মানবাধিকার কী শুধু ইহুদী খ্রিস্টান বৌদ্ধ ও হিন্দুদের জন্যই?’
১৬ সেপ্টেম্বর,২০১৭
ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান: গত ২৪ আগস্ট মায়ানমারে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযানে’ রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এছাড়া তিন লাখেরও বেশি মানুষ শরণার্থী হয়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে। এ নারকীয় ঘটনাকে সাম্প্রতিককালের ‘সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়’ বলে আখ্যায়িত করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো। রাখাইনের খ্রিস্টান বিশপের মতে, এ পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে।
এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক সনদে স্বীকৃত রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এবং বিশ্বনেতারা যেভাবে এগিয়ে আসার কথা ছিল তা পরিলক্ষিত হয়নি। বরং এনিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বে এক ধরনের রাজনীতি শুরু হয়েছে। যা মানবাধিকার প্রশ্নে খুবই অনাকাঙ্খিত এবং অনভিপ্রেত।
যেখানে বিশ্বের সব পক্ষই বলছেন মায়ানমারে ‘জাতিগত নির্মূল ও গণহত্যা’ চলছে এবং এর স্বপক্ষে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রয়েছে সেখানে আন্তর্জাতিক মহলের ত্রাণ বিতরণ আর উদ্বেগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা মানে মায়ানমারের চরম বৌদ্ধত্ববাদীদের রোহিঙ্গা নিধন হত্যাযজ্ঞে আরো সুযোগ করে দেওয়া। আজ যেখানে গণহত্যা বন্ধে মায়ানমারের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান এবং অর্থনৈতিক অবরোধ দেওয়া অনিবার্য হয়ে পড়েছে সেখানে ত্রাণ বিতরণ আর উদ্বেগ প্রকাশ একবিংশ শতাব্দীর এই সভ্যতার স্বর্ণযুগে মানবাধিকারের সঙ্গে তামাসা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকাশ্যে গণহত্যা চলবে আর রাতের আঁধারে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করবো এ জন্যই কী জাতিসংঘ, ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গড়ে তোলা হয়েছিল? কখনোই নয়।
ফলে আমরা মনে করি, মায়ানমার গণহত্যা চালিয়ে যে ধরনের অমার্জনীয় অপরাধ করছে, আমরা বিশ্ববাসী নীরবতা পালন করে এর চেয়েও বড় অপরাধী। কেননা, মায়ানমার এমন কোনো শক্তিধর রাষ্ট্র নয় যে তাকে গণহত্যা বন্ধে বিশ্বনেতারা বাধ্য করতে পারবে না। অতীতের ঘটনা থেকে এটা দৃঢ়ভাবেই বলতে পারি- এ ধরনের গণহত্যা যদি রোহিঙ্গা মুসলিমদের ক্ষেত্রে না হয়ে অন্য কোনো ধর্মের লোকদের ক্ষেত্রে হতো এতোদিন এর প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতে পারতো। এতোদিনে চীন, রাশিয়া ও মার্কিনিরাসহ বিশ্বের শক্তিধর নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়তেন, চালাতেন সামরিক অভিযান। যেমনটি ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার অজুহাতে ২০০২ সালের ২০ মে ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্ব তিমুরকে এবং ২০১১ সালের ৯ জুলাই সুদান থেকে দক্ষিণ সুদানকে জাতিসংঘ কর্তৃক পৃথক রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে তড়িত মোতায়েন করা হয়েছিল শান্তি রক্ষী মিশনকে। আজ তারা কোথায়, তাদের বিবেক কোথায়? মুসলিমরা নিধন হলে নীরব, আর অন্যদের সামান্য কিছু হলেই সরব। তাহরে মানবাধিকার কী শুধু ইহুদী, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও হিন্দুদের জন্যই?
