এখন দেশব্যাপী প্রধান আলোচ্য বিষয় সরকার ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী সে দেশের সঙ্গে কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তিতে বাংলাদেশ আবদ্ধ হতে যাচ্ছে কিনা। বেশ কয়েকবার তারিখ পরিবর্তন করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৭ এপ্রিল ৪ দিনের সরকারি সফরে ভারত যাচ্ছেন। ৮ এপ্রিল তার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একান্ত সাক্ষাৎ হওয়ার কথা রয়েছে। এই সফরকালে দুই দেশের মধ্যে দুই ডজন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। কী থাকবে এই চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে? শেখ হাসিনার সরকার তার কোনো আভাস দেয়নি। কিন্তু ভারতের মিডিয়া গদগদ হয়ে লিখতে শুরু করেছে যে, শেখ হাসিনার এই সফরকালেই ঢাকা- দিল্লি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে। : কিন্তু ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ফলাফল বাংলাদেশের জন্য ভালো হয় না। ১৯৭২ সালের সম্পাদিত ভারত বাংলাদেশ বন্ধুত্ব চুক্তির দুঃস্বপ্ন এখনো আমাদের তাড়া করে ফেরে। তারপর ১৯৯৭ সালে ২৫ বছর মেয়াদি যে পানিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তার ফলাফল বাংলাদেশের জন্য শূন্য। আমরা পানি পাইনি, পানি পাওয়ার কোনো গ্যারান্টি ক্লজও তাতে সংযোজিত নেই। ফলে ভারত পানি না দিলেও তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে দেন-দরবার করার সুযোগ আমাদের নেই। অথচ ভাটির দেশ হিসেবে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বেশির ভাগ হিস্যা বাংলাদেশের প্রাপ্য। এই চুক্তির বিষময় ফল আমরা শুরু থেকেই ভোগ করে আসছি। বাংলাদেশ ক্রমেই অনেক বেশি মরুপ্রবণ হয়ে উঠেছে। আমাদের জনগণের জীবন-জীবিকা, আচার-সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে বদলে যাচ্ছে। এর ফল আরো ভয়াবহ হতে বাধ্য। : এবার আসছে ভারত-বাংলাদেশ প্রতিরক্ষায় সহযোগিতার চুক্তির প্রশ্ন। শেখ হাসিনার সরকার এক চমৎকার পটভূমিতে সম্ভবত এই চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে। এই চুক্তির আগেই বাংলাদেশ ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের দিল্লি সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যে ট্রানজিট সুবিধার জন্য দিল্লি সরকার দেন-দরবার করে আসছিল, পাকিস্তান বা শেখ মুজিবসহ বাংলাদেশের কোনো সরকারই ভারতের সে আবদার নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার একেবারে বিনামূল্যে শূন্য প্রাপ্তিতে ভারতকে ট্রানজিট করিডোর সুবিধা দিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো দুর্বল, আর ভারতের শ’ শ’ টন পণ্য নিয়ে যেসব যানবাহন চলাচল করছে তাতে সড়কগুলো আরো ব্যবহার- অনুপযোগী করে তুলেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে অবাধে ব্যবসা করার জন্য ২০টি ভারতীয় প্রধান করপোরেশনকে অনুমোদন দিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। সেখানে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা বা বিকাশের কথা চিন্তা করা হয়নি। ফলে বাংলাদেশ এমনিতেই ভারতীয় পণ্যের বিরাট বাজারে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় করপোরেশনগুলোকে অবাধে তাদের পণ্য বাংলাদেশে বাজারজাত করতে দেয়ার ফলে পরিস্থিতি আরো সংকটাপন্ন হয়েছে। : তার উপরে ভারতের ডজন ডজন ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে বাংলাদেশে সম্প্র্রচারের সুযোগ দেয়া হয়েছে। বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশের একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও তার দেশে ঢুকতে দেয়নি। আর এসব ইলেকট্রনিক মিডিয়া কুরুচিপূর্ণ অনুষ্ঠান, শঠতা, নিচতা, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র বাংলাদেশি মানুষের পরিবারগুলোর ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। নানা কারণে এগুলো আমাদের দেশে জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গে যুক্ত আছে ভারতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন। যেগুলো ভারতীয় পণ্যের প্রতি ঘরে ঘরে নতুন আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। আমাদের শোবার ঘরগুলো এসব টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিষময় হয়ে