ফিলিস্তিনের স্মৃতি ”
।।শহীদ ড. আবদুল্লাহ আযযাম রহ. ||
এর থেকে – সপ্তম পর্ব
।।শহীদ ড. আবদুল্লাহ আযযাম রহ. ||
এর থেকে – সপ্তম পর্ব
কৌশল পরিবর্তন
আমি বললাম, আমরা পেশোয়ারে বসে আছি কেনো? আরব থেকে লোকেরা আসছিলো। তারা একসঙ্গে থাকলেও তাদের ভেতর বিভিন্ন গ্রুপ ছিলো। কারো ভেতর আফগানিস্তানে জিহাদ করার মনোভাব ছিলো আবার কারো ভেতর এই মনোভাব ছিলো না। অনেকে আবার পরস্পরের সমালোচনাও করতো। কেউ একটি দলে যোগ দিলে অপর দলের বিরুদ্ধে কথা বলতো। একটি সংগঠনে যোগ দিলে অপর সংগঠনের সমালোচনা করতো। অধিকাংশ আরব তিনদিন বা একসপ্তাহ থাকতো আবার কেউ কেউ একমাসও অবস্থান করতো। তারপর ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে যেতো। আমি বললাম, যারা আরব থেকে এসেছে এবং আফগান ভাইদের থেকে দূরে রয়েছে আমরা তাদেরকে নিয়ে কাজ করতে চাই। তারা হয়তো যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে তাদের সংকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে না। সময়-সুযোগ মতো আমরা তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে চাই। আমরা তাদেরকে বোঝাবো যে, এই জিহাদই পৃথিবীতে একমাত্র ইসলামি জিহাদ। তারপর আমরা তাদেরকে আফগানিস্তানের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দেবো। তারা আফগানিস্তানের ভেতরে তাদের দায়িত্ব পালন করবে।
এই লক্ষ্য নিয়ে আমরা একটি অফিস খুলে ফেললাম। অফিসের নাম দিলাম মাকতাবুল খেদমাহ্ বা সেবা দপ্তর। মাকতাবুল খেদমাহ্ এই কারণে যে, আমরা মুজাহিদদের এবং যারা মুজাহিদদের সহায়তায় এগিয়ে আসবে তাদের খেদমত করবো। আরব থেকে যারা আসবে তাদের প্রত্যেকের জন্যে আমরা এই মহান ইবাদতকে সহজ করার দায়িত্ব কাঁধে নিলাম। আমরা তাদেরকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসবো। তাদের জন্যে সম্মেলনের ব্যবস্থা করবো এবং তাদেরকে উৎসাহ প্রদান করবো। তাদেরকে গাড়িতে করে পেশোয়ারে নিয়ে আসবো তারপর প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠিয়ে দেবো। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর তাদেরকে ভাগ ভাগ করে আফগানিস্তানে পাঠাবো। আমরা যা চিন্তা করেছি তা হলো আরব থেকে আগত মুজাহিদদের এভাবে দায়-দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আফগানিস্তানের ভেতরে প্রবেশ করার পর আমাদের কর্মপন্থা কী হবে তাই আমরা প্রথমে ভেবেছি। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো নিম্নরূপ :
১. আমরা আফগান জিহাদের বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করার চেষ্টা করবো। পেশোয়ারে আমাদেরকে যা বলা হয়েছে তা কি আসলেই বাস্তব না বাস্তব নয়?
২. আফগানিস্তানের ভেতরে বিভিন্ন ফ্রন্ট এবং সেখানে যারা কাজ করছে তাদের অবস্থা কী?