অথচ আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী বিশ্বের যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটুক না কেন, তা বন্ধে এবং মানবাধিকারের সুরক্ষায় আমরা সবাই বদ্ধপরিকর। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিধনে বিশ্ব নেতাদের এ ধরনের নীরবতায় ধিক্কার জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে শুধু আন্তর্জাতিক পর্যায়েই নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও নোংরা রাজনীতি হচ্ছে। কী আওয়ামী লীগ, কী বিএনপি সবাই এ ইস্যুতে যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ। কেননা, গত ২৪ আগস্ট মায়ানমারে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান তথা রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরু হওয়ার পর তাদের যেধরনের ভূমিকা পালনের কথা ছিল তা পরিলক্ষিত হয়নি। বরং এক্ষেত্রে প্রথমদিকে সরকারের ভূমিকা খুবই ন্যাক্কারজনক ছিল- সীমান্তে বিজিবি রোহিঙ্গাদের প্রবেশের সুযোগ না দিয়ে তাদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। এছাড়া, রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে বিশ্বে এতো তোলপাড়, এতো উদ্বেগ-নিন্দা অথচ বাংলাদেশের কোনো দায়িত্বশীল নেতাকে রোহিঙ্গাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। অথচ কয়েক হাজার কিলোমিটার দূর থেকে তুর্কি ফার্স্টলেডি রোহিঙ্গাদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করতে এলেও তাকে যথাযথ সম্মান দেখানো হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, গত ২৪ আগস্ট মায়ানমারে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান শুরুর পর রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমাদের সরকার তাদের বাধা দিয়েছে। আর যারা গোপনে প্রবেশ করেছিল তাদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এরপর আমরা কী দেখলাম- ৩১ আগস্ট যখন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদকে ফোন করে বললেন ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিন, আমরা সব ব্যয় বহন করবো’ এরপরই সরকারের ভূমিকা রাতারাতি পাল্টে গেল। সীমান্তে রোহিঙ্গা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ও বাধা প্রত্যাহার করে নেয়া হল। এরপর কয়েকদিনেই প্রবেশ করলো চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী। এতে আমরা কী বুঝলাম- আমাদের সরকার মানবাধিকার প্রশ্নে নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ত্রাণ ও দানের প্রত্যাশায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছেন, তাই নয় কী?
যদি বিএনপির কথায় আসি- আপনারা এতো গলাবাজি করছেন, কই এতোদিন হয়ে গেল আপনাদের কোনো নেতাকে তো সরাসরি রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাধীন আরাকানের কথা বলতে শোনেনি। জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য বাম রাজনীতির চেতনাবাহী নেতাদের কথা নাইবা বললাম। ফলে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্যে বলবো- শুধু গলাবাজিতে সবকিছু হয় না, কার্যক্ষেত্রে প্রমাণ করার সময় এসেছে কে কতটুকু মানবতাবাদী। আসুন আমরা নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিম ভাই-বোনদের নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করে তাদেরকে বাঁচাতে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসি। অন্যথা দুনিয়াতে তো বটেই কাল কিয়ামতের দিনও মহান আল্লাহর কাছে আমরা জবাবদিহী করতে পারবো না।
এবার আসি রোহিঙ্গাদের প্রকৃত চাহিদা কথায়। মায়ানমারের সহিংসতা শুরুর পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকেই ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন, আবার অনেকে উদ্বেগ নিন্দা প্রকাশ করে এগিয়ে এসেছেন। এগুলো সবই ইতিবাচক এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশ্বে এ নিয়ে এতো তোলপাড় সৃষ্টি হলেও কেউ আর রোহিঙ্গাদের আসল প্রয়োজনের কথায় আসছেন না। বরং তাদের বিদ্রোহী আখ্যা দিয়ে সন্ত্রাসী তথা জঙ্গি বানানো চেষ্টা চলছে।রবিবার সকালে যখন রোহিঙ্গা স্বাধীনতাকামীদের সংগঠন আরসা’র অস্ত্রবিরতির ঘোষণা নিয়ে বিবিসির একটি প্রতিবেদন পড়ছিলাম তখন আরো বেশি ব্যথিত হয়েছি। কেননা, ওই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা স্বাধীনতাকামীদের বিদ্রোহী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে শুধু বিশ্বনেতারাই নয়, এক শ্রেণীর সাংবাদিকরাও যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের স্বাধীনতার প্রকৃত দাবিকে উপেক্ষা করে সন্ত্রাসী বানানোর চেষ্টা করছেন তা অনেকটাই দিবালোকের মতো পরিস্কার। এটা খুবই উদ্বেগজনক।
