জিহাদ প্রসঙ্গে মাওলানা আব্দুল মালেক হাফিজাহুল্লাহর বয়ান
এবং
কিছু অভিব্যক্তি -০১
এবং
কিছু অভিব্যক্তি -০১
بسم الله، الحمد لله، والصلاة والسلام على رسول الله، وعلى آله وصحبه ومن والاه، وبعد
এক. কয়েকদিন হলো মাদানীনগর মাদ্রাসায় আমাদের দেশের বরেণ্য আলেম মুহতারাম আব্দুল মালেক হাফিজাহুল্লাহ তালিবুল ইলমদের সামনে দু’টি বয়ানে কিছু নসীহা ও রাহনুমায়ীমূলক কথা বলেছেন। হুজুরের প্রতিটি বয়ানেই শিখার মতো অনেক ইলমী উসূলী বিষয় থাকে, যেগুলো প্রত্যেক আলেম ও তালিবুল ইলমের জন্য জরুরী। আল্লাহ তাআলা হুজুরের নেক হায়াত বাড়িয়ে দিন। উলামা তলাবাদের মাথার উপর এ রহমতের ছায়া আল্লাহ তাআলা দীর্ঘ করুন। আমীন।
আমি প্রথমে আল্লাহ তাআলার এবং তারপর মাওলানা আব্দুল মালেক হাফিজাহুল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নিচ্ছি যে, আমাদের দেশে ইলমী অঙ্গনে তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা এক অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটিয়েছেন। ইলমের যে সহীহ তরিকা তিনি উলামা তলাবাদের সামনে পেশ করেছেন, বলতে গেলে এ দেশে এটি তাজদিদি কাজ। আল্লাহ তাআলা হুজুরের কাজগুলো কবুল করে নিন।
দুই. মাদানীনগরের বয়ানে হুজুর ইলমের ময়দানের অনেকগুলো জরুরী উসূল তালিবুল ইলমদের সামনে পেশ করেছেন, যেগুলো সব আলেম তালিবুল ইলমের আজীবন মেনে চলা দরকার। যেমন: মাসতুর, মালহুজ, মাহজুফ, মুকাদ্দার, মুস্তাসনা- সব সহ বোঝা; ইলম হজম করা; হিকমাহ ও তাফাক্কুহ ফিদ-দ্বীন অর্জন করা; কিতাবি ইস্তি’দাদের পাশাপাশি ইলমি ইস্তি’দাদ অর্জন করা; প্রত্যেক ফনের মৌলিক কিতাবগুলো আগাগোড়া বসিরতের সাথে অধ্যয়ন করা; প্রত্যেক ফনের মাসআলা ঐ ফনের ফুকাহাদের থেকে হল করা; উস্তাদের সোহবত ইখতিয়ার করা; উস্তাদ থেকে নিজেকে মুস্তাগনি মনে না করা; নিজেকে যি-রায় মনে না করা, তাহকিকের ময়দানে ফায়েয মনে না করা; সালাফে সালিহীনের সিরাত অধ্যয়ন … ইত্যাদি আরও অনেক বিষয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে আমলের তাওফিক দান করুন। আমীন।
তিন. আলোচনা প্রসঙ্গে হুজুর জিহাদ ও মুজাহিদদের ব্যাপারে, খিলাফাহ ও সিয়াতের ব্যাপারে বেশ কিছু কথা বলেছেন। যতটুকু বুঝতে পারছি: কিছু জযবাতি অপরিপক্ক লোকের দ্বারা হুজুর মনে হয় কষ্ট পেয়েছেন। ফলে কথাগুলো বলতে হুজুর বাধ্য হয়েছেন।
আসলে অনেক ভাই-ই আছেন, যারা টুকটাক কিছু বুঝতে না বুঝতেই অন্যের উপর তা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। কেউ তাতে দ্বিমত করলে মেনে নিতে পারেন না। তার উজর কবুল করেন না। বরং অনেক শুরুত কুয়ুদ ছাড়াই তিনি বুঝেছেন, ফলে এক রকম অজ্ঞতাপ্রসূত উগ্রতা তার মাঝে কাজ করে। এ ধরনের ভাইদের ফলে কাজের ময়দানে বেশ ক্ষতি হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মাফ করুন। হুজুরের ক্ষেত্রেও হয়তো এমন কিছু ঘটনা ঘটে থাকবে; ওয়াল্লাহু আ’লাম।
