফেসবুকে ফিরে আসবে।"
নাজিমুদ্দিন কোনো ব্লগ সাইটে নিয়মিত লেখালেখি করতেন না। তার লেখালেখি ছিল মূলত তার ফেসবুক পাতায়। ফেসবুকে সাম্প্রতি তার কিছু স্টেটাসে দেখা গেছে ধর্মান্ধতা এবং ইসলামের কট্টর ব্যাখ্যা নিয়ে খোলাখুলি সমালোচনা রয়েছে। অনেক লেখায় জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিয়ে ও সমালোচনা করেছেন তিনি।
মার্চের ২৮ তারিখে একটি স্টেটাসে নাজিমুদ্দিন লিখেছিলেন, " রাষ্ট্রধর্ম দেখে কেউ করিস না ভয়, আড়ালে তার ইসলামী জঙ্গি হাসে।" ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করার বিরুদ্ধে পিটিশনটি সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তিনি সম্ভবত এই স্টেটাসটি লিখেছিলেন।
মার্চের ৩০ তারিখে দীর্ঘ একটি স্টেটাসের অংশবিশেষ ছিল এরকম :"শুধু একবার পাঁচ বছরের জন্য পরীক্ষামুলকভাবে দেশে শারিয়াহ আইন চালু করা হোক....গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি পাঁচ বছর পর কোনো মুসলিম ইহজীবনে আর ইসলামের নাম মুখে আনবে না...।
সিলেটে বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ নামে একটি সংগঠনের সাথে নাজিম উদ্দিন জড়িত ছিলেন। এছাড়া, সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের সাথেও সক্রিয় ছিলেন তিনি।
নাজিমুদ্দিনের ভাই শামিম উদ্দিন জানান, গত মঙ্গলবার টেলিফোনে তিনি জানিয়ে ছিলেন বুধবার অসুস্থ মাকে দেখতে তিনি গ্রামে যাবেন। "আমাদের বাবা নাই, আমরা দুই ভাই লন্ডনে। দুই বোন এবং অসুস্থ মাকে দেখাশোনার জন্য তার ওপরই আমরা ভরসা করতাম।"
ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য কাকে দায়ী করেন তিনি? এই প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শামিম উদ্দিন বলেন, "যারা মেরেছে তাদেরই দায়ী করবো...ইসলাম তো নষ্ট হয়না, মানুষ নষ্ট হয়।"
নাজিমুদ্দিনের বড় দুই ভাইয়ের এক ভাই বুধবার রাতেই বাংলাদেশ রওয়ানা হয়ে গেছেন। মা এবং বোনরা থাকেন সিলেটের বিয়ানীবাজারের মাটিজুয়া গ্রাম। ময়দা তদন্তের পর পরিবারে সেখানেই তাকে দাফনের পরিকল্পনা করেছে। সূত্র বিবিসি।
খুনীদের গ্রেপ্তারে আল্টিমেটাম, জবিতে রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের ছাত্রধর্মঘটের ডাক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদের হত্যাকারীদের গ্রেফতারে আল্টিমেটাম দিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শনিবার রাত ১২টার মধ্যে হত্যাকারীদেরকে গ্রেফতার না করলে রোববার রোববার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়। সকাল ৯টা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বর থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মিছিল নিয়ে তারা ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন। এরপর দুপুর ১২টার দিকে তারা মিছিল নিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক, রায়সাহেব বাজার, লক্ষ্মীবাজার ঘুরে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে জড়ো হন। এসময় তারা সদরঘাট-গুলিস্তান সড়ক অবরোধ করে আগুন জালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। দুপুর ২টা পর্যন্ত তারা এ কর্মসূচি পালন করেন। এতে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দেন। তারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ ও হত্যাকারীদেরকে গ্রেফতারের দাবি জানান। বিক্ষোভ শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতারা হত্যাকারীদের গ্রেফতারে শনিবার রাত ১২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। এর মধ্যে তাদেরকে গ্রেফতার না করা হলে রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক ছাত্রধর্মঘট এবং পরবর্তীতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথাও বলেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হামলাকারীদেরকে শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশের প্রতি আহবান জানিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অফিস থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
নাজিম হত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র নিন্দা
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যার ঘটনাকে নৃশংস ও বর্বরোচিত উল্লেখ করে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বৃহস্পতিবার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি স্পোকসপারসন মার্ক টেনার এ নিন্দার কথা জানান।
নাজিম হত্যার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মার্ক টেনার বলেন, বাংলাদেশে সংঘটিত অতীতের ঘটনাগুলোর দায় ভারতীয় উপমহাদেশের আল কায়েদা স্বীকার করেছে। নাজিম হত্যায় কারা জড়িত সে তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ হত্যার দায় এখনও কেউ স্বীকার করেনি। তাই, এ মুহূর্তে আমরা পরিস্কার করে কিছু বলতে পারছি না।
নাজিমুদ্দিন হত্যার নিন্দায় জাতিসঙ্ঘ-ইইউ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে হত্যার নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাতিসঙ্ঘের আবাসিক প্রতিনিধি।
বৃহস্পতিবার দেয়া এক বিবৃতিতে ইইউ রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু এই হত্যাকাণ্ডকে নৃশংস হিসাবে আখ্যায়িত করে ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।