অন্যদিকে গত তিন সপ্তাহের ঘটনা প্রবাহ পর্যবেক্ষণে যা বুঝলাম তাতে নিপীড়িত রোহিঙ্গারা আজীবন এদেশে শরণার্থী হিসেবে থেকে যাওয়ার জন্য আসেনি, কিংবা একটু ত্রাণের আশায় আসেনি। তারা এসেছেন জীবন বাঁচাতে, স্বাধীনতার ভয়েস রেইজ করতে। বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতার বক্তব্য অনুসারে- এই মুহূর্তে তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্বাধীনতা সংগ্রামে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন। কিন্তু বিশ্বনেতারা বরাবরই তাদের এই দাবী এড়িয়ে রক্ত পিপাসু সু চি সূরে সূর মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
অনেকেই রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বলছেন, মায়ানমারকে চাপ দিয়ে সহিংসতা বন্ধ এবং রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে পারলেই সঙ্কটের সমাধান হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বলবো- যারা এসব বলছেন তারা মূলত রোহিঙ্গাদের ফের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাচ্ছেন। আমরা তাদের এ ধরনের স্লোগানের চরম বিরোধিতা করছি।
আমরা আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আহ্বান রাখবো- যেখানে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভূমি বাড়িঘর দখল করে নিচ্ছে, নাগরিকত্ব অস্বীকার করে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে সেখানে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দিয়ে রক্তপিপাসু বৌদ্ধদের রক্তের খোরাক যোগানোর কোনো মানে হয় না। রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনাদের সমর্থন দিতে আপত্তি কোথায়? রক্তখেকো বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে যদি আপনাদের আপত্তি থাকে তবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন দিন, তাও না পারলে অন্তত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যে আরাকানের হাজার বছরের বাসিন্দা তা স্বীকার করুন। আর এটাও যদি না পারেন অন্তত নীরবই থাকেন, এরপরও তাদেরকে বিদ্রোহী সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করবেন না। তাদেরকে বিদ্রোহী সন্ত্রাসী বানানোর অপচেষ্টা থেকে আপনারা বিরত থাকলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আরাকানের স্বাধীনতার জন্য রোহিঙ্গা মুসলিমরা নিজেরাই যথেষ্ট।
আজকের নিবন্ধে আমি কাউকে ইতিহাসের পাঠ পড়াতে আসিনি। আপনারা যারা রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী বলার চেষ্টা করছেন তারাই বরং সভ্যতা বিকাশের ইতিহাস ঘেটে দেখুন- রোহিঙ্গারা আরাকানের কত শত বছরের বাসিন্দা। তাদেরকে কীভাবে বৌদ্ধরা ভূমিহীন করার চেষ্টা করছে, কীভাবে তাদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূলের চেষ্টা করছে, কীভাবে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে। একমাত্র রক্তপিপাসু সু চি আর তার বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ছাড়া পৃথিবীর এমন কেউ নেই যে রোহিঙ্গাদের ভূমি আরাকানের কথা অস্বীকার করতে পারে। ইতিহাস বলে সেই সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানিদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তীতে চাঁটগাইয়া, রাখাইন, আরাকানি, বার্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের মিশ্রণে উদ্ভুত এই সংকর জাতি এয়োদশ-চর্তুদশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পঞ্চদশ শতাব্দী হতে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের আরাকান রাজ্য নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্যের কথা সব সভ্যতার ইতিহাসেই সুলিখিত রেকর্ড। আজ বৌদ্ধরা এ চরম সত্যকে অস্বীকারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিধনে ইহুদীবাদী ইসরাইল ও হিন্দুত্ববাদী ভারতের ন্যায় মায়ানমারকে চরম বৌদ্ধত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করছে।
পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আজ বিভীষিকাময় অবস্থা। গত দুসপ্তাহে রাষ্ট্রীয় বাহিনী আর বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর চালানো ‘গণহত্যায়’ আরাকানের সর্বত্র লাশ আর লাশ, পথে প্রান্থরে মুসলিম রোহিঙ্গাদের রক্তের বন্যা, আগুনে পোড়া লাশের দুর্গন্ধে আরাকানের বাতাস দুর্গন্ধময় হয়ে উঠেছে। এসব কিছু গোপন করতেই সু চির সরকারের বাহিনী সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, সমাজকর্মীসহ আন্তর্জাতিক মহলের সদস্যদের সেখানে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। এতে সহজেই অনুমেয় সেখানকার পরিস্থিতি কতটা বিভীষিকাময়।
জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতাদের বলবো- মানবাধিকার প্রশ্নে আপনারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করুন। মুসলিম তথা জাতিগত বিদ্বেষী না হয়ে আরাকানের স্বাধীনতা সংগ্রামে রোহিঙ্গাদের সমর্থন দিন। ত্রাণ নয়, তাদের স্বাধীনতাই এখন বড় প্রয়োজন। তাই জাতিসংঘ কর্তৃক অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের জন্য আরাকানকে পৃথক রাষ্ট্র ঘোষণা করা হোক। বাংলাদেশের হর্তাকর্তাদেরও বলবো- নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমরা আমাদের জন্য অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফলে তাদের বদৌলতে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরার এটাই অপূর্ব সুযোগ। আসুন, সকল ভেদাভেদ ভুলে স্বার্থের নোংরা রাজনীতি বাদ দিয়ে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠায় আমরা সবাই যথাযথ ভূমিকা পালন করি। অন্যথা এর জন্য আমাদেরকে কঠোর মাসুল গুণতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আর সবশেষে নির্যাতিত নিপীড়িত আমার রোহিঙ্গা মুসলিম ভাই-বোনদের উদ্দেশ্যে বলবো, জানি আপনাদের অনেকে সন্তানহারা, বাবা-মা হারা, স্বামী হারা, স্ত্রী হারা কিংবা স্বজন হারা, অনেক মা-বোন ইজ্জত হারা হয়ে আর্তচিৎকার করছেন। আপনাদের রক্তে আরাকান ভাসছে। ইতিহাস সাক্ষী- কারো রক্ত কখনো বৃথা যায় না। রক্ত যদি স্বাধীনতার দাম হয় তাহলে বসনিয়া, ফিলিস্তিন, আলজেরিয়াসহ বিশ্বের অনেক জনপদই চড়া দামে তা কিনতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আপনাদের সংগ্রামে সমর্থন দেউক আর নাইবা দেউক, আরাকানের স্বাধীনতা আসন্ন ও অনিবার্য। হে আল্লাহ, নির্যাতিত জনপদ আরাকানের বাসিন্দাদের রক্তকে কবুল কর, আর রক্তের বিনিময়ে তাদেরকে ফিরিয়ে স্বাধীন ও নিরাপদ আরাকান। তুমি তো সরাসরি মজলুমদের আহাজারি শুনতে পাও, তাই রোহিঙ্গা মুসলিমদের কবুল কর। আমিন!
১৬ সেপ্টেম্বর,২০১৭
ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান: গত ২৪ আগস্ট মায়ানমারে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযানে’ রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এছাড়া তিন লাখেরও বেশি মানুষ শরণার্থী হয়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে। এ নারকীয় ঘটনাকে সাম্প্রতিককালের ‘সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়’ বলে আখ্যায়িত করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো। রাখাইনের খ্রিস্টান বিশপের মতে, এ পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে।
এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক সনদে স্বীকৃত রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এবং বিশ্বনেতারা যেভাবে এগিয়ে আসার কথা ছিল তা পরিলক্ষিত হয়নি। বরং এনিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বে এক ধরনের রাজনীতি শুরু হয়েছে। যা মানবাধিকার প্রশ্নে খুবই অনাকাঙ্খিত এবং অনভিপ্রেত।
যেখানে বিশ্বের সব পক্ষই বলছেন মায়ানমারে ‘জাতিগত নির্মূল ও গণহত্যা’ চলছে এবং এর স্বপক্ষে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রয়েছে সেখানে আন্তর্জাতিক মহলের ত্রাণ বিতরণ আর উদ্বেগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা মানে মায়ানমারের চরম বৌদ্ধত্ববাদীদের রোহিঙ্গা নিধন হত্যাযজ্ঞে আরো সুযোগ করে দেওয়া। আজ যেখানে গণহত্যা বন্ধে মায়ানমারের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান এবং অর্থনৈতিক অবরোধ দেওয়া অনিবার্য হয়ে পড়েছে সেখানে ত্রাণ বিতরণ আর উদ্বেগ প্রকাশ একবিংশ শতাব্দীর এই সভ্যতার স্বর্ণযুগে মানবাধিকারের সঙ্গে তামাসা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকাশ্যে গণহত্যা চলবে আর রাতের আঁধারে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করবো এ জন্যই কী জাতিসংঘ, ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গড়ে তোলা হয়েছিল? কখনোই নয়।