তবে হুজুর ভরা মজলিসে ব্যাপকতার সাথে আলোচনাটা যেভাবে করেছেন, আমভাবে এ দেশের জিহাদি চেতনা লালনকারী বা জিহাদি কাজের সাথে সম্পৃক্ত ভাইয়েরা প্রশ্নবিদ্ধ হন। হুজুর বয়ানে নিজেই বলেছেন, বিশেষ কোনো ব্যক্তির সমালোচনা হুজুরের উদ্দেশ্য না। তখন নির্দিষ্ট একটা নজরিয়া এবং সে নজরিয়া লালনকারীদের উপর গিয়েই সমালোচনাটা পড়ে।
চার. আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিচ্ছি যে, হুজুর যে ধরনের নজরিয়ার নকদ করেছেন, অনেক লোকই সে নজরিয়ার আওতায় পড়ে। এবং এটা শুধু জিহাদের ক্ষেত্রেই নয়, ফিতনা আর অধঃপতনের এ যামানায় ইলমের প্রত্যেকটা অঙ্গনেই এখন এ ফিতনা দেখা যাচ্ছে এবং বেশ ব্যাপকভাবেই দেখা যাচ্ছে। তবে হুজুরের আলোচনার কেন্দ্র ছিল জিহাদ। ফলে জিহাদি কাফেলার ব্যাপারে ভুল ধারণা সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক না। তাই কিছু কথা না বলে পারছি না।
পাঁচ. আমি এ কথাগুলো কোনো জিহাদি কাফেলার প্রতিনিধি হিসেবে বলছি না, এগুলো আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি। কাজেই আমার কথায় কোনো ভুল হলে সেটা শুধু আমার উপরেই বর্তানো যাবে, এ কারণে মুজাহিদদের সমালোচনা করা যাবে না। একজনের ভুলের দায়ভার আরেকজনের ঘাড়ে চাপাবো না ইনশাআল্লাহ।
ছয়. আমি শুরুতেই বলেছি, আজীবন মেনে চলার মতো অনেক জরুরী কথাই হুজুর পেশ করেছেন। সেগুলোতে আল্লাহ তাআলা আমাকেও আমল করার তাওফিক দান করুন। তবে জিহাদ ও জিহাদি কাফেলার ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে এমন কিছু পয়েন্টে আমি আমার অভিব্যক্তি তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ। ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ।
সাত. একটি সামগ্রিক অভিব্যক্তি
এর আগেও হুজুরসহ মারকাযের কিছু লেখা ও বয়ানে জিহাদের ব্যাপারে চলমান ফিতনা নিয়ে কথা এসেছে। তবে বরাবরই যে একটা শূন্যতা অনুভব করি: কথায় অনেক বেশি ইজমাল-অস্পষ্টতা থেকে যায়। কাদের রদ করা হচ্ছে, যাদের রদ করা হচ্ছে তাদের কোন কোন্ বিষয়টার রদ করা হচ্ছে, যাদের রদ করা হচ্ছে তাদের দলীল কি? এর বিপরীতে হুজুর বা মারকাযের মতটা কি, সে মতের দলীল কি, যাদের রদ করা হচ্ছে তাদের দলীলের জওয়াব কি, এ ফিতনার বিপরীতে যামানার আলোকে শরীয়তের সহীহ তরিকাটা কি? – এসবের কোনো কিছুই স্পষ্ট করা হয় না। ফলে একটা ধোঁয়াশার ভেতর থাকতে হয় সর্বদাই।
যেমন এবারের বক্তব্যেও ‘সাহাবি বিদ্বেষী লোক’, ‘গাইরে আলেম মুজাহিদ’, ‘কট্টরপন্থী সালাফী’ ‘ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ব্যবসায়ী’- এদের থেকে নতুন নতুন মাসআলা নিয়ে জিহাদ-খেলাফত-সিয়াসতের সহীহ মাফহুমের ভিন্ন ব্যাখ্যা করা হচ্ছে বলে হুজুর দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং এ চিন্তাধারার যথেষ্ট সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এখানে অনেক বেশি ইজমাল রয়ে গেছে:
- ‘সাহাবি বিদ্বেষী’, ‘গাইরে আলেম মুজাহিদ’, ‘কট্টরপন্থী সালাফী’ ‘ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ব্যবসায়ী’ এসব লোক কারা?