উঠেছে। সিরিয়াল দেখে প্রভাবিত হয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে তরুণ সমাজ। ভারতীয় টিভির বিজ্ঞাপনে প্রচারিত লেহেঙ্গার জন্য আত্মহত্যা করছে কিশোরী, তরুণরা। তাদের পরকীয়া প্রচারণায় ভেঙে যাচ্ছে বহু সংসার। সরকারের সেদিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ নেই। এসব কিছুই আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যেও সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এভাবেই আমরা ভারতীয় পণ্যের আগ্রাসনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। : যেহেতু সরকারের কাছে জনগণের ভোট আর কোনো ব্যাপার নয়। জনগণকে তোয়াক্কা করার কোনো প্রয়োজন নেই। তারা জবরদস্তি করেই ক্ষমতাই থাকবার ভারতীয় নিশ্চয়তা পেয়েছে। সেই জন্য দিল্লি যা কিছু চাইছে শেখ হাসিনার সরকার দুই হাত খুলে উজাড় করে তার সব কিছুই দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বিনিময়ে পাওয়া যাচ্ছে না কিছুই। কখনো কখনো বাচ্চাদের শান্ত করার জন্য মায়েরা যেমন শিশুদের হাতে দু-একটা চকোলেট তুলে দেয়, দিল্লি তেমনি দু-একটা চকোলেট দিয়ে বাংলাদেশকে সন্তুষ্ট রাখছে। ভারত বাংলাদেশের প্রতিবছর ৭০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করে। কিন্তু শুল্ক ও অশুল্ক নানা ধরনের বাধা তুলে বাংলাদেশের পণ্য রফতানিতে তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ ভারতে রফতানি করে প্রতিবছর মাত্র সাড়ে ৩৯ কোটি ডলারের পণ্য। সেও এক লেবেনচুষ কাহিনী। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পানি চুক্তি আছে শুধুমাত্র গঙ্গা নিয়ে। সেটিও ভারতকে যথেচ্ছ পানি প্রত্যাহারের গ্যারান্টি দেয়। আরো ৫৩ অভিন্ন নদী থেকে ভারত পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতায় থাকবার অদম্য নেশায় শেখ হাসিনা সরকার শুধুমাত্র সেটি হা করে তাকিয়ে দেখছে। কোথায়ও প্রতিবাদ নেই, পানির ন্যায্য হিস্যা চাইবার মতো শক্তি পর্যন্ত নেই। তার মধ্যে আসছে তিস্তা চুক্তির প্রশ্ন। শুকনো মৌসুমে তিস্তা শুধুই ধু-ধু বালুচর। প্রান্তরকে প্রান্তর আবাদি জমি মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গ খাঁখাঁ করছে। কিন্তু তা নিয়েও যেন জোরেশোরে কথা বলার শক্তি এই সরকারের নেই। দিল্লি আজ এ যুক্তি দেখায়, কাল সে যুক্তি দেখায়। কিন্তু তিস্তার পানি আমাদের ন্যায্য অধিকার, পাচ্ছি না কিছুই। : বাংলাদেশের এসব সমস্যার দিকে দিল্লি ফিরেও তাকায় না। সরকারও ভারত সরকারকে হুজুর হুজুর করতে থাকে। এখন ভারতের সাম্প্রতিকতম ইচ্ছা দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদন করা। তবে এটাই শেষ নয়। বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ সরকার এ দেশের ওপর দিয়ে আখাউড়া-আগারতলা, খুলনা-কলকাতা, আশুগঞ্জ, মংলা, চিটাগাং বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দিচ্ছে। আর এসব কাজের সুবিধার জন্য ফেনী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণেরও অনুমতি দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। ভারত সে কাজ দ্রুতই চালিয়ে যাচ্ছে। ফেনী, চট্টগ্রাম এলাকা বরাবর মিয়ানমার সীমান্ত। দুনিয়ার সবাই জানে যে, এই এলাকাটা বড় ধরনের যুদ্ধপ্রবণ। এমনকি এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বাহিনীও যুদ্ধ করেছিল। ফলে এই এলাকায় সংযোগ প্রতিষ্ঠা হলে ভারতীয় স্বাধীনতাকামীরা এই পথে বাংলাদেশের ওপর বহুমুখী হামলা চালাতে সক্ষম হবে। সেই কৌশলগত ধারণাও সরকারের ভেতর আছে বলে মনে হয় না। : দিল্লির সরকার শেখ হাসিনা সরকারকে সব সময় শিশু বলে মনে করে; এটা কোনো গোপন কথা নয়। হতে পারে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা সহায়তা করেছিল বলেই ভারতীয় শাসকশ্রেণীর মধ্যে এই মনোভাব প্রবল হয়েছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বলেই ভারতের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে সবকিছু করতে চায়, এমনকি তা যদি বাংলাদেশের স্বার্থের বিরোধীও হয়। ২০০৯ সাল থেকে ভারত বাংলাদেশকে ৩০০ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর সব কিছুই করেছে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের যুদ্ধরত ৭ রাজ্যের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই। কারণ কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি করিডোর হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে যেতে দীর্ঘ সময় লাগে আর সে পথ ঝুঁকিপূর্ণও বটে। আর সে জন্যই সমতল বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সহজে পণ্যসহ সামরিক সাজসরঞ্জাম নিয়ে যেতে চায় ভারত। এর শর্তগুলো অদ্ভূত। এসব কাজের টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে শুধুমাত্র ভারত। সব প্রকৌশলী, কর্মকর্তা, উপকরণ কিনতে হবে ভারত থেকে। বাংলাদেশ থেকে বড় জোর কিছু মুটে মজুর এখানে কাজ পেতে পারবে, বাকি সব ভারতের। ১০ টাকার পণ্যকে ১০ হাজার টাকা টেন্ডার দিলেও বাংলাদেশ সরকারের করবার কিছুই থাকবে না। ফলে বাংলাদেশের ভারতের কাছে ঋণই শুধু বাড়বে, লাভ কিছু হবে না। সবটুকু লাভ শুষে নেবে ভারতই। ১ কোটি টাকার কাজ করে ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেবে। : বাংলাদেশকে শোষণের ভারতীয় আর এক হাতিয়ার জ্বালানি। ভারতের অত্যধিক সালফারযুক্ত নিম্নমানের কয়লা, যা সেখানকার পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও আদালতের নির্দেশের ফলে ভারত ব্যবহার করতে পারছে না, সেই কয়লা দিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে তৈরি করা হচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প। লাখ লাখ টন ভারতীয় নিম্নমানের কয়লা আসবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে। ঢুকবে রামপালে, সেসব কয়লা জ্বলবে, চারদিকে দূষণ ছড়িয়ে পড়বে। বিপন্ন হয়ে পড়বে সুন্দরবন। তা ছাড়া গাধার নাকের সামনে যেমন মুলা ঝুলিয়ে তাকে দ্রুত চলতে উদ্বুদ্ধ করে তার মালিক, তেমনি নেপাল, ভুটানে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে তা বাংলাদেশে রফতানি করার মুলা ঝুলিয়ে রেখেছে ভারত। আর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার ভারতকে উজাড় করে দেয়ার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। এদিকে আবার এক চাতুর্যপূর্ণ চুক্তি করে নিয়েছে ভারত। সেটি হলো আঞ্চলিক সড়ক সংযোগ বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল) চুক্তি। কথা ছিল, এই চুক্তির বলে প্রত্যেক দেশ ভারতের ওপর দিয়ে অবাধে তাদের যানবাহন ও পণ্য নিয়ে অপর দেশে যেতে পারবে, পণ্য রফতানি করতে পারবে। কিন্তু নানা অজুহাতে আর ভুটানকে দিয়ে ভেটো দিয়ে সে প্রকল্পও আটকে দিয়েছে ভারত। ফলে একতরফাভাবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত সেই সুবিধা গ্রহণ করছে। আর বাংলাদেশ নেপাল, ভুটান এমনকি ভারতেও যেতে পারছে না। টাউটারি আর কাকে বলে! ভারত এখন চাইছে, একটি ব্যাপক প্রতিরক্ষা চুক্তি। যদিও এ ক্ষেত্রেও শেখ হাসিনা ও দিল্লির সরকারের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক বিরাজ করছে। ২০০৯ সাল থেকে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সেনাবাহিনী টু সেনাবাহিনী সরাসরি আলাপ-আলোচনা করছে। তারা সম্প্রীতির নামে যৌথ মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। এর ষষ্ঠ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে সর্বশেষ টাঙ্গাইলে। উপরন্তু বাংলাদেশের ঘোষিত পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে এ ধরনের মহড়া বা চুক্তি সঙ্গতিপূর্ণও নয়। তা সত্ত্বেও গত নভেম্বরে চুক্তির খসড়া নিয়ে ঢাকা সফরে এসেছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর। সেটি ভারত তখনই করেছে, যখন বাংলাদেশ চীন থেকে দুটি সাবমেরিন ক্রয় করে। মনোহর পারিকর ঢাকায় এসে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির এই প্রচেষ্টায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গেছেন বলে জানা যায়। : তবে এ কথা মানতেই হবে যে, দিল্লি ২৫ বছর মেয়াদি সামরিক সহযোগিতার চুক্তির প্রস্তাব বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তা ও অর্থনীতির কোনো দিক থেকেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি আমাদের সার্বভৌম স্বার্থের বিরোধী। দিল্লি ভারত থেকে অস্ত্রশস্ত্র কেনার জন্য বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার অফার করেছে। চুক্তিতেও এমন শর্ত থাকবে, একপক্ষ অন্য কোনো দেশ কর্তৃক আক্রান্ত হলে অন্যপক্ষ তাকে সহযোগিতা করবে, যেন সংশ্লিষ্ট দেশ নিজেই আক্রান্ত হয়েছে। এর অর্থ এই দাঁড়ায়, যদি চীন-ভারত যুদ্ধ বাধে, তাহলে