ফলে আমরা মনে করি, মায়ানমার গণহত্যা চালিয়ে যে ধরনের অমার্জনীয় অপরাধ করছে, আমরা বিশ্ববাসী নীরবতা পালন করে এর চেয়েও বড় অপরাধী। কেননা, মায়ানমার এমন কোনো শক্তিধর রাষ্ট্র নয় যে তাকে গণহত্যা বন্ধে বিশ্বনেতারা বাধ্য করতে পারবে না। অতীতের ঘটনা থেকে এটা দৃঢ়ভাবেই বলতে পারি- এ ধরনের গণহত্যা যদি রোহিঙ্গা মুসলিমদের ক্ষেত্রে না হয়ে অন্য কোনো ধর্মের লোকদের ক্ষেত্রে হতো এতোদিন এর প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতে পারতো। এতোদিনে চীন, রাশিয়া ও মার্কিনিরাসহ বিশ্বের শক্তিধর নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়তেন, চালাতেন সামরিক অভিযান। যেমনটি ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার অজুহাতে ২০০২ সালের ২০ মে ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্ব তিমুরকে এবং ২০১১ সালের ৯ জুলাই সুদান থেকে দক্ষিণ সুদানকে জাতিসংঘ কর্তৃক পৃথক রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে তড়িত মোতায়েন করা হয়েছিল শান্তি রক্ষী মিশনকে। আজ তারা কোথায়, তাদের বিবেক কোথায়? মুসলিমরা নিধন হলে নীরব, আর অন্যদের সামান্য কিছু হলেই সরব। তাহরে মানবাধিকার কী শুধু ইহুদী, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও হিন্দুদের জন্যই?
অথচ আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী বিশ্বের যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটুক না কেন, তা বন্ধে এবং মানবাধিকারের সুরক্ষায় আমরা সবাই বদ্ধপরিকর। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিধনে বিশ্ব নেতাদের এ ধরনের নীরবতায় ধিক্কার জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে শুধু আন্তর্জাতিক পর্যায়েই নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও নোংরা রাজনীতি হচ্ছে। কী আওয়ামী লীগ, কী বিএনপি সবাই এ ইস্যুতে যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ। কেননা, গত ২৪ আগস্ট মায়ানমারে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান তথা রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরু হওয়ার পর তাদের যেধরনের ভূমিকা পালনের কথা ছিল তা পরিলক্ষিত হয়নি। বরং এক্ষেত্রে প্রথমদিকে সরকারের ভূমিকা খুবই ন্যাক্কারজনক ছিল- সীমান্তে বিজিবি রোহিঙ্গাদের প্রবেশের সুযোগ না দিয়ে তাদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। এছাড়া, রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে বিশ্বে এতো তোলপাড়, এতো উদ্বেগ-নিন্দা অথচ বাংলাদেশের কোনো দায়িত্বশীল নেতাকে রোহিঙ্গাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। অথচ কয়েক হাজার কিলোমিটার দূর থেকে তুর্কি ফার্স্টলেডি রোহিঙ্গাদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করতে এলেও তাকে যথাযথ সম্মান দেখানো হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, গত ২৪ আগস্ট মায়ানমারে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান শুরুর পর রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমাদের সরকার তাদের বাধা দিয়েছে। আর যারা গোপনে প্রবেশ করেছিল তাদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এরপর আমরা কী দেখলাম- ৩১ আগস্ট যখন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদকে ফোন করে বললেন ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিন, আমরা সব ব্যয় বহন করবো’ এরপরই সরকারের ভূমিকা রাতারাতি পাল্টে গেল। সীমান্তে রোহিঙ্গা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ও বাধা প্রত্যাহার করে নেয়া হল। এরপর কয়েকদিনেই প্রবেশ করলো চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী। এতে আমরা কী বুঝলাম- আমাদের সরকার মানবাধিকার প্রশ্নে নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ত্রাণ ও দানের প্রত্যাশায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছেন, তাই নয় কী?