তিনি বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। এই অধিকার রক্ষায় সহিষ্ণুতা ও ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। ভয়ভীতির ঊর্দ্ধে উঠে মুক্তভাবে মত প্রকাশের বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতাকে ইইউ সমর্থন করে।
রাষ্ট্রদূত মায়াদু নিহত নাজিমুদ্দিন সামাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। এ ঘটনার তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
জাতিসঙ্ঘের আবাসিক প্রতিনিধির পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, তিন বছর আগে অনলাইন অক্টিভিস্ট হত্যার শুরু থেকে জাতিসঙ্ঘ এ ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। এসব ঘটনা পুঙ্খনাপুঙ্খ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার আহবান জাতিসঙ্ঘ অব্যাহত রেখেছে।
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট হত্যাকাণ্ড সাময়িকভাবে বিরতির পর নাজিমুদ্দিন সামাদ খুনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার বিষয়টি প্রতীয়মান হললো। রাজিব হায়দার হত্যার দুই বছর পর আদালত চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি রায় দিয়েছে, যা জাতিসঙ্ঘের নজরে এসেছে। ঝুঁকিতে থাকা অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের যথাযথ সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের প্রতি জাতিসঙ্ঘ আবারো আহবান জানাচ্ছে।
২৭ বছর বয়সী নাজিমুদ্দিন সামাদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বুধবার রাত ৯টার দিকে বাসায় ফেরার সময় সূত্রাপুরের একরামপুরে দুর্বৃত্তরা তাকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে
ব্লগারদের আশ্রয় দেয়ার চিন্তা করছে মার্কিন সরকার
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদকে হত্যার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এমন কয়েকজন বেছে নেয়া ব্লগারকে আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে মার্কিন সরকার। এ খবর দিয়েছে বার্তাসংস্থা এপি।
ডিসেম্বরে আমেরিকা ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো মার্কিন সরকারের কাছে বাংলাদেশি লেখকদের মানবিক আশ্রয় প্রদানের আহ্বান জানিয়েছিল।
সামাদ হত্যাকাণ্ডের পর পেন আমেরিকার কারিন ডয়েচ কারলেকার আবারও মার্কিন সরকারের কাছে তার আবেদন পুনর্ব্যক্ত করেন।
সামাদের ‘বর্বর হত্যাকাণ্ডের’ তীব্র নিন্দা জানান মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মার্ক টোনার। তিনি সাংবাদিকদের জানান, ‘সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশী জনগণের লড়াইয়ে অকৃত্তিম সমর্থন থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের। তিনি বলেন, ‘তাৎক্ষণিক বিপদে’র মুখোমুখি, এমন বেছে নেয়া কয়েকজন ব্লগারকে মানবিক আশ্রয়ের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এ ধরণের প্রশ্ন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টকে করার জন্য বলেন তিনি। মার্কিন সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসের প্রেস সেক্রেটারি শিন ইনোয়ে মানবিক আশ্রয়ের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট অনুরোধের বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। এ ক্ষেত্রে গোপনীয়তা নীতির বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি। প্রসঙ্গত, ভীষণ জরুরি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে কোন ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া ও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে ‘হিউম্যান প্যারোল’ ব্যবহৃত হয়।
শেষ স্ট্যাটাসে যা লিখেছিলেন নাজিম
সামাদ হত্যার আগ পর্যন্ত তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন। দেশ ও সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সব সময়ই সরব ছিলেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের ধারণা, সমাজের বিভিন্ন প্রতিবাদী পোস্ট ও স্ট্যাটাসের কারণেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এ হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তার হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)। গতকাল সংগঠনের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রাকিবের স্বারিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়।
নাজিমের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ৫ এপ্রিল মঙ্গলবার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করেন নাজিমুদ্দিন। সেখানে তিনি লিখেন, ‘সরকার, এবার একটু নড়েচড়ে বসো বাবা। দেশের যা অবস্থা, আইনশৃঙ্খলার যা অবনতি, তাতে গদিতে বেশি দিন থাকা সম্ভব হবে না। জনরোষ বলে একটা কথা আছে। এটার চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে না চাইলে এুনি কঠোর পদপে নেয়া দরকার সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। নতুবা দিন ফুরিয়ে আসবে খুব দ্রুত।’
এই পোস্টের বিষয়ে সেখানে সামাদের এক বন্ধু প্রশ্ন করেন, ‘আদৌ কি কিছু হবে?’ জবাবে নাজিমুদ্দিন বলেন, ‘সেটাই প্রশ্ন। আদৌ কি সরকারের টনক নড়বে!’
