সরকার কি এ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইসলাম ধর্মচ্যুত করার জন্য একেবারে উঠেপড়ে লেগেছে? সে পাঠ শুরু হয়েছে একেবারে প্রথম শ্রেণী থেকে। এর লক্ষ্য বোধ করি ভবিষ্যৎ বংশধরদের শুধু ইসলাম ধর্মচ্যুত করাই নয়, বরং তাদেরকে একেবারে হিন্দুবাদী বানিয়ে ফেলা। যাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ার পরিস্থিতি দেখা দেয়। বাংলাদেশের মানুষ যদি মুসলমানই না থাকে, তাহলে এই স্বাধীন রাষ্ট্রের আর প্রয়োজনই বা কী? আর মুসলমান ছিল বলেই তারা ভোট দিয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। আর সে কারণেই শুধু বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানুষই স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। তারা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে চাননি; কিন্তু একেবারে শিশুপর্যায়ে যা শেখানো হচ্ছে, তাতে এক-দুই জেনারেশন পরে হয়তো এখানকার মানুষ আন্দোলন করবে ভারতের সাথে এক হয়ে যাওয়ার জন্য। ভারতে কোনো এক জাতি নেই। তাদের ভাষাই আছে অর্ধশতের বেশি। জাতপাতের হাজারো বালাই আছে; কিন্তু তার পরও ভারত কেন এক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছে। এই বন্ধনের কারণ ভারতের প্রধান ধর্ম হিন্দুত্ব।
আমরা যদি এই উপমহাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাবো যে, ধর্মই উপমহাদেশকে বিভক্ত করেছিল। আর তার পেছনে ছিল অভিজাত শ্রেণীর হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষ। ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার বইয়ে লিখে গেছেন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতের বিভক্তি চাননি। ভারত বিভক্তি চেয়েছিলেন জওয়াহেরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেল। মাওলানা আজাদের মতে, জিন্নাহর পাকিস্তান দাবির পেছনে ছিল মুসলমানদের জন্য অধিকতর সুবিধা আদায়ের কৌশল মাত্র। জিন্নাহ মনে করতেন, তার আগের সাত শ’ বছর যদি ভারতে হিন্দু-মুসলমান একসাথে বসবাস করতে পেরে থাকেন, তবে স্বাধীন ভারতেও তারা একসাথে বসবাস করতে পারবেন; কিন্তু তা ভণ্ডুল করে দেন ভেতরে ভেতরে চরম সাম্প্রদায়িক নেতা নেহরু।
বাংলার ইতিহাস আরো একটু ভিন্ন রকম। কারণ যারা বাংলা ভাষায় কথা বলতেন, তখন তাদের ৬৭ শতাংশই ছিলেন মুসলমান। এখনো তা ৬০ শতাংশের ওপরেই আছে। মুসলমানের ভোটের জোরে ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলায় সরকারে ছিলেন এ কে ফজলুল হক আর শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না তৎকালের বাংলার সাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতারা। তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্রও ছিলেন। এদের নেতা ছিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। তিনি তখন বলতে শুরু করেন, সারা ভারত যদি এক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন হয়, তবু বাংলা ভাগ করতে হবে। কারণ তা না হলে এসব বর্ণবাদী হিন্দুর হয়তো কোনো দিনই ক্ষমতায় যাওয়া হবে না। আর সে আন্দোলনে বিপুল অর্থের জোগান দিয়েছিল বিরলা গ্রুপ। তাদের চিন্তা ছিল, যদি বাংলায় মুসলমান ক্ষমতায় থাকে, তবে তাদের ব্যবসায় ভাগ বসাবে ইস্পাহানি ও আদমজী গ্রুপ। আর