সে যুদ্ধে বাংলাদেশ ভারতের পক্ষ হয়ে চীনের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে? কখনো নয়। বরং ভারতীয় এই ৫০ কোটি ডলার বাংলাদেশের নদীর তীরে বাঁধ দিয়ে মানুষের জানমাল রক্ষা করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। : এখন সময় এসেছে ভারতের মনোভাবের চুলচেরা বিশ্লেষণের। ভারতের সমস্যা হলো, তারা কোনো মুসলমানপ্রধান দেশে বিনিয়োগ করতে চায় না। কিন্তু তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, এই দেশগুলোকে ভারতের বাজারে পরিণত করা। বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ ভারী যানবাহন এবং ৭০ শতাংশ ছোট তিন চাকার সিএনজি ভারত থেকে আমদানি করা হয়। তা সত্ত্বেও ভারত এখানে যৌথ উদ্যোগে এ ধরনের যানবাহন তৈরির কারখানা করতে চায় না। যদি তা করত, তাহলে বাংলাদেশের হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হতো এবং এসব কোম্পানিও এমন খাতে টাকা বিনিয়োগ করতে চায়, যাতে তাদের ব্যবসা আরো রমরমা হয়ে ওঠে। শ্রীলঙ্কাও ২০১৩ সালে একই ধরনের বিপদে পড়েছিল। ভারত সেখানে নিম্নমানের যানবাহন ডাম্পিং করার চেষ্টা করছিল। তখন শ্রীলঙ্কার সরকার এসব যানবাহনের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করতে শুরু করে। সে মাত্রাও কম ছিল না। ১২০ শতাংশ করের জায়গায় করা হয়েছিল ২৯১ শতাংশ। ২০০ শতাংশ করের জায়গায় আরোপ করা হয়েছিল ৩৫০ শতাংশ কর। আর তিন চাকার যানবাহনের যেখানে কর ছিল ৫০-৬০ শতাংশ তা বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করা হয়েছিল। মোটরসাইকেলের ওপরও একইভাবে ১০০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছিল। আর তার ফলে যেখানে ভারত শ্রীলঙ্কায় বছরে ১০০ কোটি ডলারে যানবাহন রফতানি করত, তা নেমে এক বছরের মধ্যে ৩৫ কোটি ৭০ লাখ ডলাওে দাঁড়ায়। শ্রীলঙ্কার নিজস্ব শিল্প রক্ষা পায়। আর এর পরেই ভারতীয় যানবাহন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের উপর সর্ব শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। : বাংলাদেশে গড়পড়তা ১০ জন মানুষ প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। বহু মানুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে। এর সবই ঘটে ভারতীয় যানবাহন দ্বারা। বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের এ বিষয়টির প্রতিও নজর দেয়া দরকার। ভারতের রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রি, টাটা গ্রুপ, অশোক-লেল্যান্ড, হিরো মোটর করপোরেশন, এয়ারটেল, মেরিকো, গোদরেজ, ভিআইপি ইন্ডাস্ট্রিজ, সিয়েট টায়ার, আমবাত্তুর ক্লদিং, সাহারা এবং অন্যান্য কোম্পানি বাংলাদেশের বাজারে ঢোকায় স্থানীয় শিল্পগুলো বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া ভারতীয় টেলিভিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতরে এসব পণ্যের ব্যাপক প্রচারণাও চালানো হচ্ছে। টাটা চায়ের প্রচারণায় তেমনি প্রবল। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের চা শিল্পের সর্বনাশ ঘটবে। : বাংলাদেশ ইতিমধ্যে চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় যুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ভারতের সঙ্গে একই ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর করলে তা হবে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মিলিটারি হার্ডওয়্যার চীনের তৈরি। বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের সময় আড়াই হাজার কোটি ডলারের একটি নজিরবিহীন উন্নয়ন ঋণচুক্তি স্বাক্ষরে করেছে। এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ এলে বাংলাদেশের জিডিপি ৩ শতাংশ বাড়বে। আর সে কারণেই সরকারকে ভেবে দেখতে হবে দিল্লি না বেইজিং কার সঙ্গে সে গাঁটছড়া বাঁধবে। আমরা চাই উভয়ের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব আছে এবং থাকবে। কিন্তু দয়া করে ভারতের সঙ্গে কোনো সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করবেন না। সামনে বড় বিপদ হবে। : লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক : rezwansiddiqui@yahoo.com - See more at: http://www.dailydinkal.net/2017/03/2....roAdnqY2.dpuf ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
Announcement
Collapse
No announcement yet.
ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিকে না বলুন
Collapse
X
-
Originally posted by আবু মুসান্নাহ View Postএখন দেশব্যাপী প্রধান আলোচ্য বিষয় সরকার ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী সে দেশের সঙ্গে কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তিতে বাংলাদেশ আবদ্ধ হতে যাচ্ছে কিনা। বেশ কয়েকবার তারিখ পরিবর্তন করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৭ এপ্রিল ৪ দিনের সরকারি সফরে ভারত যাচ্ছেন। ৮ এপ্রিল তার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একান্ত সাক্ষাৎ হওয়ার কথা রয়েছে। এই সফরকালে দুই দেশের মধ্যে দুই ডজন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। কী থাকবে এই চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে? শেখ হাসিনার সরকার তার কোনো আভাস দেয়নি। কিন্তু ভারতের মিডিয়া গদগদ হয়ে লিখতে শুরু করেছে যে, শেখ হাসিনার এই সফরকালেই ঢাকা- দিল্লি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে। : কিন্তু ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ফলাফল বাংলাদেশের জন্য ভালো হয় না। ১৯৭২ সালের সম্পাদিত ভারত বাংলাদেশ বন্ধুত্ব চুক্তির দুঃস্বপ্ন এখনো আমাদের তাড়া করে ফেরে। তারপর ১৯৯৭ সালে ২৫ বছর মেয়াদি যে পানিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তার ফলাফল বাংলাদেশের জন্য শূন্য। আমরা পানি পাইনি, পানি পাওয়ার কোনো গ্যারান্টি ক্লজও তাতে সংযোজিত নেই। ফলে ভারত পানি না দিলেও তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে দেন-দরবার করার সুযোগ আমাদের নেই। অথচ ভাটির দেশ হিসেবে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বেশির ভাগ হিস্যা বাংলাদেশের প্রাপ্য। এই চুক্তির বিষময় ফল আমরা শুরু থেকেই ভোগ করে আসছি। বাংলাদেশ ক্রমেই অনেক বেশি মরুপ্রবণ হয়ে উঠেছে। আমাদের জনগণের জীবন-জীবিকা, আচার-সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে বদলে যাচ্ছে। এর ফল আরো ভয়াবহ হতে বাধ্য। : এবার আসছে ভারত-বাংলাদেশ প্রতিরক্ষায় সহযোগিতার চুক্তির প্রশ্ন। শেখ হাসিনার সরকার এক চমৎকার পটভূমিতে সম্ভবত এই চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে। এই চুক্তির আগেই বাংলাদেশ ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের দিল্লি সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যে ট্রানজিট সুবিধার জন্য দিল্লি সরকার দেন-দরবার করে আসছিল, পাকিস্তান বা শেখ মুজিবসহ বাংলাদেশের কোনো সরকারই ভারতের সে আবদার নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার একেবারে বিনামূল্যে শূন্য প্রাপ্তিতে ভারতকে ট্রানজিট করিডোর সুবিধা দিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো দুর্বল, আর ভারতের শ’ শ’ টন পণ্য নিয়ে যেসব যানবাহন চলাচল করছে তাতে সড়কগুলো আরো ব্যবহার- অনুপযোগী করে তুলেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে অবাধে ব্যবসা করার জন্য ২০টি ভারতীয় প্রধান করপোরেশনকে অনুমোদন দিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। সেখানে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা বা বিকাশের কথা চিন্তা করা হয়নি। ফলে বাংলাদেশ এমনিতেই ভারতীয় পণ্যের বিরাট বাজারে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় করপোরেশনগুলোকে অবাধে তাদের পণ্য বাংলাদেশে বাজারজাত করতে দেয়ার ফলে পরিস্থিতি আরো সংকটাপন্ন হয়েছে। : তার উপরে ভারতের ডজন ডজন ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে বাংলাদেশে সম্প্র্রচারের সুযোগ দেয়া হয়েছে। বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশের একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও তার দেশে ঢুকতে দেয়নি। আর এসব ইলেকট্রনিক মিডিয়া কুরুচিপূর্ণ অনুষ্ঠান, শঠতা, নিচতা, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র বাংলাদেশি মানুষের পরিবারগুলোর ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। নানা কারণে এগুলো আমাদের দেশে জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গে যুক্ত আছে ভারতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন। যেগুলো ভারতীয় পণ্যের প্রতি ঘরে ঘরে নতুন আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। আমাদের