এর মধ্যে গত ২ এপ্রিল নাজিমুদ্দিন সামাদ লিখেন, ‘আওয়ামী ওলামা লীগ আর বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দুই বিপরীত মেরুর দুই বাসিন্দা। ওলামা লীগ কখনোই বাহাত্তরের ধর্মনিরপে সংবিধান চায়নি এবং চাইবে না।’ ফেসবুকে দেখা যায়, সামাদের পরিচিত ও বন্ধুরা সেখানে তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিজেদের মন্তব্য দিচ্ছেন। তাদের বেশির ভাগেরই দাবি, বিভিন্ন সময়ে সামাদের করা সত্যভাষণই তার বেঁচে থাকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাজিম তার ফেসবুক পেইজে দেশের আইনশৃঙ্খলা অবনতি নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। তার স্ট্যাটাসের নিচে আজহারুল ইসলাম নামে এক স্যার লিখেছেন, ‘তোমার জন্য ভয় হয় নাজিম। একটু সাবধানে থাকো। দেখতেই তো পাচ্ছ কী হচ্ছে। সাবধানে থেকো।’ জবাবে নাজিমুদ্দিন লিখেছে, ‘ভয় আমার নিজেরও হয় স্যার। অকালে মরে যাওয়ার ভয়। কিন্তু কী করবো স্যার। মাথা নত করে চুপ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে এ মরণই বোধ হয় ভালো।’
ফেসবুকে আইনশৃঙ্খলা অবনতির বিষয়ে সরকারের কঠোর পদপে চেয়ে স্ট্যাটাস দেয়ার ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই খুন হন নাজিমুদ্দিন। তার খুন হওয়ার খবর শুনে স্ট্যাটাসে অগ্নি সারথি নামে এক ফেসবুক বন্ধু লিখেছেন, ‘নাজিমুদ্দিন ভাইয়ের সাথে গত কয়েক দিন আগে চ্যাটিং হলো। উনার আশঙ্কাই আজ নির্মমভাবে সত্যি হলো। আর কত?’
বোয়াফের সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময় বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, রাষ্ট্রযন্ত্রের নাকের ডগায় একের পর এক দেশের মেধাবী নতুন প্রজন্মকে হত্যার যে অপসংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে তা দেশ, জাতি ও আগামী প্রজন্মের জন্য অশুভ সঙ্কেত। এই ধরনের ঘটনা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখানে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন হত্যা, সেখানে তনু হত্যা, ও ওইখানে মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী হত্যা, কৃষ্ণকলির বাসায় জান্নাত হত্যা, ছাত্রলীগকর্মী হত্যাকাণ্ড, হত্যার এই মহোৎসব অচিরেই বন্ধ ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে হয়তো এই লাশের মিছিলে আমাদের কারো না কারো মরদেহ কোনো এক সময় খুঁজে পাওয়া যাবে। অন্যথায় আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হবে নতুন প্রজন্ম।
নাজিমুদ্দিন সামাদের হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেফতার এবং এই হত্যার মহোৎসব নির্মূল করার ল্েয সরকারসহ সমাজের সচেতন মহলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান বোয়াফ সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময়।
সূত্রঃ
Comment