যদি বিএনপির কথায় আসি- আপনারা এতো গলাবাজি করছেন, কই এতোদিন হয়ে গেল আপনাদের কোনো নেতাকে তো সরাসরি রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাধীন আরাকানের কথা বলতে শোনেনি। জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য বাম রাজনীতির চেতনাবাহী নেতাদের কথা নাইবা বললাম। ফলে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্যে বলবো- শুধু গলাবাজিতে সবকিছু হয় না, কার্যক্ষেত্রে প্রমাণ করার সময় এসেছে কে কতটুকু মানবতাবাদী। আসুন আমরা নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিম ভাই-বোনদের নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করে তাদেরকে বাঁচাতে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসি। অন্যথা দুনিয়াতে তো বটেই কাল কিয়ামতের দিনও মহান আল্লাহর কাছে আমরা জবাবদিহী করতে পারবো না।
এবার আসি রোহিঙ্গাদের প্রকৃত চাহিদা কথায়। মায়ানমারের সহিংসতা শুরুর পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকেই ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন, আবার অনেকে উদ্বেগ নিন্দা প্রকাশ করে এগিয়ে এসেছেন। এগুলো সবই ইতিবাচক এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশ্বে এ নিয়ে এতো তোলপাড় সৃষ্টি হলেও কেউ আর রোহিঙ্গাদের আসল প্রয়োজনের কথায় আসছেন না। বরং তাদের বিদ্রোহী আখ্যা দিয়ে সন্ত্রাসী তথা জঙ্গি বানানো চেষ্টা চলছে।রবিবার সকালে যখন রোহিঙ্গা স্বাধীনতাকামীদের সংগঠন আরসা’র অস্ত্রবিরতির ঘোষণা নিয়ে বিবিসির একটি প্রতিবেদন পড়ছিলাম তখন আরো বেশি ব্যথিত হয়েছি। কেননা, ওই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা স্বাধীনতাকামীদের বিদ্রোহী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে শুধু বিশ্বনেতারাই নয়, এক শ্রেণীর সাংবাদিকরাও যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের স্বাধীনতার প্রকৃত দাবিকে উপেক্ষা করে সন্ত্রাসী বানানোর চেষ্টা করছেন তা অনেকটাই দিবালোকের মতো পরিস্কার। এটা খুবই উদ্বেগজনক।
অন্যদিকে গত তিন সপ্তাহের ঘটনা প্রবাহ পর্যবেক্ষণে যা বুঝলাম তাতে নিপীড়িত রোহিঙ্গারা আজীবন এদেশে শরণার্থী হিসেবে থেকে যাওয়ার জন্য আসেনি, কিংবা একটু ত্রাণের আশায় আসেনি। তারা এসেছেন জীবন বাঁচাতে, স্বাধীনতার ভয়েস রেইজ করতে। বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতার বক্তব্য অনুসারে- এই মুহূর্তে তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্বাধীনতা সংগ্রামে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন। কিন্তু বিশ্বনেতারা বরাবরই তাদের এই দাবী এড়িয়ে রক্ত পিপাসু সু চি সূরে সূর মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
অনেকেই রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বলছেন, মায়ানমারকে চাপ দিয়ে সহিংসতা বন্ধ এবং রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে পারলেই সঙ্কটের সমাধান হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বলবো- যারা এসব বলছেন তারা মূলত রোহিঙ্গাদের ফের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাচ্ছেন। আমরা তাদের এ ধরনের স্লোগানের চরম বিরোধিতা করছি।
আমরা আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আহ্বান রাখবো- যেখানে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভূমি বাড়িঘর দখল করে নিচ্ছে, নাগরিকত্ব অস্বীকার করে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে সেখানে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দিয়ে রক্তপিপাসু বৌদ্ধদের রক্তের খোরাক যোগানোর কোনো মানে হয় না। রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনাদের সমর্থন দিতে আপত্তি কোথায়? রক্তখেকো বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে যদি আপনাদের আপত্তি থাকে তবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন দিন, তাও না পারলে অন্তত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যে আরাকানের হাজার বছরের বাসিন্দা তা স্বীকার করুন। আর এটাও যদি না পারেন অন্তত নীরবই থাকেন, এরপরও তাদেরকে বিদ্রোহী সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করবেন না। তাদেরকে বিদ্রোহী সন্ত্রাসী বানানোর অপচেষ্টা থেকে আপনারা বিরত থাকলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আরাকানের স্বাধীনতার জন্য রোহিঙ্গা মুসলিমরা নিজেরাই যথেষ্ট।