- এদের থেকে কি কি নতুন আবিষ্কৃত মাসআলা নেয়া হচ্ছে?
- তারা জিহাদের নতুন কি মাফহুম পেশ করছে যা সালাফের যামনায় ছিল না এবং আইম্মায়ে কেরাম বলেননি?
- এসব নতুন আবিষ্কৃত নজরিয়া ও মাসআলার পক্ষে তারা কি কি ভ্রান্ত দলীল পেশ করছে?
- এর বিপরীতে জিহাদ, খেলাফত ও সিয়াসতের ব্যাপারে ইসলামের সহীহ-সঠিক অবস্থানটি কি এবং এ ব্যাপারে হুজুর ও মারযকাযের রায় কি?
- এ সহীহ সঠিক অবস্থানের দলীল কি?
- ভ্রান্তদের দলীলের খণ্ডন কি?
{ يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ حَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى الْقِتَالِ} [الأنفال: 65]
“হে নবী, আপনি মুমিনগণকে কিতালে উৎসাহিত করুন।” -আনফাল: ৬৫
“হে নবী, আপনি মুমিনগণকে কিতালে উৎসাহিত করুন।” -আনফাল: ৬৫
এ কাজটি যদি দ্বীনের অন্য কোনো বিধানের ব্যাপারে করা হতো আমরা নিশ্চিত বলতাম, এটি সহীহ তরিকার খেলাফ। এমনভাবে সমালোচনা করা যাবে না যে মানুষ দ্বীনের বিধান থেকে সরে যায়। বরং সহীহ-সঠিকটা তুলে ধরে, সেটার প্রতি তারগিব দিয়ে বাতিলের খণ্ডন করতে হবে। কিন্তু জিহাদের ব্যাপারটা এলেই আমরা কেন জানি উসূল-নীতি ধরে রাখতে পারি না।
***
আট. হুজুরের বক্তব্য ০১ (সারমর্ম; হুবহু নস নয়): [আকল-ফাহম-বাসিরাত-তাফাক্কুহ ফিদদিনের অভাবের কারণে এবং মাসতুরের সাথে সাথে মালহুজটাও না বুঝার কারণে তালিবুল ইলমরা এখন যেকোনো নতুনের পিছনে দৌড়াচ্ছে।কোনো রেসালায়, কোনো কিতাবে, কোনো বয়ানে নিজেদের তবিয়তের সাথে, মেজাযের সাথে মিলে এমন কোনো দাওয়াত পেয়েছে; ব্যস সেটাকেই হরফে আখের মনে করে।নিজের উস্তাদের কাছে এরকম কিছু শুনে না, তো মনে করে উনারা গাফেল।]
অভিব্যক্তি
হুজুরের পরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, এখানে দাওয়াত বলতে জিহাদের দাওয়াত উদ্দেশ্য। ব্যাপক কিছু উদ্দেশ্য হয়ে থাকলে, সেগুলোর মধ্যে জিহাদের দাওয়াতটা বিশেষভাবে উদ্দেশ্য। মোটকথা, জিহাদের ব্যাপারে দুয়েকটা কিতাব-রিসালা বা বয়ান শুনেই তালিবুল ইলমরা এগুলোকে বিশ্বাস করে বসছে। সত্যাসত্য যাচাই না করেই এগুলোর পেছনে ছুটছে। শুধু এতটুকুতেই ক্ষান্ত না, নিজেদের উস্তাদদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। জিহাদের ব্যাপারে এ ধরনের কথা উস্তাদরা না বলায় উস্তাদদেরকে গাফেল মনে করছে।
# মেনে নিতে হবে যে, কিছু তালিবুল ইলম বাস্তবেই এমন আছে। কিন্তু সকলেই কি এমন? আমরা তো দেখছি ভাল ভাল প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া যি ইস্তি’দাদ তালিবুল ইলম (বরং অনেক উস্তাদও আলহামদুলিল্লাহ) জিহাদে জড়াচ্ছে। অথচ জিহাদের রাস্তা যে রক্তমাখা কাটাভরা সেটা কিন্তু তারা জানে। যেকোনো সময় গ্রেফতার হতে পারে, জীবনের স্বপ্ন সব ধুলোয় মিশে যেতে পারে জেনেও জড়াচ্ছে। জিহাদে জড়ানো এ ধরনের উস্তাদ ও তালিবুল ইলমের সংখ্যা আলহামদুলিল্লাহ যথেষ্ট এবং দিন দিন বাড়ছে। তাদের ব্যাপারেও কি বলা যায়, দুয়েকটা রিসালা আর বয়ানেই ……? বরং অনেকে আছেন যারা দীর্ঘদিন যাচাই বাছাই এবং গভীর অধ্যয়নের পর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; যেমন একজন ভিন্ন ধর্মের শিক্ষিত ব্যক্তি দীর্ঘদিন গবেষণা শেষে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাদের ব্যাপারেও কি …?