শোবার ঘরগুলো এসব টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিষময় হয়ে উঠেছে। সিরিয়াল দেখে প্রভাবিত হয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে তরুণ সমাজ। ভারতীয় টিভির বিজ্ঞাপনে প্রচারিত লেহেঙ্গার জন্য আত্মহত্যা করছে কিশোরী, তরুণরা। তাদের পরকীয়া প্রচারণায় ভেঙে যাচ্ছে বহু সংসার। সরকারের সেদিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ নেই। এসব কিছুই আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যেও সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এভাবেই আমরা ভারতীয় পণ্যের আগ্রাসনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। : যেহেতু সরকারের কাছে জনগণের ভোট আর কোনো ব্যাপার নয়। জনগণকে তোয়াক্কা করার কোনো প্রয়োজন নেই। তারা জবরদস্তি করেই ক্ষমতাই থাকবার ভারতীয় নিশ্চয়তা পেয়েছে। সেই জন্য দিল্লি যা কিছু চাইছে শেখ হাসিনার সরকার দুই হাত খুলে উজাড় করে তার সব কিছুই দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বিনিময়ে পাওয়া যাচ্ছে না কিছুই। কখনো কখনো বাচ্চাদের শান্ত করার জন্য মায়েরা যেমন শিশুদের হাতে দু-একটা চকোলেট তুলে দেয়, দিল্লি তেমনি দু-একটা চকোলেট দিয়ে বাংলাদেশকে সন্তুষ্ট রাখছে। ভারত বাংলাদেশের প্রতিবছর ৭০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করে। কিন্তু শুল্ক ও অশুল্ক নানা ধরনের বাধা তুলে বাংলাদেশের পণ্য রফতানিতে তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ ভারতে রফতানি করে প্রতিবছর মাত্র সাড়ে ৩৯ কোটি ডলারের পণ্য। সেও এক লেবেনচুষ কাহিনী। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পানি চুক্তি আছে শুধুমাত্র গঙ্গা নিয়ে। সেটিও ভারতকে যথেচ্ছ পানি প্রত্যাহারের গ্যারান্টি দেয়। আরো ৫৩ অভিন্ন নদী থেকে ভারত পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতায় থাকবার অদম্য নেশায় শেখ হাসিনা সরকার শুধুমাত্র সেটি হা করে তাকিয়ে দেখছে। কোথায়ও প্রতিবাদ নেই, পানির ন্যায্য হিস্যা চাইবার মতো শক্তি পর্যন্ত নেই। তার মধ্যে আসছে তিস্তা চুক্তির প্রশ্ন। শুকনো মৌসুমে তিস্তা শুধুই ধু-ধু বালুচর। প্রান্তরকে প্রান্তর আবাদি জমি মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গ খাঁখাঁ করছে। কিন্তু তা নিয়েও যেন জোরেশোরে কথা বলার শক্তি এই সরকারের নেই। দিল্লি আজ এ যুক্তি দেখায়, কাল সে যুক্তি দেখায়। কিন্তু তিস্তার পানি আমাদের ন্যায্য অধিকার, পাচ্ছি না কিছুই। : বাংলাদেশের এসব সমস্যার দিকে দিল্লি ফিরেও তাকায় না। সরকারও ভারত সরকারকে হুজুর হুজুর করতে থাকে। এখন ভারতের সাম্প্রতিকতম ইচ্ছা দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদন করা। তবে এটাই শেষ নয়। বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ সরকার এ দেশের ওপর দিয়ে আখাউড়া-আগারতলা, খুলনা-কলকাতা, আশুগঞ্জ, মংলা, চিটাগাং বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দিচ্ছে। আর এসব কাজের সুবিধার জন্য ফেনী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণেরও অনুমতি দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। ভারত সে কাজ দ্রুতই চালিয়ে যাচ্ছে। ফেনী, চট্টগ্রাম এলাকা বরাবর মিয়ানমার সীমান্ত। দুনিয়ার সবাই জানে যে, এই এলাকাটা বড় ধরনের যুদ্ধপ্রবণ। এমনকি এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বাহিনীও যুদ্ধ করেছিল। ফলে এই এলাকায় সংযোগ প্রতিষ্ঠা হলে ভারতীয় স্বাধীনতাকামীরা এই পথে বাংলাদেশের ওপর বহুমুখী হামলা চালাতে সক্ষম হবে। সেই কৌশলগত ধারণাও সরকারের ভেতর আছে বলে মনে হয় না। : দিল্লির সরকার শেখ হাসিনা সরকারকে সব সময় শিশু বলে মনে করে; এটা কোনো গোপন কথা নয়। হতে পারে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা সহায়তা করেছিল বলেই ভারতীয় শাসকশ্রেণীর মধ্যে এই মনোভাব প্রবল হয়েছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বলেই ভারতের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে সবকিছু করতে চায়, এমনকি তা যদি বাংলাদেশের স্বার্থের বিরোধীও হয়। ২০০৯ সাল থেকে ভারত বাংলাদেশকে ৩০০ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর সব কিছুই করেছে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের যুদ্ধরত ৭ রাজ্যের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই। কারণ কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি করিডোর হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে যেতে দীর্ঘ সময় লাগে আর সে পথ ঝুঁকিপূর্ণও বটে। আর সে জন্যই সমতল বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সহজে পণ্যসহ সামরিক সাজসরঞ্জাম নিয়ে যেতে চায় ভারত। এর শর্তগুলো অদ্ভূত। এসব কাজের টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে শুধুমাত্র ভারত। সব প্রকৌশলী, কর্মকর্তা, উপকরণ কিনতে হবে ভারত থেকে। বাংলাদেশ থেকে বড় জোর কিছু মুটে মজুর এখানে কাজ পেতে পারবে, বাকি সব ভারতের। ১০ টাকার পণ্যকে ১০ হাজার টাকা টেন্ডার দিলেও বাংলাদেশ সরকারের করবার কিছুই থাকবে না। ফলে বাংলাদেশের ভারতের কাছে ঋণই শুধু বাড়বে, লাভ কিছু হবে না। সবটুকু লাভ শুষে নেবে ভারতই। ১ কোটি টাকার কাজ করে ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেবে। : বাংলাদেশকে শোষণের ভারতীয় আর এক হাতিয়ার জ্বালানি। ভারতের অত্যধিক সালফারযুক্ত নিম্নমানের কয়লা, যা সেখানকার পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও আদালতের নির্দেশের ফলে ভারত ব্যবহার করতে পারছে না, সেই কয়লা দিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে তৈরি করা হচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প। লাখ লাখ টন ভারতীয় নিম্নমানের কয়লা আসবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে। ঢুকবে রামপালে, সেসব কয়লা জ্বলবে, চারদিকে দূষণ ছড়িয়ে পড়বে। বিপন্ন হয়ে পড়বে সুন্দরবন। তা ছাড়া গাধার নাকের সামনে যেমন মুলা ঝুলিয়ে তাকে দ্রুত চলতে উদ্বুদ্ধ করে তার মালিক, তেমনি নেপাল, ভুটানে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে তা বাংলাদেশে রফতানি করার মুলা ঝুলিয়ে রেখেছে ভারত। আর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার ভারতকে উজাড় করে দেয়ার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। এদিকে আবার এক চাতুর্যপূর্ণ চুক্তি করে নিয়েছে ভারত। সেটি হলো আঞ্চলিক সড়ক সংযোগ বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল) চুক্তি। কথা ছিল, এই চুক্তির বলে প্রত্যেক দেশ ভারতের ওপর দিয়ে অবাধে তাদের যানবাহন ও পণ্য নিয়ে অপর দেশে যেতে পারবে, পণ্য রফতানি করতে পারবে। কিন্তু নানা অজুহাতে আর ভুটানকে দিয়ে ভেটো দিয়ে সে প্রকল্পও আটকে দিয়েছে ভারত। ফলে একতরফাভাবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত সেই সুবিধা গ্রহণ করছে। আর বাংলাদেশ নেপাল, ভুটান এমনকি ভারতেও যেতে পারছে না। টাউটারি আর কাকে বলে! ভারত এখন চাইছে, একটি ব্যাপক প্রতিরক্ষা চুক্তি। যদিও এ ক্ষেত্রেও শেখ হাসিনা ও দিল্লির সরকারের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক বিরাজ করছে। ২০০৯ সাল থেকে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সেনাবাহিনী টু সেনাবাহিনী সরাসরি আলাপ-আলোচনা করছে। তারা সম্প্রীতির নামে যৌথ মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। এর ষষ্ঠ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে সর্বশেষ টাঙ্গাইলে। উপরন্তু বাংলাদেশের ঘোষিত পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে এ ধরনের মহড়া বা চুক্তি সঙ্গতিপূর্ণও নয়। তা সত্ত্বেও গত নভেম্বরে চুক্তির খসড়া নিয়ে ঢাকা সফরে এসেছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর। সেটি ভারত তখনই করেছে, যখন বাংলাদেশ চীন থেকে দুটি সাবমেরিন ক্রয় করে। মনোহর পারিকর ঢাকায় এসে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির এই প্রচেষ্টায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গেছেন বলে জানা যায়। : তবে এ কথা মানতেই হবে যে, দিল্লি ২৫ বছর মেয়াদি সামরিক সহযোগিতার চুক্তির প্রস্তাব বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তা ও অর্থনীতির কোনো দিক থেকেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি আমাদের সার্বভৌম স্বার্থের বিরোধী। দিল্লি ভারত থেকে অস্ত্রশস্ত্র কেনার জন্য বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার অফার করেছে। চুক্তিতেও এমন শর্ত থাকবে, একপক্ষ অন্য কোনো দেশ কর্তৃক আক্রান্ত হলে অন্যপক্ষ তাকে সহযোগিতা করবে, যেন সংশ্লিষ্ট দেশ নিজেই আক্রান্ত