বাংলা যদি ভাগ হয়, তাহলে খণ্ডিত পশ্চিম বাংলায় তাদের ব্যবসা একচেটিয়া থাকবে। অতএব বাংলা ভাগ করতে হবে। এমনকি তার জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতেও তারা অস্ত্র কেনার টাকা দিতে থাকে। এ সম্পর্কে যাদের সংশয় আছে, তারা ঢাকার ইউপিএল প্রকাশিত জয়া চ্যাটার্জির লেখা গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বাংলা ভাগ হলো (ও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা)’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
সরকার এখন ইতিহাসের এসব তথ্য আমাদের সন্তানদের ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এ দেশের মানুষের মুসলমানিত্ব খারিজ করে কিছু নষ্ট ব্যক্তিকে দিয়ে তাদের হিন্দু বানানোর প্রকল্প যেন হাতে নিয়েছে। আর তাই একেবারে প্রথম শ্রেণী থেকেই হিন্দুত্বে শিশুদের ‘শিক্ষিত’ ও ‘দীক্ষিত’ করার আয়োজন করেছে। প্রথম শ্রেণীর ‘আমার বাংলা বই’তে অক্ষর পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে ঋষি, রথ, ঢাক, ওঝা, একতারা প্রভৃতি শব্দ। যার সব কিছুই হিন্দু ধর্মের সাথে যুক্ত। চতুর্থ শ্রেণীর ‘আমার বাংলা বই’য়ে আছে অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা ‘নেমন্তন্ন’ কাবতাটি। তাতে উপদেশ আছে পরস্পরকে ‘বাবু’ বলে সম্বোধন করার। আর শুনতে বলা হয়েছে হিন্দুদের ধর্মীয় সঙ্গীত ‘ভজন’। খেতে বলা হয়েছে, মন্দিরের ‘প্রসাদ’। অষ্টম শ্রেণীর বাংলা প্রথম পত্র পাঠ্য বই ‘সাহিত্য কণিকা’র ১৬ পৃষ্ঠায় কিছু শব্দার্থ এ রকম : নাটমন্দির-দেবমন্দিরের সামনের ঘর যেখানে নাচ-গান হয়। বোষ্টম-হরিনাম সংকীর্তন করে জীবিকা অর্জন করে এমন বৈষ্ণব। কাপালি-তান্ত্রিক হিন্দু সম্প্রদায়। চণ্ডিমণ্ডপ- যে মণ্ডপে বা ছাদযুক্ত চত্বরে দুর্গা কালী প্রভৃতি দেবীর পূজা হয়। দণ্ডবৎ- মাটিতে পড়ে ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম।
এ ছাড়া পাঠ্যবই থেকে যা বাদ দেয়া হয়েছে তার কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বাংলা বই থেকে যেসব বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে : ১. দ্বিতীয় শ্রেণী- বাদ দেয়া হয়েছে ‘সবাই মিলে করি কাজ’ শিরোনামে মুসলমানদের শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত। ২. তৃতীয় শ্রেণী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে ‘খলিফা হযরত আবু বকর’ শিরোনামে একটি সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত। ৪. চতুর্থ শ্রেণী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে খলিফা হযরত উমরের জীবনচরিত। ৫. পঞ্চম শ্রেণী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে ‘বিদায় হজ’ নামক শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত। আরো বাদ দেয়া হয়েছে কাজী কাদের নওয়াজের লিখিত ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ নামের একটি কবিতা, যাতে বাদশাহ আলমগীরের মহত্ত্ব বর্ণনা করা আছে। সেই সাথে শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে আদব-কায়দা কেমন হওয়া উচিত, কবিতায় তার বর্ণনা ছিল। ৬. পঞ্চম শ্রেণী থেকেই বাদ দেয়া হয়েছে ‘শহীদ তিতুমীর’ নামক একটি জীবনচরিত। এ প্রবন্ধটিতে মুসলিম নেতা শহীদ তিতুমীরের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের ঘটনা উল্লেখ ছিল। ৭. ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখিত ‘সততার পুরস্কার’ নামক একটি ধর্মীয় শিক্ষণীয় ঘটনা। ৮. ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে আরো বাদ দেয়া হয়েছে মুসলিম দেশ ভ্রমণকাহিনী ‘নীল নদ আর পিরামিডের দেশ’। ৯. একইভাবে মুসলিম সাহিত্যিক কায়কোবাদের লেখা ‘প্রার্থনা’ নামক কবিতাটিও বাদ দেয়া হয়েছে। ১০. সপ্তম শ্রেণী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে ‘মরু ভাস্কর’ নামক শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত। ১১. অষ্টম শ্রেণী থেকে আরো বাদ দেয়া হয়েছে ‘বাবরের মহত্ত্ব’ নামক কবিতাটি। ১২. বাদ দেয়া হয়েছে বেগম সুফিয়া কামালের লেখা ‘প্রার্থনা’ কবিতা। ১৩. নবম-দশম শ্রেণীর বই থেকে বাদ দেয়া হয়েছে মধ্যযুগের বাংলা কবি শাহ্ মোহাম্মদ সগীরের লেখা ‘বন্দনা’ নামক ইসলামভিত্তিক কবিতাটি। ১৪. একইভাবে বাদ দেয়া হয়েছে কবি আলাওলের ধর্মভিত্তিক ‘হামদ্’ নামক কবিতাটিও। ১৫. বাদ দেয়া হয়েছে মধ্যযুগের মুসলিম কবি আব্দুল হাকিমের লেখা ‘বঙ্গবাণী’ কবিতাটি। ১৬. বাদ দেয়া হয়েছে শিক্ষণীয় লেখা ‘জীবনের বিনিময়’ কবিতাটি। এটি ছিল মোগল বাদশাহ বাবর ও তার পুত্র হুমায়ুনকে নিয়ে লেখা। নবম ও দশম শ্রেণী থেকে আরো বাদ দেয়া হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বিখ্যাত ‘উমর ফারুক’ কবিতাটি।
আবার নতুন যা কিছু সংযোজিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে : ১. পঞ্চম শ্রেণীতে হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘বই’ নামক একটি কবিতা, যা মূলত মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কুরআন বিরোধী। ২. ষষ্ঠ শ্রেণীতে সংযোজিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ নামক কবিতা। যেখানে রয়েছে হিন্দুদের দেবী দুর্গার প্রশংসা। ৩. ষষ্ঠ শ্রেণীতে সংযোজিত হয়েছে ‘লাল গরুটা’ নামের একটি ছোটগল্প। যা দিয়ে কোটি কোটি মুসলিম শিক্ষার্থীকে শেখানো হচ্ছে গরু হচ্ছে মায়ের মতো। ৪. ষষ্ঠ শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে হিন্দুদের তীর্থস্থান রাঁচির ভ্রমণকাহিনী। ৫. সপ্তম শ্রেণীতে সংযোজিত হয়েছে ‘লালু’ নামের একটি গল্প। তাতে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে পাঁঠা বলির নিয়ম-কানুন। ৬. অষ্টম শ্রেণীতে পড়ানো হচ্ছে হিন্দুদের অন্যতম ধর্মগ্রন্থ রামায়ণের সংক্ষিপ্ত রূপ। ৭. নবম ও দশম শ্রেণীতে প্রবেশ করানো হয়েছে ‘আমার সন্তান’ নামের একটি কবিতা। যাতে আছে দেবী অন্নপূর্ণার প্রশংসা ও তার কাছে প্রার্থনা। ৮. পড়ানো হচ্ছে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ শিরোনামে বাউলদের যৌনাচারের কাহিনী। ৯. নবম ও দশম শ্রেণীতে ‘সাঁকোটা দুলছে’ শিরোনামের কবিতাটি সংযোজিত হয়েছে, যাতে ১৯৪৭ সালের দেশভাগকে হেয় করা হয়েছে। ১০. নবম ও দশম শ্রেণীতে সংযোজন করা হয়েছে ‘সুখের লাগিয়া’ নামক একটি কবিতা, যা হিন্দুদের রাধা-কৃষ্ণের লীলা কীর্তন।