# উস্তাদদের গাফেল মনে করার কথা যদি বলি, ঢালাওভাবে উস্তাদদের গাফেল মনে করে যে তা না। অনেক উস্তাদই সচেতন আছেন। বরং অনেকে তো উস্তাদের দাওয়াতেই জিহাদে জড়ায়।
# জিহাদের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আমরা ইলমি অন্যান্য অঙ্গনগুলো ধরি এবং যুগের অন্যান্য চাহিদাগুলোর কথা ধরি। সেগুলোর ক্ষেত্রে কি সব উস্তাদ সচেতন? যদি উত্তর না হয়, তাহলে জিহাদের মতো বিধান (যা বৈশ্বিকভাবে যুগ যুগ ধরে প্রোপাগাণ্ডার শিকার, যেখানে ধরা পড়লে নির্যাতনের শিকার হওয়া সুনিশ্চিত এবং যেটা কুরআনের ভাষ্য মতেই কঠিন বিধান) – এ ব্যাপারে কি অনেক উস্তাদ গাফেল থাকতে পারেন না? যেখানে সাধারণ যুগ সমস্যার ব্যাপারেই শতকরা দুইজন আলেম সচেতন পাওয়া মুশকিল, সেখানে জিহাদের ব্যাপারে অনেক উস্তাদ গাফেল থাকা কি আজিব গরিব কিছু? অধিকন্তু ঢালাওভাবে উস্তাদদের গাফেল মনে করে কথাটা সঠিক না। উস্তাদের বরকতেই তো আলহামদুলিল্লাহ অনেকে জিহাদের জড়িয়েছে।
# আমি একটা বাস্তব দৃষ্টান্ত দিই: যখন এদেশে প্রথম মারকাযুদ দাওয়াহয় উলুমে হাদিসের চর্চা শুরু হলো, তখন এদেশের আলেমদের এক বিশাল অংশ একে খুব একটা ভাল নজরে দেখতে পারলো না। ‘উলুমে হাদিস আবার কি? কই আমরা তো উলুমে হাদিস পড়িনি, আমরা কি দ্বীনের খেদমত করছি না? হাফেয ইবনে হাজার ফাতহুল বারি লেখার পর উলুমে হাদিসের আর কি পড়ার আছে? সনদ দিয়ে আমরা কি করি, আমাদের দরকার মতন? –ইত্যাদি অজ্ঞতাসূলভ অনেক আজিব ও গরিব কথা শুনা গেছে, যেগুলো শুনে একজন সচেতন আলেম লা হাওলা আর ইন্না লিল্লাহ পড়া ছাড়া কিছু করার নেই। তো উলুমে হাদিসের মতো ইলমের একটা এমন অনিবার্য প্রযোজ্য শাখার ব্যাপারেই যদি আলেমদের বিশাল কাফেলার এ রকম অভিব্যক্তি হয়, তখন আশ্চর্যের কি আছে যে, এর চেয়েও বেশি সংখ্যক আলেম জিহাদ, সিয়াসত, খিলাফতের মতো নাজুক, কষ্টকর ও প্রোপাগাণ্ডার শিকার বিধানের ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে গাফেল থাকবেন?