হয়েছে। এর অর্থ এই দাঁড়ায়, যদি চীন-ভারত যুদ্ধ বাধে, তাহলে সে যুদ্ধে বাংলাদেশ ভারতের পক্ষ হয়ে চীনের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে? কখনো নয়। বরং ভারতীয় এই ৫০ কোটি ডলার বাংলাদেশের নদীর তীরে বাঁধ দিয়ে মানুষের জানমাল রক্ষা করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। : এখন সময় এসেছে ভারতের মনোভাবের চুলচেরা বিশ্লেষণের। ভারতের সমস্যা হলো, তারা কোনো মুসলমানপ্রধান দেশে বিনিয়োগ করতে চায় না। কিন্তু তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, এই দেশগুলোকে ভারতের বাজারে পরিণত করা। বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ ভারী যানবাহন এবং ৭০ শতাংশ ছোট তিন চাকার সিএনজি ভারত থেকে আমদানি করা হয়। তা সত্ত্বেও ভারত এখানে যৌথ উদ্যোগে এ ধরনের যানবাহন তৈরির কারখানা করতে চায় না। যদি তা করত, তাহলে বাংলাদেশের হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হতো এবং এসব কোম্পানিও এমন খাতে টাকা বিনিয়োগ করতে চায়, যাতে তাদের ব্যবসা আরো রমরমা হয়ে ওঠে। শ্রীলঙ্কাও ২০১৩ সালে একই ধরনের বিপদে পড়েছিল। ভারত সেখানে নিম্নমানের যানবাহন ডাম্পিং করার চেষ্টা করছিল। তখন শ্রীলঙ্কার সরকার এসব যানবাহনের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করতে শুরু করে। সে মাত্রাও কম ছিল না। ১২০ শতাংশ করের জায়গায় করা হয়েছিল ২৯১ শতাংশ। ২০০ শতাংশ করের জায়গায় আরোপ করা হয়েছিল ৩৫০ শতাংশ কর। আর তিন চাকার যানবাহনের যেখানে কর ছিল ৫০-৬০ শতাংশ তা বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করা হয়েছিল। মোটরসাইকেলের ওপরও একইভাবে ১০০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছিল। আর তার ফলে যেখানে ভারত শ্রীলঙ্কায় বছরে ১০০ কোটি ডলারে যানবাহন রফতানি করত, তা নেমে এক বছরের মধ্যে ৩৫ কোটি ৭০ লাখ ডলাওে দাঁড়ায়। শ্রীলঙ্কার নিজস্ব শিল্প রক্ষা পায়। আর এর পরেই ভারতীয় যানবাহন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের উপর সর্ব শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। : বাংলাদেশে গড়পড়তা ১০ জন মানুষ প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। বহু মানুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে। এর সবই ঘটে ভারতীয় যানবাহন দ্বারা। বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের এ বিষয়টির প্রতিও নজর দেয়া দরকার। ভারতের রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রি, টাটা গ্রুপ, অশোক-লেল্যান্ড, হিরো মোটর করপোরেশন, এয়ারটেল, মেরিকো, গোদরেজ, ভিআইপি ইন্ডাস্ট্রিজ, সিয়েট টায়ার, আমবাত্তুর ক্লদিং, সাহারা এবং অন্যান্য কোম্পানি বাংলাদেশের বাজারে ঢোকায় স্থানীয় শিল্পগুলো বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া ভারতীয় টেলিভিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতরে এসব পণ্যের ব্যাপক প্রচারণাও চালানো হচ্ছে। টাটা চায়ের প্রচারণায় তেমনি প্রবল। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের চা শিল্পের সর্বনাশ ঘটবে। : বাংলাদেশ ইতিমধ্যে চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় যুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ভারতের সঙ্গে একই ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর করলে তা হবে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মিলিটারি হার্ডওয়্যার চীনের তৈরি। বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের সময় আড়াই হাজার কোটি ডলারের একটি নজিরবিহীন উন্নয়ন ঋণচুক্তি স্বাক্ষরে করেছে। এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ এলে বাংলাদেশের জিডিপি ৩ শতাংশ বাড়বে। আর সে কারণেই সরকারকে ভেবে দেখতে হবে দিল্লি না বেইজিং কার সঙ্গে সে গাঁটছড়া বাঁধবে। আমরা চাই উভয়ের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব আছে এবং থাকবে। কিন্তু দয়া করে ভারতের সঙ্গে কোনো সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করবেন না। সামনে বড় বিপদ হবে। : লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক : rezwansiddiqui@yahoo.com - See more at: http://www.dailydinkal.net/2017/03/2....roAdnqY2.dpuf ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
Comment