আমরা নিশ্চিতভাবে মনে করি, এর কোনো কিছুই কাকতালীয় ঘটনা নয়। এর সব কিছুই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ইসলামবিদ্বেষের জন্ম দেয়া এবং শিশুদের হিন্দুত্ববাদের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলা। তা না হলে পাঁঠা বলির নিয়মকানুন কেন আমাদের শিশুদের পড়তে হবে? হাক্কানি তরিকত ফেডারেশন বলেছে, ধর্মের প্রতি যাদের বিশ্বাস নেই, বরং যারা ইসলামবিদ্বেষী এমন সব বামপন্থী ব্যক্তি দ্বারা এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে; যা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন কবির চৌধুরী, কো-চেয়ারম্যান ড. খলীকুজ্জমান আহমদ, সদস্য ড. জাফর ইকবাল, অধ্যাপক নিতাই চন্দ্র সূত্রধর প্রমুখ; কিন্তু কোন বিবেচনায় আমরা এই শিক্ষানীতি গ্রহণ করছি। এর মধ্যে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য আছে বলে মনে করি না।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, প্রধানমন্ত্রীও বোধকরি তার অবস্থার পরিবর্তন করেছেন। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, নোংরামি পর্নোচিন্তা, তা মুক্তচিন্তা নয়। মুক্তচিন্তা যদি নোংরা জঘন্য চিন্তা হয়, তবে এটি মুক্তচিন্তা হতে পারে না। যে লেখা পড়লে ঘৃণা হয়, লজ্জা হয়, তা মুক্তচিন্তা নয়; এটা বিকৃত মানসিকতা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা আছে। আমিও ধর্ম মানি; কিন্তু যখন আমি যাকে মানি, তার সম্পর্কে বিকৃত কথা লেখে, তখন আমার খারাপ লাগে। বিরোধিতা করে মানুষের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করা কাম্য নয়। কাউকে আঘাত করে লিখলেই মুক্তচিন্তা হয়ে যায় না। যারা এসব লিখছে, তারা রুচিবোধ রেখে লিখুক, তবে তো কোনো সমস্যা নেই। প্রধানমন্ত্রীর মতো এ দেশের ৯২ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন; কিন্তু পাঠ্যবইয়ে যা লেখা হয়েছে, তা আমাদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করে। যা শুধু নাস্তিক্যবাদই উসকে দেয় না, যার লক্ষ্য এ দেশের মুসলমানদের একেবারে হিন্দু ধর্মে দীক্ষা দেয়া।
আমাদের দাবি, অবিলম্বে এসব পাঠ্যপুস্তক রদ করে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ধর্ম সংস্কৃতির অনুকূল পাঠ্যবই রচনা করে ছাত্রদের পড়ানোর ব্যবস্থা করা হোক।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com -
See more at: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/115115
আমরা যদি এই উপমহাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাবো যে, ধর্মই উপমহাদেশকে বিভক্ত করেছিল। আর তার পেছনে ছিল অভিজাত শ্রেণীর হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষ। ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার বইয়ে লিখে গেছেন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতের বিভক্তি চাননি। ভারত বিভক্তি চেয়েছিলেন জওয়াহেরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেল। মাওলানা আজাদের মতে, জিন্নাহর পাকিস্তান দাবির পেছনে ছিল মুসলমানদের জন্য অধিকতর সুবিধা আদায়ের কৌশল মাত্র। জিন্নাহ মনে করতেন, তার আগের সাত শ’ বছর যদি ভারতে হিন্দু-মুসলমান একসাথে বসবাস করতে পেরে থাকেন, তবে স্বাধীন ভারতেও তারা একসাথে বসবাস করতে পারবেন; কিন্তু তা ভণ্ডুল করে দেন ভেতরে ভেতরে চরম সাম্প্রদায়িক নেতা নেহরু।