# অধিকন্তু গাফেল মনে করার সিলসিলা ১ম দিন থেকে শুরু হয় না। কওমি তলাবারা উস্তাদ ভক্ত। উস্তাদের কথায় উঠে বসে। উস্তাদের পা ধুয়ে দেয়াকে সৌভাগ্য মনে করে। উস্তাদ দাঁড়িয়ে থাকতে বললে দাঁড়িয়ে থাকে, কান ধরতে বললে কান ধরে। উস্তাদের বাজার করে দেয়া, উস্তাদের ক্ষেতে কাজ করে দেয়া সৌভাগ্যের সোপান মনে করে। এভাবে একটা নয় দু’ইটা নয়; পাঁচ-দশ-বিশ বছর পর্যন্ত উস্তাদের সোহবতে কেটে যায়। কথায় আছে: ‘সাহিবুল বাইতি আদরা বিমা ফিহি’- ‘ঘরের খবর ঘরের লোকই ভাল জানে’। এ দশ বছর সোহবতে কোনো দিন আমার উস্তাদের মুখে শুনিনি হারানো খেলাফতের স্মৃতি কথা। শুনিনি কাশ্মিরি মা বোনোর আহজারির কথা। শুনিনি আফগান ইরাক সিরিয়ার শিশুদের না খেয়ে মরার করুণ কাহিনি। শুনিনি আল্লাহর শাসন আর কুফরি শাসনের ব্যবধানের কথা। বরং শুনেছি রফয়ে ইয়াদাইন আর আমীন বিল জাহর। শাদ্দে রিহালের মাসআলায় ইবনে তাইমিয়াকে এক হাত দেখে নেয়া। যারা আরেকটু সচেতন তারা বলেছেন, তালেবান আমেরিকার তৈরি। উসামা বিন লাদেন আমেরিকার দালাল। মোল্লা উমর ইসলামের ক্ষতি করেছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা হারাম। শাতেমে রাসূলদের হত্যাকারীদের মাথায় শয়তান চেপেছে। যারা আরও সচেতন তারা বলেছেন, জিহাদের জন্য ইমাম লাগবে- কিতাবে আছে, আমাদের ইমাম নাই। আকাবিরদের তাজরেবার দ্বারা সাবেত হয়েছে জিহাদের দ্বারা কাজ হয় না। আরাকানিরা আল্লাহর গজবে পড়েছে। আইএস মুসলিমদের তাকফির করে, তাদেরকে তো আমেরিকা মারবেই। শুনেছি সুফিয়ানে কেরাম হলেন প্রকৃত মুজাহিদ। শুনেছি নির্বাচনের জিহাদের কথা। ... ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন আমি কিভাবে বলতে পারি, তিনি যুগ সচেতন? আমি উস্তাদকে মুহাব্বাত করি। মাথার তাজ মনে করি। কিন্তু বলে দিতে পারি না, তিনি মুফতি। তাহলে যুগ সচেতন কিভাবে বলতে পারি, অথচ তার হাল আমি দশ বৎসর ধরে জানি?