৩. আরব যুবকদের মধ্যে যারা শাহাদাত-পিপাসু তারা তাদের শাহাদাতের পিপাসা তৃপ্ত করবে। আল্লাহপাক যাকে ইচ্ছা নির্বাচন করেন এবং তাকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করেন।
৪. তারপর আমাদের হাতে যে-সহায়তা রয়েছে তা যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে দেবো।
অপ্রত্যাশিত ব্যাপার
আরবরা আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। তাদের উদ্দেশ্যগুলো আমার মাথায় ছিলো। আমি ভাবলাম আফগানিস্তানে তাদের অনেক কাজ রয়েছে। তারা বিপুল কাজকর্ম আঞ্জাম দেবে এবং পীড়িত এলাকাগুলোকে সজীব করে তুলবে।
আফগানরা যখন শুনলো তাদের এলাকায় আরবরা প্রবেশ করছে, তারা তাদের দেখার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে রইলো। তারা আরবদের স্বাগত জানানোর জন্যে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে এলো। আশি, নব্বই, একশো বছরের বৃদ্ধরা এলো, তরুণ-যুবারা এলো, এমনকি শিশু-কিশোররাও এলো। তারা আরব মেহমানদের আসবাবপত্র ও মালসামানা বহন করে নিয়ে চললো। ছোটো ছোটো ছেলেরাও যার যার সাধ্যমতো জিনিস বহন করে নিয়ে চললো। বরফঢাকা পথ, পাথুরে পথ পাড়ি দিয়ে তারা তিন-চার দিন হেঁটে তাদের গন্তব্যে পৌঁছলো। আরবরা তাদেরকে কুরআন পড়ে শোনালো। ছোটোদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আদর করলো। আফগানরা বাড়িতে ফিরে গিয়ে গর্বে সঙ্গের বললো, আমরা আরবদের দেখেছি। তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে এসেছি। যখনই কোনো আফগান কোনো আরবকে দেখতো তাদেরকে জড়িয়ে ধরতো। 'হে আল্লাহর রাসুলের নাতি' বলে তাদের সম্বোধন করতো। তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বলতো, তোমরা আমাদের দেশকে রক্ষা করার জন্যে এসেছো।
আরবরা যে-পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে আফগানিস্তানে গিয়েছিলো আফগান জনগণের কাছে বিভিন্ন সহায়তা পৌঁছে দেয়া—এই পরিকল্পনার চেয়েও যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তাদের সামনে ছিলো তা হলো আফগান জনগণের শিক্ষা, তাদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল চাঙ্গা করা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় আন্দোলন সৃষ্টি করা। অনেক এলাকা আরবদের অপেক্ষায় ছিলো যে তারা সেখানে আসবে এবং কার্যক্রম শুরু করবে। কিন্তু আরবরা গুলি চালানোর জন্যে অস্থির ছিলো। 'কোথায় অপারেশন', 'কোথায় যুদ্ধক্ষেত্র', 'আমরা শাহাদাত বরণ করতে চাই', 'কোথায় আয়তলোচনা হুর', এইসব বলে তারা হাহাকার করে উঠলো। তারা কমান্ডারকে একবার, দুইবার এবং বারবার পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। কমান্ডার যদি কোনো অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। তাহলে তারা সেটা বাস্তবায়ন করবে। আর আমাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো অপারেশন অব্যাহত রাখা। শত্রুদের নিশ্বাস ফেলারও সুযোগ না দেয়ার পরিকল্পনা আমাদের ছিলো। আমরা তাদেরকে মরণকামড় দিয়ে ধরতে চেয়েছিলাম, যাতে তারা এক মুহূর্তের জন্যে স্বস্তিতে থাকতে না পারে।