বাংলার ইতিহাস আরো একটু ভিন্ন রকম। কারণ যারা বাংলা ভাষায় কথা বলতেন, তখন তাদের ৬৭ শতাংশই ছিলেন মুসলমান। এখনো তা ৬০ শতাংশের ওপরেই আছে। মুসলমানের ভোটের জোরে ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলায় সরকারে ছিলেন এ কে ফজলুল হক আর শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না তৎকালের বাংলার সাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতারা। তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্রও ছিলেন। এদের নেতা ছিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। তিনি তখন বলতে শুরু করেন, সারা ভারত যদি এক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন হয়, তবু বাংলা ভাগ করতে হবে। কারণ তা না হলে এসব বর্ণবাদী হিন্দুর হয়তো কোনো দিনই ক্ষমতায় যাওয়া হবে না। আর সে আন্দোলনে বিপুল অর্থের জোগান দিয়েছিল বিরলা গ্রুপ। তাদের চিন্তা ছিল, যদি বাংলায় মুসলমান ক্ষমতায় থাকে, তবে তাদের ব্যবসায় ভাগ বসাবে ইস্পাহানি ও আদমজী গ্রুপ। আর বাংলা যদি ভাগ হয়, তাহলে খণ্ডিত পশ্চিম বাংলায় তাদের ব্যবসা একচেটিয়া থাকবে। অতএব বাংলা ভাগ করতে হবে। এমনকি তার জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতেও তারা অস্ত্র কেনার টাকা দিতে থাকে। এ সম্পর্কে যাদের সংশয় আছে, তারা ঢাকার ইউপিএল প্রকাশিত জয়া চ্যাটার্জির লেখা গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বাংলা ভাগ হলো (ও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা)’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
সরকার এখন ইতিহাসের এসব তথ্য আমাদের সন্তানদের ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এ দেশের মানুষের মুসলমানিত্ব খারিজ করে কিছু নষ্ট ব্যক্তিকে দিয়ে তাদের হিন্দু বানানোর প্রকল্প যেন হাতে নিয়েছে। আর তাই একেবারে প্রথম শ্রেণী থেকেই হিন্দুত্বে শিশুদের ‘শিক্ষিত’ ও ‘দীক্ষিত’ করার আয়োজন করেছে। প্রথম শ্রেণীর ‘আমার বাংলা বই’তে অক্ষর পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে ঋষি, রথ, ঢাক, ওঝা, একতারা প্রভৃতি শব্দ। যার সব কিছুই হিন্দু ধর্মের সাথে যুক্ত। চতুর্থ শ্রেণীর ‘আমার বাংলা বই’য়ে আছে অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা ‘নেমন্তন্ন’ কাবতাটি। তাতে উপদেশ আছে পরস্পরকে ‘বাবু’ বলে সম্বোধন করার। আর শুনতে বলা হয়েছে হিন্দুদের ধর্মীয় সঙ্গীত ‘ভজন’। খেতে বলা হয়েছে, মন্দিরের ‘প্রসাদ’। অষ্টম শ্রেণীর বাংলা প্রথম পত্র পাঠ্য বই ‘সাহিত্য কণিকা’র ১৬ পৃষ্ঠায় কিছু শব্দার্থ এ রকম : নাটমন্দির-দেবমন্দিরের সামনের ঘর যেখানে নাচ-গান হয়। বোষ্টম-হরিনাম সংকীর্তন করে জীবিকা অর্জন করে এমন বৈষ্ণব। কাপালি-তান্ত্রিক হিন্দু সম্প্রদায়। চণ্ডিমণ্ডপ- যে মণ্ডপে বা ছাদযুক্ত চত্বরে দুর্গা কালী প্রভৃতি দেবীর পূজা হয়। দণ্ডবৎ- মাটিতে পড়ে ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম।