# হুজুর বলেছেন, দুয়েকটা কিতাব রিসালা আর বয়ান শুনেই পেছনে ছুটছে তালিবুল ইলমরা। এখানেও সেই আগের কথাটা বলতে হয়, ‘সাহিবুল বাইতি আদরা বিমা ফিহি’। আমি দশ বছরের সোহবতে ভাল করেই জানতে পেরেছি আমার উস্তাদ কতটুকু যুগ সচেতন। আমি এও দেখেছি, অনেক কিতাবের হাওয়ালা দিয়ে পড়ানোর কারণে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আমার প্রিয় উস্তাদের কিতাব কেটে দিয়েছে। জিহাদের পক্ষে বলার কারণে দফতরে ডেকে নিয়ে তাকে শাসানো হয়েছে এবং বেশি না বুঝতে সতর্ক করা হয়েছে। আমি দেখেছি কিভাবে চামড়া কালেকশানের মতো গাইরতহীন কাজটিকে আকাবিরের দোহাই দিয়ে গৌরবের কাজ বানানো হয়েছে। আমার দীর্ঘ সোহবতে আমি সব হাকিকত জানি। অপরদিকে প্রতিনিয়ত খবর পাচ্ছি কি হচ্ছে ইরাকে আফগানে। নাফ নদীতে কিভাবে ভেসে আসছে রোহিঙ্গাদের লাশ। আর আমার উস্তাদ কিভাবে জনসম্মুখে ফতোয়া দিচ্ছেন, রোহিঙ্গাদের পক্ষে জিহাদ করা হারাম, ইলকাউন নাফস ইলাততাহলুকাহ। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে উস্তাদের ফতোয়ায় আরও রক্তক্ষরণ হলো। কথাটা তিনি অন্যভাবে স্বাভাবিক করেও বলতে পারতেন। আল্লাহ মাফ করুন! জিহাদ মুমিনের ফিতরতের তাকাজা। আমার মা বোনের আহাজরি শুনে আমি কি বসে বসে শুনবো জিহাদ হারাম, ইলকাউন নাফস ইলাততাহলুকাহ? অথচ কুদুরিতেও লিখা আছে জিহাদ ফরয!! হিদায়াতেও আছে। সব কিতাবেই আছে। আমার ফিতরত তো আল্লাহর ফরযকৃত এ বিধানটির জন্য আল্লাহর রহমতে তৈয়ার হয়েই ছিল। কিন্তু আমার উস্তাদের অপব্যাখ্যা এতদিন আমার পথে পর্দা হয়ে ছিল। আজ যখন একটা বয়ান শুনলাম, একটা রিসালা পড়লাম- এটা নতুন কোনো কিছু নয়, সত্যটার সামনে যে কৃত্রিম পর্দা ছিল সেটা শুধু সরে গেল। দশ বছর পর হারানো ভাইয়ের সাথে দেখা হলে যেমন ভাইকে চেনা যায়, জিহাদের বিধানটির সাথে দশ বছর পর এভাবেই আমার দেখা হল। এটি শুধু একটি রিসালা বা একটি বয়ানের প্রভাব নয়, এটি ফিতরত আর শাশ্বত সত্যের প্রভাব।
# অধিকন্তু একটা রিসালা পড়েই বা একটা বয়ান শুনেই পিছনে ছুটছে বিষয়টা এমন না। যারা জিহাদে জড়িত তারা উস্তাদের অজান্তেই হয়তো তিন বছর/পাঁচ বছর আগে থেকেই জড়িত। এ পাঁচ বছর যাবতই সে জিহাদ নিয়ে পড়াশুনা করে আসছে। ময়দানের ভিডিও ও নুসরতের দৃশ্যগুলো দেখে আসছে। অস্ত্রের ঝনঝনানি পাঁচ বছরই তাকে মুগ্ধ করে আসছে। এ পাঁচ বছর যাবতই সে তার উস্তাদের যুগ-সচেতনতার মাত্রা (!!) দেখে আসছিল আর মনে মনে দুঃখ করছিল, আফসোস করছিল। হয়তো কোনো কারণবশত আজ উস্তাদের সামনে প্রকাশ পেলো সে জিহাদি। সে মানহাজি। সে জযবাতি।
# যামানা এখন আপডেট। প্রতিদিনের জিহাদের আপডেট চলে আসে তালিবুল ইলমের হাতে। মুজাহিদদের বিজয়ে তালিবুল ইলমরা মিষ্টি খাওয়ার আয়োজন করে। আর উস্তাদ রয়ে গেছেন সেই গতানুগতিক আমীন বিল জাহর, রফয়ে ইয়াদাইন, শাদ্দুর রিহাল কিংবা ইমাম নাই, নির্বাচনের জিহাদ, খানকার জিহাদ ইত্যাদি নিয়ে। অতএব, তালিবুল ইলমরা এক দিনেই একটা রিসালা পড়েই, একটা বয়ান শুনেই পিছনে ছুটেছে ধারণাটা ভুল। মুহাম্মাদের এক মজলিসের কালিমার দাওয়াতেই বাপ দাদার ধর্ম সাহাবারা কেন ছেড়েছিল? এটা কি এক মজলিসের দাওয়াত? না’কি শাশ্বত সত্য আর ফিতরত? সাথে আছে ‘সাহিবুল বাইতি আদরা বিমা ফিহি’। (চলমান ইনশাআল্লাহ …)
Comment