তারপরও আমাদের মনে হয়েছিলো, আরবদের জন্যে উপযুক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আফগান জনগণের জন্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা, আত্মবিশ্বাসে তাদেরকে বলীয়ান করা। কারণ আফগানিস্তানে যুগযুগ ধরে যুদ্ধ চলছে। এসব এলাকার আলেমগণ ও আল্লাহর পথের দায়িগণ আগেই শাহাদাত বরণ করেছিলেন। ফলে পরবর্তী বংশধর মূর্খ হয়ে পড়ে। নেতৃত্বের যোগ্যতা দূরে থাকুক সাধারণ ইসলামি জ্ঞানও তাদের ছিলো না। আফগানিস্তানে এমন অনেক এলাকা ছিলো যেখানকার লোকেরা সুরা ফালাক সুরা নাসও জানতো না। আরবদের কাছে একসময় অনুভূত হয় যে তাদের আবশ্যক কর্তব্য হলো আফগানদের শিক্ষাদান করা। তাদেরকে কুরআনের শিক্ষাদান করা। কারণ আফগানদের হৃদয়ে প্রবেশের একমাত্র চাবি হলো আল কুরআন। তাই যে-যুবকই কুরআনের মাধ্যমে তাদের মাঝে প্রবেশ করেছে তারা তাকে বরণ করে নিয়েছে। তাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছে। আমি ভাই সাঈদ আল- জাযায়েরি এবং ভাই আবু আসেম সম্পর্কে অন্যত্র লিখেছি। আবু আসেম আহমদ শাহ মাসউদের কাছে যান। আহমদ শাহ মাসউদ আবু আসেমের কাছে তিরিশজন কমান্ডারকে অর্পণ করেন। এই কমান্ডারগণ রুশ বাহিনীকে পরাস্ত করেছিলেন। তারা কয়েক বছরে রুশ বাহিনীর চারশো পাঁচশো ট্যাঙ্ক চূর্ণবিচূর্ণ করেছিলেন। আর আহমদ শাহ মাসউদ তাদেরকেই কুরআন শেখার জন্যে আবু আসেমের নিকট অর্পণ করলেন। আবু আসেম তাদের মাঝে একবছর ছিলেন। আমি এই কমান্ডারদের একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আবু আসেম কেমন ছিলেন? তিনি বললেন, আমরা আহমদ শাহ মাসউদকে আশ্চর্যরকম ভালোবাসি। কিন্তু আবু আসেমের জন্যে আমাদের যে ভালোবাসা-তার কাছে এই ভালোবাসা তুচ্ছ। তিনি আমাদের হৃদয়ের সিংহাসনে সবসময় ভাস্বর ছিলেন। এই কমান্ডার আরো বললেন, আমি আবু আসেমের মতো গাম্ভীর্যপূর্ণ মানুষ আর দেখি নি। আমাদের কেউ তাঁর সামনে পা ছড়িয়ে বসার সাহস পেতো না। তাঁর দাড়ি নিয়ে কৌতুক করা, তাঁর সামনে মুচকি হাসা বা ঠাট্টা-তামাশা করার সাহস কারো ছিলো না। হায় আল্লাহ! তাঁর বয়স ছিলো মাত্র তেইশ বছর বা চব্বিশ বছর। তাঁর গলার স্বর ছিলো সুমধুর। আবু হাজের জামিল ও আবু ইয়াহইয়া জামিলের কন্ঠস্বরের সঙ্গে তাঁর কণ্ঠস্বর তুলনা করা যায়। তিনি আমাদের কুরআন মুখস্থ করাতেন এবং নিক-নির্দেশনামূলক শিক্ষাদান করতেন।
তিরিশজন কমান্ডার, যাঁরা ছিলেন পরিচিত, রুশ বাহিনীকে ব্যর্থ ও অস্থির করে রাখার কারণে যাঁরা ছিলেন তাদের ত্রাস এবং যাদের ব্যাপারে রাশিয়া উপাধি প্রয়োগ করেছিলো তারাই কুরআন শেখার জন্যে যুবক আবু আসেমের ছাত্র হলেন। আবু আসেম দীর্ঘদিন তাঁদের মাঝে থাকতে পারেন নি। তিনি শাহাদাত বরণ করেছিলেন। তাঁর শাহাদাত বরণের ঘটনা ছিলো আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আশ্চর্য ঘটনা। যুদ্ধক্ষেত্রে রওয়ানা হওয়ার দিন সকালে আবু আসেম লিখে রেখেছিলেন যে তিনি শহীদ হবেন। তাদের দলে একশো সতেরো জন মুজাহিদ ছিলেন। তাদের মধ্যে মাত্র দুইজন সেদিন রোযা রেখেছিলেন—আবু আসেম আর শাহ কলন্দর। সেদিন শহীদও হয়েছিলেন দুইজন—শুধু দুই রোযাদার—আবু আসেম আর শাহ কলন্দর।
সফিউল্লাহও লিখে রেখেছিলেন যে তিনি শহীদ হবেন। আবদুল্লাহ আনাস, বর্তমানে আহমদ শাহ মাসউদের উপদেষ্টা, তাঁকে বললেন, 'আমরা এখানে দুইজন আরব আছি। আমাদের একজন আজ শহীদ হবে। আমি কসম খেয়ে বলতে পারি, আমাদের একজন আজ শহীদ হবে।' সফিউল্লাহ তাঁকে বললেন, 'আপনি আল্লাহর নামে কসম খাচ্ছেন। আপনি কি আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করছেন?' আনাস বললেন, 'আমি আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করছি না। আমি শুধু কসম খেয়ে বলছি, একজন অবশ্যই শহীদ হবে। আমি গায়েব জানি না। আপনি কি অন্ধ? আপনি কি তার চেহারায় শাহাদাতের নুর দেখতে পান নি?'
আবু আসেম শহীদ হয়ে ফিরে এলেন। সবাই কুরআন পাঠের মজলিসে বসলেন। আবু আসেমের জায়গাটা খালি। তাঁরা সেই খালি জায়গার দিকে তাকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলেন।
আরও পড়ুন
ষষ্ঠ পর্ব
Comment