এ ছাড়া পাঠ্যবই থেকে যা বাদ দেয়া হয়েছে তার কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বাংলা বই থেকে যেসব বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে : ১. দ্বিতীয় শ্রেণী- বাদ দেয়া হয়েছে ‘সবাই মিলে করি কাজ’ শিরোনামে মুসলমানদের শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত। ২. তৃতীয় শ্রেণী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে ‘খলিফা হযরত আবু বকর’ শিরোনামে একটি সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত। ৪. চতুর্থ শ্রেণী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে খলিফা হযরত উমরের জীবনচরিত। ৫. পঞ্চম শ্রেণী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে ‘বিদায় হজ’ নামক শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত। আরো বাদ দেয়া হয়েছে কাজী কাদের নওয়াজের লিখিত ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ নামের একটি কবিতা, যাতে বাদশাহ আলমগীরের মহত্ত্ব বর্ণনা করা আছে। সেই সাথে শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে আদব-কায়দা কেমন হওয়া উচিত, কবিতায় তার বর্ণনা ছিল। ৬. পঞ্চম শ্রেণী থেকেই বাদ দেয়া হয়েছে ‘শহীদ তিতুমীর’ নামক একটি জীবনচরিত। এ প্রবন্ধটিতে মুসলিম নেতা শহীদ তিতুমীরের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের ঘটনা উল্লেখ ছিল। ৭. ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখিত ‘সততার পুরস্কার’ নামক একটি ধর্মীয় শিক্ষণীয় ঘটনা। ৮. ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে আরো বাদ দেয়া হয়েছে মুসলিম দেশ ভ্রমণকাহিনী ‘নীল নদ আর পিরামিডের দেশ’। ৯. একইভাবে মুসলিম সাহিত্যিক কায়কোবাদের লেখা ‘প্রার্থনা’ নামক কবিতাটিও বাদ দেয়া হয়েছে। ১০. সপ্তম শ্রেণী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে ‘মরু ভাস্কর’ নামক শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত। ১১. অষ্টম শ্রেণী থেকে আরো বাদ দেয়া হয়েছে ‘বাবরের মহত্ত্ব’ নামক কবিতাটি। ১২. বাদ দেয়া হয়েছে বেগম সুফিয়া কামালের লেখা ‘প্রার্থনা’ কবিতা। ১৩. নবম-দশম শ্রেণীর বই থেকে বাদ দেয়া হয়েছে মধ্যযুগের বাংলা কবি শাহ্ মোহাম্মদ সগীরের লেখা ‘বন্দনা’ নামক ইসলামভিত্তিক কবিতাটি। ১৪. একইভাবে বাদ দেয়া হয়েছে কবি আলাওলের ধর্মভিত্তিক ‘হামদ্’ নামক কবিতাটিও। ১৫. বাদ দেয়া হয়েছে মধ্যযুগের মুসলিম কবি আব্দুল হাকিমের লেখা ‘বঙ্গবাণী’ কবিতাটি। ১৬. বাদ দেয়া হয়েছে শিক্ষণীয় লেখা ‘জীবনের বিনিময়’ কবিতাটি। এটি ছিল মোগল বাদশাহ বাবর ও তার পুত্র হুমায়ুনকে নিয়ে লেখা। নবম ও দশম শ্রেণী থেকে আরো বাদ দেয়া হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বিখ্যাত ‘উমর ফারুক’ কবিতাটি।
আবার নতুন যা কিছু সংযোজিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে : ১. পঞ্চম শ্রেণীতে হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘বই’ নামক একটি কবিতা, যা মূলত মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কুরআন বিরোধী। ২. ষষ্ঠ শ্রেণীতে সংযোজিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ নামক কবিতা। যেখানে রয়েছে হিন্দুদের দেবী দুর্গার প্রশংসা। ৩. ষষ্ঠ শ্রেণীতে সংযোজিত হয়েছে ‘লাল গরুটা’ নামের একটি ছোটগল্প। যা দিয়ে কোটি কোটি মুসলিম শিক্ষার্থীকে শেখানো হচ্ছে গরু হচ্ছে মায়ের মতো। ৪. ষষ্ঠ শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে হিন্দুদের তীর্থস্থান রাঁচির ভ্রমণকাহিনী। ৫. সপ্তম শ্রেণীতে সংযোজিত হয়েছে ‘লালু’ নামের একটি