আজকের নিবন্ধে আমি কাউকে ইতিহাসের পাঠ পড়াতে আসিনি। আপনারা যারা রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী বলার চেষ্টা করছেন তারাই বরং সভ্যতা বিকাশের ইতিহাস ঘেটে দেখুন- রোহিঙ্গারা আরাকানের কত শত বছরের বাসিন্দা। তাদেরকে কীভাবে বৌদ্ধরা ভূমিহীন করার চেষ্টা করছে, কীভাবে তাদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূলের চেষ্টা করছে, কীভাবে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে। একমাত্র রক্তপিপাসু সু চি আর তার বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ছাড়া পৃথিবীর এমন কেউ নেই যে রোহিঙ্গাদের ভূমি আরাকানের কথা অস্বীকার করতে পারে। ইতিহাস বলে সেই সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানিদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তীতে চাঁটগাইয়া, রাখাইন, আরাকানি, বার্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের মিশ্রণে উদ্ভুত এই সংকর জাতি এয়োদশ-চর্তুদশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পঞ্চদশ শতাব্দী হতে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের আরাকান রাজ্য নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্যের কথা সব সভ্যতার ইতিহাসেই সুলিখিত রেকর্ড। আজ বৌদ্ধরা এ চরম সত্যকে অস্বীকারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিধনে ইহুদীবাদী ইসরাইল ও হিন্দুত্ববাদী ভারতের ন্যায় মায়ানমারকে চরম বৌদ্ধত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করছে।
পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আজ বিভীষিকাময় অবস্থা। গত দুসপ্তাহে রাষ্ট্রীয় বাহিনী আর বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর চালানো ‘গণহত্যায়’ আরাকানের সর্বত্র লাশ আর লাশ, পথে প্রান্থরে মুসলিম রোহিঙ্গাদের রক্তের বন্যা, আগুনে পোড়া লাশের দুর্গন্ধে আরাকানের বাতাস দুর্গন্ধময় হয়ে উঠেছে। এসব কিছু গোপন করতেই সু চির সরকারের বাহিনী সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, সমাজকর্মীসহ আন্তর্জাতিক মহলের সদস্যদের সেখানে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। এতে সহজেই অনুমেয় সেখানকার পরিস্থিতি কতটা বিভীষিকাময়।
জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতাদের বলবো- মানবাধিকার প্রশ্নে আপনারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করুন। মুসলিম তথা জাতিগত বিদ্বেষী না হয়ে আরাকানের স্বাধীনতা সংগ্রামে রোহিঙ্গাদের সমর্থন দিন। ত্রাণ নয়, তাদের স্বাধীনতাই এখন বড় প্রয়োজন। তাই জাতিসংঘ কর্তৃক অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের জন্য আরাকানকে পৃথক রাষ্ট্র ঘোষণা করা হোক। বাংলাদেশের হর্তাকর্তাদেরও বলবো- নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমরা আমাদের জন্য অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফলে তাদের বদৌলতে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরার এটাই অপূর্ব সুযোগ। আসুন, সকল ভেদাভেদ ভুলে স্বার্থের নোংরা রাজনীতি বাদ দিয়ে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠায় আমরা সবাই যথাযথ ভূমিকা পালন করি। অন্যথা এর জন্য আমাদেরকে কঠোর মাসুল গুণতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আর সবশেষে নির্যাতিত নিপীড়িত আমার রোহিঙ্গা মুসলিম ভাই-বোনদের উদ্দেশ্যে বলবো, জানি আপনাদের অনেকে সন্তানহারা, বাবা-মা হারা, স্বামী হারা, স্ত্রী হারা কিংবা স্বজন হারা, অনেক মা-বোন ইজ্জত হারা হয়ে আর্তচিৎকার করছেন। আপনাদের রক্তে আরাকান ভাসছে। ইতিহাস সাক্ষী- কারো রক্ত কখনো বৃথা যায় না। রক্ত যদি স্বাধীনতার দাম হয় তাহলে বসনিয়া, ফিলিস্তিন, আলজেরিয়াসহ বিশ্বের অনেক জনপদই চড়া দামে তা কিনতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আপনাদের সংগ্রামে সমর্থন দেউক আর নাইবা দেউক, আরাকানের স্বাধীনতা আসন্ন ও অনিবার্য। হে আল্লাহ, নির্যাতিত জনপদ আরাকানের বাসিন্দাদের রক্তকে কবুল কর, আর রক্তের বিনিময়ে তাদেরকে ফিরিয়ে স্বাধীন ও নিরাপদ আরাকান। তুমি তো সরাসরি মজলুমদের আহাজারি শুনতে পাও, তাই রোহিঙ্গা মুসলিমদের কবুল কর। আমিন!
Comment