গল্প। তাতে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে পাঁঠা বলির নিয়ম-কানুন। ৬. অষ্টম শ্রেণীতে পড়ানো হচ্ছে হিন্দুদের অন্যতম ধর্মগ্রন্থ রামায়ণের সংক্ষিপ্ত রূপ। ৭. নবম ও দশম শ্রেণীতে প্রবেশ করানো হয়েছে ‘আমার সন্তান’ নামের একটি কবিতা। যাতে আছে দেবী অন্নপূর্ণার প্রশংসা ও তার কাছে প্রার্থনা। ৮. পড়ানো হচ্ছে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ শিরোনামে বাউলদের যৌনাচারের কাহিনী। ৯. নবম ও দশম শ্রেণীতে ‘সাঁকোটা দুলছে’ শিরোনামের কবিতাটি সংযোজিত হয়েছে, যাতে ১৯৪৭ সালের দেশভাগকে হেয় করা হয়েছে। ১০. নবম ও দশম শ্রেণীতে সংযোজন করা হয়েছে ‘সুখের লাগিয়া’ নামক একটি কবিতা, যা হিন্দুদের রাধা-কৃষ্ণের লীলা কীর্তন।
আমরা নিশ্চিতভাবে মনে করি, এর কোনো কিছুই কাকতালীয় ঘটনা নয়। এর সব কিছুই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ইসলামবিদ্বেষের জন্ম দেয়া এবং শিশুদের হিন্দুত্ববাদের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলা। তা না হলে পাঁঠা বলির নিয়মকানুন কেন আমাদের শিশুদের পড়তে হবে? হাক্কানি তরিকত ফেডারেশন বলেছে, ধর্মের প্রতি যাদের বিশ্বাস নেই, বরং যারা ইসলামবিদ্বেষী এমন সব বামপন্থী ব্যক্তি দ্বারা এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে; যা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন কবির চৌধুরী, কো-চেয়ারম্যান ড. খলীকুজ্জমান আহমদ, সদস্য ড. জাফর ইকবাল, অধ্যাপক নিতাই চন্দ্র সূত্রধর প্রমুখ; কিন্তু কোন বিবেচনায় আমরা এই শিক্ষানীতি গ্রহণ করছি। এর মধ্যে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য আছে বলে মনে করি না।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, প্রধানমন্ত্রীও বোধকরি তার অবস্থার পরিবর্তন করেছেন। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, নোংরামি পর্নোচিন্তা, তা মুক্তচিন্তা নয়। মুক্তচিন্তা যদি নোংরা জঘন্য চিন্তা হয়, তবে এটি মুক্তচিন্তা হতে পারে না। যে লেখা পড়লে ঘৃণা হয়, লজ্জা হয়, তা মুক্তচিন্তা নয়; এটা বিকৃত মানসিকতা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা আছে। আমিও ধর্ম মানি; কিন্তু যখন আমি যাকে মানি, তার সম্পর্কে বিকৃত কথা লেখে, তখন আমার খারাপ লাগে। বিরোধিতা করে মানুষের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করা কাম্য নয়। কাউকে আঘাত করে লিখলেই মুক্তচিন্তা হয়ে যায় না। যারা এসব লিখছে, তারা রুচিবোধ রেখে লিখুক, তবে তো কোনো সমস্যা নেই। প্রধানমন্ত্রীর মতো এ দেশের ৯২ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন; কিন্তু পাঠ্যবইয়ে যা লেখা হয়েছে, তা আমাদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করে। যা শুধু নাস্তিক্যবাদই উসকে দেয় না, যার লক্ষ্য এ দেশের মুসলমানদের একেবারে হিন্দু ধর্মে দীক্ষা দেয়া।
আমাদের দাবি, অবিলম্বে এসব পাঠ্যপুস্তক রদ করে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ধর্ম সংস্কৃতির অনুকূল পাঠ্যবই রচনা করে ছাত্রদের পড়ানোর ব্যবস্থা করা হোক।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com -
See more at: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/115115
Comment